তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ২৫
(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )
বাড়ি ফিরে আরমিনকে কিছু জিজ্ঞাস করার সাহস বা সুযোগ হলো না সায়রার। বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করবে করবে করে আর করা হয়নি। দরজার সামনের থেকে ফিরে এসেছে। সেদিনের পর থেকে আরমিনও বেশ চুপচাপ হয়ে গেছে। কোন সাড়াশব্দ নেই! বাড়ির কারো সাথে তেমন কথাবার্তাও বলে না। সারাক্ষণ নিজের ঘরে শুয়ে বসে কাটায়। দুদিন পর সায়রার ফাস্ট ইয়ার ফাইনাল। পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত সে। তাই আরমিনকে নিয়ে খুব একটা ঘাঁটতে যায়নি। কি দরকার ঘাঁটাঘাঁটি করার? যদি আরসাল রিজেক্টও করে থাকে, তা একান্তই আরসালের নিজেস্ব সিদ্ধান্ত! সেই সিদ্ধান্তকে পাল্টানোর মত অধিকার বা সাহস কোনটাই সায়রার নেই।
.
সকাল আটটা মেইন রোডে দাঁড়িয়ে আছে সায়রা। আশেপাশে কোন রিক্সা গাড়ি কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। শুনেছে সামনের রাস্তায় আজ বিরাট সমাবেশ। তাই রাস্তাঘাট সব সকাল থেকে সারাদিন বন্ধ থাকবে। তার উপর পরিক্ষার কেন্দ্র পড়েছে সাভারের শেষ মাথা ধামরাই । যার নাম শুনলেও কোনদিন যাওয়া হয়নি সায়রার। সেখানে রাস্তা চেনা- জানাত অনেকদূর!
সময় মত পরিক্ষার হলে পৌঁছাতে পারবে তো? ভাবতেই ভয়ে চোখ মুখ চুপসে গেলো সায়রার। অশ্রুভারাক্রান্ত চোখ। নাক লাল টকটকে। বারংবার ঘড়ি দেখছে আর চোখের জল মুছছে। পাশ থেকে সিন্থিয়া বেগম মেয়েকে দেখছে। অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলেন তিনি। ভেবেছিল, সায়রাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে তিনি অফিসে চলে যাবেন। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে মেয়েকে বিপদে দেখে ফেলে যাওয়া উচিত মনে হলো না। মনে মনে ভেবে নিলেন আজ অফিস কামাই দিবে। সায়রার মাথায় হাত রেখে আশ্বস্ত স্বরে বললেন সিন্থিয়া,
–” চিন্তা করিস না মা! হাতে এখনো একঘণ্টা সময় আছে ঠিক পোঁছে যাবি।”
মায়ের কথা কানে আসতেই আরেকবার ঘড়ি দেখে নিলো সায়রা। ‘আটটা নয়’। ঠিক সময় কেন্দ্রে পৌঁছাতে না পারলে এত কষ্ট, এত পরিশ্রম সব শেষ! ভয়ে কেঁদে উঠল সায়রা। কোন দিশা না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করল সে। পিছুপিছু সিন্থিয়াও গেল। কিছুদূর যেতেই আরসালকে দেখল। গাড়ি করে বাড়ির দিকে ফিরছে। সায়রাদের দেখে থামল। আরসাল গাড়ি থেকে নেমে মুখোমুখি হলো । এক পলক সায়রার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে নিলো । চিন্তিত স্বরে সিন্থিয়া বেগমকে প্রশ্ন করল আরসাল,
–” কোথায় যাচ্ছ ছোট মা?”
–” বলোনা বাবা! অফিসের জন্য বেরিয়েছিলাম, নয়টা থেকে সায়রার পরিক্ষা শুরু ধামরাই কলেজে সিট পড়েছে। ভেবেছিলাম ওকে গাড়িতে তুলে দিয়ে অফিসে যাবো । কিন্তু এদিকে রাস্তাঘাট সব বন্ধ! তার উপর ঐদিকের রাস্তাঘাট চিনেনা সায়রা , ওর বান্ধবীরা সবাই অনেক আগেই চলে গেছে। শুধু সায়রাই রয়ে গেছে!”
ক্লান্ত চিন্তিত সুরে উত্তর দিলেন সিন্থিয়া বেগম। কিছু একটা ভেবে আরসালের ততক্ষণাত উত্তর,
–” তুমি বাড়ি ফিরে যাও। আমি পেছন দিকের শাখা রাস্তা দিয়ে সায়রাকে পৌঁছে দেব!”
–” তোমার সমস্যা হবে না? খামাখা ঝামেলা হবে তোমার! ”
–“আমি আজ সারাদিন ফ্রি। ”
সিন্থিয়া আর কথা বাড়াল না এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে। সায়রার নাকচ করার মত বিকল্প নাই। পরিক্ষায় ঠিক সময় উপস্থিত থাকতে হলে তাকে এক্ষুণি আরসালের সাথে বেড় হতে হবে! তার উপর মায়ের মুখের উপর না করার সাধ্যি কই? দ্রুত পায়ে আরসালের পাশের সিটে বসল সায়রা। গাড়ি চলছে নিজ গতিতে। শক্ত হাতে ফাইল চেপে ধরেছে সায়রা। শরীরের কাঁপুনি তখনো থামেনি তার, চোখ বেয়ে ঝরছে অঝোর ধারা! বড় বড় নিশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু হচ্ছে না। মাথায় শুধু পরিক্ষার চিন্তা ঘুরঘুর করছে। আরসাল সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তা লক্ষ করল। সামনের টিস্যুর বক্সটা সায়রার দিকে এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর আওয়াজ করল,
–” মাথা ধরছে আমার। কান্না বন্ধ কর!”
ঝটপট দুইটা টিস্যু হাতে নিয়ে চোখমুখে চেপে ধরল সায়রা। সাইড ব্যাগ থেকে পানির বোতল হাতে নিয়ে ঢকঢক করে কয়েক ঢোক পানি গিলে নিজেকে শান্ত করল। আজ কতদিন পর মানুষটার এত কাছাকাছি সে। কতদিন পর সেই চিরচেনা মাতাল ঘ্রাণটাকে কাছ থেকে অনুভব করছে। পরিক্ষার আগে উনার সাথে দেখা হওয়াটা কি খুব জরুরী ছিল? যা পড়েছে সবটা তো আউলে গেল! এইতো মাথাটা ফাঁকা। একেবারে ফাঁকা! আড়চোখে একবার আরসালকে দেখে নিলো সায়রা। ফরমাল ড্রেসে আরসাল। অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছিল বোধহয়। উনিও নিশ্চয়ই তার- ই মত ভুক্তভোগী! এসব ভেবে গভীর ভাবনায় ডুব দিলো সায়রা।
মেইন রোড ছেড়ে শাখা রাস্তার দিকে গাড়ি ফিরতেই ভ্রু কুঁচকে এলো সায়রার। ঝটপট প্রশ্ন করে উঠল আরসালকে,
–” এটা কোথায়! কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
আরসাল বিরক্তির মুখ করে কয়েক পলক সায়রার দিকে তাকিয়ে বাহিরের সাইনবোর্ডের দিকে ইশারা করল। হলুদ বোর্ডে গোটাগোটা কালো অক্ষরে লিখা ‘ধামরাই থানারোড’ । টনক নড়ল সায়রার। এটাই তো তার গন্তব্য। এখান থেকে রিক্সা নিয়ে ধামরাই কলেজ। যেখানে সায়রার সিট পড়েছে। আশেপাশে আরেকবার খেয়াল করল সায়রা। একদম শুনশান নিরিবিলি জায়গা। আশেপাশে দুএকটা টংয়ের দোকান। হাতে গুনা তিন চারটা রিক্সা। এটা কি করে থানা রোড হতে পারে? কোথাও এমন নিরিবিলি জনশূন্য থানা রোড আছে জানা ছিল না সায়রার।
আরসাল ড্রাইভ করতে করতে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
–” চেনা নাই, জানা নাই একা একা ড্যাং ড্যাং বেড়িয়েছিলি! তোকে একা ছাড়লে দেখা যেত, তুই গেটে পা রেখেছিস! আর এদিকে সবার পরিক্ষা শেষ! ঘন্টা বাজছে! ”
কোনো উত্তর দিলো না সায়রা, লজ্জায় গুটিয়ে নিলো। ভার্সিটির সামনে গাড়ি থামতেই ফাইল হাতে নিয়ে খিঁচে এক দৌড় দিলো। কিছু পথ গিয়ে থেমে গেল সায়রা। পিছন ফিরে বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে জোর আওয়াজে বলল,
–” ধন্যবাদ আরসাল ভাই!”
উত্তর দিলো না আরসাল। চেহারায় গম্ভীর ভাব এঁটে চোখ ফিরিয়ে নিলো। সায়রা চলে গেল। পরিক্ষা শেষে গেটের বাহিরে আরসালের গাড়ি থেমে থাকতে দেখে বেশ চমকাল সায়রা। কাছে যেয়ে গাড়ি কালো কাঁচে ঝুঁকল। ভেতরে আরসাল আছে কিনা দেখার চেষ্টা করল। পারল না। কালো কাঁচের জানালা ভেদ করে সায়রার দৃষ্টি ভিতরে পৌঁছাতে পারল না। পেছন থেকে আরসালের ভারী আওয়াজ ভেসে এলো,
–” পরিক্ষা শেষ!”
সায়রা ভড়কে গেল। পিছন ফিরল। মুচকি হেসে বেশ স্বাভাবিক স্বরে বলল,
–” আপনি যাননি আরসাল ভাই? এতক্ষণ এখানেই ছিলেন?”
উত্তর দিলো না আরসাল। ধমকে বলল,
–” গাড়িতে উঠ!”
সায়রা বিনাবাক্যে গাড়ি চড়ে বসল। সিটে হেলান দিয়ে জানালার কাছে মাথা ঠেকাল। চার ঘন্টা পরিক্ষা দিয়ে ভীষণ ক্লান্ত সে। শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। গত দুই রাত ভালো ঘুম হয়নি। চোখের পাতা জ্বলছে। ঘুমে ঢলঢল করছে দুচোখ। কখন যে চোখ লেগে গেল, স্বরণে নেই সায়রার।
ঘুম ভাঙল ঘন্টা দুএক পর। পিটপিট দৃষ্টি মেলে সামনে তাকাতেই ছিটকে গেল সায়রা। ড্রাইভিং সিটে হেলান দিয়ে নিমিষ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আরসাল। কেমন জানো অদ্ভুত, মাতাল দৃষ্টি। চোখে গভীর কোন ভাষা ভাসছে। কিন্তু সেই ভাষা বুঝার ক্ষমতা বা সাহস কোনটাই নেই সায়রার। আরসালের গাঢ় দৃষ্টি সায়রার গলার ছোট তিলটায়। ধর ফরিয়ে উঠল সায়রা। ওড়না ঠিক করতে করতে মুখ বেঁকিয়ে বলল,
–” এমন শকুন দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন কেন আরসাল ভাই?”
–” শিকার করবো তাই!”
সায়রা ভ্রু কুঁচকে একবার আরসালের দিকে তাকাল। যেন ভীষণ বিরক্ত সে। ঘড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে দ্বিগুণ বিরক্তি নিয়ে বলল সায়রা,
–” আরসাল ভাই এখানে গাড়ি থেমে কেন? বাড়ি ফিরব কখন? সন্ধ্যা নামল প্রায়! ”
আরসালের আগের মতই গম্ভীর আওয়াজ,
–” ফিরবো না বাড়ি। এই গাড়িতে তুই আমি এই ভাবেই বন্ধী থাকব সারাজীবন। কি ভালো হবে না?”
এবার সায়রা আগের চেয়ে আরো বেশি বিরক্ত নিয়ে বলল,
–” আবার! আবারো, আপনি পাগলামো শুরু করেছেন? আমারই ভুল আমি আপনার সাথে এসেছি। থাকবো না আমি। আমি একাই চলে যাবো! ”
গাড়ি থেকে নামার জন্য দরজার দিকে হাত বাড়াতেই পেছন থেকে টান পড়ল। পিছন ফিরতেই নিজের কাছে টেনে নিলো আরসাল। বুকে যেয়ে পড়ল সায়রা। সে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো আরসাল। দিনের শেষ কোমল আলো সায়রার মুখে পড়ছে। ঝলঝল করছে ঘুমঘুম চোখ। অবাধ্য চুল গুলো বারংবার কপাল ছুঁচ্ছে। বেশ আবেশে তা সরিয়ে দিলো আরসাল। যেন এই মুহূর্তে অবাধ্য চুল গুলোকে গুছিয়ে দেওয়া অত্যন্ত জরুরী। না করলেই নয়। মনোযোগ সেদিকে রেখে বেশ আবেগী স্বরে বলল আরসাল,
–” এত নিখুঁত অভিনয় কি করে করিস তুই? বিরক্ত হয় না?”
হুট করে আরসালের এমন প্রশ্নে ভড়কে উঠল সায়রা। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে,
–” কিসের অভিনয়! কি বলছেন আপনি!”
স্মিত হেসে সায়রার দিকে তাকাল আরসাল। কপালের টুপ করে চুমু এঁকে নাকের সাথে নাক ঘষতে ঘষতে বলল,
–” কতদিন আমার থেকে সত্য লুকাবি তুই? তুই চলিস ডালে ডালে, আমি চলি পাতায় পাতায়!”
সায়রা চোখ মুখ খিঁচে বলল,
–” হেঁয়ালি বন্ধ করে। সোজাসুজি বলুন কি করেছি আমি!”
–” সোজাসুজি বলব?”
সায়রা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। আরসাল সায়রাকে ছেড়ে স্ট্রেইট বসল। সায়রার দিকে কঠোর দৃষ্টি মেলে গম্ভীর আওয়াজে বলল,
–” তোর বোন আমাকে পছন্দ করে তুই তা আগে থেকে জানতি? ওর জন্যই কি আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছিস?”
সায়রা চুপ। থতমত খেয়ে গেছে। এভাবে আরসালের কাছে একদম ধরা পড়ে যাবে বুঝেনি সে। প্রচণ্ড উত্তেজনায় শরীর থরথর কাঁপছে তার। কি রেখে কি বলবে? বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইনিয়েবিনিয়ে আমতা আমতা জবাব দেয় সায়রা,
–” কই, আমি তো কিছু জানি না! আরমিন আপু আপনাকে পছন্দ করে নাকি?”
হো হো করে গা কাঁপিয়ে হাসল আরসাল। তার যা বুঝার জানার, সে তা বুঝে গেছে! পাশ থেকে সায়রা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। হাসছে কেন আরসাল ভাই। উনি কি কিছু টের পেয়েছে! সে কি ঠিকঠাক গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারেনি!
সন্ধ্যা নেমেছে। চারিদিক অন্ধকার। গাড়ি বাড়ির সামনে থামতেই সায়রা নেমে গেল। পেছন থেকে ডাকল আরসাল। সায়রা থামল, পিছন ফিরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। আরসাল বেশ স্বাভাবিক স্বরে বলল,
–” সাবধান সুন্দরী! এই শকুনের নজর পড়ছে, মনে ধরেছে তোকে! বলা তো যায় না কখন আবার উড়িয়ে নিয়ে যাই!”
সায়রা বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে চেয়ে রইল। আরসালের কথার আগাগোড়া বুঝল না। বেশ কিছুক্ষণ পর বিরবির করল,
–” আপনি পাগল হয়েছেন। বড্ড পাগল! ”
তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ২৬
(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )
ফোনটা বেজে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। চোখ উঁচিয়ে একবার ফোনের দিকে চোখ বুলাল সায়রা। গোটাগোটা অক্ষরে লিখা ‘ Arsal calling’। খানিক বিরক্ত হলো। উনি আবার পাগলামো শুরু করল? আবারো! এবার ভাঙ্গলে নিজেকে কি করে শক্ত করবে সায়রা? বুকে আটকে রাখা নিশ্বাসটা ফোঁস করে বেরিয়ে এলো। আর মাত্র একটা পরিক্ষা। আগামীকালের পরিক্ষা শেষ হলেই ঝামেলা মুক্ত। মনে মনে সিদ্ধান্ত এঁটেছে সে, এবার পরিক্ষা শেষে বেশ কয়েকদিনের জন্য নানীর বাড়িতে বেড়াতে যাবে। এতে দুটো লাভ, প্রথম মন ভালো থাকবে! দ্বিতীয়ত আরসাল থেকে দূরে থাকা যাবে বেশ কয়েকদিন। এসব ভাবনার মাঝেই চুল গুলো হাত খোপা করে নিলো সায়রা। চেয়ারে দুপা তুলে আবারো পড়ায় মনোযোগ দিলো। দরজায় কারো কড়া আঘাতে টনক নড়ল সায়রার। বইয়ের পাতা থেকে চোখ তুলে, দরজার দিকে মেলল। দাদী এসেছেন। ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি টেনে ধীর স্বরে বলল সায়রা,
–” কিছু বলবে দাদী?”
নুরজাহান বেগম ভিতরে এসে সায়রার মুখোমুখি চেয়ারটায় বসল। চোখেমুখে গম্ভীর ভাব এঁটে আছেন তিনি। দাদীর এমন গম্ভীর ভাব দেখে বই খাতা গুছিয়ে রাখল। ভীতু আওয়াজে জিজ্ঞেস করল,
–” কিছু কি হয়েছে দাদী? আরমিন আপু ঠিক আছে তো?”
নুরজাহা বেগম হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললেন,
–” সব ঠিক আছে, তোর সাথে কিছু কথা ছিল!”
–” হ্যাঁ দাদী বলো”
–“আর কয়টা পরিক্ষা আছে?”
–” আগামীকাল শেষ।”
–” তোর জন্য বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। উনারা দুএকের ভেতর আসতে চাইছে। তোর কি মতামত! ”
দাদীর কথা গুলো গরম শিশার মত সায়রার কানে ঢুকল। মাথায় যেন বাজ পড়ল তার।হতভম্ব, বিস্ময়ে থম মেরে গেছে। নিজেকে সামলে ঝটপট জবাব দিলো সে,
–” বিয়ে? হুট করে বিয়ে কেন? পড়াশোনা শেষ হোক ভালো চাকরী পাই তারপর না হয় বিয়ে নিয়ে ভাবা যাবে!”
দাদীর দাম্ভিক উত্তর,
–” বিয়ের পরেও পড়াশোনা করা যায়। আর রইল চাকরীর কথা! এমন তো নয় যে তোকে চাকরী করে বরকে খাওয়াতে হবে। এখন বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়?”
মাথা নুয়ে মাটিতে পায়ের বৃদ্ধ আঙ্গুল ঘষছে সায়রা। গভীর কোন চিন্তায় মগ্ন সে। দাদী এখন কি বলে আটকাবে সে? নুরজাহান বেগম আগের মত গম্ভীর কন্ঠে আওড়াল,
–” তুই কি কাউকে পছন্দ করিস?”
সায়রা ঘাবড়াল, ভড়কাল। পিটপিট দৃষ্টি মেলে একবার দাদীর দিকে চাইল। নুরজাহান বেগমের দৃষ্টি পূর্বের মতই কঠোর, শক্ত। সায়রাকে নিশ্চুপ দেখে, নুরজাহান বেগম ধমকে বললেন,
–” আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি সায়রা! তোর কাউকে পছন্দ? ”
বেশ কিছুক্ষণ নীরব কাটল। সায়রা কিছু ভেবে চেয়ারে পোক্ত ভাবে বসে, গলা ঝেড়ে নীরবতা কাটিয়ে বলে,
–” আমি আরসাল ভাইকে ভালোবাসি দাদী। উনিও আমাকে ভালোবাসেন।”
নুরজাহান বেগমের বিস্ময় আকাশ চুম্বী। চোখে মুখে ক্রুদ্ধতার আভা স্পষ্ট। নুরজাহান বেগম কিছু বলার জন্য মুখ খুলবেন তার পূর্বেই বলে উঠে সায়রা,
–” কিন্তু! কিন্তু আমি চাইনা এই সম্পর্কটা সামনে আগাক।ভবিষ্যৎ এ কোন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হোক। আমার আর আরমিন আপু মাঝে কোন দ্বন্দ্ব হোক! এই সম্পর্ক এখানেই ইতি টানা উত্তম! যদি তোমার আমার কথায় বিশ্বাস না হয়, তুমি বিয়ের সম্বন্ধের ব্যাপারটা সামনে আগাতে পারো। আমার কোন আপত্তি নাই। শুধু একটু সময় প্রয়োজন!”
দাদীর চুপচাপ ক্ষীণ দৃষ্টিতে বেশকিছুক্ষণ সায়রাকে দেখলেন। মনে মনে কিছু একটা ভেবে আলতো হাসলেন। যেন উনার অনুমান ঠিক ঠিক মিলেছে! কপালের দুশ্চিন্তার বলিরেখা গুলো মিলিয়ে গেল। সন্তুষ্ট মেজাজে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন তিনি। দাদীর শান্ত স্বভাবে বেশ অবাক হলো সায়রা। এত বড় এক ঘটনা জানার পরও দাদী এত শান্ত? ব্যাপারটা বেশ ঘাপলা লাগল তার।
.
রিক্সার জন্য রাস্তার পাড় দিয়ে হাঁটছে সায়রা। এই রোডটা একদম ফাঁকা, জনশূন্য, নিরিবিলি। শেষের পরিক্ষা হওয়ায় ডিপার্টমেন্টের সবাই ছোট করে গেটটুগেদারের আয়োজন করেছে। সায়রা যাবেনা যাবেনা বলেও, বান্ধবীদের পিড়াপীড়িতে যেতে হচ্ছে তাকে। সবাই অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে। শুধু সায়রাই পিছনে পড়েছে। কাঁচা রাস্তা ছেড়ে পাকা রাস্তার দিকে পা বাড়াতেই, আচমকা ছোঁ করে এক গাড়ি এসে থামল। গাড়িটা চিন্তে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না সায়রা। আরসালের গাড়ি। গাড়ির মালিকের রক্তিম দৃষ্টি লক্ষ করে আঁতকে উঠল সায়রা। পেছন থেকে বেশ কয়েকবার ডাকল আরসাল। শুনল না সায়রা। না দেখার মত করে, দ্রুত পা চালাল। এতে আরসাল আরো বেশি ক্ষেপে গেল। গাড়ি থেকে নেমে এক দৌড়ে সায়রার পাশে এসে দাঁড়াল সে। হাত চেপে নিজের দিক ফিরিয়ে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
–” ডাকছি আমি! কথা কানে যাচ্ছে না তোর?”
সায়রা থতমত খেয়ে গেল। কি বলবে খুঁজে পাচ্ছেনা সে। নীরবে শুধু হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। আরসাল জোর গলায় আবারো ধমক দিয়ে বলল,
–” এভাবে বাইম মাছের মত মোড়ামুড়ি করছিস কেন? সোজাসুজি দাঁড়া! আমার ফোন ধরছিলি না কেন? সমস্যা কি তোর! শুনলাম বিয়ে করতে রাজি হয়েছিস।”
সায়রা থামল। পিটপিট করে আরসালের দিকে দৃষ্টি মেলল। আরসাল স্থির দৃষ্টিতে ঠাই তাকিয়ে। দৃষ্টি সরিয়ে বলল সায়রা,
–” আমার আপনাকে পছন্দ না। আপনি তা বুঝেন না কেন? আর তাছাড়া বিয়ের বয়স হয়েছে আমার। বিয়ে করব, বরের সাথে ঘুরবো, বাচ্চা হবে, বাচ্চা নিয়ে খেলব! তাতে আপনার সমস্যাটা কোথায়?”
আরসাল নিস্তব্ধ চেয়ে বেশ শান্ত স্বরে আওড়াল,
–” এটাই কি তোর শেষ কথা?”
উত্তর দিলো না সায়রা। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ।আরসাল কয়েক বার ক্রুদ্ধ নিশ্বাস ফেলে, আগের মত শান্ত স্বরে বলল,
–” আপসে না পেলে ছিনিয়ে নিবো তোকে। এর পর যা যা হবে সবকিছুর জন্য তুই দায়ীই।”
কিছু বুঝবার আগে আরসাল সায়রার হাত বেঁধে, মুখে কস্টিপ লাগিয়ে দিলো। সবকিছু যেন পূর্ব পরিকল্পিত। স্তম্ভিত রইল সায়রা। কিছু বলার চেষ্টা করল কিন্তু স্পষ্ট বেরিয়ে এলো না কিছু। সায়রাকে কাঁধে তুলে ফ্রন্ট সিটে সিটবেল্ট চাপিয়ে বসিয়ে দিলো। ছাড়া পাবার জন্য জোরাজুরি করল সায়রা। পারল না। চোখ জোড়া থেকে ক্লান্তিহীন অশ্রু ঝরছে। নিজেকে ছাড়ানো আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু বিফল! আরসালের সামনে সায়রা সকল প্রচেষ্টা বিফল।
.
রাত নয়টা। মাথায় লাল ভারী ওড়না। হাতে লাল চুড়ি। খোলা কেশ। গায়ে ভীষণ সাদামাটা থ্রিপিস। এমন সাদামাটা বিয়ের কনে কাজী সাহেব এই প্রথম দেখছেন। খানিক পূর্বেই আরসাল সায়রার বিয়ে হয়েছে। কাজী সাহেব কনের মুখ দেখেই বুঝেছে বিয়েতে কনের মত নেই। জোরপূর্বক, হুমকি ধমকি্তে হচ্ছে। কাজী সাহেব প্রথমে বিরোধ করতে চাইলে, মোটা অংকের সম্মানি দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেয় আরসাল! কাজী সাহেব এতে মহা খুশি। আনন্দে সালাম করতে করতে বিদায় নিয়েছেন। এখন ঘরটা পুরোপুরি খালি। আরসালের বন্ধুবান্ধব বাকি সবাই বাহিরে চলে গেলে। ঘরে শুধু আরসাল আর সায়রা। মৃদ্যু আলো জ্বলছে ঘরটায়। সায়রা কেঁদে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। চোখ জোড়া ফুলে রক্তিম হয়ে আছে। টপটপ অশ্রুকণা গাল বেয়ে ঝরছে। সামনের চেয়ারটায় বসে আছে আরসাল। দৃষ্টি বেশ শান্ত স্থির । নিশ্চুপ সায়রার কাণ্ড দেখছে। সায়রার ফোনটা আরেকবার বেজে উঠতেই মাটিতে সজোরে আছাড় মারল আরসাল। বিকট শব্দ হয়ে কয়েক খণ্ডে ছড়িয়ে পড়ল। ঘাবড়ে গেল সায়রা। অটোমেটিক কান্না বন্ধ হয়ে গেল। আরসাল সামনের দিকে চেয়ার টানল। ভয়ে পিছন সরে গেল সায়রা। থরথর কাঁপছে সে। এই চেনা মানুষটাকে আজ বড্ড অচেনা লাগছে তার। এই দৃষ্টিতে আজ ভয়ংকর জেদ চেপেছে। যেই জেদ সবকিছু তছনছ করতে সক্ষম! চোখের জল মুছে দিয়ে সায়রার মুখোমুখি বসল আরসাল, দৃষ্টি মিলিয়ে!
গম্ভীর কন্ঠে বলল,
–” এভাবে কাঁদছিস কেন? যা হবার হয়ে গেছে। এখন আইনি ভাবে তুই আমার বউ সায়রা। তোর উপর শুধু আমার অধিকার!”
সায়রা হতভম্ব। শরীর অবশ হয়ে আসছে তার। আরসাল সায়রার হাত টেনে নিজের কাছে আনল। বুকের সাথে বেশ গভীরভাবে জড়িয়ে ধরল। ঘাড়ে থুতনি ঠেকিয়ে কানের কাছে নাক ঘষতে ঘষতে ফিসফিস আওয়াজ করে বলল,
–” এখন না আছে অনিশ্চয়তা, না আছে হারানোর ভয়। এখন তুই শুধু আমার! শুধুই আমার!”
চলবে……..