টক ঝাল মিষ্টি পর্ব -০৭

#টক_ঝাল_মিষ্টি (পর্ব ৭)
নুসরাত জাহান লিজা

লাবণ্য ক্ষণকাল স্তব্ধ হয়ে বসে রইল, ভাঙা টুকরোগুলো যেন ওকে চোখ রাঙাচ্ছে। অনিকেত যেভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে তাতে ওর মনে হয়েছে গ্লাসটা যেন ওকেই ছুঁড়েছে। ঝিকে মেরে বউকে শাসানো যাকে বলে।

লাবণ্য অনিকেতের দিকে পানি ছুঁড়ে নিজেই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল অল্প সময়ের জন্য। অতিরিক্ত রেগে গেলে কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। একবার স্কুলে পড়ার সময় একটা জুনিয়র মেয়েকে থাপ্পড় দিয়ে বসেছিল মানা করা সত্বেও বারবার ওর গালে হাত দেয়ার জন্য। তখনও প্রথমে বুঝতে পারেনি কী হলো। এমন রাগ হলে কিছু একটা যেন ভর করে ওর মধ্যে। লাবণ্য তখন লাবণ্য থাকে না। এরপর থেকে সে সামলে চলার চেষ্টা করে। আজ বহুদিন পরে আরেকবার সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল।

অন্যভাবেও রিয়্যাক্ট করা যেত। অনুশোচনায় পুড়তে না পুড়তেই অনিকেত যে কাণ্ডটা ঘটালো তাতে আর অনুশোচনা টিকল না, বরং পুরোনো রাগটা ফিরে এলো। কোথাও একটা অভিমানের কাঁটা ওকে খোঁচাতে থাকল। চোখ বেয়ে জল গড়ালো, অচেনা অভিমানের জল!

***
অনিকেত নিজের রাগ কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। এই মেয়ে পেয়েছেটা কী! এতদিন সহ্য করেছে, কিন্তু আজকের কাণ্ডকে সে গায়ে হাত তুলাই বলবে, হাতে মারেনি তো কী হয়েছে! তারচাইতে কম কিছু নয় এটা। চশমাটা খুলে রেখে বিছানায় দু’হাতে চুলগুলো টেনে ধরে বসে রইল কতক্ষণ। পুরুষ নির্যাতনের কোনো মামলা হয় না বলে শুনেছিল, এখন কী তেমন কোনো আইন আছে! উকিলের সাথে এসব নিয়ে পরামর্শ করা যায় কিনা এসব ভাবতে শুরু করল।

বেশকিছু সময় অতিবাহিত হবার পরে রাগটা কিছুটা কমে এলো, মেল ইগো সরিয়ে মাথা ঠান্ডা করে শুরু থেকে আবার ঘটনাটা ভাবল। কিছুক্ষণ পরে মনে হলো এভাবে বলাটা মোটেও ঠিক হয়নি। একটা মানুষকে সুযোগ সন্ধানী বলাটা ঘোরতর অপমানজনক একটা ব্যাপার। সে এটা তখন কোনোকিছু চিন্তা না করেই বলে ফেলেছে। সে তো বরাবরই এমন, যখন যা মুখে আসে বলে ফেলে। আগে বা পরে সেই কথায় কোনো প্রভাব পড়বে কিনা সেটা নিয়ে ভাবে না। আজও তাই করেছে, আর তাতেই একটা বড় ভুল হয়ে গেছে। জীবনে প্রথমবারের মতো নিজের ভুলটা চোখে পড়ল। লাবণ্য রেগে কিছুটা ওভাররিয়েক্ট করে ফেলেছে, কিন্তু আসল দোষটা তো ওর নিজেরই।

আজ অনিকেতের জন্য সব প্রথমের দিন বোধহয়। আরেকটা সিদ্ধান্তও জীবনে প্রথমবার নিল, সেটা হলো লাবণ্যকে একবার স্যরি বলবে, মন থেকেই বলবে। ভাবা মাত্রই হাঁচি শুরু হলো, মনে পড়ল ভেজা মাথা আর মুখে এখনো বসে আছে। ওর ঠান্ডা লাগার ধাত, এই শীত পরি পরি অবস্থায় সেটা আরও বেড়ে যায়। ক্ষোভের কিছুটা আবার ফিরে এলেও নিজের সিদ্ধান্তে অনড় রইল। ওকে কেউ এমন কথা বললে সে তার মাথাই ফাটিয়ে দিত, লাবণ্য তো অল্পের উপর দিয়েই ছেড়ে দিয়েছে!

তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়িয়ে মাথাটা মুছে নিল, এরপর দ্রুতপায়ে বাইরে এসে ডাইনিংয়ে উঁকি দিয়ে দেখল সেখানে লাবণ্য নেই। এরপর হেঁটে লাবণ্যর ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। ঝোঁকের মাথায় চলে এলেও হুট করে একটা দ্বিধা এসে মনে জড়ো হলো। স্যরি বলাটা কী ঠিক হবে! আবার মনে হলো, বলা তো উচিত ই। কিন্তু কখনো কোনো মেয়েকে ‘স্যরি’ বলা হয়নি, তাদের ইম্প্রেস করার চেষ্টা কখনো করা হয়নি। ‘স্যরি’ বলার আলাদা কোনো কায়দা-কানুন আছে কিনা তাও অনিকেত জানে না।

শেষমেশ দ্বিধা কাটিয়ে ওঠা হয় না, লাবণ্যর রুমের সামনে মুহূর্ত কয়েক পায়চারি করে ডাইনিং রুমে চলে এলো। এসে দেখল সব কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। কী মনে করে জায়গাটা নিজেই পরিষ্কার করল! এরপর গুটিগুটি পায়ে নিজের ঘরে চলে গেল। যাবার আগে লাবণ্যর দরজার দিকে আরেকবার ক্ষণকালের জন্য তাকিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল। দরজাটা খোলাই রাখল, লাবণ্য তো এখন এই রুমেই ঘুমায়। রাতে যদি চলে আসে! যে জেদি মেয়ে, মনে হয় না আসবে, তবুও দরজাটা শুধু ভিড়িয়ে দিয়েই শুয়ে পড়ল। বলা বাহুল্য লাবণ্য না থাকা সত্বেও ওর জন্য জায়গা রেখে দেয়াল ঘেঁষে জায়গাটায় গা এলিয়ে দিল। কিন্তু আজ ঘুম এলো না, এপাশ ওপাশ করাই সার হলো কেবল। সাথে হাঁচিটাও বড্ড জ্বালাচ্ছে। ঠান্ডা ভালোমতোই পেয়ে বসার চেষ্টা করছে।

বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করে দেখল রাত একটা সতেরো। এক ঘণ্টার উপরে অতিবাহিত হয়ে গেছে। অথচ সারাজীবন শোবার কিছুক্ষণের মধ্যে সে ঘুমিয়ে পড়তে অভ্যস্ত। বিরক্ত হলো খুব, একটা ‘স্যরি’ না বলতে পারার যন্ত্রণা ওকে এভাবে পীড়া দিচ্ছে ভেবে অস্থিরবোধ করল।

এককাপ চা খেলে ভালো হতো, ঠান্ডাকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। রান্নাঘরে যাবার উদ্দেশ্যে বেরুবে সেই মুহূর্তেই লাবণ্যর গলার একটা ছোট্ট আর্তনাদ ভেসে এলো। একরাশ অস্থিরতা নিয়ে দৌড়াল সেদিকে।

***
লাবণ্য আজ খুব করে কেঁদেছে, এরপর সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙার পর বুঝতে পারে গলা শুকিয়ে কাঠা। পানি নিয়ে আসা হয়নি। উঠে এসে পানি নিয়ে ফিরে যাবার সময় গ্লাসের এক টুকরো ভাঙা অংশ পায়ে বিঁধে যেতেই আৎকে উঠে। লাইট জ্বালানোই ছিল, কিন্তু মেঝে পরিষ্কার দেখে সেভাবে খেয়াল করেনি আর। তাতেই এই অঘটন ঘটল, রক্ত গড়াচ্ছে ভালোরকম। একটু বেশি করেই বিঁধেছে বেশ বোঝা যাচ্ছে। বসে পড়ে পা থেকে টুকরোটা বের করার চেষ্টা করছিল তখনই অনিকেতের আগমন।

উদভ্রান্তের মতো এগিয়ে এসে লাবণ্যর সামনে বসে ওর পা পর্যবেক্ষণ করা শুরু করল। এরপর বিঁধে যাওয়া কাচ বের করার জন্য হাত লাগাতে এলে লাবণ্য বলল,
“আমি দেখছি, আপনার সাহায্যের কোনো প্রয়োজন নেই।”

“দেখুন, প্লিজ আমি ইচ্ছে করে এটা রাখিনি। বিশ্বাস করুন, জায়গাটা পরিষ্কার করার সময় আমার চোখে পড়েনি এটা।”

“বিশ্বাস করলাম। এখন সরুন তো এখান থেকে।”

“দেখুন, ঝগড়া করার জন্য অফুরন্ত সময় পাবেন। আমি তো পালিয়ে যাচ্ছি না। এখন এটা আমাকে দেখতে দিন, প্লিজ। এরপর যত খুশি ঝগড়া করুন আমার কিছুই বলার থাকবে না।”

অনিকেতের এই যে আন্তরিকতা দেখানোর চেষ্টা সেটাই লাবণ্যকে আরও তাতিয়ে দিল। অনিকেতের হাত সরিয়ে দিতে দিতে বলল,
“কী বলতে চাইছেন? আমিই সারাক্ষণ ঝগড়া করি? আপনি অসহায়, গোবেচারা মানুষ? আপনার এই আলগা ঢং আপনার পকেটে ঢুকিয়ে রাখুন। আমাকে না দেখালেই ভালো হয়।”

“আচ্ছা, আমি ঝগড়া করি সারাক্ষণ। আপনি কিছুই করেননি। খুশি? এখন আমার কাঁধে ভর দিয়ে একটু উঠুন প্লিজ। পায়ে খুব বেশি ভর দেবেন না।”

লাবণ্যর দৃষ্টিতে এখনো আগুন ঝরছে, “আমি সুযোগ নিতে চাই না। সরুন প্লিজ।” গলায় কাঠিন্য ফুটিয়ে বলল লাবণ্য।

অনিকেত ওর রাগের ধার ধারল বলে মনে হলো না, সে নিজেই লাবণ্যর একটা হাত শক্ত করে ধরে নিজের কাঁধের একপাশ দিয়ে নিয়ে অন্যপাশে রেখে নিজের অন্য হাত উঁচিয়ে ওর হাতটা ধরে দাঁড় করালো। এরপর লাবণ্য আর কথা বাড়াল না, চুপচাপ পা ফেলে এগিয়ে গেল। অনিকেতের কিছু মনে হলো কিনা জানে না, কিন্তু ওর কেমন যেন অস্বস্তি হলো। এই প্রথম এতটা কাছাকাছি ওরা। অপ্রত্যাশিত সাহায্য আর এভাবে এতটা কাছে দুটো মিলিয়ে অনুভূতিটা একদম নতুন। লাবণ্যর অজান্তেই রাগের পারদটা আচমকা কিছুটা নেমে গেল।

অনিকেত লাবণ্যকে বিছানায় বসিয়ে স্যাভলন আর তুলো নিয়ে এসে রক্ত পরিষ্কার করে এন্টিসেপটিক ক্রিম লাগিয়ে দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল। কেমন বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল ওকে পুরোটা সময়। ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশেও ঘামছে খুব। কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করল। পরে মনে হলো অনিকেত ওর বাবার এক্সিডেন্টর পরে থেকেই নাকি রক্ত দেখলে ভয় পায়। শফিক আঙ্কেল বলেছিলেন একদিন। তবুও যে লাবণ্যর জন্য এটা করল এতেই বাকি রাগটুকু পালিয়ে গেল। মনে মনে মাফ করে দিল ছেলেটাকে।

অনিকেত লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে দেখল মেয়েটা কেমন অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে ওকে দেখছে। ওর মনে হলো বুঝি লাবণ্য বোবা চাহনিতে ওকে বলছে,
“আপনার সাথে নাহয় একটু ঝগড়াই করি, তাই বলে সেটা আপনি এভাবে শোধ করবেন?”

এমনভাবে না তাকিয়ে যদি ওকে কয়টা ঝাঁঝালো কথা শুনিয়ে দিত, সেটাই বোধহয় ভালো হতো। আগের যত অস্বস্তি সব সরিয়ে সে বলল,
“আমি স্যরি, তখন ওইভাবে বলাটা একদম ঠিক হয়নি। আমি আপনাকে কীভাবে স্যরি বলব বুঝতে পারছিলাম না৷ আসলে ঘটা করে দুঃখপ্রকাশ করা আমার হয় না। আমি আপনাকে কষ্ট দেবার জন্য কথাটা বলিনি। আমি কিছুদিন থেকে আপনার আচরণে ফেডআপ ছিলাম। তাই সবসময় জিততে চাইতাম। তখন আগে-পিছে কিছু না ভেবে বলে ফেলেছি। মন থেকে বলিনি।”

লাবণ্য এখনও প্রগাঢ় অভিমান নিয়ে তাকিয়ে আছে বলে মনে হলো। অনিকেত কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই আবারও হাঁচি দিয়ে বসল।

“একটু আগেও তো ভালোই ছিলেন, এমন অবস্থা হলো কী করে? এরমধ্যে বেশ কয়েকবার হাঁচি-কাশি দিয়ে একাকার।”

অনিকেত হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল লাবণ্যর দিকে, সে কত কষ্ট করে স্যরি বলল, তার উত্তরে কিছু তো বললই না, উল্টো এভাবে ওর শারীরিক অবস্থা নিয়ে কটাক্ষ করল।

লাবণ্য ওর মন পড়তে পারল, হেসে ফেলল সশব্দে। অনিকেত আরও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। অদ্ভুত মেয়ে তো! চোয়াল শক্ত হতে শুরু করেছে রাগে, বলল,

“আমি কি হাসার মতো কিছু বলেছি?”

“আপনি যে এমন বুদ্ধু সেটা আমি আগেই জানতাম। রেগে থাকলে হাসলাম কেন বলুন তো? আপনার হুট করে ঠান্ডা লাগল কেন সেটা নিয়ে কনসার্ন হলাম কেন?”

অনিকেতের চেহারায় আবার রঙ ফিরে আসতে শুরু করল। সে কী না কী ভেবেছে! মেয়েদের মুখ দেখে মন পড়তে পারার কোনো বিদ্যা থাকলে সে দ্রুতই সেটা রপ্ত করে নেবে। নইলে এই মেয়ের সাথে থাকা সম্ভব নয়। বড্ড কঠিন মেয়ে!

লাবণ্য ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আবারও মুখ খুলল, “আসলে আমিও স্যরি। বুঝতে পারছি ঠান্ডা কীভাবে লেগেছে। তবে আপনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন বলে সেই অংশটুকু কেটে দিলাম মন থেকে। এরপর একটু ভেবেচিন্তে কথা বলবেন, কেমন?”

অনিকেত মৃদু হেসে বলল, “অনেক তো টম এন্ড জেরি খেলা হলো। এবার কি আমরা বন্ধু হতে পারি?”

“সেটা অবশ্যই পারি। তবে আপনি আগে বলুন, মাথাটা ভালোভাবে মুছেননি কেন?”

অনিকেত উত্তর না দিয়ে ডান হাতটা লাবণ্যর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “তাহলে এখন আমরা বন্ধু তাই তো?”

লাবণ্য ক্ষণকাল ইতস্তত করে হাতটা ধরে বলল, “বন্ধুত্বে ‘আপনি’ একটু দূরের মনে হয়। আমরা বরং সম্পর্কের মতো সম্বোধনেও একধাপ এগোই, কী বলেন?”

অনিকেত হেসে ফেলল, কী অদ্ভুত সুন্দর হাসি। শিশুর সারল্যে উদ্ভাসিত মুখটা। আগে কখনো অনিকেতের এই হাসিটা দেখেনি লাবণ্য। হৃদপিণ্ড ভেদ করে যেন হৃদয়ের গহীনে গিয়ে আঘাত হানলো হাসিটা। বুকে ব্যথার মতো বাজল, ভেতর থেকে কেউ যেন বলছে,
“তুই ডুবিস না, লাবণ্য। এই ভয়ংকর সুন্দর হাসিতে তুই মরবি শেষে।”

কিন্তু লাবণ্য মনের কথা শুনল না। স্থান, কাল, পাত্র ভুলে অনিকেতের সেই হাসিতেই বুঁদ হয়ে রইল।
…….
(ক্রমশ)
(পরের পর্ব পরশুদিন দেব ইনশাআল্লাহ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here