মেঘদিঘির পাড়ে পর্ব -০৪

মেঘদিঘির পাড়ে – ৪
মালিহা খান

৯.
দীর্ঘক্ষণ উশখুশ করে বিভার ঘুম যখন ভাঙলো, ইউসুফ তখনো ড্রাইভ করছে। নিচের ঠোঁট কামড়ে মনোযোগী চোখে সামনের কাঁচে তাকিয়ে আছে। যেনো সেই কাঁচে কেও কোটি টাকার সিনেমা চালিয়ে রেখেছে, বা বিনা পয়সায় সার্কাস দেখাচ্ছে বা কাঁচে কোনো জাদু আছে। তাকালে চোখের দৃষ্টি বাড়ে।
ইউসুফের শার্টের বোতাম সবকটা খোলা। একটু পরপর চুলে চালানো আঙ্গুলের ভঙ্গিটাতেও কেমন ভিন্নতা খুঁজে পায় বিভা।
তার মাথাটা বন্ধ জানলার কাঁচে ঠেকানো, কি ভীষণ অবহেলা তাইনা? বিভা একমনেই হাসলো। কেমন গা ছাড়া হাসি। ছন্নছাড়া- হতাশ হাসি। সেই হাসিতে শব্দ হলোনা। ঠোঁট আলগা হলোনা। ইউসুফ ফিরেও তাকালোনা একবার। বিভা নিজ থেকেই বললো,”আমি উঠেছি।”

-“তো?”

-“কিছুনা।” হাল্কা গলায় উওর দিয়েই চুপ করে গেলো বিভা। কিছুক্ষণ পর আবার বললো,

-“পৌঁছিনি এখনো?”

-“ফিরছি।”

বিভার চোখ কপালে উঠে গেলো। এতোক্ষণে টনক নড়লো। বাইরে রাত। কালো ঘুটঘুটে রাত। এতো রাত কখন হলো? বাজে ক’টা? তারাতো বিকেলে বেরিয়ে ছিলো। তবে? এক পাহাড়সম বিস্ময় নিয়েই বিভা প্রশ্ন ছুঁড়ল,”মানে? আপনি ফোন কিনেননি?”

-“কিনেছিতো, এইযে।” ইউসুফ গাড়ির সামনের ড্রয়ারটা খুলে দিলো। ভেতরে তিনটা চকচকে বাক্স।

বিভার বিস্ময় বিশাল এভারেস্ট ছুলো,

-“কখন কিনেছেন? এতগুলো কেনো?”

ইউসুফ ড্রয়ারটা আটকে উঁচুকন্ঠে বললো,”তুমি ঘুমিয়ে ছিলে।…আবার কখন ভেঙে ফেলো ঠি ক তো নেই কোনো। দু’দিন পরপর এত রাস্তা বয়ে কিনতে আসাও ঝামেলা। তাই বেশি করে কিনে রাখলাম। কথায় না পেরে তো এই এক ফোনের উপরই হাত চলে তোমার। আর কি পারো?”

বিভা চোখমুখ কঠিন করলো। মনে মনে বলল,”আপনি তিনটে ফোন কিনতে পারেন অথচ দু’মিনিট কাছে বসিয়ে আমাকে নরম গলায় একটু মানা করতে পারেন না? আপনি মানা করলে আমি আর কোনোদিন আপনার ফোনে হাত দিবো? আর কোনোদিন আপনাকে বিরক্ত করবো? বিশ্বাস করেন, এই রাস্তার বিশাল লম্বা হেডলাইটটাকে সাক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞা করলাম আপনার এই গোটা তিনটে ফোন আর ভীষণ নাকউঁচু স্বভাব আমি একদিনে ভাঙব।”

মইদুলের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলো পরদিন দুপুরেই। বারান্দার রেলিং ঘেঁষে ইভা ঘন্টাখানেক দাড়িয়ে রইলো মেঘদিঘিতে চেয়ে। এই দিঘির নাম মেঘদিঘি না। গ্রামের লোকজন একে সাধারণ, ঝোপের পাশে থাকা পড়ে থাকা খুব নগন্য একটা দিঘি বলেই জানে। নামকরণ টা সে নিজে করেছে। দিঘির জলে পুরো আকাশটা দেখা যায়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় একখন্ড আকাশ এসে এই পৃথিবীতে বিছিয়ে পড়েছে। থইথই করছে মেঘ। নীল সাদা ভীষণ সুন্দর জলমেঘ।

১০.
সাদা মেঘে কৃষ্ণচূড়ার ঝাঁক। দিঘির টলমলে জলে গোধুলীরাঙা আকাশের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি ভাসছে। মাঝে দু’একটা বেগুনী শাপলা। বোধহচ্ছে আকাশের গায়েই মাথা উঁচু করে ফুঁটে আছে ওরা। দিঘির একপাশের পরপর পাঁচটে লাল সিঁড়ির পর ষষ্ঠ সিঁড়ি থেকে যেয়ে বাকিগুলো ডুবেছে পানির নিচে। ঠান্ডা পানির নিচে সেই ষষ্ঠ সিঁড়িতেই পা ডুবিয়ে বসে আছে ইভা। আজ বাহাদুর আসেনি। আসার আগে দেখে এসেছে বিভার ঘরে বসে পেন্সিল কামড়ে কামড়ে খাতায় অঙ্ক কষছে। সে যেতেই করুণ চোখে একবার চাইলো, বিভার কড়া চোখ রাঙানীতে আবার মাথা নিচু করে খাতায় মনোযোগ দিলো।
সেই দৃশ্য মনে পড়তেই দিঘির জলে পা নাচিয়ে খিলখিল করে হেসে ফেলল ইভা। নির্জন জা’গাটায় ভারি অদ্ভুত সুন্দর শোনালো সেই ঝলমলে হাসির শব্দ।
ক্যামেরার সাটারের ‘সাঁট’ আওয়াজটাও এলো তখনই। ইভার পিলে চমকে উঠলো। বা’কাঁধের ঠি ক উপরে কারো হাতের অস্তিত্ব টের পেতেই ধরফরিয়ে উঠে দাড়ালো সে। কাঁধের সাথে লেগে সায়নের ক্যামেরাটা
হাত থেকে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো। দু’হাতে আঁকড়ে কোনরকমে বাঁচিয়ে নিলো সে। মাত্র একধাপ উপরেরর সিঁড়িতে আস্ত এক অপরিচিত পুরুষ দেখে ইভার চোখমুখ ভয়ে চুপসে গেলো নিমিষেই। সমস্ত গা শিঁউরে উঠলো সর্বগ্রাসী আতঙ্কে। সায়ন ক্যামেরা থেকে চোখ তুলে একপলক মেয়েটার পাংশুটে মুখ দেখলো। একধাপ নিচে নামতে নামতে প্রচন্ড বিব্রত কন্ঠে বলল,

-“ভয় পাবেন না, আমি আপনার ছবি তুলিনি…।”

আগন্তককে নামতে দেখে আপনাআপনিই পিছিয়ে গেলো ইভা। সায়ন হঠাৎই চিৎকার করলো,

-“আপনি..। কথা সম্পূর্ণ হলোনা। তার আগেই পানির নিচের পিচ্ছিল সিঁড়িতে পা পিছলে গেলো ইভার। হতভম্ব সায়ন তড়িৎগতিতে হাত ধরার চেষ্টা করলো। লাভ হলোনা। ভয়ে, আতঙ্কে জবুথবু ইভা চিৎকার করতেও বেমালুম ভুলে গেলো যেনো। থইথই পানিতে দু’তিনবার তলিয়ে গিয়ে নাকেমুখে পানি ডুকে গেলো তরতর করে। শ্বাস আটকে এলো মূহুর্তেই। সাতপাঁচ না ভেবে ক্যামেরাটা সিঁড়ির উপর রেখেই পানিতে নেমে গেলো সায়ন। পরপর কতগুলো সিঁড়ি। পা রাখলেই নাগাল পাওয়া যাচ্ছে। আর বোকা মেয়েটা ভাসতে ভাসতে মাঝখানে চলে গেছে। সায়ন পানি হাতড়ে সামনে এগোলো। আশেপাশে একটা কাকপক্ষীও নেই।
ইভা ডুবছে প্রায়। সায়ন দ্রুত একহাতে কব্জি চেপে কাছে টানলো। দ্বিধাগ্রস্থ হাতেই নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ফেললো ইভার তুলতুলে ছোট্ট শরীরটা। বিব্রতবোধটা যেনো গলার মাঝে শক্ত কাঁটার মতো আটকে গেলো এবার,

-“দেখি ধরুন আমাকে। গলা ধরুন। এই মেয়ে?”

ইভা ধরলোনা। নিশ্চুপ, চৈতন্যহীন লেপ্টে রইলো সায়নের বুকের মধ্যিখানে। তার ক্ষীণ শ্বাস খুব ধীরগতিতে পড়তে থাকলো। খোঁপা খুলে যাওয়া বিশাল দৈর্ঘ্যর লম্বা লম্বা ভেজা চুলগুলো লতাপাতার মতোন পেঁচিয়ে গেলো সায়নের হাতে- বাহুতে।
ইভাকে পাড়ে তুলে বিব্রত সায়ন এবার আরো বিব্রতবোধ করলো। সন্ধ্যে নামার আগমূহুর্তের আবছা আলোতে ইভার দিকে তাকাতেই তার প্রচন্ড লজ্জা লাগলো।
বারকয়েক গালে চাপড় মেরেও লাভ হলোনা। শুধু ইভার মাথাটা এদিক ওদিক হলো মাত্র। অজ্ঞান ইভা সেই অজ্ঞানই রইলো। নিরুপায়, দিশেহারা সায়নকে মাত্র কয়েকমূহুর্তের সিদ্ধান্তে গোটা সাতাশ বছরের জীবনের সবচাইতে অসস্তিকরকাজটাই করতে হলো তখন। ইভার জ্ঞান ফিরলো কিয়ৎক্ষণের জন্য। কয়েকসেকেন্ড নিভু নিভু চেয়ে থেকে, অত্যন্ত দূর্বল গলায় কিছু বলার চেষ্টা করে আবারো অচেতন হয়ে গেলো সে।
সায়ন আবার ডাকল,”এই মেয়ে? এইযে মিস? আপনি..।” ইভার মাথাটা বামদিকে হেলে পড়ল। গালে একদলা মাটি লেপ্টে গেলো রংয়ের মতোন।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সায়ন। এদিক ওদিক চাইলো একবার। তার গাড়িটা একটু দূরেই পার্ক করা। সুন্দর ফিরছিলো রাস্তা দিয়ে, কি করতে যে এই দিঘির ছবি তুলতে এলো কে জানে! না আসত, না মেয়েটার সাথে দেখা হতো, না এইরকম চরম বিদঘুটে পরিস্থিতিতে পড়তে হতো।
গ্রামে সন্ধ্যাে হতেই রাত নামে। মানুষের আনাগোনা কমে যায়। আবার দিঘির পাশের ঝোপ-ঝন্জাল। ভুল করে হলেও আশেপাশের কেও তাদেরকে এমন অবস্থায় দেখলে তিল কে তাল বানাতেও বিন্দুমাত্র ভাববেনা। উল্টো আরো বিরাট ঝামেলায় ফেঁসে যাবে অনায়াসে। এই মেয়ের বাড়ি কোথায় কে জানে! জানার কথাও না অবশ্য!
ইভাকে গাড়ির পিছের সিটে শুঁইয়ে দিয়ে খুব আঁটসাঁট ভঙ্গিতে তার গায়ের চুপচুপে ওড়নাটা টেনে নিলো সায়ন। দু’হাতে চিঁপড়ে পানি ঝড়িয়ে গায়ের উপর মেলতে যেতেই টের পেলো তার হঠাৎ প্রচন্ড লজ্জা লাগছে। লজ্জায় কানের লতি গরম হয়ে যাচ্ছে। হাত কাঁপছে, বুক কাঁপছে, মেয়েটার দিকে তাকানোতে যেনো ঘোরতর, গুরুতর অপরাধ।
পুরুষমানুষের লজ্জা কম থাকে’ কথাটা হঠাৎই প্রচন্ড মিথ্যে মনে হলো সায়নের। নিঝঝুম অদ্ভুত দিঘির পাড়ে সায়ন নিজের ভিতরের সবচেয়ে লজ্জাশীল সত্তাটাকেই খুঁজে পেলো যেনো। নিজের হাঁটুর বয়সি একটা ছোট্ট মেয়েকে দেখে সারা বিশ্বের সমস্ত লজ্জা এসে ভর করলো প্রাপ্তবয়স্ক চোখের পাতায়।
ড্রাইভিং সিটে বসে ফোন করলো সে,

-“ফুপি? আমি ব্যাক করছি বুঝলে? পথে একটু ঝামেলা হয়েছে।”

-“সেকি! তোর না জরুরি কাজ পড়লো? সকালের মধ্যে না ফিরতে হবে?”

-“আজ আর ফেরা হয়েছে!”বিরবির করতে করতেই ফোন কাটলো সায়ন।

মেঘদিঘিকে একলা ফেলে দিঘিকন্যাসমেত গাড়ি কিছুক্ষণের মতোই চোখের আড়াল হয়ে গেলো।

~চলবে~

[রি-চেক হয়নি]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here