নীলচে তারার আলো পর্ব -১৩+১৪

#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_১৩

হিয়া শাড়ির আঁচলটা কাঁধ থেকে সরিয়ে নিচে ফেলে পিছনে ঘুরতেই দেখলো শুভ্র ভ্রু কুঁচকে বুকের কাছে দু হাত ভাজ করে দাড়িয়ে আছে। হিয়া হকচকিয়ে উঠলো, মারাত্মক ভয় পেয়েছে সে। চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু গলা দিয়ে তার এক বিন্দু আওয়াজ বের হচ্ছে না। হিয়া দু পা পিছিয়ে এসে দুকাধে হাত দিয়ে নিজেকে ঢেকে ফেললো। হিয়া স্তম্ভিত হয়ে দাড়িয়ে আছে। হার্ট বিট অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে তার। শুভ্র কি করে তার ঘরে আসবে? তাহলে সামনে কে? নাকি সে কি সে ভুল দেখছে কিংবা হেলোসিনেট করছে। কিন্তু দু সেকেন্ডের মধ্যেই হিয়ার সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো।

হিয়াকে এমন স্তম্ভিত হয়ে থাকতে দেখে শুভ্র অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,” আঁচলটা কি নিজে তুলবে নাকি এসে তুলে দিয়ে হবে?”

হিয়ার সাড়াশব্দ নেই, সে এখনও নিশ্চুপ। এতক্ষণ নিশ্চুপ থাকার মেয়ে তো সে না। শুভ্র উপায় না পেয়ে নিজেই এগিয়ে এসে বললো,” এতো স্তম্ভিত হওয়ার কিছু হয় নি।”, তারপর আঁচলটা নিচে থেকে তুলে হিয়াকে মুড়িয়ে দিতেই হিয়া এক পলক শুভ্রের দিকে তাকিয়েই অজ্ঞান হয়ে গেলো। অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতেই শুভ্র চটজলদি ধরে ফেললো হিয়াকে। তারপর হিয়াকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখে হতভম্ব হয়ে বললো,” হোয়াট দা হেল!”

✨ হিয়া আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালো। তার ঘরের বাতি জ্বলছে। চোখ খুলে প্রথমেই সে নিজের দিকে তাকালো শাড়িটা ঠিক আছে কিনা দেখতে। তারপর বাম পাশে তাকাতেই দেখলো রুপা তার মাথার কাছে বসে আছে। উহ! তাহলে কি ঐটা দুঃস্বপ্ন ছিলো। হিয়া মাথায় হাত দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসলো। রুপা হিয়াকে ধরে বসিয়ে বলল,” ঠিক আছিস? এমন হটাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলি কিভাবে?”

হিয়া কিছু বলার আগেই দেখলো শুভ্র রূমে ঢুকছে। চোখ বড় বড় করে হিয়া তাকিয়ে আছে। তারপর শুভ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে রুপাকে জিজ্ঞেস করলো,” এই ঘরে তুই কয়জনকে দেখতে পাচ্ছিস?

রুপা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,” কয়জনকে দেখতে পাচ্ছি মানে?”

হিয়ার এখনও মনে হচ্ছে সে হেলোসিনেট করছে। শুভ্র ভ্রু কুঁচকে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। নীল শাড়ি, হাতে চুড়ি, চোখে কাজল দিয়ে কোথা থেকে ফিরেছে? হিয়া ফ্যাল ফ্যাল করে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণে সে বুঝতে পারছে। এটা শুভ্র, কোনো দুঃস্বপ্ন কিংবা হেলোসিনেশন নয়। লোকটা এইখানে কি করছে? এসে একেবারে তার ঘরে ঘাপটি মেরে বসেছে। সে ভুল করে একবার রূমে গিয়ে ছিলো তাতে তো পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছিলো।

রূপা প্রায় হতভম্ব হয়ে দুজনকে দেখছে। এমন ভাবে এরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে কেনো? রুপা আমতা আমতা করে বলল,” আমি যাই। বাবাকে বলি যে তোর জ্ঞান ফিরেছে।” বলেই সে কেটে পড়লো।

রুপা চলে যেতেই হিয়া রেগে বললো,” আপনি এইখানে কি করছেন?”

শুভ্র কোনো কথা বললো না। স্বাভাবিক ভাবে হিয়ার বিছানার একপাশে বসে পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখতে লাগলো। হিয়ার রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে।তাকে তো রুমেও ঢুকতে দেয় না আর এইখানে এসে একেবারে বিছানায় বসে আছে।

শুভ্র ফোনটা কিছুক্ষণ স্ক্রোল করে হিয়ার দিকে তাকালো। তারপর বললো,” এতক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছো তাও মন ভরেনি আমাকে দেখে। আর কতক্ষন তাকিয়ে থাকবে?”

” হ্যা আমাকে তো ভুতে ধরেছে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকতে যাবো।”, চট করে জবাব দিল হিয়া। দিয়েই অন্যদিকে তাকালো সে। শুভ্র আড় চোখে তাকিয়ে বললো,” তাহলে তো তোমার চোখে সমস্যা।”

তারপর এগিয়ে এসে হাত বাড়াতেই হিয়া একদম খাটের সাথে মিশে গেলো। শুভ্র হাত বাড়িয়েছিল পানির গ্লাসটা নিতে, হিয়াকে জড়সড় হতে দেখে পানির গ্লাসটা হিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
” নাও, এইটা আমার থেকে বেশি তোমার প্রয়োজন।”

হিয়া কাপা কাপা হাতে গ্লাসটা ধরলো, সত্যি তার তৃষ্ণা পেয়েছে। এক চুমুকে পুরোটা শেষ করতেই শুভ্র বললো,” আমার দিকে তাকিয়ে থেকে একেবারে গলাও শুকিয়ে ফেলেছ।”

হিয়া গ্লাসটা নামিয়ে বললো,” ফালতু কথা একদম বলবেন না। বলছি না আপনার দিকে তাকাই নি।”

শুভ্র হিয়ার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে রাখলো। তারপর স্থির দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। হিয়া না চাইতেও চোখ নামিয়ে ফেললো।

” তুমি আমাকে এতো ভয় পাও কেনো? ভয়ের চটে অজ্ঞানই হয়ে গেলে।”, হটাৎ শুভ্রের এমন শান্ত স্বরে কেমন একটা শিহরণ জেগে উঠলো হিয়ার মনে।

হিয়া আড় চোখে তাকিয়ে বললো,” মোটেও আমি ভয় পাই নি। ওটাতো এমনেই। মানে…. জানি না কেনো হয়েছে। কিন্তু ভয় পাই নি আমি।”

” তাহলে তো ভালোই। উঠে নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে রাখো, কাল সকালে যেতে হবে।”, হিয়া মুখ ফ্যাকাশে করে বললো,” কাল যাবো মানে? সবে তো এক সপ্তাহ হলো আমি এসেছি আর আমার পরীক্ষার তো অনেক দেরী আছে। আর আপনি এসেছেন কেনো আমাকে নিতে?”

” মা পাঠিয়েছে তোমায় নিয়ে যেতে। তোমার যেতে ইচ্ছে না হলে যাবে না।”,স্বাভাবিক ভাবেই বললো শুভ্র।

হিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে হনুমানটা এতো ভালো হলো কবে? এটা কি স্বপ্ন? কি যন্ত্রণা! সব কিছু স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে কেনো তার কাছে? হিয়া পরক্ষনেই হেসে বললো,” ঠিক আছে তাহলে আমি যাবো না।”

শুভ্র ফোনটা বের করে মায়ের নাম্বারটা হিয়ার সামনে ধরতেই হিয়া চোখ বড় বড় করে তাকালো। শুভ্র বললো,” নাও, ফোন করে বলো যে তুমি আসতে চাও না। আমিও তাহলে রাতেই ফিরে যাচ্ছি, শুধু শুধু কালকের ক্লাস মিস দেওয়ার কোনো মানে হয় না।”

শুভ্রের চালাকি ধরতে পেরে হিয়া রাগী গলায় বললো,” আপনি ইচ্ছে করে এমন করছেন, তাই না? আমি কিভাবে ওনাকে না বলবো? আর আপনাকে বললেই আপনার চলে আসা লাগবে? এসেছেন কেনো আপনি? আপনার না সময়ের অনেক দাম। নষ্ট করছেন কেনো আপনার সময়?”

” বক বক তো ভালোই করতে পারো। সাহস দেখানোর বেলায় শুধু ভিজে বিড়াল।”,বলেই ফোনটা পকেটে ভরে উঠে পড়তেই হিয়ার মামী এক গ্লাস দুধ নিয়ে হাজির। হিয়া চোখ বড় বড় করে তাকালো। মামী এগিয়ে এসে হিয়ার মুখের সামনে ধরে বলল,” নে এক ঢোকে শেষ করবি।”

হিয়া ভয়ে ভয়ে মামীকে জিজ্ঞেস করলো,” হটাৎ দুধ।” মামী কঠিন গলায় বলল,” কথা কম। জলদি শেষ কর। চুলায় তরকারি বসাইয়া আসছি।”

হিয়া নাক মুখ কুঁচকে গ্লাসটা হাতে নিলো। তারপর তার মামীর দিকে তাকালো। সে ধমকের সুরে বললো,” তাকিয়ে আছিস কেনো? শেষ কর।”

দুধ হিয়ার একদম পছন্দ না। কিন্তু মামী তো এমনই, না খেলে ঠাস করে একটা লাগাইয়া দিবে। তাই আর কিছু না বলে দুধটা অনেক কষ্ট করে শেষ করে গ্লাসটা মামীর হাতে দিলো। তিনি গ্লাসটা হাতে নিয়ে হিয়াকে বললেন,” চুপ করে বসে থাকবি। খাট থেকে নামবি তো তোর খবর আছে।” হিয়া গাল ফুলিয়ে বসে আছে।

শুভ্র হিয়ার মামীকে অবাক হয়ে দেখছে। তিনি যেতে যেতে শুভ্রের উদ্দেশ্যে বলেন,” ঢাকা গিয়েই টেস্ট করে ফেলবা, বুঝসো কি বললাম?”

শুভ্র অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে হ্যা সূচক হালকা ঘাড় কাত করলো। মামী চলে যেতেই হিয়া অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,” টেস্ট? কিসের টেস্ট?”

শুভ্র ভ্রূ কুচকে হিয়ার দিকে তাকালো। তারপর বললো,” তুমি কয় বক্স আচার খেয়েছো?”

হিয়া অবাক হয়ে বললো,” মানে? আমি কয় বক্স আচার খেয়েছি তা দিয়ে আপনার কি? আর আপনি জানলেন কি করে?”

” তোমার মামী বলল তুমি নাকি অনেক আচার খেয়েছো। তোমার মাথাও নাকি একটু ঘুরিয়েছে।”, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো শুভ্র।

” হ্যা, তাতে আপনার কি?”,রেগে বললো হিয়া। আরে আজব! আমার ইচ্ছে হয়েছে আমি খেয়েছি। আর আমার মাথা ঘুরিয়েছে ঘুরাক, তাতে এই লোকের কি?

শুভ্র নিশব্দে হাসলো অতিরিক্ত তেলযুক্ত খাবার বেশি পরিমাণে খাওয়ার কারণে হিয়ার মাথাটা ঘুরিয়েছে আর এতে হিয়ার মামী কি কি চিন্তা করে বসে আছে। শুভ্র হাসি ঠোঁটের কোন রেখে বললো,” আমার কিছু না তবে তোমার মামীর ধারণা তুমি প্রেগনেন্ট। তাই টেস্ট করাতে বললো।”

হিয়া হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। এইসব কি শুনছে? কি দেখছে সে? সে পাগল হয়ে গেছে নাকি এই লোকটা পাগল হয়ে গেছে। আর এই বদমাইশ লোকটা দেখো হাসছে। হিয়া বিছানা থেকে একটা বালিশ শুভ্রের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললো,” হাসছেন কেনো আপনি? আর উল্টা পাল্টা এইসব কি বলছেন। মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনার?”

শুভ্র হাত বাড়িয়ে বালিশটা ধরে বললো,” তোমাদের পুরো ফ্যামেলি কি এমন? একজন ভয়ে অজ্ঞান হচ্ছে তো আরেকজন ভাবছে সেটা প্রেগনেন্সির জন্য হচ্ছে।”

হিয়া রাগে কিরমির করছে। এতো কথা বলা শিখেছে কবে এই লোকটা? শুভ্র হাতের বালিশটার দিকে তাকালো তারপর বললো,” আর বালিশ ছুড়ে মেরেছো কেনো? তোমাকে ছুঁড়ে মারবো? পড়ে তো আবার অজ্ঞান হয়ে যাবা।” শেষের টা উপহাস করে বললো শুভ্র।

হিয়া শুভ্রকে যত দেখছে তত অবাক হচ্ছে। এমন শুভ্রকে সে এর আগে দেখেনি। এমনভাবে সে এতদিনে প্রথম দেখছে শুভ্রকে। হিয়া আর কোনো কথা বললো না। চুপ করে বসে আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে রইল। হিয়ার নিজের কাছেই আজব লাগছে। হটাৎ অজ্ঞান হওয়ার কি ছিলো? আর এই অজ্ঞান হওয়া নিয়ে কতকিছু হয়ে গেলো।

✨ হিয়া শাড়ী বদলেছে। এখন বিছানায় বসে আছে।হিয়া আগে থেকে এসেই নিজের খাটের অর্ধেকের বেশি জায়গা নিয়ে বসে আছে। হিয়া চিন্তায় শেষ। এই লোকটার সাথে তাকে এক ঘরে থাকতে হবে। কি ভয়ানক! হিয়া রূপার রূমে থাকতে গিয়েছিল মামী এক ধমক দিয়ে রূমে পাঠিয়ে দিয়েছে। উফফ সবাই খালি তাকে ধমকের উপর রাখে। একটু ভালো করে কথা বলা যায় তার সাথে। হিয়ার বুকটা ধুক ধুক করছে।

শুভ্র ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে আসলো। তারপর স্বাভাবিক ভাবেই হিয়ার পাশে এসে শুয়ে পড়লো। হিয়া কিছুটা সরে এসে আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে রইল। শুভ্রের আলোতে ঘুম আসে না তাই সে চোখ খুলে হিয়ার দিকে তাকাতেই দেখলো হিয়া আড় চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

শুভ্র ভ্রু কুঁচকে ফেলতেই হিয়া কড়া গলায় বললো,” আমি কিন্তু নীচে ঘুমাবো না। এটাবাংলা সিনেমা না। আপনি ভুলেও আমাকে নিচে শুতে বলবেন না। আপনার এতো সমস্যা হলে আপনি নীচে শুয়ে পড়ুন।”

” নাহ্ আমার কোনো সমস্যা নেই। আর এইটা তোমার ঘর তাই তোমার বিছানায় তুমি শুতেই পারো। কিন্তু ঘুমানোর আগে লাইটটা অফ করে দিও।”,বলেই অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে পড়লো শুভ্র।

হিয়া হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। হটাৎ এতো ভদ্র হয়ে গেলো কিভাবে? হিয়া উঠে গিয়ে সুইচটা বন্ধ করে তার ঘরের নীল তারা গুলো জ্বেলে দিলো। হিয়া একদম অন্ধকারে ঘুমাতে পারে না। তারপর নিজেকে পাতলা চাদর দিয়ে মুড়িয়ে একপাশে গুটি মেরে শুয়ে পড়লো। ভালোয় ভালোয় আজ রাত পার হলেই সে বাঁচে। শুভ্র কিছুক্ষণ পর চোখ মেলতেই দেখলো। হিয়ার রুমে ছোটো ছোটো তারা ঝুলছে। অন্ধকারে সেই তারা গুলোর হালকা নীল অবয়ব রুমটায় ছড়িয়ে পড়েছে।

শুভ্র ভ্রূ কুচকে বললো,” তোমাকে লাইট বন্ধ করতে বলেছিলাম এতগুলো আলো জ্বেলে দিতে বলিনি।”

হিয়া মুখ ঘুরিয়ে শুভ্রের দিকে তাকালো তারপর বললো,” আমি অন্ধকারে ঘুমাতে পারি না।”

শুভ্র হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,” আমি আলোতে ঘুমাতে পারি না।”

” তাহলে একদিন না ঘুমিয়ে থাকুন,কিচ্ছু হবে না আপনারা।” ,বলেই হিয়া মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়লো।

শুভ্র উঠে গিয়ে একটা তারা বাদে বাকি সবগুলো তারার আলো বন্ধ করে দিয়ে এসে শুয়ে পড়লো। হিয়া তাকিয়ে দেখলো শুধু তার মাথার উপরের বড় তারাটা জ্বলছে। হিয়া রেগে গিয়ে বললো,” কি করলেন আপনি এইটা?”

” চুপ চাপ ঘুমাও। আর উঠে গিয়ে যদি একটা এক্সট্রা তারা জ্বেলে দিয়েছো। তাহলে তো আমাকে চিনো।”, ধমকের সুরে বললো শুভ্র।

হিয়া মুখ বাকালো, এইতো হনুমানটা আসল রূপ দেখাচ্ছে। রুমটা তার, কিন্তু হুকুম দিচ্ছে এই লোকটা। হনুমান কোথাগার!
#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_১৪

শুভ্রের ঘুম ভেঙেছে খুব সকালে। হিয়ার রূমের একটা জানালা খোলা থাকায় ভোরের আলোয় রুমটা আলোকিত হয়ে গেছে। পাখিদের কিচিমিচির আওয়াজ ভেসে আসছে কানে। প্রকৃতির ডাকে কখনই এমনভাবে সে জাগে নি। শুভ্র আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালো। তারপর নিজের বাম পাশে তাকাতেই দেখলো হিয়া গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। ছোট্ট বাচ্চাদের মতন গালের নীচে একটা হাত রেখে ঘুমাচ্ছে হিয়া।

শুভ্রের বাবা আসতে রাজি না হওয়ায় শুভ্রের মা তাকে জোড় করেছে। মোহনা এসেও হিয়াকে খুঁজেছে। কি অদ্ভূত কয়েক মাসেই মেয়েটা সবার এতো কাছের হয়ে গেলো। এই স্টুপিড মেয়েটার কি এমন ক্ষমতা যার জন্যে শুভ্রনীল আহমেদ এতদূর এসেছে। নাকি এই মেয়েটাকে জ্বালাতে তারও ভাললাগে। হয়তো!
শুভ্র দ্বিতীয়বারের মতো হিয়ার দিকে ফিরলো। হিয়া নড়ে চড়ে উঠে চোখ খুললো কিন্তু শুভ্র চোখ সরালো না, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

হিয়া চোখ খুলে শুভ্রকে নিজের সাথে এক বিছানায় দেখে চমকে উঠে দূরে সরতেই হুড়মুড়িয়ে চাদর সহ নীচে পড়ে গেলো। পড়েই আহ্ করে চিৎকার করে উঠলো। বিছানা থেকে পড়ে তার মাথায় এলো সে আর শুভ্র একই ঘরে ছিলো সারারাত। হিয়া কোমড় ধরে আর্তনাদ করে উঠলো।

হিয়ার এমন কান্ড দেখে শুভ্র ভ্রু কুঁচকে উঠে বসলো। এই মেয়েটা অতিরিক্ত পরিমাণে ছটফট করে। শুভ্র ভ্রূ ডলতে ডলতে বললো,” কোমড় কি ভেঙেছে? ভেঙে গেলেও কিন্তু স্ট্রেচারে করে ঢাকায় যেতে হবে।”

হিয়া রাগে কটমট করে শুভ্রের দিকে তাকালো তারপর বললো,” আপনি তো সেটাই চান। আমি কোমড় ভেঙে ঘরে বসে থাকি।”

” সে তোমার কোমড় ভাঙলেও তুমি ভাঙ্গা কোমড় নিয়ে লাফালাফি করবে। ঘরে বসে থাকার মেয়ে তো তুমি না।”, বলতে বলতে শুভ্র খাটের উপর থেকে উকি দিয়ে নিচে তাকালো। হিয়া কোমড়ে হাত দিয়ে বসে আছে আর বির বির করে কি জানি বলছে। শুভ্রকে দেখে কটমট করে তাকালো। তারপর বললো,” তাকিয়ে তাকিয়ে কি মজা নিচ্ছেন?”

শুভ্র হিয়ার কথা সম্পূর্ন অগ্রাহ্য করে বললো,” কতক্ষন বসে থাকবা নিচে?”

” সারাদিন বসে থাকবো। আপনার কোনো সমস্যা?”, মুখ বাকিয়ে বললো হিয়া।

” নাহ্, কোন সমস্যা নেই। বসে থাকো।”,বলেই শুভ্র উঠে পড়ল।

হিয়া আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে রইল। এইটা মানুষ নাকি পাথর। কোনো মায়া দয়া কিছু নেই। সে যে পরে গেছে একবার জিজ্ঞেসও করলো না, ব্যাথা পেয়েছে কিনা? উল্টে বলে কিনা কোমড় ভাঙ্গলে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাবে। হিয়া আস্তে আস্তে উঠলো।তেমন বেশি ব্যাথা পায় নি সে। কিন্তু ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই এভাবেই খাট থেকে এর সে পড়েনি কখনো। লোকটার সাথে যে এক বিছানায় ঘুমিয়েছে সেটা তার মাথাতেই ছিলো না।

কি ভয়ানক একটা এক্সপিরিয়েন্স। যাক রাতটা ভালোয় ভালোয় কেটেছে। হিয়া বিছানা গুছিয়ে চট জলদি রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। এই লোকটার আসে পাশে থাকা মানেই বিপদ।

এতো ভরে এর আগে কোনোদিন উঠেনি শুভ্র। হিয়ার রুমটা খুব সাজানো। পড়ার টেবিলে হিয়ার ফ্যামেলি ফটো। হিয়ার বাবার কথা শুভ্রের মনে আছে। এই ছবিতে স্পষ্ট তাকে সে চিনতে পারছে। শুভ্রের প্রথম সাইকেল চালানো তার কাছ থেকেই শেখা। তখন নয় দশ বছরের হবে হয়তো শুভ্রের। রফিক সাহেবের সাথে সেটাই তার প্রথম আর শেষ দেখা। এমন নির্মম মৃত্যু কেনো এই লোকটার বেলাই হলো।

শুভ্রের কাছে এবার সবটা পরিষ্কার। তার বাবার না বলা কথা গুলোও আজ তার জানা হয়ে গেলো। বাবার উপর রাগটাও তার অনেকটা কমে গেলো। রফিক সাহেব যে বাবার কতো কাছের সেটা সে জানে। বাবা তাকে সবটা বললে হয়তো পুরো ব্যাপারটা এতো বাজে হতো না। হটাৎ এক বিষণ্ণতায় তার মুখে ভরে এলো। শুভ্র ছবিটা আগের জায়গায় রেখে হাঁটতে বেড়িয়ে এলো।

শুভ্র ফিরে আসতেই হিয়ার মামার সাথে দেখা। তিনি ড্রয়িং রুমে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। শুভ্রকে আসতে দেখে পত্রিকা নামিয়ে বললেন,” জগিংয়ে গিয়েছিলে নাকি?” বলেই হিয়াকে ডাকতে ডাকতে বললো,” এই হিয়া জামাইকে তোয়ালে দে।”

শুভ্র চলে যাওয়ায় হিয়া এই ফাঁকে নিজের রুমে ঢুকে ব্যাগটা গুছিয়ে নিচ্ছিলো।” জামাইকে তোয়ালে দে ” মামার মুখে কথাটা শুনেই রাগ লাগলো। এই হনুমাটাকে আবার তোয়ালে দিতে হবে কেনো? কি দরদ! একেবারে জামাই জামাই করে পাগল। সে চলে যাচ্ছে তাতে কারোর কিছু না। হিয়ার আবার ডাক পড়তেই হিয়া উচু গলায় বললো,” আসি….!” জামাই জামাই করে সবাই পাগল হয়ে গেছে।

হিয়া তোয়ালে হাতে মুখ কালো করে এগিয়ে এলো। শুভ্র সোফায় বসে ছিলো। হিয়া তোয়ালেটা এনে একেবারে শুভ্রের মুখের সামনে ধরলো। শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তোয়ালেটার দিকে তাকালো। একদম মুখের সামনে এনেই ধরতে হবে মেয়েটার। শুভ্র তোয়ালে হাতে নিতেই হিয়া মামার দিকে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে চলে গেলো।
শুভ্র তোয়ালে দিয়ে ঘাড় মুছতে মুছতে মামাকে বললো,” আচ্ছা, হিয়ার বাবার কি হয়েছিলো। আমি শুধু দুসংবাদটা জানি এর বেশি কিছু আমার জানা নেই।”

কথাটা জিজ্ঞেস করতেই হিয়ার মামার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,” কি আর বলবো? সব আল্লাহর ইচ্ছা। যতটুকু শুনেছি গভীর রাতে চালক নাকি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে সরু রাস্তায়। তারপর বাস উল্টে খাদে পড়ে যায়। তারপর না হয় নাই বা বললাম। হিয়ার বাবা আইসিইউতে ছিলেন দুই দিন।”, এতটুকু বলেই চোখ ভিজে এলো তার।তিনি চুপ করে থেকে নিজেকে সামলে বললেন,
” আকাশ আর আমার বোন ওরা তো শেষ চেষ্টাও আমাকে করতে দেয় নি। আর আমি অনেক চেষ্টা করেছি দুলাভাইকে বাঁচানোর কিন্তু পারিনি।” এতটুকু বলেই তিনি কেদে ফেললেন।

শুভ্র উঠে এসে মামাকে ধরলো। তিনি চোখের পানি মুছে বললেন,” আমি ঠিক আছি।” শুভ্র মামাকে ধরে তার পাশে বসলো।

” হিয়াকে আল্লাহ বাঁচাইয়া রাখসে কিন্তু ওর বাম পায়ে বিশাল এক ক্ষতি হয়ে গেছে। অপারেশন করাতে এখন শুধু হাঁটতে পারে। কয়মাস যে মেয়েটা বিছানায় বসে ছিল, চুপ করে শুধু কানতো। কথাও বলতো না ঠিক করে। ডাক্তার ওকে দৌড়াতে বারণ করছে। হিয়ার অপারেশনের টাকা জোগাড় করতে মেয়ের বিয়ের জন্যে জমানো সব টাকা খরচ করে ফেলায়, তোমার মামীও কম কথা শোনায় নি মেয়েটাকে। সে মহিলাও দুশ্চিন্তায় এমন করতো।”, মামার কথার মাঝেই শুভ্র মামার হাত ধরে বললো,” আপনি চিন্তা করবেন না।আপনার মেয়ের বিয়ের সব ব্যাবস্থা আমি করবো।”

” তোমার বাবাও এক কথা বলছে। তাই তোমার মামী শান্ত আছে। কিন্তু হিয়ার জন্য আমার বড়ো চিন্তা হয়। আমার মেয়ের জন্যে তো আমি আছি।ওর তো কেউ নেই।”,মাথা নিচু করে বললেন তিনি।

” আমরা সবাই আছি।”, শুভ্রের মুখে এমন কথা শুনে মামা কিছুটা স্বস্তি পেলেন। ছেলেটাকে প্রথমে সে যেমনটা ভেবেছিল ছেলেটা আসলে তেমন না।

✨ শুভ্র নাস্তার টেবিলে বসতেই মেসেজের আওয়াজ হলো তার ফোন থেকে। শুভ্র ফোনটা বের করে হাতে নিলো। প্রভার ম্যাসেজ এসেছে। শুভ্র ম্যাসেজ দেখার আগেই হটাৎ হিয়ার মামী এসে শুভ্রের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বন্ধ করে পাশে রেখে দিয়ে বললেন,
” খাবার সময় ফোন টিপা ভালো না। খাবার খাওয়া একটা সওয়াবের কাজ।”

শুভ্রের মুখটা দেখার মতন হয়েছে। মামীর এমন আচরণে সে হতভম্ভ। হিয়া পাশেই বসে ছিল। শুভ্রের চোখ মুখের অবস্থা দেখে সে ঠোঁট চেপে হাসছে। মামী যে কি জিনিস লোকটা এইবার টের পাবে। মামী খাবারের প্লেট এগিয়ে দিয়ে বললো,” তোমার নাকি ঢেঁড়স পছন্দ অনেক। তাই ঢেঁড়স করেছি, সবজিও নাকি খাও। সবজিও রান্না করেছি আমি।………….” মামী ক্রমাগত কথা বলতেই থাকলেন।

শুভ্রের রীতিমতন মাথা ধরে গেছে। আর ঢেঁড়স? এইটা কবে তার প্রিয় হলো। অদ্ভূত! চট জলদি নাস্তা করে সে উঠে পড়ল। তারপর নিজের ফোন নিতে ফিরে এসে দেখে হিয়া পুরো ঢেঁড়সের বাটিটা সামনে নিয়ে বসে আছে। আচ্ছা এই বার সে বুঝেছে ঢেঁড়স তার প্রিয় কথাটা হিয়ার মামী কেনো বলেছে। বাঁদরটা নিজের পছন্দ তার উপর চালিয়ে দিয়েছে। শুভ্র চলে যেতেই হিয়ার মামী আবার আসলো। তারপর শুভ্রকে বললো,” আমি এতো কষ্ট করলাম তুমি তো একবার খেয়েও দেখলে না।”

শুভ্র অপ্রস্তুত হয়ে হাসলো। তারপর মামী হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,” তুই পুরো বাটি নিয়ে বসেছিস কেনো? দে জামাইকে একটু খাইয়ে দে।” বলেই তিনি সামনে গেলো।

মামির কথা শুনে হিয়া চোখ বড় বড় করে তাকালো। মামির কথায় হিয়াকে লজ্জা দিতেই শুভ্র ঝুকে এসে বললো,” দেও। খেয়ে বলি কেমন হয়েছে।”
হিয়া হা করে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে রইল। মামীর হাতের ঢেঁড়স হিয়ার অনেক পছন্দ। মামী শুভ্রের প্রিয় খাবার জানতে চেয়েছিল, শুভ্রও বাসায় ছিল না। তাই হিয়ার যেটা খেতে ইচ্ছে করেছিল সে সেটা বলে দিয়েছে। এমন ভেজালে পড়তে হবে কে জানতো।

হিয়া বাটিটা শুভ্রের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,” নিজে নিয়ে খান।”

” পারবো না। আমার নামে মিথ্যে কথা ছড়িয়েছ এর ফল তো তোমাকে ভুগতেই হবে। খাইয়ে দেও।” বলেই হিয়ার মামীর দিকে ঈশারা করলো। হিয়া মুখ কালো করে শুভ্রের দিকে তাকালো। পাগল হয়ে গেছে, সবাই পাগল হয়েগেছে। লোকটাকে আবার খাইয়ে দিতে হবে। কেনো? হাত আছে কেনো? সাজিয়ে রাখার জন্যে? দূর থেকে মামী তাকিয়ে আছে।

অসহ্য লাগছে, হিয়া কথা বাড়ালো না চামচে করে এক গাল খাইয়ে দিতেই শুভ্রের চোখে চোখ পড়ল। হিয়ার বুকের ভিতরটা ধুক ধুক শুরু হয়েছে হিয়া সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালো। শুভ্র যেতে যেতে মামীকে বললো,” দারুন হয়েছে।”

হিয়ার ইচ্ছে করছে ঢেঁড়সটা লোকটার মাথায় ঢেলে দেয়। ইচ্ছে করে এমন করলো। বদমাইস ডাক্তার।

✨ হিয়া গাড়িতে উঠার সময় শুভ্রকে ড্রাইভিং সীটে দেখে হা করে রইলো। তারপর ভ্রু কুঁচকে বললো,
” ড্রাইভার কাকু কোথায়? আপনি একা এসেছেন? আমাকে আপনার সাথে একা একা সাড়া রাস্তা যেতে হবে?”

শুভ্র নিজের চশমাটা পরিষ্কার করছিলো। হিয়ার কথায় সে উত্তর দিলো না। চশমা পড়ে সামনে তাকিয়ে বললো,” কচটেপ আছে?”

উত্তর না পেয়ে হিয়া গাড়িতে উঠে বসছিলো। শুভ্রের এমন প্রশ্নে হিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,” কেনো? আপনার চশমা ভেঙে গেছে?”

শুভ্র আড় চোখে হিয়ার দিকে তাকালো তারপর বললো,” যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটা বলো।”

হিয়া রেগে বললো,” আরে আমার কাছে কচটেপ আসবে কোথা থেকে? আমি কি স্টেশনারি দোকান ব্যাগে নিয়ে ঘুরি?”

” এক কাজ করো। তোমার রুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে কচটেপ নিয়ে নিজের মুখে লাগিয়ে তারপর আসো।”, গম্ভীর মুখে বললো শুভ্র।

হিয়া রেগে গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার জন্যে সিট বেল্ট খুলতে নিতেই শুভ্র গাড়ী স্টার্ট দিলো। হিয়া কড়া গলায় বললো,” গাড়ি থামান। আমি আপনার সাথে যাবো না, আমি একা একা ট্রেনে করে যেতে পারবো।”,হিয়ার কথার মাঝেই শুভ্র ইয়ারপড কানে দিয়ে এক দৃষ্টিতে সামনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। হিয়া মুখ গোমড়া করে বসে বসে শুভ্রকে মনে মনে বকা দিতে লাগলো।

[ #চলবে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here