মেঘদিঘির পাড়ে পর্ব -০৫

মেঘদিঘির পাড়ে – ৫
মালিহা খান

১১.
সোনালী বিকেল সন্ধ্যার চাদরে গা ঢাকা দিলো। নির্বিঘ্ন নিজর্নতায় সবেমাত্র চাঁদের নরম আলো ছড়ালো।বিভা তখনো ছোট্ট বাহাদুরকে অঙ্ক করাতে ব্যস্ত। ছেলেটা খালি পড়ায় ফাঁকি দেয়।
ঘরের বন্ধ দরজায় ঠকঠক শব্দ। ইভা এসেছে ভেবে খাতায় এটা ওটা দেখিয়ে দিতে দিতে বিভা উচুকন্ঠে উওর দিলো,”আয়।”
দরজা খুললো। একঝলক চোখ তুলে দেখলো বিভা। থতমত খেয়ে গেলো সাথেসাথেই। দরজায় ইউসুফ দাড়িয়ে আছে। বিভা আমতাআমতা করলো। মিনমিনে কন্ঠে বলল,”মানে…আসেন।”
ইউসুফকে ব্যস্ত দেখাল। বিভার মিনমিনে কন্ঠটা তার কান অবধিও পৌঁছালোনা। ঘরের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে চোখ বুলিয়ে সে অত্যন্ত অস্হির কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল,”ইভা কোথায়? তোমার সাথে নেই?”
বিভা কিছুক্ষণ কথাহীন চেয়ে রইলো। ইউসুফের চিন্তিত চোখদুটো তার ভীষণ সুন্দর দেখালো। তারপর বলল,”না, ঘরে আছে হয়তো।”
ইউসুফ দু’বার পলক ফেললো। চিন্তার বদলে সেখানে এসে ভর করলো ভীতি। কন্ঠ স্পষ্টতর,”ঘরে নেই। দেখে এলাম তো মাত্র।”
বিভা ভ্রু কুঁচকালো, বিছানা ছেঁড়ে নামতে নামতে বলল,

-“সেকি! বিকেলে বললো ওই দিঘিরপাড়ে যাচ্ছে। এতক্ষণে তো ফিরে আসার কথা। আসেনি? সন্ধ্যা হয়ে গেছে।”

ইউসুফ মৃদুকন্ঠে শুধালো,”ওখানে গিয়েছে? আচ্ছা, আমি দেখছি।”

ইউসুফ চলে গেলো। দিঘির পাড় তন্নতন্ন করে খুঁজেও ইভাকে পাওয়া গেলোনা। খবর পাওয়া মাত্র সরফরাজ ফিরে এলো ঘন্টাখানেকের মধ্যেই। দিঘির আশপাশে আরো একদফা খোঁজাখোঁজি চললো। সবার থমথমে চেহারার দিকে তাকিয়ে ইউসুফ নিচুস্বরে বলল,”সরফরাজ? পানিতে একবার খুঁজে দেখব?”
সরফরাজ উওর দিলোনা। নিরবে চেয়ে রইলো অন্ধকার দিঘির কুচকুচে পানিতে।
ইউসুফ নামল পানিতে। ডুবকি লাগালো অনেকক্ষণ। শেষ সিঁড়িটায় দাড়িয়ে বুকচেপে রইলো বিভা। ইউসুফ উঠলো খালি হাতে। সিঁড়ির কোঁণে দাড়িয়ে থাকা বিভার টলমলে চোখদুটোতে চেয়ে জীবনে প্রথববারের মতোন বিভাকে জানিয়ে বিভার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

-“চিন্তা করোনা।”

বিভা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। সেই রাতে দিঘির পাড়ে দাড়িয়ে পাষাণ ইউসুফ কেনো যেনো খুব নরম হয়ে গেলো। তার নমনীয়তায় বিভার চোখের পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো ইউসুফের ভেজা চুপচুপে শার্টে।

১২.
ফুপির বাসার কাছাকাছি পৌঁছে ব্রেক চাপলো সায়ন। পাশের সিটে মেলে দেয়া প্রায় শুকিয়ে আসা শার্টটা নিয়ে গায়ে চড়াল। বোতাম আটকালো। উপরের লুকিং গ্লাসে চোখ পড়লো হঠাৎই। এবার আর লজ্জা পেয়ে চোখ নামাল না সায়ন। বরং চেয়ে থাকলো অপলক কিছুক্ষণ।
ছোট্ট আয়নায় সেই দু’মিনিটের দেখায়ই বোধহয় কিছু একটা হয়েছিলো। নামবিহীন, শিরোনামহীন কিছু একটা।
সায়ন পেছনে ঝুঁকে গিয়েছিলো। হাতের পিঠে ইভার গালের কাঁদামাটি মুছে দিয়েছিলো।

লিথিশা ফুপি একা মানুষ। গ্রামের বিশাল দোতালা বাড়িটা তার প্রয়াত স্বামীর। বিয়ের দু’বছেরের মাথায় স্বামীর হঠাৎ মৃত্যুর পর তিনি আর বিয়ে করেননি। নি:সন্তান পন্চাশার্ধ মহিলাটাকে নি:সন্দেহে পৃথিবীর সবচাইতে ভালো মানুষগুলোর কাতারে ফেলে দেয়া যায়। বড়ভাইয়ের ছেলেকে এক পৃথিবী সমান ভালোবাসা মানুষটাকে দেখলে কেও বলবেই না মানুষটার জীবনে এত একাকীত্ব, এতো দু:খ, এতো বেদনা।
সায়নের গাড়ির আলো দেখামাত্রই দৌড়ে দৌড়ে বেরিয়ে এলেন তিনি। দারোয়ান ঝিমাচ্ছিলো। লিথিশা ফুপি ধমকে জাগালো তাকে। সায়নের হর্ণ চাপতে হলোনা। দারোয়ান তাড়াহুড়ো করে বিশাল লোহার গেটটা খুলে দিলো। একপাশে গাড়ি থামিয়ে সায়ন যেইনা বেড়ালো, লিথিশা ফুপি জানলার ভেতর দিয়ে ইভার পা’টুকু দেখেই আৎকে উঠলেন,

-“সায়ন? বাবা, কি করেছিস?”

সায়ন উওর দিলোনা। ফুপির উত্তেজিত হবার স্বভাব আছে। ইভাকে পাঁজকোলা করে বের করতেই লিথিশা ফুপি এবার দ্বিগুন জোরে চেঁচালেন,”হায় আল্লাহ! কি হয়েছে ওর? গা ভেজা কেনো? এত ছোট মেয়ে? কোথায় পেলি?”
সায়ন ক্লান্ত কন্ঠে বলল,”ফুপি ভেতরে যাই? উনি অজ্ঞান। ঘরে নিয়ে যাই?

-“আয় আয়, আমার ঘরে নিয়ে চল।”

ইভাকে ঘর পর্যন্ত নিয়ে যেতে যেতেই সবটা বললো সায়ন। লিথিশা ফুপি এবারো চেঁচালেন,”তুই ভয় দেখালো কেনো? বেচারি না জানি কত ভয় পেয়েছে। জ্ঞানটাও ফিরেনি এখনো। আল্লাহ!”
সায়ন চুপ করে রইলো। ফুপির কথায় মনে হলো ভুলটা আসলে তারই হয়েছে।
ইভাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ফুপির কাছে পানি চাইলো সায়ন। ফুপি পানি দিলে ইভার মুখে ছিঁটালো। পরপর কয়েকবার পানির ছিঁটা পেতেই চোখ পিটপিট করলো ইভা। ঝাপসা চোখে সায়নকে মুখের উপর ঝুঁকে থাকতে দেখেই গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে দু’হাত উঠিয়ে বুকে ধাক্কা লাগালো। হতবিহ্বল সায়ন বিমূঢ় চোখে তাকাল। বিরবির করে বলল,

-“ও গড!”

ইভার মাথা টলছে। বারবার চোখ বুজে আবার তাকাচ্ছে সে। ভেজা শরীর ঘেমে যাচ্ছে। লিথিশা ফুপি এগিয়ে এলেন। সায়ন আস্তে করে বলল,”জামা বদলে তোমার কিছু পড়তে দিও ফুপি, ঠান্ডা লেগে যাবে। আমি একটু শাওয়ার নিয়ে আসি। পুকুরের পানিতে নামা লেগেছে।”

ক্রিম কালারের তোয়ালে টা দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে ইভার চুলগুলো পিঠময় ছড়িয়ে দিলেন লিথিশা। ইভার গায়ে আকাশী শাড়ি। গোসল করেছে একটু আগে।

-“বুঝলে মা, কামিজ তো এখন পড়া হয়না। শাড়ি ছাড়া কিছু নেই। একটু অপেক্ষা করো, তোমার জামাটা শুকিয়ে গেলেই ওটা পরে নিও।”

ইভা মাথা নাড়ালো। লিথিশা আবার বললেন,”সায়ন এলেই তোমার বাসায় জানাচ্ছি, সকালেই পৌছে দিয়ে আসবে। ভয় পেয়োনা। আসলে ও তো জানেনা তোমার বাসা কাছেই ছিলো। শহর থেকে এসেছে তো! গ্রামের কাওকেই চিনেনা। কাঁপছো কেনো? শীত করছে?”
ইভা দু’দিকে মাথা নাড়ালো। লিথিশা তার হাতদুটো ধরলেন,”শোনো মা, জীবনে সবকিছু কি আর সোজাসাপটা চলে বলো? এইযে আজ তুমি পানিতে না পড়লে কি সায়ন তোমাকে নিয়ে আসতো? তোমার সাথে আমার দেখা হতো? এত সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে যে আমার আশেপাশেই কোথাও থাকে আমি জানতে পারতাম? ভাগ্যিস পুকুরে পড়েছিলে।”
ইভা হেসে ফেললো। হাসি নিয়েই গা কাঁপিয়ে একটা হাঁচি দিলো। লিথিশা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন,”ইশ!

সায়ন এলো একটু পরে। ইভা একবার চোখ তুলেই মাথা নুইয়ে রইলো।

-“দেখি! আপনার বাসার কারো নাম্বার দিন। জানিয়ে দেই।”

ইভা সরফরাজের নাম্বার বললো। লিথিশা কথা বললেন। বোনের সাথে কথা বলে সরফরাজের প্রায় থেমে যাওয়া হৃদস্পন্দন আবার প্রান ফিরে পেলো যেনো। বারবার বললো,”আমি এক্ষুনি আসছি।” লিথিশা অনেক করে বলে মানালো তাকে। এতরাতে আসাও বিপদ। শেষমেষ কথা হলো,সকালে সে এসেই নিয়ে যাবে ইভাকে।
ইভা হাঁচি দিচ্ছে বারবার। নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে। চোখে পানি চলে আসছে। লিথিশা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন,”ইশ! দাড়াও, গরম পানি নিয়ে আসি।”
লিথিশা ছুটে ছুটে বেরিয়ে গেলেন। এক আকাশ সংকোচ নিয়ে ইভার মাথায় হাত রাখলো সায়ন। বললো,

-“আমি বুঝিনি আপনি এতো ভয় পেয়ে যাবেন ইভা।”

ইভা নিমীলিত ভঙ্গিতে চুপসিয়ে গেলো। গলা দিয়ে কথা বেরোলো না। তবে মাথা ঝাঁকিয়ে দু’তিনটা হাঁচি
ঠি কই বেরোলো। লিথিশা পানি নিয়ে এলেন। সায়ন মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিলো। লিথিশা একহাতে ধরে ইভাকে পানি খাওয়াতে খাওয়াতে বললেন,

-“দেখ সুন্দর লাগছে না? আর কিছু ছিলোনা বুঝলি? শাড়িটা মনে আছে? ওইযে গতবছর জন্মদিনে তুই উপহার দিলি যে?”

সায়ন মুখে বললো,”মনে আছে।” আর মনে মনে বললো,

-“মেঘের মতোন সুন্দর লাগছে।”

~চলবে~

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here