নীলচে তারার আলো পর্ব -১৫+১৬

#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_১৫

বাড়িতে ফিরে আরেক কান্ড, শুভ্রের ফুফু এসেছেন। রবীউল সাহেবের একমাত্র বড় বোন। রবীউল সাহেব যতটা শান্ত এই মহিলা অতটাই অশান্ত। ভাইয়ের বাড়িতে এসেই হুলোসস্তর শুরু করে দেয় সে। গাড়ী বাড়ির সামনে থামতেই হিয়া নিজের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো। শুভ্রের দিকে তাকালো পর্যন্ত না। লোকটা তাকে অনেক কিছু বলছে, এনার সাথে সে আর কথাই বলবে না।

বাড়িতে ঢুকেই প্রথমে শুভ্রের ফুফুর মুখোমুখি হলো হিয়া। শুভ্রের ফুফুকে সে এর আগে দেখেনি। খুব সাস্থ্যবান মহিলা। গালের দুপাশে বয়সের ছাপ পড়লেও মাথা ভর্তি কালো কেশ। গায়ের রং শ্যামলা।

পাশে সাহারা খাতুন কড়াইয়ে তেল দিচ্ছিল। হিয়াকে দেখে শুভ্রের ফুফু রাবেয়া আক্তার বললেন,” সাহারা.. কে এই মেয়ে।” মহিলার কণ্ঠ এমন যা শত আওয়াজের মাঝেও আপনার কানে বাজবে। হিয়া থমকে দাড়ালো। তারপর সৌজন্যের জন্যে হালকা হেসে তাকালো। সাহারা খাতুন হিয়ার দিকে তাকালো তারপর বললো,” ও আপনার ভাইয়ের বন্ধুর মেয়ে।”

মহিলাটা আর কিছু বলতে চাইলো কিন্তু তার আগে সাহারা খাতুন হিয়াকে বললেন,” জার্নি করে এসেছো। যাও রূমে গিয়ে রেস্ট নেও।” হিয়া চুপচাপ সিড়ি বেয়ে উপরে নিজের রূমে চলে গেলো।

হিয়া চলে যেতেই রাবেয়া আক্তার বললেন,” মেয়েটা সুন্দর। বড় বড় চোখ। কি সুন্দর ব্যাবহার! আমার পছন্দ হয়েছে।”

রাবেয়া আক্তারের মুখে এমন কথা শুনে পরক্ষনেই সাহারা খাতুনের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।


ক্লাস শেষে ড্রাইভারকে গাড়ি নিয়ে ভার্সিটির সামনে দেখে শুভ্র এগিয়ে আসলো। শুভ্রের পিছু পিছু প্রভাও এলো। শুভ্র ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো,” কি ব্যাপার তুমি এইখানে কি করছো? তোমাকে আমি কি বলেছিলাম?”

ড্রাইভার মলিন গলায় বললো,” গিয়েছিলাম কলেজের সামনে। আপামনি আসে নাই।”

হিয়ার এমন আচরণে শুভ্রের রাগ হচ্ছে। কোনো কথা শুনে না, নিজের যা ইচ্ছে তাই করে বেড়ায়। শুভ্র ড্রাইভারকে টাকা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে ড্রাইভিং সীটে বসলো। প্রভা হকচকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,”কোথায় যাচ্ছিস তুই?”

” কলেজে।”, বলতে বলতে সিট বেল্ট পরে নিল শুভ্র।

প্রভা গাড়ীর অন্যপাশের দরজা খুলে শুভ্রের পাশের সিটে বসে পড়তেই শুভ্র অবাক হয়ে তাকাতেই প্রভা বললো,” আমিও যাবো। বাই দ্যা ওয়ে তুই এতো অস্থির হয়ে আছিস কেনো?”

শুভ্র গাড়ির স্টার্ট দিতে দিতে বললো,” অস্থির হয়ে থাকতে যাবো কেনো?”

” নাহ্ তোকে দেখে মনে হলো। কিন্তু কলেজে যাচ্ছিস কেনো?”, মনের কোনের ক্ষীণ সন্দেহ থেকে প্রশ্ন করলো প্রভা।

শুভ্র দৃষ্টি সামনে রেখে বললো,” ওইদিন রাস্তায় কিছু ছেলে নাকি হিয়ার পিছু নিয়েছিলো। তাই সেফটির জন্য গাড়ি পাঠালাম কিন্তু মহারানী তো আবার সোজা কথার মানুষ না।”

শুভ্রের মুখে এমন কথা শুনে প্রভার বুকটা ধক করে উঠলো। শুভ্রের হিয়ার জন্যে এতো অস্থির হয়ে আছে। কই তার জন্যে তো শুভ্রকে কখনো এমন অস্থির হতে দেখেনি। প্রভা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলো,” তোর কি হিয়ার জন্যে চিন্তা হচ্ছে?”

শুভ্র হা বা না কিছু বলার আগেই শুভ্র জোরে ব্রেক কষলো। তারপর গাড়ী থেকে নেমে গেলো। প্রভা অবাক হয়ে শুভ্রের ছুটে যাওয়া দেখছে।

আজ ছেলেগুলো ফাঁকা জায়গা পেয়ে হিয়ার পথ আটকে দাড়িয়েছে। হিয়া ভয় পেলেও চোখে মুখে সে ভয়ের ছাপ প্রকাশ করেনি। তিনজনের মাঝের সুন্দর ছেলেটা এগিয়ে আসতে আসতে বললো,” কি ভেবেছো? কয়েকদিন কলেজে না আসলে আমরা ভুলে যাবো যে তুমি আমাদের দেখিয়ে দিয়েছিলে।”

হিয়া দু পা পিছালো। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গেছে।ছেলেটা আরো বললো,” এতদিন কিছু করিনি কিন্তু আজ করবো।”,বলেই পাশের ছেলেটাকে ঈশারা করতেই সে এসে হিয়ার হাতের কব্জি চেপে ধরলো।

ভয়ে হিয়া চোখ বড় বড় করে তাকালো। তারপর কড়া গলায় বললো,” আমি কে তোমরা জানো? আমার যদি কিছু হয়েছে না তোমাদের এমন হাল হবে ভাবতেও পারছো না। আমাকে ছেড়ে দেও।” আত্মরক্ষায় বানিয়ে বানিয়ে কিছু মিথ্যে কথাও বললো। তাতে কোনো লাভ হলো না। ছেলে গুলো উচু গলায় হাসতে লাগলো। তারপর হিয়ার হাত ধরে টানতে লাগতেই হিয়া ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলো। তবুও সাহস করে ছেলেটার হাতে সজোরে এক কামড় বসিয়ে দিয়ে ব্যাগ নিয়ে দৌঁড়াতে শুরু করলো। পিছনে ছেলে গুলোও ছুটছে, হিয়ার পায়ে প্রচুর ব্যাথা হচ্ছে কিন্তু এ ব্যাথা এখন তার কাছে কিছুই না।

চিপা গলি পেরিয়ে মেইন রাস্তায় আসতেই হটাৎ একটা বাসের সামনে এসে পড়লো হিয়া। হিয়া চোখ মুখ কুচকে ফেলতেই মনে হলো কে যেনো তাকে নিজের বাহুতে জড়িয়ে নিয়েছে।

শুভ্র দৌড়ে এসে হিয়াকে নিজের বুকে টেনে সরিয়ে আনলো বাসের সামনে থেকে। হিয়া শক্ত করে শুভ্ররের শার্ট চেপে ধরলো, শুভ্রের বুকে মাথা রাখতেই হিয়া শুভ্রের হৃদ কম্পন অনুভব করতে পারলো। প্রচন্ড গতিতে শুভ্রের হার্ট বিট করছে।

বাস চালক ব্রেক কষে জানালা দিয়ে মাথা বের করে কড়া গলায় বললো,” এমন রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করেন কেন? যত্তসব,পরে দুর্ঘটনা হইলে তো ড্রাইভারের দোষ।” বলেই তিনি বাস স্টার্ট দিলেন।

বাস চালকের এমন উক্তিতে হিয়ার হুস ফিরল। হিয়া শুভ্রের বুক থেকে মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো। শুভ্র চোয়াল শক্ত করে রাগে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। শুভ্র হিয়ার দুই বাহু শক্ত করে ধরে ধমক দিয়ে বললো,” তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? এভাবে কেউ রাস্তার মাঝে দৌড়ায়?”, হিয়া মাথা নিচু করে রইলো কোনো উত্তর দিলো না খালি একবার ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চিপা গলিটার দিকে তাকালো। হিয়ার এই তাকানোতেই শুভ্র সবটা বুঝে গেলো। শুভ্র সেদিকে তাকালো কিন্তু আসে পাশে কাউকে দেখলো না।

শুভ্র আরো রেগে গিয়ে বললো,” গাড়ি পাঠিয়েছিলাম না। এতো কিসের জেদ তোমার?”

এতক্ষণে প্রভা গাড়ি থেকে নেমে ছুটে এলো। প্রভাকে দেখে হিয়া শুভ্রের শার্ট ছেড়ে কিছুটা পিছিয়ে দাড়ালো। এর মাঝেই শুভ্র আবার ধমক দিয়ে বললো,” চুপ চাপ দাড়াও। এক পাও নড়বে না।”

হিয়া আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকালো। হিয়ার ভয় লাগছে। এমন রেগে আছে কেনো লোকটা? হিয়ার কেমন জানি লাগছে। মনে হচ্ছে শরীরটা কাপছে, পায়েও প্রচুর ব্যাথা হচ্ছে। দাতে দাত চিপে সে ব্যাথা সহ্য করছে হিয়া।

প্রভা এগিয়ে এসে বলল,” কি হয়েছে? হিয়া তুমি ঠিক আছো?” বলেই শুভ্রের দিকে তাকিয়ে দেখলো শুভ্রের রক্তিম চেহারা।এসব ব্যাপারে শুভ্র একটু বেশি রাগী। শুভ্র যদি হাতের কাছে ছেলেগুলোকে পেতো তাহলে প্রথমে মেরে হাড় ভেঙ্গে তারপর নিজেই ব্যান্ডেজ করে বাড়িতে পাঠাতো।

শুভ্র তো এমনই রাগী। প্রভা এগিয়ে গিয়ে হিয়ার হাত ধরে ওকে গাড়ির দিকে নিয়ে যেতেই হিয়া এক পা ফেলেই ব্যাথায় আর্তনাদ করে, আবার ঠোঁট কামড়ে ব্যাথা সহ্য করলো।

প্রভা বললো,” তুমি কি ব্যাথা পেয়েছো কোথাও? ওরা কি কিছু করেছে?” তারপর পাশেই একটা বেঞ্চ দেখতে পেয়ে হিয়াকে সেখানে বসালো। তারপর প্রভা ভালো করে দেখলো হিয়ার হাতে চাপের দাগ পরে গেছে। কেউ শক্ত করে ধরলে যা হয়।

হিয়া পায়ে হাত দিয়ে ব্যাথায় নাক মুখ কুচকে আছে। উফফ অসহ্য এই ব্যাথাটা আবার শুরু হয়েছে। শুভ্র কিছুক্ষণ হিয়ার দিকে নিশ্চুপে তাকিয়ে থেকে নিজের শার্টের হাতা ভাজ করে এগিয়ে এসে হিয়াকে কোলে তুলে নিতেই, হিয়া হকচকিয়ে উঠলো। ভরা রাস্তায় লোকটা কি করছে? হিয়া লজ্জায় মাথা নামিয়ে বললো,” নামান আমাকে, মানুষ দেখছে।”

শুভ্র হিয়ার দিকে একবার রাগী চোখে তাকাতেই হিয়া চুপ করে থেকে নিজের মুখটা শুভ্রের শার্টে লুকিয়ে ফেললো। আশেপাশের অনেকেই হা করে তাকিয়ে দেখছে, ব্যাপারটায় যেনো তারা খুব মজা পাচ্ছে।

প্রভা সেই মানুষের ভিড়ে দাড়িয়ে আছে নিশ্চুপে। হটাৎ কেমন একটা অদৃশ্য ব্যাথা তার শরীরে বয়ে যাচ্ছে। ব্যাথাটা আরো তীব্র হলো যখন শুভ্র হিয়াকে প্রভার জায়গায় বসালো। সময় যেনো সেইখানেই থমকে গেছে প্রভার। শুভ্র ড্রাইভিং সিটে বসার আগে প্রভাকে খুঁজলো কিন্তু হটাৎ প্রভা এই ভিড়ের মাঝে নেই। তাহলে কি প্রভা চলে গেছে।

শুভ্র ড্রাইভিং সিটে বসে একবার হিয়ার দিকে তাকালো। ব্যাথায় চোখ বন্ধ করে মাথা নুইয়ে আছে সে। শুভ্র গাড়ি থামতেই হিয়া চোখ খুললো। তারপর বাইরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো। এইটা তো বাসা না, ক্লিনিক। হিয়া কৌতূহল চোখে শুভ্রের দিকে তাকালো ততক্ষনে শুভ্র গাড়ি থেকে নেমে গেছে। হিয়া চুপ চাপ শুভ্রের কান্ড দেখছে। শুভ্র কিছুক্ষণ পর এসে হিয়ার পাশের দরজাটা খুললো। দরজা খুলে বের হতে গিয়ে দেখলো শুভ্র একটা হুইলচেয়ার সামনে এনে রেখেছে। হিয়া হকচকিয়ে তাকালো তারপর বললো,” এটা এনেছেন কেনো? আমি এটাতে বসবো না। আর ক্লিনিকেও যাবো না।”

শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” তুমি যাবা না তোমার ঘাড় যাবে।”

” নিয়ে যান। আমার ঘাড় নিয়ে যান কিন্তু আমার পা যাবে না।”, আসে পাশে তাকিয়ে বললো হিয়া।

শুভ্র ধমকের সুরে বললো,” সাট আপ।”
হিয়া হুইলচেয়ারে বসতে একদম পছন্দ করে না। এর আগেও তাকে বসতে হয়েছে। আর সে তো হাঁটতে পারে তাহলে কেনো হুইচেয়ারে যাবে। হিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,” ধমক দিয়ে কাজ হবে না। আমি হুইলচেয়ারে করে যাবো না, ব্যাস।”

” বসতে বলেছি। নাহলে সবার সামনে কোলে তুলে নিবো।”,বলেই শুভ্র এগিয়ে আসতেই হিয়া ফট করে হুইলচেয়ারে বসে পড়লো। এই ছেলের কোলে বসার তার কোনো শখ নেই। যে ভরা রাস্তায় কোলে নিতে পারে সে যে এইখানে নিবে না তার কি গ্যারেন্টি!
#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_১৬

” বসতে বলেছি। নাহলে সবার সামনে কোলে তুলে নিবো।”,বলেই শুভ্র এগিয়ে আসতেই হিয়া ফট করে হুইলচেয়ারে বসে পড়লো। এই ছেলের কোলে বসার তার কোনো শখ নেই। যে ভরা রাস্তায় কোলে নিতে পারে সে যে এইখানে নিবে না তার কি গ্যারেন্টি!

ক্লিনিকে নিয়ে গেছে সেটা পর্যন্ত ঠিক ছিলো হটাৎ আবার পুলিশ স্টেশনে আসার কি দরকার! ছোটো বেলা থেকেই পুলিশ দেখলে হিয়ার ভয় লাগে। শুভ্র পুলিশ স্টেশনের সামনে গাড়ি থামলো। হিয়া ক্লান্ত দৃষ্টিতে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটা কি এখন পুলিশে ডাইরি করবে? হুহ কি লাভ হবে ডাইরি করে? ডাইরির পাতা বন্ধের সাথে সাথে এই অভিযোগটাও কর্পূরের মতন উধাও হয়ে যাবে। শুভ্র গাড়ি থেকে বের হয়ে যেতেই হিয়া ঘুমের ভান ধরলো। এই লোকটা এখন যদি থানার ভিতরেও যেতে বলে? বলতেই পারে!সে থানায় পা দিবে না, জীবনেও না।

হিয়াকে সম্পূর্ন ভুল প্রমাণ করে শুভ্র একাই থানার ভিতরে গেলো। হিয়া হালকা চোখ খুলে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলো শুভ্র একাই যাচ্ছে। শুভ্র এমন ভঙ্গিতে যাচ্ছে যেনো এটা থানা নয় তার মামার বাড়ি। হিয়া গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বের করে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। এই শুভ্রনীল আহমেদ অতিরিক্ত পরিমাণে ভদ্র লোক। নিশ্চই সে মারামারি করতে জানে না, মারপিট করতে জানা থাকলে কেউ পুলিশ স্টেশনে আসে না।

হিয়ার আরো অবাক হলো যখন কিছুক্ষণ পর থানার অফিসার শুভ্রের সাথে বেড়িয়ে আসলো। অফিসারটা শুভ্রের বয়সী মনে হচ্ছে। সে অফিসার শুভ্রের গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে হিয়াকে বললো,” ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নামগুলো তো শুভ্র বলেই দিয়েছে। আমার জন্যে এখন ওদের খুঁজে পাওয়াটা সহজ হবে।”

হিয়া হা করে শুভ্রের মুখটা একবার দেখলো। নাম বলে দিয়েছে মানে? এই লোক নাম জানে কিভাবে? উনি কি ডাক্তারি ছেড়ে গোয়েন্দা হয়েছেন। হিয়া অফিসারটার দিকে তাকালো তিনি আবার বললেন,” আমি অপু শুভ্রের মামাতো ভাই।” বলেই শুভ্রের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,” কে এই মেয়ে?

শুভ্র আড় চোখে অপুর দিকে তাকালো। এই পরিচয় পর্বটা তার বিরক্তিকর লাগছে। হিয়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই শুভ্র গাড়ি স্টার্ট দিয়ে অপুর উদ্দেশ্যে বললো,” আমার তাড়া অছে আজ।”বলেই গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো। আগে হিয়ার মনে হতো শুভ্র শুধু তার সাথেই এমন করে কিন্তু না এই ডাক্তার সাহেব তো সবাইকে ওষুধের উপর রাখে। হিয়া কিছুক্ষন চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলো,” আচ্ছা আপনি ওই ছেলেগুলোর নাম জানলেন কিভাবে? ওদের তো আপনি দেখেননি পর্যন্ত।”

শুভ্র আড় চোখে হিয়ার দিকে তাকালো তারপর বললো,” সেটা তোমার জানতে হবে না।”

” হ্যা আমার কিছুই জানা লাগবে না। আপনি সব জেনে বসে থাকুন। ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে সেখানেও ডাক্তারের সাথে আপনি কথা বললেন এই থানায় এনে গাড়ীতে বসিয়ে রাখলেন। যখন আমার জানার দরকার নেই তাহলে আমাকে আনলেন কেনো?”, বলেই হাপিয়ে গেলো হিয়া। বিরক্তি লাগছে তার। হিয়া হাপিয়ে উঠে চুপ করে আছে।শুভ্র গাড়ির ড্রয়ার থেকে একটা পানির বোতল হিয়ার দিকে এগিয়ে দিল। হিয়ার রাগ হচ্ছে পনির বোতলটা নিতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু তৃষ্ণাও পেয়েছে। হিয়া ফট করে শুভ্রের হাত থেকে পনির বোতলটা নিলো। শুভ্রের গোমড়া মুখটা তার অসহ্য লাগছে। যদিও ক্লিনিকে যাবার পর তার ব্যাথাটা কমেছে। তাও পাশে কেউ এমন মুখ করে বসে থাকলে কেমন লাগবে?

হিয়া সর্ব শক্তি দিয়ে চেষ্টা করেও বোতলটা খুলতে পারলো না। বোতলটাও লোকটার মতন। হিয়া গাল ফুলিয়ে বোতলটা একপাশে রেখে দিলো। শুভ্র বিরক্তি নিয়ে বোতলটার দিকে তাকালো।তারপর সামনে গাড়িটা থামিয়ে, বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে বোতলটা হাতে নিয়ে খুললো। তারপর হিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,” নাও।”

শুভ্রের এমন শান্ত ব্যাবহার হিয়ার ঠিক হজম হচ্ছে না।হিয়া হাত বাড়িয়ে পানির বোতলটা নিলো। তারপর পানি খাওয়া শেষ করতেই শুভ্র গাড়ি স্টার্ট দিলো।

বাড়ি ফিরতে এতো দেরী হওয়ায় রবীউল সাহেব ভীষণ চিন্তায় ছিলেন। কিন্তু করিডোর দিয়ে শুভ্রের গাড়িতে হিয়াকে ফিরতে দেখে তিনি আরো বেশ অবাক হলেন। এই ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা তিনি খুঁজে পেলেন না।

শুভ্র গাড়ি থেকে নেমে যেতেই হিয়া তাড়াহুড়ো করে রীতিমত দৌড়ে শুভ্রের সামনে এসে দাড়ালো। আজকের ঘটনাতে শুভ্রের মেজাজ এমনেই বিগড়ে ছিল হিয়াকে দৌড়াতে দেখে আরো রেগে গিয়ে বলল,” আবার দৌড়াচ্ছ কেনো? ছটফট না করে থাকতে পারো না?”

হিয়া চোখ পিট পিট করে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে আছে।সে একটা কথা শুভ্রকে বলবে লোকটা মানবে কিনা কে জানে? এমনই অগ্নিকুন্ড হয়ে আছে। শুভ্র চোখ বুজে নিজের রাগ সামলে বললো,” পায়ের ব্যাথা কি কমেছে?”

হিয়া হা সূচক মাথা নাড়ল।
” আচ্ছা, তাহলে ভিতরে যাও।”,বলে চলে যেতেই হিয়া আবার এসে শুভ্রের সামনে দাড়ালো। এগুতে গিয়েও থমকে দাড়াতে হলো শুভ্রকে। শুভ্র ভ্রু কুঁচকে বললো,
” তুমি কি আবার কোনো ভাবে আমার কোলে করে ভিতরে যেতে চাইছো? লিসেন ডোন্ট টেক ইট ফর গ্র্যান্টেড।”

হিয়া হকচকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে দু পা পিছিয়ে হাত দিয়ে না না করতে করতে বললো,” আমার একটা কথা ছিল।”

শুভ্র নিজের দিকে আঙ্গুল দিয়ে বললো,” আমার সাথে? আর ইউ সিউর?”

হিয়া হা সূচক মাথা নেড়ে বললো,” হুম,আজ যা হয়েছে সেটা আপনি কাউকে বলবেন না।”

শুভ্র হিয়ার কথায় এবার প্রচুর বিরক্ত হয়ে হিয়াকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিতেই হিয়া আবারো সামনে এসে দাড়াতেই শুভ্র বললো,” দেখো, একদম আমাকে রাগিয়ে দিয়ো না। আর তোমার এইসব স্টুপিড কথা শোনার আমার ইচ্ছে নেই।”

” আপনি তো এমনেই রেগে থাকেন আরেকটু রাগলে কি হবে? হয়তো ঘূর্ণিঝড়ের বদলে সাইক্লোন আসবে, আসলে আসুক। কিন্তু প্লীজ আপনি বাসার কাউকে বলবেন না।”, কাদো কাদো চেহারা করে বললো হিয়া। তাতে কি কোনো লাভ হলো? শুভ্র আবারো পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।

শেষ এবার এই ঘটনা যে কতদূর গড়াবে তা কেউ জানে না। রবীউল সাহেব যদি কলেজ বদলে দেয়।হিয়া আস্তে আস্তে বাসায় ঢুকলো শুভ্রের পিছনে পিছনে। শুভ্র এসেই সোফায় গা হেলিয়ে দিলো। হিয়া চুপি চুপি নিজের রুমে যাওয়ার আগেই রবীউল সাহেব সামনে এসে বললো,” কিরে এতো দেরী হলো কেনো আজ?”

হিয়া হকচকিয়ে তাকালো তারপর আমতা আমতা করে বলল,” পড়ে গেছিলাম। ”

” পড়ে গিয়েছিলি মানে? বেশি ব্যাথা পেয়েছিস? কিভাবে পড়লি?”, চিন্তিত হয়ে প্রস্ন করলো রবীউল সাহেব।

এবার সে কী বলবে? হিয়া এদিক সেদিক তাকিয়ে বলল,” বে…..বেশি ব্যাথা পাই নি।”

” কিন্তু পড়লি কিভাবে?”, আবারো প্রশ্ন করলেন তিনি। হিয়া আমতা আমতা করে বলল,” হোচট খেয়ে পড়ে গেছি।”

” দেখে শুনে হাটবি না?”,বকা দিয়ে বললেন রবীউল সাহেব। তারপর আস্তে আস্তে বললেন,” শুভ্রের গাড়িতে করে এলি কি করে?”

উফফ মিথ্যে জিনিটাই ভেজাল একটা বলে থামা যায় না একটার পর একটা বলতে থাকতে হয়। হিয়া আড় চোখে একবার শুভ্রের দিকে তাকালো শুভ্র চোখ বন্ধ করে আছে। তারপর হিয়া কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,” আমি লিফট চাইলাম। পড়ে গেছিলাম যে তাই। প্রথমে দিতে চায় নি,পড়ে আপনার কথা বলতেই রাজি হয়। আর রাস্তায় এতো জ্যাম ছিলো প্রায় দুইঘন্টা জ্যামে বসে ছিলাম।”

রবীউল সাহেব আড় চোখে একবার ছেলের দিকে তাকালেন। তারপর হিয়াকে বললো,” আচ্ছা গিয়ে তাহলে ফ্রেশ হয়ে নে।”

রবীউল সাহেব চলে যাচ্ছিল হিয়া আশে পাশে তাকিয়ে বললো,” সবাই কোথায়?”, বাড়িতে এলেই শুভ্রের ফুফুর আওয়াজ তো কানে আসারই কথা। কিন্তু বাড়িটা একদম ঠান্ডা হয়ে আছে। রবীউল সাহেব যেতে যেতে বললো,” ওরা কোথায় যেনো গেছে সেই সকালে। মোহনাকেও সঙ্গে নিয়ে গেছে।”

রবিউল সাহেব চলে যেতেই হিয়া দম ফিরে পেলো। উফফ যাক এই লোকটা মুখ বন্ধ রেখেছে। শুভ্র উঠে দাড়িয়ে সিড়ির দিকে এগুতে এগুতে কিছুদূর গিয়ে আবার থেমে গেলো। শুভ্রের পিছু পিছু হিয়া উঠছিলো কিন্তু শুভ্রর থেমে যাওয়ায় আরেকটু হলেই শুভ্রের সাথে একটা ধাক্কা খেতো সে। হিয়া চুপ করে সিড়ির একপাশে দাঁড়ালো অন্য সময় হলে সে চেঁচিয়ে উঠতো কিন্তু এখন সে ভদ্র বাচ্চা। শুভ্র দুই সিড়ি নীচে নেমে হিয়ার সামনে এসে দাড়ালো। হিয়ার বুকের ভিতরটা ধুক ধুক করছে।আবার কি কিছু হয়েছে নাকি সে কিছু করেছে? শুভ্র এগিয়ে এসে রেলিংয়ের দুপাশে হাত রাখতেই হিয়া জড়সড় হয়ে দাঁড়ালো।

শুভ্র স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ হিয়ার বিচলিত চেহারার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,” কাল থেকে ড্রাইভার তোমাকে নিতে যাবে, গাড়িতে আসা যাওয়া করবে। আর যদি সেটা না করো তাহলে বাবাকে আমি নিজে গিয়ে সবটা বলবো। এরপর বাবা কি করবে সেটা তো ধারণা করতেই পারছো?”বলেই শুভ্র সিড়ি বেয়ে উঠে নিজের রুমে চলে গেলো।

হিয়া থ মেরে দাড়িয়ে রইলো। হটাৎ শুভ্রের এতো মাথা ব্যাথা কেনো তাকে নিয়ে। হিয়া কিছুই বুঝতে পারলো না। লোকটা কি একটু হলেও তার জন্যে ভাবে? সারাদিন শুভ্র রাগ করে থাকলেও হিয়ার প্রতি শুভ্রের এই চিন্তাটুকু হিয়ার মাঝে নতুন অনুভূতির জন্ম দিলো। লোকটা এতটাও বাজে না।

🦋 সাহারা খাতুন,রাবেয়া ফুফু আর মোহনার ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হলো। রাবেয়া আক্তারের এই বাড়িতে আসার একটা কারণ হলো তিনি নিজের ছেলের জন্যে মেয়ে খুঁজছেন। ছেলেটাকে বিয়ে দিয়ে দিতে পারলে তিনি চিন্তা মুক্ত হোন। মনের মতো মেয়ে পাচ্ছেন না, পেলেও পরিবার ভালো না। রাতে খাবারের পর তিনি এসে শুভ্রের পাশে বসলেন। শুভ্র কফি হাতে সোফায় বসে ছিল।

রাবেয়া ফুফু বললেন,” এতো ব্যাস্ততা তোর! ফুফুর সাথে তো কথা বলার সময়ও নেই।”

শুভ্র কফিটা নামিয়ে রেখে বললো,” তুমি রাগ করেছো নাকি?”

” রাগ করলে কি করবি? রাগ ভাঙ্গতে পারবি?”, ফুফুর কথায় শুভ্র বললো,”চেষ্টা করতে পারি।”

এইসবের মাঝেই রবীউল সাহেব একপাশে টিভি ছেড়ে খবর শুনতে বসেছেন মাত্র, তখনই রাবেয়া ফুফু বলে উঠলেন,” এই রবীউল।”

রবীউল সাহেব নিজের বোনের দিকে তাকিয়ে বললেন,” বোলো বুবু।”

” তোর বন্ধুর মেয়েটাকে আমার ভালো লেগেছে। খুব মায়াবী একটা চেহারা।”,মোহনা পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো ফুফুর কথা শুনে থেমে এইদিকে আসতে আসতে বললো,” বন্ধুর মেয়ে? বাবার কোন বন্ধুর মেয়েকে আবার তোমার পছন্দ হলো?”

রবীউল সাহেবের সাথে সাথে শুভ্রও কৌতূহল নিয়ে তাকালো। রাবেয়া ফুফুর উত্তরে সবচেয়ে বেশি চমকে গেছে শুভ্র। কারণ এই উত্তরটা শুভ্রের চিন্তার বহিরে ছিলো। রাবেয়া ফুফুর হিয়াকে পছন্দ হয়েছে। তিনি আরো বললেন,” মেয়েটার মামার সাথে আমি কথা বলতে চাই। তুই ওনাকে আসতে বল নয়তো আমি নিজে গিয়ে দেখা করে আসবো।”

মোহনা অবাক হয়ে বললো,” আরে এক্ষুনি কিসের কথা রায়হানের যদি অন্য কাউকে পছন্দ থাকে! তুমি ওকে জোর করবে নাকি?”

” ধুর বোকা মেয়ে, আমি মা। আমি জানি না? আমার ছেলের পছন্দের কেউ থাকলে ঠিক বুঝতাম। আর আমি এমনিতেই একটু দেখা করতে চাই হিয়ার মামার সাথে।”, বলতে বলতে নিজের ভাইয়ের দিকে তাকালো।

রবীউল সাহেব এতক্ষণ শুভ্রের দিকে গম্ভির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন।মনে মনে তার ভীষন রাগ লাগছে।রাগ সামলে তিনি ভারী গলায় বললেন,” হিয়ার মামাকে ডাকতে হবে না। এখন আমি ওর গার্জিয়ান। এতো পছন্দ হলে রায়হান কে এসে হিয়াকে দেখতে বল। পছন্দ হলে সেটা পরে ভাবার বিষয়।”,বলেই তিনি গট গট করে হেঁটে চলে গেলেন।

কথাগুলো একপ্রকার না ভেবেই ক্ষোভের বশেই বললেন তিনি। যে জিনিসের মর্যাদা কেউ রাখতে জানো না সেটা তার জন্যে না।
শুভ্র অনেক বেশি অবাক তার বাবার কথা শুনে। বাবা চাইছে কি? আমনা আমনি শুভ্রের কপালের একটা ভাজ পড়লো। মোহনা হতভম্ভ হয়ে দাড়িয়ে আছে। একটু আগে তার বাবা কি বলে গেলো?

[ #চলবে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here