মেঘদিঘির পাড়ে পর্ব -০৬

মেঘদিঘির পাড়ে – ৬
মালিহা খান

১৩.
সে নিশীথে ঘুম হলোনা সায়নের। আঁখিপল্লব এক করা গেলোনা শতচেষ্টার পরও। মধ্যরজনীর নিষ্প্রহরে চোখের পাতায় বারংবার ভেসে উঠলো ভীত সেই চোখ, বুকে লেপ্টে থাকা নরম দেহ, আধভেজা পিঠ ছড়ানো চুলে; আসমানি শাড়িতে মোড়ানো এক তুলতুলে মেঘরমণীর স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। ঘুটঘুটে অন্ধকারে, আধনিভন্ত চোখে, সেই নিভৃত প্রতিচ্ছবিতেই রাত কাটলো সায়নের।
মেঘের রং হাল্কা হলো। কৃষ্ণ সরে শুভ্রে ভরলো। নীলাভ প্রত্যুষের প্রভায় শেষমেষ ঘুমিয়েই পড়লো ইভা।
সাতটার দিকে লিথিশার ঘুম ভাঙলো। পাশ ফিরে ইভাকে গভীর ঘুমে দেখে মৃদু হাসলেন তিনি। সারারাত ঘুমায়নি মেয়েটা। নিরবে জেগে ছিলো। নতুন জায়গা, অচেনা ঘরে হয়তো অস্বস্তি লাগছিলো। সে যতবার বলেছে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়তে। ততবার মিনমিন করে উওর দিয়েছে,”জি ঘুমাচ্ছি।” কিন্তু আদোতে ঘুমাতে পারেনি।
লিথিশা আবার হাসলেন। এক পশলা মমতা নিয়ে হাসলো তার চোখদুটোও।

একহাতে তোয়ালে ঘষে মাথা মুছতে মুছতে বিছানার বালিশগুলো এলোমেলো করে ফেললো সায়ন। প্রচন্ড অধৈর্য স্বভাব তার। ছোট্ট কুশন দু’টো তো মেঝেতেই ফেলে দিলো। ফোনটা পাচ্ছেনা অনেকক্ষণ। বিছানায় নেই তো কোথায় রেখেছিলো? রাতে ফুপির ঘর থেকে এসে ফোন দেখা হয়নি আর। বালিশের পাশে নিয়েই তো ঘুমায় সবসময়। তাহলে কি ফুপির ঘরে রেখে এসেছে? মুখ বিকৃতি করে এবার চরম বিরক্তিকর ভঙ্গি করলো সায়ন। একটা নিত্তান্ত তুচ্ছ ছেলেমানুষি কারণে সারারাত ঘুম হয়নি, মেজাজ এমনিই থেতিয়ে আছে। তোয়ালেটা এককাঁধে ঝুলিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলো সে। উদ্দেশ্য ফুপির ঘর।
দু’তিনবার আঙুলের টোঁকা দিয়েও যখন সাড়া পাওয়া গেলোনা তখন আস্তে করে দরজার নব ঘুরালো সায়ন। ফুপি ঘরে নেই। ইভা সোজা হয়ে ঘুমাচ্ছে। মাথাটা হেলে রয়েছে ডানদিকে। থুতনি যেয়ে ঠেকেছে গলার হাড়ে। সায়ন নিশব্দে ঢুকলো। দুই বালিশের মাঝখানের জা’গাটায় তার ফোনটা। ইভার একহাত পেটের উপর আরেকহাত ঠি ক তার ফোনটার উপর। সায়ন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কাছে যেয়ে সামান্য ঝুঁকে যেইনা ইভার হাতটা সরানোর জন্য মাত্র একটু ধরেছে বিপত্তিটা বাঁধলো তখনই। ঘুমন্ত ইভা ঘুমে ডুবেই প্রচন্ড জোরে তার হাতটা মুঠোয় চেপে ধরলো। শুধু ধরলোইনা বরং ঝুপ করে পাশ ফিরে অত্যন্ত আদুরে গোছে গালের নিচে টেনে নিলো। পাতলা ঠোঁটদুটো লেপ্টে গেলো সায়নের কব্জিতে। সায়নকে ঝুঁকে যেতে হলো। ভারসাম্য বজায় রাখতে অন্যহাতটা যেয়ে পরলো বালিশের উপর, বিছিয়ে থাকা চুলে। ফলস্বরুপ চুলের গোড়ায় মারাত্বক টান খেয়ে “আহ্” বলে চাপা স্বরে গুঙ্গিয়ে উঠে চোখ কুঁচকে তাকাল ইভা। তার তাকাতে দেরি হল কিন্তু মুখের উপর সায়নের ভেজা টাওয়ালটা পড়তে দেরি হলোনা। সদ্য ঘুম ভাঙা ইভা লজ্জায়, হতভম্বতায়, আড়ষ্টতায়, চুলের ব্যাথায় মিলেমিশে কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে গেলো। টাওয়ালের নিচেই চোখমুখ খিঁচে বুজে ফেললো। নিজের অজান্তেই মুঠোয় ধরা শক্ত হাতটা খামছে ধরলো দ্বিগুন জোরে।
সায়ন খানিকক্ষণ নিশ্চুপ চেয়ে রইলো। অত:পর চাপা গলায় বলল,”হাত ছাড়ুন ইভা।”
ইভা একমূহুর্ত থমকালো। সায়নের হাত ধরে রেখেছে বুঝতেই বিদ্যুতের গতিতে ছেড়ে দিয়ে নিজের হাতটা গলার কাছে গুটিয়ে নিলো সে।
হাত ছাড়া পেয়ে মুখের উপর থেকে টাওয়ালটা সরিয়ে দিলো সায়ন। ইভা পিটপিট করলো। সায়ন তার চোখের দিকেই চেয়ে রয়েছে। স্পষ্ট, কাঁটা চাহনী। ইভা ভড়কে গেলো। চুল ছাড়ানোর জন্য হাতটা একটু উঠাতেই নিজের বিশাল হাতের থাবায় ইভার ছোট্ট হাতটা ইভার থুতনির সাথেই চেপে ধরলো সায়ন। তর্জনীটা ঠোঁট বরাবর রেখে হিমশীতল কন্ঠে বললো,

-“আমাকে আপনি টান দিয়েছেন। অযথা ধাক্কা দিবেন না।”

বলতে বলতেই বালিশে রাখা হাতটায় অপ্রকাশিত রাগের বহি:প্রকাশ স্বরুপ আরো চাপ দিলো সে।

নিরুপায় ইভা অসহ্য ব্যাথায় কুঁকরিয়ে গেলো। ঠোঁটের উপর আঙ্গুল নিয়েই চোখমুখ খিঁচে বলল,”আল্লাহ আমার চুল…”

মাথায় দপদপ করে জ্বলা রাগটা হঠাৎই নিভে গেলো। ঝট করে বালিশের উপর থেকে হাতটা সরিয়ে, চেপে রাখা হাতটাও ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালো সায়ন। বললো,

-“ব্যাথা পাচ্ছেন আগে বলবেন না! দেখি ফোনটা দিন।”

ইভা তাড়াতাড়ি উঠে বসলো। একহাতে ঢিলে হওয়া আচঁল টেনে আরেকহাতে সায়নের বাড়িয়ে রাখা হাতে ফোনটা দিলো।
লিথিশা ঢুকলেন হাল্কা শব্দে দরজা খুলে। ইভা চমকে উঠলো। লিথিশা প্রশ্নাত্বক চোখে একবার সায়নের দিকে তাকালেন। সায়ন নিজ থেকেই বলল,

-“ফোনটা রাতে রেখে গিয়েছিলাম ফুপি।”

লিথিশা ভ্রু কুঁচকালেন,

-“ফোন নিতে এসেছিস ভালো কথা। ওকে উঠালি কেনো?”

সায়ন বেরোতে বেরোতে বলল,
-“আমি উঠাইনি ফুপি। নিজেই উঠে গিয়েছেন। টেবিলে নাস্তা দিয়েছো? ক্ষুধা লেগেছে।”

ইভা হাতের তালুতে মাথা ডলছে। এতো জোরে কেও চুলে টান দেয়? লিথিশা খেয়াল করতেই আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন,

-“মাথা ঘঁষছো কেনো মা? ব্যাথা করছে?”

বাড়ি ফেরার পর তেমন কোনো প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে হলোনা ইভাকে। ঘন্টাখানেক তাকে ধরে কান্নাকাটি, আদর- আহ্লাদ করে বাড়ির পরিবেশ শান্ত হলো। শুধু সরফরাজ ফেরার পথে একবার জিজ্ঞেস করেছিলো,

-“ইভা? ছেলেটা সত্যি বলেছে তো?”

ইভা উওর দিয়েছিলো,”জি ভাইজান।”

সেদিন বিকেলে আবার দিঘির পথ দিয়েই ফিরতে হলো সায়নের। দিঘির কাছাকাছি আসলে গাড়ি থামিয়ে কিছুক্ষণ নিরবে চেয়ে রইলো সে।
সময় গড়ালে গাড়ি ছুটে গেলেও মন থেমে রইলো সেই সম্মোহনী দিঘির পাড়ে, আকাশ হওয়া সচ্ছ জলে, শেষসিঁড়িতে পা ডুবিয়ে বসে থাকা ভীতু নারীতে।

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here