নীলচে তারার আলো পর্ব -১১+১২

#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_১১

সোফায় বসে বসে স্পোর্টস চ্যানেলে ফুলটব খেলা দেখছে। শান্ত ভঙ্গিতে সে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। খেলা দেখার সময়েও তার মধ্যে কোনো উত্তেজনা নেই। খালি প্রতিপক্ষ দল গোল করলে সে ভ্রু কুঁচকে ফেলছে। আরাব শুভ্রের একপাশে এসে বসলো। আরাবকে দেখে শুভ্র বললো,” কেমন আছেন?”

” ভালো থাকি কিভাবে? না জানিয়ে তো বিয়ে করে ফেললে। একটা মাত্র দুলাভাই জানাবার প্রয়োজন বোধ করলে না “, আফসোস করে বললো আরাব। সেই মুহুর্তে রবীউল সাহেব পাশের আরেকটা সোফায় এসে বসলো। শুভ্র তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো,” নিজের বিয়ে নিজেই জানলাম না আপনাকে কি করে জানাতাম?”

ছেলের কথা রবীউল সাহেব গায়ে না মেখে বললেন,” তোমার বাবা মাকে রাজি করিয়ে ঢাকায় এনে রাখলেই পারো। দেশে একা একা, বয়স হয়েছে এখন। এইভাবে একা থাকা ঠিক না।”

” সে অনেক চেষ্টা করেছি ওনারা আসতে চান না। বাবা ঘাট বাজার ঘুরে বেড়ায় মা গ্রামের মহিলাদের সাথে গল্প করে এতেই ওনারা খুশি। শহরের বন্ধি জিবন তাদের ভালোলাগে না। তবে এবার আমি যাবো ভাবছি, মোহনাকে নিয়ে কিছুদিন থেকে আসবো।”, হাসি মুখে বললো আরাব বলেই শুভ্রের দিকে তাকালো তারপর বললো,” তুমিও চলো আমাদের সাথে। খুলনা শহরটা অনেক সুন্দর। ভালো লাগবে তোমার।”

শুভ্র হালকা হাসার চেষ্টা করলো। এর মাঝে আরাবের চোখ পড়লো শুভ্রের হাতের ব্যান্ডেজের দিকে। তারপর বললো,”একি তোমার হাতে কি হয়েছে?”

“বাঁদর”, বলেই শুভ্র থামলো হিয়াকে সিড়ি বেয়ে নীচে নামতে দেখে বললো,” বাঁদর না, বিড়াল। জঙ্গলী বিড়াল কামড়েছে।”

” কি বলছো? ঢাকা শহরে জঙ্গলী বিড়াল?”,অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো আরাব।

“হুম, পাহাড়ি এলাকায় ঘুরিয়ে এনেছে তো তাই জঙ্গলী হয়ে ফিরেছে।”, বলতে বলতে হিয়ার দিকে তাকালো শুভ্র। পাশ দিয়েই যাচ্ছিল সে, শেষের কথাটা কানে আসতেই রাগী চোখে শুভ্রের দিকে তাকালো। আরাব হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,” কি বলছো?কার বিড়াল?”

” এইযে পাশেরই। আপনি চিনবেন না।”, বলতে বলতে উঠে পড়লো শুভ্র।

মোহনা নিজের ব্যাগটা নিয়ে নিচে নামতেই হিয়া গিয়ে মোহনার কাধে মাথা ফেলে বললো,” তুমি আবার কবে আসবা?”

” যখন ইচ্ছে হবে চলে আসবো।”মোহনা হিয়ার মাথায় হাত বুলাতে গিয়ে দেখলো চুল ভেজা। মোহনা ভ্রু কুঁচকে বললো,” কয়বার গোসল করা লাগে দিনে?”

” ইচ্ছে করে করিনি। ওই ডাক্তার মশাই আমার মাথায় পানি ঢেলে দিয়েছিল।”,মোহনা রীতিমত অবাক হয়ে বললো,” শুভ্র…?”

হিয়া হা সূচক মাথা নাড়লো। শুভ্র ডাইনিং টেবিলে এসে গ্লাসে পানি ঢালছে।মোহনা শুভ্রের হাতের দিকে তাকিয়ে হিয়াকে প্রশ্ন করলো,” ওটা নিশ্চই তোমার কাজ।” হিয়া এদিক ওদিক তাকিয়ে হা সূচক মাথা নাড়লো।

” ছিঃ নিজের বরকে কেউ এইভাবে কামড়ায়? তাও আবার হাতে। নেক্সট টাইম থেকে গলায় কামড় বসাবে। তখন কোনো সমস্যা হবে না, তখন কেউ জিজ্ঞেস করবে না কে কামড়েছে। এখন মা যদি জানে তুমি তার ছেলের হাতের এই দশার কারণ তাহলে তো হয়েছে।এক ঘণ্টার একটা লেকচার শোনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করো।”, মোহনার কথায় হিয়া ভয়ে ভয়ে নিজের শাশুড়ির দিকে তাকালো। গম্ভীর মুখে এক ঘন্টা যদি এই মহিলা তাকে লেকচার দেয় তাহলে সে বেচে থাকবে কিনা কে জানে?

______________

শুভ্র আজ নিজে ড্রাইভিং করছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হলে সে এমনটা করে। আজ শুভ্রের কাজ আছে, আজ প্রভাটাও ভার্সিটিতে আসেনি। পাহাড়ে থেকে এসে ফ্লু বাধিয়েছে এক সপ্তাহ হলো। খুব শখ হয়েছিলো না পাহাড় দেখবে। শখ মিটেছে আশা করি।

হিয়া ভয়ে জড়সড় হয়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। ছেলেগুলো আজ আবার পিছু নিয়েছে। তিনটা ছেলে পিছনে প্রচুর হইচই করছে। অপ্রীতিকর কিছু বাক্য ছুঁড়ে মারছে। হিয়া ঝড়ের বেগে হাটছে। দুপুরে এই সময়টায় রাস্তায় মানুষ জন কম থাকে তাই এরা এতো সাহস পায়। হিয়া ঠিক করেছে সামনে লোকজন বেশি দেখলে তাদের ডেকে এদের গণপিটুনি খাইয়ে তবে ছাড়বে। হিয়া যাচ্ছিল হটাৎ বাড়ির গাড়িটা দেখতে পেলো। গাড়িটা হিয়ার চেনা তাহলে কি ড্রাইভার কাকু আছে ভিতরে? থাকলে তো ভালো এনাকে দিয়ে আজ এদের শায়েস্তা করা যাবে। এমন বিশাল গাড়ী দেখে ছেলেগুলো একপাশে চুপটি করে গল্প করার ভান করে দাঁড়িয়ে আছে।

হিয়া দৌড়ে এসে গাড়ির সামনে দাড়িয়ে পড়লো। শুভ্র সজোরে ব্রেক কসলো। এই মেয়ে কি পাগল? এভাবে চলন্ত গাড়ীর সামনে এসে দাড়িয়েছে! হিয়া গাড়ির জানালার সামনে এসে কাচে নক করতেই শুভ্র গ্লাসটা নিচে নামলো।

শুভ্র ড্রাইভ করছে। হিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। এই লোকটা ড্রাইভিং সীটে কি করছে? শুভ্র চোখের চশমাটা ঠিক করে বললো,” কোনো সেন্স নেই তোমার? রাস্তা ঘাটে এমন লাফালাফি করছো কেনো? আর ড্রাইভার কোথায়? তোমাকে নিতে আসেনি?”

হিয়া সব প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে বললো,” আপনি মারপিট করতে পারেন? একসাথে তিন জনকে পেটাতে হবে, পারবেন? থ্রি ভার্সেস ওয়ান।”

শুভ্র বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে বললো,” মানে?”

” মানে বুঝেন না? রাম ধোলাই দিতে জানেন? কয়েটাকে রাম ধোলাই দিতে হবে।”,বলেই কটমটিয়ে ছেলে গুলোর দিকে তাকালো।

শুভ্র গাড়ির ইঞ্জিন স্টপ করে দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো। তারপর হিয়ার সামনে এসে দাড়িয়ে বললো,”কি বলতে চাও স্পষ্ট করে বলো।”

” আর কত স্পষ্ট করে বলবো? ডাক্তারির ভাষায় বলতে হবে নাকি? যে এমন ভাবে মারবেন যেনো উল্লেখিত সকল স্থানে এতটি সেলাইয়ের প্রয়োজন হয়। সার্বিক কোনো ক্ষতি আমি চাই না সামান্য কিছু ভয় দেখলেই চলবে।” বলেই ছেলেগুলোর দিকে হাত দিয়ে ঈশারা করতেই ছেলেগুলো দৌড়ে পালিয়ে গেলো।

শুভ্র তাকাতেই দেখলো তিনটা ছেলে দৌড়ে পালাচ্ছে। শুভ্র হিয়ার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললো,” আমাকে লাগবে কেনো? তুমি নিজে কি কম? কাছে আসলেই একটা কামড় বসিয়ে দিবে। তুমি তো কম এক্সপার্ট না এইসবে।”

হিয়ার নিজেকেই চড়াতে ইচ্ছে করছে এই লোকের কাছে সাহায্য চাওয়া ভুল হয়েছে। হিয়া রেগে গিয়ে বললো,” ভুল হয়েগেছে। মাফ করে দিন।” বলেই হিয়া হাঁটা শুরু করতেই, শুভ্র শক্ত করে হিয়ার ব্যাগটা ধরে থামিয়ে বললো,” গাড়িতে বসো।”

হিয়া আড় চোখে তাকিয়ে বললো,”কেনো?”

” আমি বসতে বলেছি তাই।”,

” আমি আপনার কথা কেনো শুনবো?”, কথার পিঠে কথা বললো হিয়া। শুভ্র রেগে গিয়ে হিয়ার ব্যাগ ধরে টেনে এনে গাড়ীর দরজা খুলে গাড়িতে বসিয়ে সিট বেল্ট পরিয়ে দিতে দিতে বললো,”বড্ড বেশী কথা বলা শিখেছো তুমি।”

” আমি আপনার সাথে যাবো না।”,বলে শেষ না করতেই শুভ্র ধমকের সুরে বললো,” চুপ চাপ বসে থাকো।” সেই ধমকের উপর কথা বলার সাহস নেই হিয়ার। হিয়া গাল ফুলিয়ে বসে আছে।

শুভ্র একটা বিশাল শোরুমের সামনে গাড়ি থামলো। হিয়াকে গাড়িতে লক করে সে বেড়িয়ে এসে নিজের কাজটা সেরে নিল। শুভ্র ফিরে এসে গাড়ির দরজা খুলতেই হাই ভলিউমে মিউজিক তার কানে ভেসে এলো। শুভ্র শক্ত চোখে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।সে চোখ বন্ধ করে মনের আনন্দে মিউজিকের সাথে সাথে দুলছে। শুভ্র ড্রাইভিং সীটে বসার সাথে সাথেই মিউজিকটা অফ করে দিলো। মিউজিক বন্ধ হতেই হিয়ার বুঝতে বাকি রইলো না যে হনুমানটা চলে এসেছে। হিয়া চোখ খুলে বিরক্তি নিয়ে শুভ্রের দিকে তাকালো। এইতো আসতে না আসতেই শুরু করে দিয়েছে। শুভ্র গাড়ি স্টার্ট দিলো কিছুদূর যেতেই বিশাল ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়লো। অনেক্ষন হয়ে গেলো তবুও জ্যাম ছাড়ার নাম নেই।

শুভ্র সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। গাড়ির জানালায় একটি মেয়ে হাত দিয়ে আওয়াজ করতেই শুভ্র চোখ খুলে তাকালো। শুভ্র জানালা খুলে দেখল একটা ছোট্ট মেয়ে গোলাপ বিক্রি করছে। হাতে পাঁচটা গোলাপের ছোট্ট একটা গুচ্ছ। গোলাপ কিনবে কিনা জানতেই গাড়ির জানালায় নক করেছে সে। শুভ্রের মায়া হলো, এই কড়া রোদে ছোট্ট মেয়েটা ফুল হাতে ঘুরছে। মেয়েটা একগাল হাসি দিয়ে বললো,” ভাইয়া আপুর জন্য ফুল নিবেন? শেষ গুচ্ছ।” বলেই হিয়ার দিকে ঈশারা করলো মেয়েটা। শুভ্র হিয়ার দিকে ফিরলো, হিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে ঘাড় কাত করে।

শুভ্র পিচ্ছি মেয়েটার দিকে পাঁচশো টাকার নোট বের করে দিয়ে বললো,” ফুল লাগবে না। এইটা রাখো, আর রোদে রোদে ঘুরবে না।”

মেয়েটা টাকাটা নিয়ে বললো,” তাইলে ফুলগুলা কি করুম? এইগুলা নষ্ট হইয়া যাইবো।” বলেই জানালা দিয়ে গোলাপের গুচ্ছটা দিয়ে বললো,” রাইখ্যা দেন। আপু খুশি হইবো।” বলেই মেয়েটা নাচতে নাচতে চলে গেলে।

শুভ্র কোমল দৃষ্টিতে ফুলের দিকে তাকালো। তারপর আস্তে করে হিয়ার কোলে গোলাপ গুচ্ছোটা রেখে দিলো। তার পাঁচ দশেক মিনিট পরেই জ্যাম ছাড়লো। গাড়ি স্টার্ট দিতেই হিয়ার ঘুম ভেঙে গেলো। আস্তে আস্তে চোখে খুলে তাকাতেই তার মনে পড়লো সে এখন গাড়িতে আছে। মাথা ঠিক করে বসতেই কোলের কাছে গোলাপ দেখে সত্যি অনেক খুশি হয়ে গেলো। হিয়া অবাক হয়ে বললো,” গোলাপ গুলো কোথা থেকে এলো?” বলেই শুভ্রের দিকে তাকালো।শুভ্রের দৃষ্টি সামনে স্থির অন্য দিকে তাকাচ্ছে না।

হিয়া আবার বললো,” এগুলো কি আপনি কিনেছেন?”

শুভ্র দৃষ্টি সামনে রেখে বললো,” নাহ্ একটা বাচ্চা মেয়ে দিয়ে গেছে।”

হিয়া ফুলগুলো হাতে নিয়ে অবাক হয়ে বললো,”এমনি এমনি দিয়ে গেলো? আপনি বাচ্চাটাকে চিনেন? আপনার কেউ হয়?”

শুভ্র গম্ভীর গলায় বললো,” রাখতে ইচ্ছে না ফেলে দেও। এতো প্রশ্ন করছো কেনো? দেখছোনা ড্রাইভ করছি।”

হিয়া মুখ বাকালো, মানুষ তো না যেনো গরম তেলের কড়াই একটা পানির বিন্দু পড়তেই একে বারে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। হিয়া সারা রাস্তা আর কোনো কথা বললো না। ফুলগুলো পেয়েই সে খুশি।

বাড়িতে ফিরে হিয়া আরো খুশি হয়ে গেলো। ছোট মামা এসেছে। হিয়া খুশিতে আত্মহারা, বাড়িতে এসেই ছুটে মামাকে জড়িয়ে ধরলো। হিয়া মামা সকালে এসেছেন, হিয়াকে কিছুদিন নিজের কাছে রাখতে চান। যদিও তিনি হিয়া আর শুভ্র দুজনকেই সঙ্গে করে নিয়ে যেতে এসেছেন কিন্তু রবীউল সাহেব শুভ্রের যাওয়ার ব্যাপারে না করে বললেন,” শুভ্র যেতে পারবে না। তুমি বরং হিয়াকে কিছুদিন নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখো। শুভ্রের অনেক ব্যস্ততা।” কারণ রবীউল সাহেবের ধারণা শুভ্র গেলে অবশ্যই সে কোনো সমস্যা করবে। এতে হিয়ার মামার চিন্তা বাড়বে। লোকটাকে চিন্তায় ফেলতে চান না তিনি।

শুভ্র বাড়িতে এসে একটু চমকালো। হিয়ার মামার সাথে এটা তার দ্বিতীয় সাক্ষাৎ। প্রথমবারের সে ঠিক করে কথাও বলে নি লোকটার সাথে। তাই এবার নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে কথা বললো। এতে হিয়ার মামার মনের যে ক্ষীণ ভয় ছিল তা দূর হলো। বিয়ের পর শুভ্র এমনভাবে চলে আসাটা মানতে পারেন নি তিনি। কিন্তু শুভ্রের কথাবার্তা তার আগের চেয়ে অনেক বেশী ভালো লাগছে আজ। কথাবার্তা শেষে শুভ্র নিজের রূমে এসে ফ্রেশ হয়ে বের হতে গিয়ে দেখলো হিয়া ব্যাগ নিয়ে নিজের রুম থেকে বের হচ্ছে। আজ রাতে ট্রেনেই সে ময়মনসিং যাবে।

হিয়ার সাইড ব্যাগে বিকেলের সেই একগুচ্ছ গোলাপ বের হয়ে আছে। শুভ্র তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বের হয়ে এলো। হটাৎ ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছে মেয়েটা?
#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_১২

হিয়া বাড়ি ফিরে যেনো মামীর এক নতুন রুম দেখলো। মামী তাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো। মামী মুখে কড়া কথা বললেও মনটা তার নরম সেটা আজ বুঝলো সে। মামী তাকে কখনো এভাবে জড়িয়ে ধরবে হিয়া কল্পনায়ও ভাবতে পারেনি। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়ার পর মামী হিয়াকে টেনে অন্য রুমে নিয়ে বসলো তারপর বললো,” দেখ সত্যি করে আমাকে বলবি তোর বরটা কেমন? মারধর করে তোকে?”

হিয়া চোখ বড় বড় করে তাকালো। মামী আরো বললো,” আমি যতই খারাপ হই না কেনো। হুট করে তোর এমন বিয়েতে আমি রাজি হই নি। বিয়ে তো আর ছেলে খেলা না। যে ছেলে বিয়ে করেই উধাও সে আর কত ভালো হবে। মারধর করলে আমাকে বল আমি থানায় যাবো। তোর মামাকেও নিয়ে যাবো সঙ্গে। তুই একদম ভয় পাবি না।”

হিয়ার বিস্ময়ের সীমা রইল না। আসলেই যারা মুখে কঠিন তাদের মনটা সবসময় নরম থাকে। মহিলাটা সত্যি তার জন্যে চিন্তা করে। হিয়া হাসি মুখে বললো,” না না এইরকম কিছুই না। উনি তো অনেক ভালো। এতো ভালো যে উনার প্রশংসায় আমি বাক্য খুঁজে পাচ্ছি না।” হিয়া মনে মনে বললো, আসলে তো বদের হাড্ডি।

হিয়াকে দেখে সবচেয়ে খুশি হয়েছে রূপা। রুপা ক্লাস নাইনে পড়ে। হিয়াকে সে চোখে হারায়। রাতে রূপা হিয়ার সাথেই ঘুমাবে বলে বালিশ নিয়ে হিয়ার রূমে চলে এলো। দুজনে পাশাপাশি শুয়ে আছে রূপা আগ্রহ নিয়ে বললো,” আপু তোর বরটা কি রোমান্টিক?”

হিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ঐটা বেটা রোমান্টিক কিনা আমি কিভাবে জানবো। যবে থেকে এসেছি সবাই খালি বর করছে। আমাকে নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যাথা নেই। বর বর করে মাথা খাচ্ছে।

হিয়া হালকা লজ্জা পাওয়ার চেষ্টা করে বললো,” হুম অনেক।” সঙ্গে সঙ্গে অন্য দিকে তাকিয়ে মুখ বাকালো। রুপা হিয়াকে টানতে টানতে বললো,” আপু কিছু গল্প শুনা না। আচ্ছা তোর ব্যাগের ওই গোলাপগুলো কি জিজু দিয়েছে?”

হিয়া হা সূচক মাথা নাড়লো তারপর চোখ খুলে টেবিলের গোলাপগুলোর দিকে একবার তাকালো। হালকা নীল আলোয় গোলাপের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। রুপা ফিসফিসিয়ে বললো,” আচ্ছা আপু তোদের ফার্স্ট কিস কবে হয়েছে? কিস করলে কেমন লাগে?”

রূপার প্রশ্ন শুনে হিয়া সঙ্গে সঙ্গে নিজের কানে হাত দিয়ে কান বন্ধ করলো। মুহুর্তে হার্ট বিট বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে তার। হিয়া ধমক দিয়ে বললো,”এই তুই চুপ কর।”

” এমন করছিস কেনো? বলনা।”,বলেই হিয়ার দিকে তাকালো। হিয়া কটমট করে তাকিয়ে আছে রূপার দিকে। রুপা থেমে বললো,” আচ্ছা তুই ঘুমা। কালকে বলিস আমাকে।”

রূপার কথায় যেনো হিয়ার মাথা ঘুরছে। ইস ওই লোকটার সাথে ছি ছি। এইসব ভাবতেই বুক কেপে উঠছে।

✨ হটাৎ আজ ডাইনিং টেবিলে শুভ্রকে দেখে সাহারা খাতুন খুশী হলেন। কিন্তু আবার মনে হলো এতদিন কি হিয়া বাসায় ছিল দেখে তার ছেলে সবার সাথে খেতে আসেনি। মেয়েটাকে এতো অপছন্দ তার ছেলের? রবীউল সাহেব আরো রেগে আছেন। তার ছেলের এই ব্যাবহারের কারণে মেয়েটা প্রতিদিন একা একা হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরে। আর মেয়েটা যেই চলে গেলে নবাব সাহেব ডাইনিংয়ে খেতে এসেছে।

শুভ্র চুপচাপ এসে তার বাবার বরাবর সামনের চেয়ারটায় বসলো। বাড়িটা নিঝুম দ্বীপের মতন লাগছে। তার বাবা তো কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে তার সাথে। সাহারা খাতুন খাবার বেড়ে দিয়ে নিজের প্লেট নিয়ে পাশে বসতে বসতে রবীউল সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন,” মেয়েটা কবে ফিরবে কিছু বলেছে?”

শুভ্র চামচ হাতে তুলে নিয়ে একবার তার বাবার দিকে তাকালো। রবীউল সাহেব না বোঝার ভান করে বললো,”কে মোহনা? সবে এক সাপ্তাহ হয়েছে মেয়েটা গেছে, জামাইও আছে। থাকুক, মনে পড়লে ওরাই আসবে।”

শুভ্র ভ্রু কুঁচকে নিজের বাবার দিকে তাকালো। লোকটা বুঝেও না বোঝার ভান করছে। সাহারা খাতুন গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বললো,” আমি মোহনার কথা জিজ্ঞেস করছি না। হিয়া কবে ফিরবে?”

“পরীক্ষার আগে চলে আসবে!”, রবীউল সাহেবের কথায় শুভ্র ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে বসলো ,” পরীক্ষা কবে?”

রবীউল সাহেব আর সাহারা খাতুন দুজনেই অবাক হয়ে তাকালো। তাদের এভাবে তাকিয়ে থাকায় শুভ্র অপ্রস্তুত হয়ে বললো,” অ্যাম জাস্ট আস্কিং। এভাবে তাকানোর কিছু হয়নি।”

রবীউল সাহেব বেঙ্গাতক সুরে বললেন,” হুম্ সেটাই তোমার তো আবার উপর তলায় শিফট হতে হবে। সমস্যা নেই দুই সাপ্তাহ তুমি শান্তিতে থাকতে পারবে।”
বাবার কথায় শুভ্রর রাগ লাগছে। শান্তিতে থাকবো মানে? আড় দু সাপ্তাহ মানে কি? দু সপ্তাহ থাকবে মেয়েটা? থাকুক।

” তুমি তো একবার আমার সাথে কোথা বললে না। এতদিন থাকার অনুমতি দিয়ে দিয়েছো।”, সাহারা খাতুন কঠিন গলায় বললেন।

” কেনো ভালো করিনি? তোমাদের মা ছেলের তো সুবিধাই হয়েছে। কয়েকদিন আরামে থাকবে ,তাই মানা করিনি।”, রবীউল সাহেবের কথায় সাহারা খাতুন রেগে বললো,” তুমি সামনের সোমবারে গিয়ে ওকে নিয়ে আসবে। সামনে যেহেতু পরীক্ষা পড়াশোনাও করা লাগবে। এতদিন মামার বাড়ি থাকতে হবে না।”

শুভ্র খাবার মুখে দিতে দিতে নিজের বাবার দিকে তাকালো তিনি শান্ত গলায় বলল,” আমার কাজ আছে,তোমাদের এতো প্রয়োজন হলে তোমরা গিয়ে নিয়ে এসো।”

শুভ্র কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে খাবার শেষ না করেই উঠে পড়লো। সাহারা খাতুন চিন্তিত গলায় বললেন,” কি ব্যাপার খাওয়া ছেড়ে উঠলি কেনো?”

” আমার হয়ে গেছে।”,বলেই নিজের রুমে চলে গেল। শুভ্রের কেনো জানি প্রচন্ড বিরক্তি লাগছে। শুভ্র রূমে এসেই বিছানায় গা হেলিয়ে দিয়ে শুয়ে মাথার নীচে দুই হাত রাখলো। হটাৎ সবকিছুতে এতো বিরক্তির কারণ শুভ্র সে খুঁজে পাচ্ছে না। মেয়েটা চলে গেছে এই কয়েকদিন মেয়েটাকে দেখতে হবে না আরো খুশি হবার কথা শুভ্রের।
তার সব কিছুতে এই বিরক্তির কারণ কি এই মেয়েটা? হোয়াট নন্সসেস! সে এইসব কি চিন্তা করছে। মেয়েটা গিয়েছে ভালো হয়েছে।

✨ হিয়া ডানা ঝাপটানো পাখির মতন ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে ফোনে দিবার সাথে কথা হচ্ছে। দিবার সবচেয়ে কাছের বন্ধু এখন হিয়া। হিয়া নেই বলে সে কলেজেও যাচ্ছে না।

আজ হিয়া শাড়ী পরেছে। শাড়ী পড়তে সে একদমই পারে না। রুপা তাকে পড়িয়ে দিয়েছে। নীল রঙের একটা শাড়ি। হটাৎ শাড়ী পড়ার পিছনেও একটা কারণ আছে। আজ মামা তাদের বই উৎসবে নিয়ে যাবে। তাদের মহল্লায় এইটা প্রায় হয়। সেই উপলক্ষে হিয়া আর রুপা শাড়ি পরেছে। বিলের ধারে ফাঁকা মাঠে, এক সারিতে সবাই বই নিয়ে বসে আর বিলের চারিপাশ অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো হয়। বই না কিনলেও সেই সুন্দর দৃশ্য দেখতে রাতে সবাই ভির জমায়।

হিয়াদের ফিরে আসতে আসতে রাত হলো। হিয়ার অনেক মজা লাগছে, মামীও বকা বকি করে না। আহ্ আর ঢাকা না ফিরে গেলেই ভালো হতো। ঐ পাজি লোকটার ধমক খাওয়া লাগতো না। যদিও আংকেল,মোহনা আর দিবার জন্যে খারাপ লাগবে আর শাশুড়িটার জন্যেও খারাপ লাগবে। খালি হনুমানটার জন্যে লাগবে না।

বাড়ী ফেরার পথে প্রচুর বৃষ্টি শুরু হলো। গেটের সামনে এসে দেখলো বাড়ির মেইন দরজা খোলা আর সারা বাড়ি অন্ধকার,দেখে প্রথমে সবাই একটু ঘাবড়ে গেলো। ঘরে এসে মামী মামী বলে ডাকতেই রান্নাঘর থেকে তিনি আওয়াজ দিয়ে রুপাকে ডাকলেন।

” এই হিয়া, রুপাকে রান্নাঘরে আসতে বলতো।”,

এইদিকে রূপা অনেকটা ভিজে গেছে। সে মুখ কালো করে বললো,” শাড়িটা বদলে আসি, মা।”

রান্নাঘর থেকে আবার আওয়াজ এলো,” নাহ্ এক্ষুনি আয়, আর হিয়াকে নিজের রূমে যেতে বল।”

হিয়া আর রূপা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। রুপাকে রান্নাঘরে কেনো ডাকছে আর হিয়াকে রুমেই বা কেনো যেতে বলছে। এর মাঝেই রূপার আবার ডাক পড়লো,” কিরে এতো সময় লাগে কেনো আসতে। উড়ো জাহাজে উঠেছিস নাকি?”

রুপা দৌড়ে রান্নাঘরে গেলো এক্ষুনি না গেলে মহিলাটা বেলুন খুন্তি হাতের কাছে যা পাবে তাই দিয়েই উত্তম মাধ্যম লাগাবে।

হিয়া আর কিছু না ভেবে তড়িঘড়ি করে নিজের রুমে এলো, কারণ হিয়ার কেনো জানি মনে হচ্ছে শাড়িটা এক্ষুনি খুলে যাবে। রূমে এসেই সে দরজা বন্ধ করে দিলো। ঘরে দুটো মোমবাতি জ্বালানো আছে। হিয়া শাড়ির আঁচলটা কাঁধ থেকে সরিয়ে নিচে ফেলে পিছনে ঘুরতেই দেখলো শুভ্র ভ্রু কুঁচকে বুকের কাছে দু হাত ভাজ করে দাড়িয়ে আছে। হিয়া হকচকিয়ে উঠলো, মারাত্মক ভয় পেয়েছে সে। চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু গলা দিয়ে তার এক বিন্দু আওয়াজ বের হচ্ছে না। হিয়া দু পা পিছিয়ে এসে দুকাধে হাত দিয়ে নিজেকে ঢেকে ফেললো। হিয়া স্তম্ভিত হয়ে দাড়িয়ে আছে। হার্ট বিট অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে তার। শুভ্র কি করে তার ঘরে আসবে? তাহলে সামনে কে? নাকি কি সে ভুল দেখছে কিংবা হেলোসিনেট করছে।

[ #চলবে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here