তোমার প্রণয় নগরে পর্ব -২৩+২৪

তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব- ২৩

(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

বাড়ি ফিরে গত দুইদিনে নিজেকে অনেকটাই গুছিয়ে নিয়েছে সায়রা। মনের সব বিহ্বলতা কাটিয়ে, চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরমিনকে তাদের প্রেমের সম্পর্কের কথা জানাবে। সবটা জানাবে। সকাল থেকে মনে মনে কথা গোছাচ্ছে সায়রা। কোথা থেকে শুরু করবে, কিভাবে শুরু করবে, কি কি বলবে!
বাড়ি এখন ফাঁকা। মা অফিসে, বাবা বাহিরে, পিয়াস পাখি স্কুলে। বাড়িতে শুধু দাদী , আরমিন আর সে। এটাই সঠিক সময় আরমিনের সাথে কথা বলার। সায়রা দরজার দিকে পা বাড়াতেই বাহির থেকে দাদীর চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসে। ভড়কে যায় সায়রা। দ্রুত পায়ে আরমিনের রুমের দিকে ছুটে যায় । চেঁচামেচির আওয়াজ সেই রুম থেকেই আসছে। দরজার সামনে যেতেই প্রচণ্ড ধাক্কা সায়রা। আরমিনের গলায় ওড়না বাঁধা, দাদীর আরমিনের চুল ধরে এলোমেলো মারছে। হাউমাউ করে কাঁদছে আরমিন। ছুটে যেয়ে দাদী থেকে ছাড়িয়ে আরমিনকে জড়িয়ে ধরল সায়রা। নুরজাহান বেগম ক্রোধে ফোঁসফোঁস করছে। চিৎকার করে বলল সায়রা,

–” তুমি কি পাগল হয়েছ দাদী! মেরে ফেলবে মেয়েটাকে?”

নুরজাহান বেগম শক্ত হাতে আরমিনের মাথায় থাপড় দিতে চাইল সায়রা সামনে আসায় তার লাগল। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল সায়রা। দাদী টেনে আরমিনকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলল,

–” তুই সর সায়রা। ওকে আজ মেরেই ফেলবো। ওর মরার শখ জেগেছে! ফাঁসি দেয়, আত্মহত্যা করতে চায়! সর তুই, আমি নিজের হাতে গলা চেপে মেরে ফেলি ওকে ।”

দাদীর কথায় হতবম্ভ সায়রা। আরমিন আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে। গলার এই ফাঁদ ফাঁসির! বিস্মিত চোখে আরমিনের দিকে তাকাল সায়রা। আরমিন সায়রাকে শক্ত ভাবে জড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদে দেয়। বিছানায় নুরজাহান বেগম ধপ করে বসে পরে। ছোট থেকে তিল তিল করে মানুষ করেছে আরমিনকে। কড়া শাসন করলেও মায়ের অভাব পূর্ণ করেছে। সর্বদা মায়া মমতা দিয়ে আগলে রেখেছে। সেই আরমিন কিনা আজ আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে? যাকে নিয়ে উনার এত গর্ব, অহংকার আজ সেই নাতনি তার সকল গর্ব অহংকার ভেঙে চুরচুর করে দিয়েছে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল তিনি। সায়রা নিজেকে বেসামাল লাগছে। মাথা ধরছে। প্রচণ্ড চোখ জ্বলছে। বড়বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো সে। কাঁপা কাঁপা হাতে আরমিনের মুখ ছুঁয়ে বলে,

–” এসব পাগলামো কেন করছ! কি হয়েছ আপু!”

বোনের সামান্য ছোঁয়ায় আরমিন যেন আরো বেশি আহ্লাদী হয়ে উঠল। সায়রাকে জড়িয়ে ধরে, চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। ভেতরের সব কষ্ট কান্নাভেজা চিৎকারে বেরিয়ে আসছে।

–” সায়রা! সায়রারে! আমি তাকে ভুলতে পারব না। আমি তাকে খুব চাই। আমি পারবনা তুর্জয় ভাইকে বিয়ে করতে! সবাই আমাকে কেন জোর করছে! কেন!”

নুরজাহান বেগম পাশ থেকে ধমকে বলল,

–” নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী চাইতে হয়। তোর কি যোগ্যতা আছে ওই ছেলেকে চাওয়ার? তুর্জতের মত এত ভালো ছেলে যে তোকে বিয়ে করছে তাই তোর সাত পুরুষের ভাগ্য! তুই পঙ্গু। তোর কাউকে চাওয়ার অধিকার নাই।”

নুরজাহানের কথায় আরমিনের কান্নার বেগ বাড়ল। কান্নায় হাউমাউ করতে করতে বলল,

–” তাই তো মরে যেতে চাইছি। পঙ্গুত্ব নিয়ে আর বাঁচতে চাইনা। এই অপমান এই অবহেলা আর নিতে পারছিনা। আমার সহ্য সীমানা ছাড়িয়েছে। এই পঙ্গুত্বের জন্য সারাজীবন শুধু অপ্রাপ্তির বোজ বয়ে গেলাম। আর পারছিনা আমি! মরেই আমার শান্তি!”

আরমিন নিজেকেই নিজে আঘাত করছে। সায়রা জোর খাটিয়ে আরমিনের হাত চেপে ধরে। কান্না কান্না করতে করতে বলে,

–” থামো আপু। অনেক হয়েছে! কত! আর কত আঘাত করবে নিজেকে। তোমাকে কেউ বিয়ের জন্য জোর করবে না। তুমি তোমার ইচ্ছের অধীন প্লিজ বন্ধ করো এবার। প্লিজ।”

আরমিন থামল। সায়রা আরমিনকে ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। এই কান্না নিজের ভেতরের অনুতাপের। আজ তারই জন্য আরমিনের এত অবহেলা এত অপমান! ছোট থেকে সব কিছু কেবল আরমিন হারিয়েছেই। অপ্রাপ্তির তালিকা বিশাল তার। এত কিছুর পরও নিজেদের সম্পর্কের কথা আরমিনের সামনে কি করে তুলবে সে? কি করে বলবে আরসালকে যে সেও ভালোবাসে! নিজের বোনেরই সামনে তার ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে নিজের জীবন কি করে সাজাবে সে? কি করে বোনের সামনে এসে দাঁড়াবে! যদি আরমিন নিজের বড় কোন ক্ষতি করে ফেলে! সেই অনুতাপের বোজা সারাজীবন বইতে পারবে তো সে!
কারো মন কন্ট্রোল করার অধিকার নেই সায়রার। না আরমিনের , না আরসালের। কিন্তু নিজের মনের উপর তো সেই অধিকার আছে এমন না যে আরমিনকে আরসাল দান করছে। সায়রা স্পষ্ট জানে আরমিন আরসালের মাঝে কোন সম্পর্ক হওয়া অসম্ভব। একদমই সম্ভব না। আরসাল চিরকাল আরমিনকে বোনের চোখে দেখেছে তা সায়রা বেশ জানে। কিন্তু তাই বলে এই না , যেই মানুষটাকে তার বোন জীবন দিয়ে ভালোবাসে সেই মানুষটাকে নিয়ে তারই চোখে সামনে সংসার সাজাবে। এত সাহস সায়রার নেই। চিরকালই তো অনুতাপের বোজা টেনেছে সে। আর কত টানবে! নতুন করে সেই বোজা বাড়াতে চায়না। সারাজীবন তো আরমিনের অপ্রাপ্তির কারণ হয়ে এসেছে সে। এখন নতুন করে আরমিনের আজাব হতে চায় না। সম্পর্কের সমীকরণ গুলো এলোমেলো হয়ে গেছে সব। বিচ্ছেদই তার এক মাত্র ফল। সায়রার নিয়তিতে হয়তো আরসাল লিখাই নেই। তাই তো বারংবার বিচ্ছেদ। এই সম্পর্কটাকে হয়তো এখানেই ইতি টানা আবশ্যক! সারারাত ভাবল সায়রা। খুব ভাবল। সবশেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছাল। এই সম্পর্ক রাখা যায় না। বিচ্ছেদেই সবার মঙ্গল। কি হবে ভালোবাসা না পেলে। পৃথিবীতে কত মানুষই তো আছে যাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পায়নি। সায়রার ভালোবাসাটা না হয় অপূর্ণই রইল। সম্পর্কের ইতি টানছে ভালোবাসার তো নয়! নীরবে নিভৃত ভাবে চিরকাল ভালোবাসলে ক্ষতি কি!

.
প্রভাত বেলা। সব গুছিয়ে অফিসের রওনা হচ্ছে সিন্থিয়া। বাড়ি ফাঁকা। গত দুইদিন শাশুড়ি রাগ করে বাড়ি ছেড়ে বোনের বাড়ি উঠেছে। আরমিন পাখি গেছে শাশুড়ির মান ভাঙিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে। আরমিন তুর্জয়কে বিয়ে করতে অমত প্রকাশ করেছে , মূলত তা কেন্দ্র করেই রাগ! অবশ্য আরমিনের অমতের ব্যাপারটা সিন্থিয়াকেও বেশ ভাবাচ্ছে। এত ভদ্র পার্ফেক্ট ছেলে তুর্জয়। তুর্জয়কে রিজেক্ট করার কারণ কি আরমিনের? প্রেমঘটিত ব্যাপার নয় তো আবার! এদিকে সায়রাটাও বেশ চুপচাপ শান্ত হয়ে গেছে। হসপিটাল থেকে ফিরে একদম নেতিয়ে গেছে। সারাক্ষণ মন মরা হয়ে ঘরে পড়ে থাকে। কারণ জিজ্ঞেস করলে ব্যাপারটা এড়িয়ে যায়। কি হয়েছে মেয়েটার! বাড়িতে তার অগোচরে কিছু তো চলছে। যা তিনি জানেন না। এসব ভাবনার মাঝেই সায়রার ঘরে এসে পৌছাল সিন্থিয়া। লাল ফ্লোরাল ডাবল কম্বলে নাক মুখ ঢেকে ঘুমাচ্ছে সায়রা। কদিনে চোখের নিচে কালি জমে গেছে। চোখ সারাক্ষণ নিদ্রাজড় লাল। যেন কতরাত ঘুমায় না যেন! বড্ড মায়া হলো সিন্থিয়ার। মেয়ের চুলে আঙুল গলিয়ে ধীর স্বরে ডাকল। পিটপিট আড়ষ্ট চোখ সায়রা। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,

–” কিছু বলবে মা?”

–” আমি অফিসে যাচ্ছি দরজা বন্ধ কর। আর শুন টেবিলে নাস্তা রেডি আছে। বিছানার পাশে ফল রেখে যাচ্ছি। সবটা শেষ করবি। কেমন?”

সায়রা স্মিত হাসার চেষ্টা করল,

–” আচ্ছা মা”

মায়ের পিছুপিছু ঘুমে ডুলতে ডুলতে দরজা অবধি গেল সায়রা। মাকে বিদায় দিয়ে দরজা বন্ধ করে। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে নিলো। মুখে খাবার দিতেই চোখেমুখে বিরক্তি ফুটে উঠল। যেন তেতো বিষ গিলছে। গা গুলিয়ে আসছে। কিছুটা সময় নিয়ে জোর করেই দু লোকমা মুখে দিলো। তাকে বাঁচতে হবে, এই প্রাণহীন শরীরকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নিজের জন্য না হলেও বাবা মায়ের জন্য বাঁচিয়ে রাখতে হবে। খাবার এঁটো করে টেবিল ছেড়ে উঠল সায়রা। হাত ধুয়ে নিজের বিছানায় গা হেলাতেই ডোরবেল বেজে উঠল। ছোট নিশ্বাস ছেড়ে বিছানা ছেড়ে দরজার দিকে পা বাড়াল। নিশ্চয় কাজের খালা এসেছে। সায়রা ভাবলেশহীন দরজা খুলল। বিপরীত পাশের মানুষটাকে দেখে বেশ চমকাল, ভড়কাল! কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করল না। মুখের উপর দরজা লাগাতে লাগাতে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,

–” বাড়িতে কেউ নাই আরসাল ভাই! পরে আসবেন ।”

আরসাল হাত দিয়ে দরজা আটকাল। ঠেলে ভিতরে এসে। দরজা বন্ধ করে সামনে এগোতে এগোতে গম্ভীর আওয়াজে বলল,

–” আমার প্রয়োজনটা তোর সাথে! ”

সায়রা আরসালের দিকে তাকাল না। শরীর কাঁপছে তার। পায়ে পায়ে বারি খাচ্ছে। পেছন ফিরে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে উত্তর দিলো,

–” আপনি চলে যান। সবাই আসুক, পরে কথা হবে।”

আরসাল সায়রার পিছুপিছু সায়রার ঘরে আসল। সায়রা মুখ ফিরে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। এই মানুষটার দিকে তাকানোর বিন্দু মাত্র সাহস নেই তার। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল আরসাল। সায়রার এভাবে মুখ লুকানো তার রাগ তিন গুন বাড়িয়ে দিলো। সায়রার হাতের বাজু টেনে মুখোমুখি দাঁড় করাল। ধমক দিয়ে উঠল,

–” সমস্যা কি তোর? এভাবে এড়িয়ে চলছিলস কেন আমাকে?”

সায়রা নিরুত্তর! গলায় থুতনি ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখজোড়া ফ্লোরে যেয়ে ঠেকেছে। আরসালের তাতে রাগ হলো। প্রচণ্ড রাগ। আচমকা সায়রার থুতনি চেপে মুখ উঁচু করল আরসাল। সায়রা এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে আরসালের দিকে চাইল। উষ্কখুষ্ক অগোছালো চুল। ক্রোধে রক্তিম চোখ। এই অগ্নিদৃষ্টির প্রতাপে এখনি যেন ভস্ম হবে সায়রা। দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত কন্ঠে আওড়াল আরসাল,

–” ফোনের উপর ফোন করছি, ম্যাসেজের উপর ম্যাসেজ! লোকজন দিয়ে খবর পাঠাচ্ছি। কানে যাচ্ছেনা তোর? আমি পাগল হচ্ছি সায়রা।”

এবার সায়রা মুখ খুলল,

–” কেন পাগল হচ্ছেন আপনি?”

–” কারণটা কি তোর অজানা?”

সায়রা নিজেকে আরসাল থেকে ছাড়াল। দুজনের মাঝেকার দূরত্ব বাড়াল। কাঠকাঠ স্বরে বলল,

–” কেন আমার পেছন পরে আছেন আরসাল ভাই? আমার এখন আর আপনাকে ভালোলাগেনা। মন উঠে গেছে। আচ্ছা বলুন তো আমি কি একবারও বলেছি, আমি আপনাকে ভালোবাসি? নিজের থেকে সবটা ধরে নিয়ে, কেন শুধু শুধু বিরক্ত করছেন আমাকে! অন্যকাউকে পছন্দ আমার!”

আরসালের প্রচণ্ড ক্ষেপল। সায়রার চুলে মুঠি টেনে দেয়ালের সাথে মিশাল। ক্রোধে ফোঁসফোঁস করছে আরসাল। তপ্ত নিশ্বাস সায়রার চোখমুখে এসে পড়ছে। ভীরু দৃষ্টিতে চোখ মেলে আরসালের দিকে তাকাল। চোখে তার খুনের নেশা! প্রাণ নিতে যেন এক সেকেন্ড ভাববে না সে। থরথর কাঁপছে সায়রা। চোখে অজস্র জলে ভিড়। গলা শুকিয়ে কাঠ। আরসাল দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

–” ফাইজলামো হচ্ছে? তুই বললি আর আমি মেনে নিবো! তোকে কে বিয়ে করবে? যে বিয়ে করতে আসবে সে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে? শুন সায়রা! আমার টিনেজ প্রেম না! যে প্রেমিকার কথায় গা ভাসিয়ে দেবদাশ বনে যাবো। আমি আমার জিনিশ আদায় করতে জানি। আপসে না পেলে ছিনিয়ে নিবো।”

সায়রা ভয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠল। আরসাল ছেড়ে দিলো। সায়রার ফোনের দিকে চোখ যেতেই ফোন হাতে তুলে সজোরে মাটিতে আছাড় মারল। চুরচুর হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। চিৎকার করে বলল,” যেই মোবাইলে আমার ফোন রিসিভ হয় না, সেই মোবাইল তোর কাছে থাকার কোন মানে হয়না”

সায়রা কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ল। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে মুখ চেপে কাঁদছে। আরসাল আঙ্গুল দিয়ে চুল পিছনে টেনে নিলো। রাগ তখনো দমেনি। চোখ বুজে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল আরসাল। মিনিট দশেক কাটল। সায়রা নিশ্চুপ কেঁদেই যাচ্ছে। ভয়ে কাঁপছে তো কাঁপছেই। আরসাল লক্ষ করল। পানির গ্লাস নিয়ে সায়রার কাছে যায়। সায়রা ভয়ে দূরে সরে গেল। আরসাল মুখের সামনে পানি তুলে শান্ত স্বরে বলল,

“পানিটা খেয়ে নে সায়রা”

ভয়ে ভয়ে ঢকঢক করে পানিটা শেষ করল সায়রা। পাশ থেকে ফলের প্লেটটা হাতে তুলে নিলো আরসাল। শান্ত স্বরে বলল,

–” এগুলো খাসনি কেন? খেয়ে নে। শক্তি মিলবে!”

সায়রা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আরসালের চোখে কি ভালোবাসা! কি মায়া! খানিক পূর্বে এই মানুষটার চোখেই কি খুনের নেশা ছিল? হতভম্ব সে!
এক পিছ আপেল তুলে সায়রার মুখের সামনে ধরল আরসাল।
সায়রা নাকচ করতে চাইল, পারল না। অনিচ্ছাকৃত ভাবে ভয়ে ভয়ে আরসালের হাত থেকে ফল গুলো খেয়ে নিলো।
দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে আছে সায়রা। আরসাল নিমিষ মাতাল দৃষ্টিতে দেখছে। চোখে এক গাঢ় নেশা লাগল। আচমকা, এক টানে সায়রাকে নিজের বুকে মিলাল। নাক গলাল চুলে। ঘ্রাণ টেনে নি্তে নিতে মাতলা স্বরে বলল,

–” হতে পারি তোর জীবনের পড়ন্ত বিকাল, আমার কাছে তুই সর্বদাই সোনালি সকাল। ভালোবাসি পুতুল বউ!”

সায়রা কাঁপছে শুধু। থর থর করে কাঁপছে। এই কন্ঠে কত আবেগ, অনুভূতি, মায়া! কি হলো এত শক্ত আবরনে ঢেকে। এই মানুষটার এক ডাকেই তো সেই আবরন চূর্ণবিচূর্ণ হচ্ছে বারংবার।
বেশ কিছুক্ষণ পর আরসাল সায়রার কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল। গভীর করে! কেঁপে উঠল সায়রা। চোখ মেলল না। ফিসফিসিয়ে বলল আরসাল,

–” এই শরীর নিয়ে ভার্সিটি যেতে হবে না। তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে হবে। প্রোপার রেস্ট নে। ”

সায়রা প্রত্যুত্তর করল না। বসে রইল ঠাই। উঠে গিয়ে বারান্দার দরজা খুলল আরসাল। হসপিটাল থেকে ফিরে এসে এই দরজা মেলেনি সায়রা। কারণ একটাই, আরসাল। ভারী স্বরে বলল আরসাল,

–” ঝড় হোক, তুফান নামুক এই দরজা যেন কখনো বন্ধ না হয় আর!”
তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব- ২৪

(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

চার খণ্ড ভাঙা ফোনটা হাতে নিয়ে বসে আছে সায়রা। জোরা লাগানোর বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে। মোবাইলের উপরের কাঁচটা ভেঙে চুরমার। এইতো তিন মাস হলো ফোনটা কিনেছে। এখনো নতুন। কত পছন্দের ছিল তার। ফোন চালানো বৃথা চেষ্টা করল, হলো না। মন খারাপ করে বসে রইল সায়রা। কেউ জিজ্ঞাস করলে কি বলবে? কিভাবে ভেঙেছে? মুখভার করে গভীর চিন্তায় ডুবে রইল।

দিনের আলো মাড়িয়ে অন্ধকার এসে ঝেঁকে বসেছে। সন্ধ্যার আকাশ। চারিদিক আঁধার কালো, আমাবস্যার রাত! আকাশে নেই কোন তারকারাজি। গলির ব্যস্ত রাস্তা কৃত্রিম আলোয় আলোকিত। মিনিট দুএকের ব্যবধানে সুড়সুড় রিক্সা চলছে। নিকষ কালো অম্বরে বেখেয়ালি চেয়ে আছে সায়রা। আঁখিদ্বয় জলে ছলছল। ভাবনা কাটল কারো উপস্থিতিতে। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই দেখল- আরসাল নিমিষ দৃষ্টিতে অপলক চেয়ে আছে। আরসালকে দেখতেই তড়পান করে উঠল সায়রা। পিছন ফিরে দ্রুত পায়ে সামনের দিকে পা বাড়াতেই। গম্ভীর করে বলে উঠে আরসাল,

–” স্টপ সায়রা! আর একপা বাড়ালে খুব খারাপ হবে!”

এক পাও বাড়াল না সায়রা। ঠাই দাঁড়িয়ে থাকল। আরসাল মুখোমুখি হলো সায়রার। নত মাথায় দাঁড়িয়ে আছে সে।চোখ তার মাটিতে, আরসালের গভীর দৃষ্টি দেখছে সায়রাকে। কৃত্রিম আলোয় নিকষ কালো রাতেও স্পষ্ট মুখশ্রী ফুটে আছে সায়রার। মুখে দ্বিধাদ্বন্দ্বের বলিরেখা তার। চোখে এক সমুদ্র মায়া। কি লুকাচ্ছে মেয়েটা! কেন এত জটিলতা? এই লুকোচুরি খেলাই খেলছে কেন! চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে আরসালের। সায়রার শ্লথ স্বর ভেসে এলো,

— ” কিছু বলবেন আরসাল ভাই? রাত হচ্ছে আমাকে নিচে যেতে হবে।”

আরসাল ছোট এক নিশ্বাস ফেলল। চোখ সরিয়ে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,

–” সমস্যা কি তোর? আমাকে ইগ্নোর করছিস কেন?”

নিরুত্তর সায়রা। সায়রার বাহু চেপে ধরল আরসাল। কাছে টেনে হুঙ্কার দিয়ে বলল,

–” মুখে তালা কেন? কথা কানে যাচ্ছেনা?”

সায়রার চোখ জলে টলটল। ছাড়া পাবার আপ্রাণ চেষ্টা। হাত ছুড়াছুঁড়ি করবে বারংবার। জোর ধমক দিলো আরসাল। শান্ত হলো সায়রা। মাথা নুয়ে নিশ্চুপ কেঁদে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। আরসাল চিৎকার করে বলল,

–” শান্ত আছি মানে এই না আমি তোর সব বেয়াদবি মেনে নিবো। সময় দিচ্ছি নিজেকে প্রস্তুত কর। খুব শীঘ্রই তোদের বাড়ি মা বাবা সম্বদ্ধ নিয়ে আসবে। আমি চাই ভালোয় ভালোয় হোক সব। কোনরকম বাড়াবাড়ি করবি না। আমি রেগে গেলে ফল কত ভয়ংকর হতে পারে নিশ্চয় জানিস?”

আরসালের উত্তরে চিৎকার করে উঠল সায়রা। প্রতিবাদী স্বরে,

–” নিজেকে কি ভাবেন আপনি! সবাই আপনার গোলাম! আপনি যা বলবেন তাই শুনতে হবে সবাইকে? কতবার বলবো আমার আপনাকে পছন্দ না। একদম পছন্দ না। ঘৃণা করি আপনাকে। আমি জাস্ট আপনার সাথে টাইমপাস করছিলাম। আপনি আমাকে অপমান করেছেন, তাই আমি প্রেমের নাটক করে কষ্ট দিকে আপনাকে তা সুদেআসলে ফিরাতে চেয়েছি। আপনি কেন বুঝেন না আমি আপনার প্রতি বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্টেড নাহ!”

ক্ষেপে গেল আরসাল। নিজের কাছে টেনে, হাত মুড়িয়ে নিজের সাথে চেপে ধরল। আরসালের ফোঁসফোঁস তপ্ত নিশ্বাস পড়ছে সায়রার মুখে। চোখ মুখ বুজে আছে সে। চোখের বাঁধ মাড়িয়ে গাল বেয়ে পড়ছে অশ্রুকণা। খুনের নেশা চেপেছে আরসালের। অন্যহাতে শক্ত ভাবে মুখ চেপে ধরল সায়রাকে। চোখ বুজেই আর্তনাদ করে উঠল সায়রা। শুনল না আরসাল! তাগড়াই গর্জন করে বলল আরসাল,

–” বেশি বাড় বেড়েছিস! শান্ত ভাবে সবটা হেন্ডেল করতে চেয়েছি। কিন্তু তুই করতে দিলি না। এখনি নিচে গিয়ে কাজি ডেকে বিয়ে করব তোকে। চল!”

ছিটকে ছাড়ল আরসাল। মোবাইল বের করে কাউকে ফোন লাগাল। সায়রার হাত টানতে টানতে নিচে নিয়ে যাচ্ছে। ভয়ে হাত পা কাঁপছে সায়রার। কান্নাকাটি আহাজারি করছে সে। হাত ছাড়িয়ে নিজেকে মুক্ত করতে আপ্রাণ প্রচেষ্টা। থামাতে চাইল আরসালকে। পারল না। আরসাল আজ রাগে অন্ধ। সায়রার কান্নাকাটি আহাজারি কোনটাই কানে পৌঁছাচ্ছে না তার! ক্লান্ত হয়ে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে। চিৎকার করে বলে,

–” মরে যাবো আরসাল ভাই! আমাকে কোন কিছু করতে বাধ্য করলে আমি নিজের জান নিয়ে নেবো!”

থেমে গেল আরসাল। পিছন ফুরে দেখল ডুকরে কাঁদছে সায়রা। চোখ গাল অশ্রুতে ভিজে। সায়রার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল আরসাল। আগের মত কান্না করতে করতে বলল সায়রা,

–” আপনি কেন বুঝেন না, আমি আপনাকে ভালোবাসি না। আপনাকে আমার সহ্য হয় না! বিরক্ত লাগে। প্রচণ্ড বিরক্ত! ”

এতটুকু বলেই সায়রা হাউমাউ কাঁদছে। আরসাল ঝুঁকল! গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে শান্ত ভাবে বলল,

–” বিরক্ত? তুই আমার উপর বিরক্ত?”

সায়রা চুপ। আরসাল আবার বলল,

–” আচ্ছা, সব বুঝলাম! কাঁদছিস কেন তুই? তোর চোখ তো অন্য কিছু বলছে। কোনটা মানব তোর চোখের ভাষা নাকি মুখের? ”

সায়রা এবারো চুপ। আরসাল জবাবের অপেক্ষায় থাকল বেশ কিছুক্ষণ। অবশেষে মুখ খুলল সায়রা। কান্নাভেজা আওয়াজে বিরবির করে বলল,

–” আমার আপনার থেকে মুক্তি চাই। আমাকে আমার মত থাকতে দিন আরসাল ভাই!”

গম্ভীর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল আরসাল। সায়রা মাথা নুয়ে কেঁদে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। আরসাল ফোঁস শ্বাস ছাড়ল। সায়রার সামনে একটা ব্যাগ রেখে তেজি স্বরে আওড়াল,

–” ফোন দিতে এসেছিলাম!”

কিছুক্ষণ থেমে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে চেয়ে কন্ঠে গম্ভীরতা এঁটে বলল আরসাল,

— “আজকের পর আর কোন দিন তোকে বিরক্ত করব না সায়রা। তুই মুক্ত!”

তড়াক করে উঠে। বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেল আরসাল। থম মেরে আরসালের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল সায়রা শুধু। আজ নিজের হাতে সব শেষ করে দিলো সে!

.
সেদিনের পর আরসালকে আর দেখেনি সায়রা। আরসালের বারান্দার দরজাটাও বন্ধ। সায়রার খারাপ লাগলেও নিজেকে বুঝিয়ে নিয়েছে সায়রা। যা হচ্ছে ভালোই হচ্ছে। আরসাল ভুল বুঝে দূরে সরে যাক । এটাই তো সায়রা চায়! নিজেকে মিছেমিছি বুঝিয়ে নিয়েছে সে। সামনে ফাস্ট ইয়ার ফাইনাল। পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত সায়রা। ক্লাস, টিউশন, গ্রুপ স্টাডি পর পর শেষ করে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরছে সে। সন্ধ্যা নামতে এখনো অনেকটা সময়। শীতের প্রবণতা তখন আকাশ চুম্বী। চাদরে শক্ত করে হাত মুড়িয়ে , গুটিসুটি পায়ে গলির রাস্তায় হাঁটছে সায়রা। মদির দোকানের পাশে নাইট গার্ড চাচা বসে। গায়ে ছেঁড়া সোয়েটার। মাথায় পুরানো কান টুপিতে ঢাকা। শীতের এই রুক্ষতা থেকে বাঁচতে আগুন জ্বেলে উষ্ণতার ছোঁয়া নিচ্ছে তিনি। সায়রাকে দেখে উৎফুল্ল হেসে বললেন,

–” কই গেছিলা মা?”

–” ভার্সিটিতে চাচা”

–” শরীর গতর ভালানি মা”

–” জি চাচা ভালো, আপনি কেমন আছেন?

–” হ মা ভালা!”

নাইট গার্ড চাচার সাথে টুকটাক কথা সেরে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় সায়রা। হ্ঠাৎ চোখ আটকায় মোরের শেষ মাথায় চায়ের দোকানটার পাশে গাড়িটায়। আরসালের গাড়ি। সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে, দ্রুত পা বাড়াতে যেয়েও থেমে যায় সায়রা। ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে। আরসালের পাশের সিটে আরমিন। আরমিনের চোখ মুখ ফুলে আছে। বার বার চোখ মুছছে। সায়রাদের বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই তড়াক করে নেমে গেল আরমিন। বিষয়টা বেশ খটকা লাগল সায়রার। আরসাল ভাই আরমিন আপুকে রিজেক্ট করেনি তো আবার! ঘাবড়াল সায়রা। আরমিনের পিছু পিছু সায়রাও বাড়িতে গেল।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here