#দখিনা_হাওয়া
#মারিয়া_আক্তার
[১২] (অন্তিম পর্ব)
সায়াহ্নের শেষ প্রহর এখন। বাড়ির সকলে মিলে ড্রয়িংরুমে বসে আছে। সবার হাতে চা। বিন্দু চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে চায়ের কাপটা টি-টেবিলের ওপর আস্তে করে রাখে। মোটামুটি আড্ডায় মেতেছে সকলে। আলী আকবর মির্জা সোফায় চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসে আছেন। মুখে ওনার তৃপ্তির হাসি। নয়না বেগমও ওনার পাশে বসে আছেন। আরাধ সিঙ্গেল সোফায় আরাম করে বসে আছে। সেই সোফার হাতলের ওপর আরান বসে আছে। বিন্দু সকলকে পর্যবেক্ষণ করে কিছুক্ষণ।
– আমি একটা কথা বলতে চাই। আরাধ এবং বিন্দু দু’জনেই মন দিয়ে শোনো আমার কথা।
বিন্দু এবং আরাধ খানিকটা নড়েচড়ে বসে। পূর্ণ মনোযোগ সহকারে তাকায় আলী আকবর মির্জার দিকে।
– বলো বাবা। কি বলবে?
আরাধ কথাটা বলে চায়ের কাপটা টি-টেবিলের ওপর রাখে। আলী আকবর মির্জা মুচকি হেসে বলেন,
– তোমাদের দু’জনের জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
আরান উৎফুল্ল হয়ে বলে,
– কি সারপ্রাইজ বাবা?
আলী আকবর মির্জা বলেন,
– অনুমান করতে পারবি? দেখি অনুমান করে বল।
– কি জানি? তুমি কি সারপ্রাইজ দেবে সেটা আমি কিভাবে অনুমান করবো? তার থেকে বরং তুমিই বলে দাও কি সারপ্রাইজ দেবে ওদের।
আরান খানিকক্ষণ ভেবে জবাব দেয়।
আলী আকবর মির্জা মৃদু হেসে বলেন,
– আমি চাই বিন্দু এবং আরাধ হানিমুনে যাক। বিয়ের পর ওদের কোথায় যাওয়া হয়নি। এবার একটু একান্তে সময় কাটাক দু’জনে। জায়গাটা তোমরা সিলেক্ট করে নিও। সব ব্যয়ভার আমার। ভেবে নিও, এটা আমার তরফ থেকে তোমাদের দু’জনের জন্য ওয়েডিং গিফট।
বিন্দু কিছু বলবে তার আগেই আরাধ তাড়াহুড়ো করে বলে,
– না বাবা। এসবের কোনো প্রয়োজন নেই। আর আমার অফিস থেকে ছুটিও নিতে পারবো না আমি। তাই এখন এভাবে কোথাও যেতে পারবো না।
বিন্দু থমথমে মুখে আরাধের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার কত আশা ছিল বরের সাথে হানিমুনে যাবে। স্কুল, কলেজ বা ভার্সিটি থেকে যতবারই শিক্ষাসফরে যাওয়া হতো। বিন্দু কখনো যায়নি। আক্ষেপও ছিল না কখনো। ভেবে রেখেছিল বরের সাথে যাবে। কিন্তু এই হাদারামটাতো না করে দিচ্ছে।
– আমি কোনো না শুনতে চাচ্ছি না আরাধ। তুমি বিন্দুকে নিয়ে হানিমুনে যাচ্ছো। এটাই ফাইনাল। জায়গাটা তোমরা ঠিক করে নিও। মিসেস মির্জা একটু ঘরে আসুন প্লিজ।
আলী আকবর নয়না বেগমকে রুমে আসতে বলে চলে গেলেন রুমে। নয়না বেগমও মুচকি হেসে ওনার পিছন পিছন রুমে চলে গেলেন। ওনাদের যাওয়ার পরপরই আরান উঠে দাঁড়িয়ে কান্নার অভিনয় করতে লাগলো।
– তোরাই হানিমুনে যা। আর আমি আজীবন সিঙ্গেলই থাকবো। আমাকেতো বাবার চোখেই পড়ে না। আমিতো বাবার ছেলে নই। তুই-ই বাবার একমাত্র ছেলে। আমাকে বাবা বিয়ে দেবে না। যাহ তোরাই হানিমুনে যা।
কথাটা বলতে বলতে আরান বিন্দুকে চোখ মেরে রুমে চলে যায়। বিন্দু আরানের দিকে চোখ গরম তাকিয়ে থেকে আবার আরাধের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায়। হনহনিয়ে চলে যেতে নেয় রুমে। তা দেখে আরাধ বিন্দুর পথ আটকে দাঁড়ায়।
– কি ব্যাপার? এভাবে সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন কেন?
আরাধ ক্যাবলামার্কা হেসে বলে,
– বাবা এসব কি বলছে বিন্দু? হানিমুনে? আমি জানি তুমি নিজেও যেতে চাইবে না। তাই তোমার হয়ে আমি-ই না করে দিয়েছি। ভালো করেছি না?
– হ্যাঁ, খুব ভালো করেছেন। এবার সামনে থেকে সরুন।
বিন্দু রেগেমেগে সামনে দু’পা এগোয়। তা দেখে আরাধ মাথা চুলকে ভাবে, কোনো গণ্ডগোল করে ফেললো নাতো আবার?
– বিন্দু দাঁড়াও।
বিন্দু পিছনে না ফিরেই বলে,
– এই একদম ডাকবেন না আমায়। আর আমার পিছন পিছন রুমেতো আসবেনই না।
আরাধ ক্যাবলাকান্তের মত বলে,
– তুমি কি হানিমুনে যেতে চাইছিলে বিন্দু?
– আমার উত্তর শোনার আগেইতো আপনি উত্তর দিয়ে দিলেন। এখন এত কিছু জিজ্ঞেস করছেন কেন? এখন আমি যাচ্ছি না।
– এই এসব কি বলছো? তুমি কি প্রথমে যেতে চেয়েছিলে?
বিন্দু কিছুই বলে না বিপরীতে।
– চুমকি চলেছে একা পথে,
সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে?
রাগ করো না, সুন্দরী গো!
রাগলে লাগে তোমায় আরো ভালো।
বিন্দু হাঁটা থামিয়ে পিছনে ফিরে কোমরে হাত গুঁজে আরাধের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকায়। নাকটাকে যথাসম্ভব ফুলিয়ে বলে,
– এই এই আপনি এসব আজেবাজে গান গাইছেন কাকে নিয়ে হ্যাঁ?
আরাধ লাজুক হেসে বলে,
– আমার বউকে নিয়ে গাইছি গো সুন্দরী।
– আপনাকে আমি ওয়ার্নিং দিচ্ছি, আমাকে এই সুন্দরী ফুন্দরী নামে ডাকবেন না।
– না, আমি তোমায় সুন্দরী বলেই ডাকবো। দেখি তুমি কি করতে পারো।
– আমি কিছুই করবো না যাচ্ছি আমি। যত খুশি সুন্দরী সুন্দরী বলে জপ করুন।
– আরে আরে যাচ্ছো কই? আগে আমার প্রশ্নের উত্তরটাতো দিয়ে যাও।
আরাধের সাথে কোনোরূপ কথা না বাড়িয়ে বিন্দু সামনের দিকে যেতে নেয়। আরাধ দৌঁড়ে গিয়ে বিন্দুর সামনে পথ আটকে দাঁড়ায়। চোখমুখ খানিকটা শক্ত করে বলে,
– তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এখান থেকে যেতে পারবে না বিন্দু। তোমায় উত্তর দিয়েই যেতে হবে। উত্তর পজিটিভ হলেও দিতে হবে, নেগেটিভ হলেও দিতে হবে।
– যদি বলি আমি উত্তর দিতে বাধ্য নই।
– দেখো বিন্দু তুমি এসব ঠিক হচ্ছে না। বাবা আমাদের দু’জনকে হানিমুনে পাঠাতে চাচ্ছে। আমিতো তোমার কথা ভেবেই না বলেছি কিন্তু এখনতো তুমি কিছুই বলছো না। এটা কি বাবাকে কষ্ট দেওয়া হচ্ছে না?
বিন্দু ডান পাশের ভ্রুঁটা উঁচু করে বলে,
– আমারতো মনে হচ্ছে বাবার চেয়ে আপনার কষ্টটা বেশি।
আরাধ আমতাআমতা করে বলে,
– আমার কষ্ট কেন হবে? আমিতো জাস্ট বাবার খুশির জন্য বলছি। নাহলে আমারও এত সখ নেই এই হানিমুন ফানিমুনে যাওয়ার বুঝতে পেরেছো?
– হুম। বুঝতে পেরেছি। আপনার যেহেতু কোনো ইচ্ছা নেই তাহলে যাওয়ারও প্রয়োজন নেই। আমি বাবাকে বুঝিয়ে বলে দেবো। বাবা কিছুই মনে করবেন না এতে।
বিন্দু কথাটা বলে চলে যেতে নিলে আরাধ বিন্দুর হাত ধরে আটকে দেয়। কাতর চোখে তাকায় বিন্দুর দিকে।
– এমন করছো কেন? চলো না!
– আপনি না চাইছেন না যেতে? তাহলে এখন যেতে বলছেন কেন?
আরাধ মুখটাকে খানিকটা ইনোসেন্ট করে বলে,
– আমি আমার বউয়ের সাথে একান্তে সময়যাপন করতে চাচ্ছি। তুমি এত বাঁধা দিচ্ছো কেন?
– তার মানে আপনি নিজেই চাচ্ছেন আমি যাই?
– হ্যাঁ গো সুন্দরী! আমি-ই চাচ্ছি।
– তাহলে বাবার সামনে এই অভিনয়টা করার কারণ কি ছিল?
আরাধ মাথা নিচু করে বলে,
– আমি ভেবেছিলাম তুমি নিজেই হয়তো যেতে চাইবে না। ভেবেছি তুমি হয়তো আমার সাথে যেতে কম্পোর্ট ফিল করবে না, তাই।
– আপনাকে এত কিছু ভাবতে কে বলেছে? আমিতো আপনার সাথেই হানিমুনে যাবো। আমার একটামাত্র বর। তার সাথে যাবো না তো কার সাথে যাবো?
আরাধ বিন্দুর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।
– আমার মুখ থেকে সত্যি কথা বের করার জন্য এতক্ষণ এসব করলে, তাই না?
বিন্দু গর্বের সাথে বলে,
– অবশ্যই।
আরাধ চোখ ছোট ছোট করে তাকায় বিন্দুর দিকে। তারপর মুচকি হেসে বিন্দুকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে।
”সমাপ্ত”