এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব -৫৩+৫৪+৫৫

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৫২

হাসপাতাল থেকে তন্নি অরুনাভ মুখার্জীর সাথে বেরিয়েছে বাড়ি ফিরবে বলে। দিয়ানের কাছ থেকে সরছেই না সালমা বেগম। তৃষাকে রেখে এসেছে তাই তার কাছে। বাড়ি গিয়ে আবার টিউশনিতে যাবে তন্নি। বাসের জন্য মেইন রাস্তাটা পার হতে হবে। অরুনাভ মুখার্জী দেখেশুনে পার হয়ে গেছেন। তন্নি দুবার চেষ্টা করলো এগোনোর। কিন্তু ব্যস্ত সড়ক পার দিতেই পারলো না। হঠাৎই ওর হাত ধরলো কেউ। পাশে তাকিয়ে স্বস্তিককে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তন্নি। স্বস্তিক হাটা লাগালো ওকে নিয়ে। রাস্তাপার হয়ে ছেড়ে দিলো ওর হাত। অরুনাভ মুখার্জী দেখেছেন সবটাই। কিন্তু তার কাছে গুরুত্ব পায়নি বিষয়টা। বাসের জন্য এদিক ওদিক তাকালেন উনি। স্বস্তিক ফোন স্ক্রল করছে আর তন্নি ওর দিকে তাকিয়ে আছে। অরুনাভ মুখার্জীর ফোন আসতেই কল রিসিভ করে একটু পাশে সরলেন উনি। তন্নি বলে উঠলো,

-আপনি আমার হাত কেনো ধরলেন?

ফোন থেকে চোখ তুলে তন্নির দিকে তাকালো স্বস্তিক। বললো,

-আমার মনে হয়েছিলো তোমার হাত ধরে তোমাকে রাস্তা পার হওয়া শেখানো উচিত,তাই ধরেছি। আর স্বস্তিক মুখার্জী যদি মনে করে কোনো কিছু তার করা উচিত,সেটা ও করেই।

তন্নি তাচ্ছিল্যে হেসে মৃদ্যুস্বরে বললো,

-হুহ্! করনীয়!

ধীরে বললেও পুরোটাই শুনেছে স্বস্তিক। হুট করে আবারো তন্নির হাত ধরলো ও। বিস্ফোরিত চোখে তাকালো তন্নি। স্বস্তিক বললো,

-আমার কথাকে তাচ্ছিল্য কেনো করছো তন্নি? যদি এই হাত না ছাড়া আমার করনীয় বলে মনে হয়,আমি কিন্তু একেবারে হাতের মালিককে নিজের করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখি ট্রাস্ট মি।

আটকে ছিলো কিছুক্ষন তন্নি। পাশে অরুনাভ মুখার্জীকে আসতে দেখে ঝাড়া মেরে হাত ছাড়িয়ে নিলো স্বস্তিকের থেকে। সরে দাড়ালো অনেকটা। এ পর্যন্ত স্বস্তিকের সাথে অনেক ঝগড়া করেছে,অনেক ধমকি শুনেছে। কিন্তু ভয় পায়নো। তবে আজকে স্বস্তিকের কথায় ভয় করছে ওর। অজানা কারনে অদ্ভুত একধরনের ভয়। এটা কি ভয়? তবে এমন অদ্ভুত কেনো? যদি ভয় না হয়,তবে এর নাম কি?

আরাব বাসায় ঢুকে দোয়াকে ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজাতে দেখলো। কালো খয়েরী শাড়ি কোমড়ে গোজা,চুল খোপা,কপালের সামনে কিছু পরে আছে। কখনো হাতের পিঠে চুলগুলো ঠেলে দিয়ে চুপচাপ খাবার সার্ভ করছে দোয়া। আরাব ভেতরে না এগিয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখতে লাগলো ওকে। গত কয়েকদিনে কতো কি গেছে ওর উপর দিয়ে,সেটা জানে আরাব। এ কয়দিন দোয়া হসপিটাল,রংধনু দুটোই যথেষ্ট পটুহস্তে সামলেছে। নিজের অপরাধবোধের জন্য সেভাবে কথা বলতে পারেনি ও দোয়ার সাথে। শুধু দিনশেষে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছে দোয়াকে নিয়ে। যদিও দোয়া ওর কাছাকাছি থেকে ওকে বোঝার চেষ্টা করেছে,কিন্তু আরাব নিজেই দুরুত্ব রেখে চলেছে খানিকটা। একটা ছোট শ্বাস ফেলে সোজা ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো ও। ততক্ষনে সবাই খেতে বসে গেছে। তৌফিক ওয়াহিদ আরাবকে দেখে বললেন,

-তুমি কখন আসলে?

-সবেই এসেছি।

কথাটা বলে চেয়ার টেনে বসে গেলো আরাব। তৌফিক ওয়াহিদ দোয়ার দিকে তাকালেন। দোয়া পাশেই দাড়িয়ে। ওর চেহারায় মলিনতা। বললেন,

-তোমার ভাইকে কবে ছাড়ছে হসপিটাল থেকে?

সবাই কিছুটা অবাক হলো। তৌফিক ওয়াহিদ দোয়ার ভাইয়ের খোজ নিচ্ছে,এটা ওদের কাছে অবাক হওয়ারই বিষয়। দোয়া বললো,

-ডক্টর বলেছে আর কিছুদিন সময় লাগবে।

কেনো যেনো দোয়ার এমন মলিন চেহারা,স্থির দৃষ্টি সহ্য হচ্ছে না তৌফিক ওয়াহিদের। তাছাড়া প্রতিদিন সবাই খেতে বললেও দোয়া খেতে বসে না,যতোক্ষন না আরাব বলছে। আজ আরাবও কিছু বলছে না দোয়াকে। তাই উনি এবার আরাবকে কিছুটা কড়াকন্ঠে বললেন,

-তোমাকে নিয়ে বাসায় কেউ অনমনস্ক থাকে,টেনশনে থাকে,সেটা তোমার বোঝা উচিত আরাব।

আরাব চামচ নাড়িয়ে খাবার বাড়ছিলো। বাবার কথায় আটকে গেলো ও। তৌফিকা,মিসেস ওয়াহিদ দুজনেই অবাক। এই কথাটা কিছুদিন আগে আরাব শোনাতো ওর বাবাকে,আর আজ আরাবকেই শোনাচ্ছেন তৌফিক ওয়াহিদ। মুচকি হেসে দোয়ার দিকে তাকালো আরাব। দোয়া এতোক্ষন ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো। চোখমুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না আরাবের। পানসে হয়ে আছে একদম। দোয়ার ভেতরটা যেনো দুমরে মুচড়ে যাচ্ছে ওর ওমন চেহারা দেখে। আরাব বললো,

-তুমি এখনো দাড়িয়ে কেনো? খেতে বসো?

-আপনারা খেয়ে নিন,আমি…

আরাব চেয়ার টেনে দিলো। গম্ভীর ইশারায় দোয়াকে বোঝালো বসতে। চেয়ারটা আরাবের দিকে বাকানো। দোয়া সোজা হয়ে বসে নিজের জন্য খাবার বাড়তে যাবে,আরাব ওর মুখের সামনে নিজের প্লেটসহ খাবার তুললো। বিস্ময়ে পাশে তাকালো দোয়া। ওর চেয়ার আরেকটু টেনে ওকে একেবারে নিজের দিকে ঘোরালো আরাব। দোয়া আশেপাশে তাকালো। তৌফিকা আর মিসেস ওয়াহিদ ঠোট টিপে হাসছে,তৌফিক ওয়াহিদ নিজের মতো খাচ্ছেন। যেনো কিছুই চোখে পরছে না তার। দোয়া চেয়ার টানলো সোজা হয়ে বসবে বলে। কিন্তু চেয়ারের দুপাশে পা দিয়ে আটকে রেখেছে আরাব। দোয়ার মুখের সামনে খাবার তুলে বললো,

-তোমার জন্য খাবার মাখিয়েছি।

-আ্ আরাব…

আরাব খাইয়ে দিলো ওকে। আর ইশারাতেই ওকে চুপচাপ খেতে বললো। মাথা নিচু করে তাই‌ করলো দোয়া। কয়েকবার খেয়ে বললো,

-আর না। প্লিজ।

আরাব থামলো। পানি খেয়ে উঠে দাড়ালো দোয়া। একই প্লেটে নিজের জন্য খাবার নিলো আরাব। ততক্ষনে তৌফিকাদেরও খাওয়া শেষ। তৌফিক ওয়াহিদ,তার মিসেস চলে গেছেন। তৌফিকা উঠে দাড়ালো ঘরে যাবে বলে। টুইঙ্কেল ঘরে একা। মুফতাহিরের নাইট শিফট আজ। দোয়া টেবিল গোছাচ্ছিলো। আরাব খাবার মাখাতে মাখাতে বললো,

-তোর সাথে কথা ছিলো আপু।

-হুম বল।

তৌফিকা থেমে রয়েছে। আতকে উঠলো দোয়া। চেয়ার শক্ত করে ধরে দাড়ালো ও। তৌফিকাকে কি বলবে আরাব? কিভাবে বলবে? ক্ষীনকন্ঠে বললো,

-আ্ আরাব?

থেমে রইলো আরাব। দোয়ার দিকে তাকিয়ে আবারো বোনের দিক ফিরলো ও। বলে উঠলো,

-তুই না বিদেশে পিএইচডি করতে যেতে চেয়েছিলি?

কপাল কুচকে তাকালো তৌফিকা। বিয়ের পর ও মুফতাহির দুজনেই বাইরে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু টুইঙ্কেল আসার পর আর ভাবেনি এসব নিয়ে। আজ হঠাৎ আরাব এসব বলায় বিস্মিত না হয়ে পারলো না ও। বললো,

-হঠাৎ আমার পিএইচডি নিয়ে পরলি কেনো?

-কারন আমি চাই তুই তোর পড়াটা শেষ কর। পাসপোর্ট,ভিসার এপেইল করেছি তোর জন্য। তুই নেক্সট মান্থ দেশের বাইরে যাচ্ছিস তোর পিএইচডি কভার করতে।

বিস্ফোরিত চোখে তাকালো তৌফিকা। চেচিয়ে বললো,

-মানেহ্?

-এক কথা বারবার কেনো জিজ্ঞাসা করছিস আপু? মানেটা বুঝিস তুই। তোর কোনো স্বপ্ন অপুর্ন থাকুক,তা আমি হতে দেবো না। তুই বাইরে যাচ্ছিস পিএইচডির জন্য। দ্যাটস্ ইট!

-পাগল হয়ে গেছিস তুই আরাব? এখন মুফতাহির বাইরে যেতে রাজি হবে বলে তোর মনে হয়?

-মুফতাহির ভাইয়া তো যাচ্ছে না! ইভেন টুইঙ্কেলও যাবে না। তুই গিয়ে পড়াটা কম্প্লিট করে আয়,টুইঙ্কেলকে আমরা সামলে নেবো।

তৌফিকা দোয়ার দিকে তাকালো। দোয়া স্তব্ধ হয়ে গেছে যেনো। কি বলবে,কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। আরাব নিজের মতো খেতে ব্যস্ত। তৌফিকা একটু শান্ত হয়ে বললো,

-তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে আরাব। আমি কোথাও যাচ্ছি না! মুফতাহির,টুইঙ্কেলকে ছেড়ে তো আরো না! যা পাগলামী করেছিস,ক্যান্সেল করে দে!

তৌফিকা চলে গেলো ওখান থেকে। খাবার খাওয়া হলো না আরাবের। দোয়ার দিকে তাকাতেই দেখে ওর চোখ ছলছল করছে। হাত ধুয়ে হনহনিয়ে রুমে চলে আসলো আরাব। না পারবে দোয়ার কান্না থামাতে,না পারবে ওখানে সামনে থেকে ওর কান্না দেখতে। ও জানতো এসবের পর ওর খাওয়া হবে না,আর দোয়াও তখন আর খাবে না। এজন্যই আগে দোয়াকে খাইয়ে দিয়েছে আজ। দোয়াও আসলো ওর পিছন পিছন। রুমে ঢুকে দেখে আরাব থাই গ্লাসের জানালার সামনে দাড়িয়ে। পকেটে দুহাত গুজে বাইরে তাকিয়ে। তৌফিকাকে বাইরে পাঠানো তো বাহানামাত্র। আরাব যে মুফতাহিরকে আইনের হাতে তুলে দিতে চাইছে,সেটা বুঝতে বাকি রইলো‌না দোয়ার। ধীরসুস্থ্যে এগিয়ে গেলো ও আরাবের দিকে। পেছন থেকে জরিয়ে ধরে ওর পিঠে মাথা ঠেকিয়ে বললো,

-প্রতিবার যখন আমি কান্না করতাম,আপনি আমায় আগলে রেখেছেন আরাব। আমি নিশ্চিন্তে আপনার বুকে মুখ গুজে কেদেছি। কিন্তু আপনি কেনো তার বিপরীতে চলছেন,বলতে পারেন?

বুকের উপর থাকা দোয়ার হাতদুটো শক্ত করে ধরলো আরাব। বললো,

-দেখেছো দোয়া? এটুকোতেই আপু অভিমান করলো আমার সাথে।

দোয়া কিছুই বললো না। আরাব পেছন ফিরে মাথা নিচু করে বললো,

-আ’ম সরি দোয়া। বোনের সুখের জন্য অনেকটা বেশি স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম আমি। অনেকটা বেশি। এতোটা বেশি যে,যাদেরকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি,তাদের সবাইকে ঠকাতে শুরু করেছিলাম। প্রত্যেককে ঠকিয়েছি আমি। প্রত্যেককে।

-আপনাকে সরি শব্দে মানায় না আরাব। আপনি কোনো ভুল করতেই পারেন না। আর যাদেরকে আপনি ভালোবাসেন,তাদের জন্য যা করেছেন,সবটা ভালোবাসাই ছিলো আরাব। একে ঠকানো বলে না।

আরাব জাপটে জরিয়ে ধরলো দোয়াকে। দোয়া কিছুটা চমকে উঠেছে ওর এ হেন কাজে। তারপর ওউ জরিয়ে রইলো আরাবকে। আরাব শক্ত করে দোয়াকে নিজের মাঝে মিশিয়ে নিয়ে অস্থিরভাবে বলতে লাগলো,

-আমি সব সামলে নেবো দোয়া। সব! কিন্তু দিনশেষে আমার তোমাকে চাই। তুমি নামক স্বস্তি চাই। আমার পাশে তুমি না থাকলে,আমি হেরে যাবো দোয়া। হেরে যাবো। প্লিজ বি দেয়ার ফর মি। প্লিজ! তুমি ছাড়া আমার নিজেকে অসহায় লাগে দোয়া। প্লিজ এভাবে দুরে রেখো না আমাকে! প্লিজ!

-আপনার ভালোবাসায় দুরে যাওয়ার কোনো পথ আপনি অবশিষ্ট রাখেন নি আরাব। আমার কাছে আপনি ছাড়া কোনো গন্তব্যই নেই। আপনাকে ছাড়া নিজেকে কল্পনা করতে পারি না আমি। দুরে কি করে রাখবো বলুনতো?

দোয়ার কথায় কিছুটা শান্ত হলো আরাব। ওকে ছেড়ে ওর দুগাল ধরলো। দোয়া তাকিয়ে রইলো আরাবের চোখের দিকে। যেটুকো দুরুত্ব ছিলো,সবটা উশুল করে নিতে কাতর ওই চাওনি। একাধারে দোয়ার গালে কপাল,নাকে পাগলের মতো কয়েকবার ঠোট ছুইয়ে আরাব বললো,

-ভালোবাসি।

গোড়ালি উচিয়ে দুহাতে আরাবের চুল মুঠো করে নিলো দোয়া। ঠোটের স্পর্শে ভালোবাসার প্রতিত্তর একে দিলো ভালোবাসি বলা ঠোটজোড়ায়।
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৫৩

একহাত মাথার নিচে রেখে মাথা খানিকটা উচিয়ে দোয়ার দিকে তাকিয়ে আছে আরাব। সকালের স্নিগ্ধ আলো দোয়ার ঘুমন্ত চেহারায় এসে লাগছে। কোকড়া চুলগুলো এলোমেলোভাবে মুখচোখের উপর পরছে। আস্তেকরে সেগুলো হাত বাড়িয়ে সরিয়ে দিলো আরাব। আলতো চুমো একে দিলো ওর কপালে। চোখ মেললো দোয়া। আরাবের হাসিমুখটা দেখে যেনো চারপাশ আলোকিত হয়ে গেলো ওর। মৃদ্যু ধাক্কায় মুখের উপর থেকে সরিতে দিলো আরাবকে। উঠে বসে ছাড়া চুলগুলো খোপা করে বিছানা থেকে নামলো দোয়া। আঁচলে টান অনুভব করে পেছন না ফিরে বললো,

-সকাল সকাল একদম জ্বালাতে শুরু করবেন না সাইন্টিস্ট মশাই!

আরাব উঠে এসে বুকে হাত গুজে সামনে দাড়ালো ওর। বড়বড় চোখে ওর দিকে তাকালো দোয়া। আরাবের হাত খালি। তাহলে আচল আটকালো কোথায়? পেছন ফিরে দেখে আচলটা বিছানার এককোনে পেচিয়ে রাখা। আরাব এগিয়ে দুহাতে কোমড় জরিয়ে ধরলো দোয়ার। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,

-তোমাকে এটুকো জ্বালিয়ে আমার শান্তি হয়না দোয়া। তোমাকে তো লজ্জায় লজ্জায়,আদরে আদরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিতে ইচ্ছে করে। তোমাকে তো…

দোয়া আবারো সরিয়ে দিলো ওকে। গলা ঝেড়ে বললো,

-হ্ হয়েছে হয়েছে। ল্যাবে যাবেন তো?

মুখ কালো করে অন্যদিক তাকিয়ে হু বললো আরাব। ঠোট টিপে হেসে ফ্রেশ হতে চলে গেলো দোয়া। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে আরাব পড়ার টেবিলে বসে চুল উল্টাচ্ছে,মুখে কলম ঢুকিয়ে কিছু ভাবছে আর লেখছে। তৃপ্তির হাসলো দোয়া। এমনটাই করে প্রতিদিন সকালে আরাব। ঘুম থেকে উঠেই নাকি ওর দুচারটে জিনিস মনে পরে যায়,সব ছেড়ে আগে ওগুলোই নোট করে ফেলে। গত কয়েকদিনে ওদের দুজনের মাঝের দুরুত্বে সে রুটিনেও খাদ পরে গিয়েছিলো। গলা ঝাড়লো দোয়া। আরাব ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে উঠে দাড়ালো। তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো কিছু না বলে। দোয়া আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল মুছছিলো। এরমাঝেই ফোন বেজে উঠলো। দোয়া ডাক লাগাতে যাচ্ছিলো আরাবকে। পরপরই মনে পরলো,ফোনটা ওর নিজের। ওর বাবার নির্দোষ প্রমান হওয়ার পর অনেককিছুই পাল্টে গেছে যে। মাথা নেড়ে হেসে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে তাজীনের কল। রিসিভ করে দোয়া বললো,

-হ্যাঁ বলো তাজ। কেমন আছো?

-হুম ভালো। তুই?

-আলহামদুলিল্লাহ। নিরব ভাইয়া? তোমার শশুড়?

-সবাই ভালো আছি। আব্…দোয়া?

-হুম বলো?

-ত্ তোকে কিছু বলার ছিলো।

-হ্যাঁ বলোনা!

-ওই আসলে…হ্যাঁ রে দিয়ান কেমন আছে?

কপাল কিঞ্চিত কুচকে আসলো দোয়ার। মুখে বললো,

-হুম ভালো আছে। সামনের মাসেই ছাড়বে বলেছে ডক্টর।

-ও।

তাজীন চুপ করে গেলো। দোয়ার বিষয়টা ভালো লাগছে না। ব্যস্ততা দেখিয়ে বললো,

-কি হয়েছে তাজ? কোনো সমস্যা?

তাজীন আস্তেধীরে বললো,

-আমি প্রেগনেন্ট দোয়া।

দোয়ার চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে চেচিয়ে বলে উঠলো,

-কি বলছো কি তুমি তাজ?

দোয়ার চিৎকার শুনে ওয়াশরুমের দরজা খুলে রুমে তাকালো আরাব। দরজা খোলার শব্দে সেদিক তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো দোয়া। শুধু তোয়ালে পরে আধভেজা শরীরে আরাব। হাসি থামিয়ে ইশায়ার বললো গোসল সেরে আসুন,আমি ঠিক আছি। আরাব দরজা লাগিয়ে দিলো। তাজীনের সাথে আরো বেশ কিছুক্ষন কথা বললো দোয়া। কথা বলা শেষে কল কেটে আয়নার সামনে দাড়ালো দোয়া। মনটাই ভালো হয়ে গেছে ওর। কিছুদিন পরই তাজীনের কোলে একদম ছোট একটা বাচ্চা আসবে,ওর ছোটছোট হাতপা ছুড়ে খেলবে,আধোআধো গলায় তাজীনকে মা বলে ডাকবে,নিরব খেলবে বাচ্চাটার সাথে,রুম জুড়ে বাচ্চাটার খেলনা,হাসি কান্নার শব্দ। ভাবনার মাঝেই চমকে উঠলো দোয়া। আরাব এসে ওর ঘাড়ে নাক ডুবিয়েছে। পেছন থেকে জরিয়ে ধরে বললো,

-ম্যাম চিৎকার কেনো করেছিলেন ওভাবে?

দোয়া মাথা নিচু করে বললো,

-তাজীন প্রেগনেন্ট আরাব।

আরাব দোয়াকে ছেড়ে দিলো। ওর দিক ঘুরে দোয়া মাথা নিচু রেখেই আচল আঙুলে পেচাতে পেচাতে বললো,

-খুব তাড়াতাড়িই তাজীনের কোলজুড়ে একটা পুচকে থাকবে। তাজীন‌ আদর করবে পুচকেটাকে। পুচকেটা হাসবে,ছোট্ট ছোট্ট হাত পা ছুড়ে ছুড়ে খেলবে। ওর ছোট্ট গালটায়…

ম্যাসেজ টোন আসলো দোয়ার ফোনে। কিছুটা থমকে গেলো দোয়া। যেনো কোনো ধ্যান থেকে বেরোলো ও। আরাবের দিকে একপলক তাকালো। শান্ত দৃষ্টি ওর। চোখ সরিয়ে ফোন হাতে নিলো দোয়া। আরাব চুপচাপ ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গেলো। দোয়া ম্যাসেজ চেইক করে বললো,

-ও্ ওরা বাবার এন্টিডোড যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কোনো মেডিসিন ইন্ডাস্ট্রিকে হ্যান্ডওভার করতে বলছে আরাব।

আরাব পেছন ফিরলো। দোয়ার গালে হাত রেখে মুচকি হেসে বললো,

-আমি বিজনেসের ভাষা বুঝি না দোয়া। কিন্তু আমি তোমাকে বুঝি। আমি জানি,তুমি যা করবে,ভেবেই করবে। আমি আছি তোমার পাশে। সবসময়। এন্টিডোড রংধনু ইন্ডাস্ট্রিতে আসুক বা অন্যকোথাও,আমি যে তোমার সাথেই আছি,এটাতে কোনো সন্দেহ রেখো না প্লিজ। আই‌ লাভ ইউ।

আস্তে করে আরাবের বুকে মাথা রাখলো দোয়া। আরাব ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে নিলো দোয়া। ও জানে,আজকে ওর একটা সিদ্ধান্তে অনেককিছু বদলে যেতে চলেছে। অনেককিছু। কিন্তু এই মাথা গোজার জায়গাটা কোনোদিনও বদলাবার নয়। আরাব,ওরই! ওর পাশে সবসময় ছিলো,আছে,আজীবন থাকবে!

মুফতাহির হসপিটাল থেকে বেরোতেই একটা বেশ দামী গাড়ি ওর সামনে এসে দাড়ায়। মুফতাহির পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলো গাড়িটাকে। পেছন থেকে জারা চেচিয়ে বললো,

-ইউ ব্লাডি রাস্কেল! আমি যে দিয়ানের ওটিতে ঢুকেছিলাম,সেটা আরাবকে বলার সাহস কি করে হলো তোমার? হাউ ডেয়ার ইউ?

মুফতাহির পেছন ফিরলো। জারা যেনো অগ্নিশর্মা হয়ে আছে। আশেপাশে তাকিয়ে শান্তভাবে বললো,

-পাব্লিক প্লেসে সিন ক্রিয়েট করো না জারা। বাসায় যাও।

মুফতাহির পা বাড়াচ্ছিলো চলে আসবে বলে। জারা ছুটে এসে ওর পথ আগলে দাড়ালো। চেচিয়েই বললো,

-সিন ক্রিয়েট? সব সিন তো তুমি ক্রিয়েট করেছিলে মুফতাহির ভাইয়া! আমি আর সিন ক্রিয়েট করলাম কই? আমি কিন্তু সবটা জানি! সবটা! সো ডোন্ট ট্রাই টু মেক মে কোয়াইট! তাতে আমি আরো বেশি বলতে শুরু করবো!

চোখ বন্ধ করে শ্বাস ছাড়লো মুফতাহির। বললো,

-কি চাও কি তুমি?

-চেয়েছিলাম! চেয়েছিলাম! শুধু আরাবকে চেয়েছিলাম! কিন্তু পাইনি! পাইনি আরাবকে আমি!

-আর এজন্য দোয়ার ভাইয়ের ক্ষতি করতে চেয়েছিলে তুমি। ওদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি…

-যা করছিলাম,বেশ করছিলাম। আর যা করবো বলে ভেবেছি,তা তো আমি করবোই। কিন্তু তুমি ঠিক করো নি মুফতাহির ভাইয়া! আমার এগেইনিস্টে না গেলেও পারতে। তাতে তোমারই লস হয়েছে জানোতো? আফসোস! আরাবের কাছে আমার নামটা নিয়ে নিজের পায়েই কুড়ালটা মেরেছো তুমি।

বাকা হেসে শেষ কথাটা বললো জারা। মুফতাহির কপাল কুচকে তাকালো ওর দিকে। জারা একটু এগিয়ে দাড়িয়ে বললো,

-আমি জানি তোমার ভাই ডক্টর সুমন মুফতাহির এখন কোথায় ডক্টর সজল মুফতাহির।

মুফতাহির বড়বড় চোখে তাকালো ওর দিকে। জারা ঘাড় বাকিয়ে বললো,

-ঝাটকা লাগা? দেন লেটস্ মেক আওয়ার গিভ এন্ড টেক ডিল? হোয়াট সে?

হাত মুঠো করে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো মুফতাহির। বললো,

-কি করতে হবে আমাকে?

জারা একটা বিশ্বজয়ের হাসি দিলো। পরপরই তীব্র রাগ ফুটে উঠলো ওর চেহারায়। দাতে দাত চেপে চেচিয়ে বললো,

-আরাব আমার নয়,তো কারো নয়। যাকে আমি পাইনি,তাকে নিয়ে দোয়াকে সংসার করতে দেখতে পারবো না। আমাকে সবার সামনে চড় মেরেছে আরাব! ওর জন্য আমাকে কলেজ থেকে রাস্টিকেট করা হয়েছে! আমাকে…আমাকে ধমকি দিয়েছে ও! হিসেব আর পরিনতির ধমকি! তার আগে আমিই হিসেব নেবো সবটার! শেষ করে দেবো সব! শেষ করে দেবো!
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৫৪

-বাবার বানানো এন্টিডোডের ফর্মুলা শশুড়ের ফার্মাইন্ডাস্ট্রিতেই তো দেবে সাফাত রওশনের মেয়ে। এটা তো আমরা সবাই জানি। কালিংয়ে এসে অন্য মেডিসিন ইন্ডাস্ট্রিকে চাহিদা বুঝিয়ে এতো ফর্মালিটি দেখানোর কি আছে? শেষমেষ তো সেই শশুড়ের কোম্পানিতেই যাবে ফর্মুলা!

আজকে দোয়া ফর্মুলা হ্যান্ডওভার করবে বলে বায়োমেডিতে মেডিসিন ইন্ডাস্ট্রির মালিকেরা এসেছে সবাই। সবে বায়োমেডিতে বাইক পার্ক করেছে আরাব। এরমাঝেই ওর বাইকের পেছনে দোয়াকে দেখে আশেপাশের মানুষগুলো কানাঘুষা করতে শুরু করলো। দোয়া কিছুই বললো না। শুধু মুচকি হেসে বাইক থেকে নামলো। হাতের ফাইলটা বুকে জরিয়ে দাড়ালো ও। একনজর তাকালো ওর জন্য উৎসুক হয়ে বসে থাকা বড়বড় বিজনেসম্যানদের ঢলের দিকে। খানিকটা তাচ্ছিল্যেও হাসলো। আজকে ওর মতো একটা সাধারন মেয়েকে নিয়ে কতো কি! যে মানুষটাকে সবাই মিলে অপমান করতে করতে সুইসাইডের দিকে ঠেলে দিয়েছিলো,তারই আবিষ্কার হাসিল করার জন্য কতো কি! আশেপাশের কথা শুনে আরাব শক্ত হয়ে বাইকেই বসে। ওর দিকে তাকালো দোয়া। বুঝলো ওর রাগের কারনও। ওর কাধে হাত রেখে বললো,

-নামুন?

বাইক ছেড়ে নামলো আরাব। দুজনে এগোলো ভেতরে। দোয়াকে অভ্যর্থনা জানানো শেষে বসতে বলা হলো। আশেপাশে আরাবকে খুজলো দোয়া। আরাব ততোক্ষনে এপ্রোন পরে ওর পাশে এসে দাড়িয়েছে। দোয়া কিঞ্চিত বিস্ময়ে তাকালো। আরাব মুচকি হেসে বললো,

-আমি এখানে তোমার বর বা রংধনুর প্রতিনিধি হয়ে আসি নি দোয়া। বায়োমেডিতে আমারও নিজস্ব কিছু দায়িত্ব আছে।

দোয়া সুন্দর একটা হাসি দিয়ে মাথা উপরনিচে নাড়ালো। চলে আসছিলো ও। আরাব পিছুডাক দিলো ওকে। দোয়া পেছন ফিরতেই আরাব বললো,

-এখনো অবদি তোমাকে বলেছি,এন্টিডোড কাকে দেবে,সেটা সম্পুর্ন তোমার সিদ্ধান্ত দোয়া। কিন্তু শেষমুহুর্তে আমি আমার সিদ্ধান্তটাও তোমাকে জানাতে চাই।

ঠোট আটকে হাসি আটকালো দোয়া। ও জানে আরাব কি বলতে চাইছে। মুখে বললো,

-হ্যাঁ বলুননা।

-আমি‌ চাইনা তুমি ফর্মুলা রংধনুকে হ্যান্ডওভার করো। রংধনু টাকা ছাড়া আর কিছু বোঝে না দোয়া। তোমার বাবার কষ্ট,ইচ্ছে কোনোটারই মুল্যায়ন হবে না রংধনুতে।

দোয়া মুগ্ধভাবে তাকিয়ে রইলো আরাবের দিকে। পাশ থেকে আরাবের এক কলিগ ডাক লাগালো ওকে। আরাব পেছনে তাকিয়ে দোয়াকে বললো,

-যে কোম্পানিকে দিচ্ছো,সেখানে যেনো তোমার বাবার ইচ্ছের প্রাধান্য থাকে। এন্টিডোড যেনো সর্বনিম্ন টাকায় সেল হয়,এটা এনশিওরের দায়িত্ব কিন্তু তোমার দোয়া। আর আমি জানি তুমি পার্ফেক্ট ডিসিশনটাই নেবে।

মাথা উপরেনিচে নাড়ালো দোয়া। আরাব বেরিয়ে আসলো ওখান থেকে। ওকে বলা হয়েছিলো দোয়ার অনুষ্ঠানে বিজনেসম্যানদের ফর্মুলা নিয়ে প্রেজেন্টেশন দেওয়ার জন্য। ও করেছেও‌ সেটা। তারপর যখন আলোচনা চলছিলো,ফর্মুলা কোথায় কিভাবে যাবে,গেলে উপকারিতা কি,তখনই চলে এসেছে আরাব। বাইরে খানিকটা দুরে দাড়ালো। বাইকে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো মাথা নিচু করে। প্রোগ্রাম শেষে বেরোলো দোয়া। হাসিমুখে আরাবের দিকে এগোলো ও। দোয়াকে দেখেই আরাব বৃহৎ হাসির রেখা আঁকলো ওর ঠোটেও। দোয়া এগিয়ে বললো,

-আরাব এন্টিডোড…

-বাইকে ওঠো। একজায়গায় নিয়ে যাবো তোমাকে।

দোয়া কিছুই বললো না। অবাকও হলো না। মুচকি হেসে ব্যাকসিটে উঠে বসলো বাইকের। বাইক স্টার্ট দিলো আরাব। একটুখানি পথ চলার পরই বুকের দিকটায় দোয়ার হাত অনুভব করে সেদিকে তাকালো ও। বরাবর দোয়া ওর কাধে হাত রেখে বসে। আসার সময়ও কাধে হাত রেখেই বসে এসেছে। পাব্লিক প্লেস বিষয়টা সবসময় দোয়ার কাছে প্রাধান্য পায়,এটা জানে আরাব। কিন্তু এখন হুট করেই ওকে জরিয়ে ওর জ্যাকেটটা খামচে ধরেছে দোয়া। ওর পিঠে মাথাও ঠেকিয়েছে। হাসি প্রসারিত করে বাইক ছুটালো আরাব। দোয়া চুপচাপ ওভাবেই রইলো। গন্তব্যে পৌছে বাইক থামিয়ে আরাব বললো,

-ম্যাডাম আজকে লোকে কি বলবে নীতি উপেক্ষা করলেন যে?

দোয়া মাথা তুললো। আরাবের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

-আপনাকে ভালোবেসে,আপনার হৃদস্পন্দন শুনে,নিজেকে সাহসী করে তুলেছি আরাব। সেখানে লোকে কি বলবে নীতি একেবারে তুচ্ছ!

দোয়া বাইক থেকে নামলো। কিন্তু সামনে থাকা দ্বিতল দালানের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো একপ্রকার। চোখ ভরে উঠলো ওর। ছলছল চোখে আরাবের দিকে তাকালো ও। আরাব পকেটে দুহাত গুজে হাসছে। দোয়া আরেকবার তাকালো সামনে। বড়বড় অক্ষরে দালানের সামনের দিকটাতে লেখা স্বপ্নরঙ আর্ট একাডেমি। একাডেমির ভেতরের প্রায় সবটাই দেখা যায় বাইরে থেকে। কাচের দেওয়ালের ওপারে রঙের মেলা বসেছে যেনো। ছোট বড় সবাই রঙ নিয়ে খেলতে ব্যস্ত,হাসিঠাট্টা,আড্ডামস্তিতে আকাতে ব্যস্ত। বাবা মারা যাওয়ার পর এই প্রথম এখানে আসলো দোয়া। আগে ইচ্ছে হলেই মনের সবটুকো রঙ এসে এটে দিয়ে যেতো এখানে এসে। এখানকার সব রঙ,তুলি,ক্যানভাস উন্মুক্ত ছিলো ওর জন্য। সাফাত রওশন নিজে এই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। দোয়ার আর্টগুলো বিক্রির টাকা রাস্তার ছেলেমেয়েদের দিয়ে দেওয়া হতো। কতো সুন্দর ছিলো দিনগুলো! আরাব এগিয়ে এসে আস্তেকরে বললো,

-তোমার স্বপ্নের রঙ দোয়া। স্বপ্নরঙ!

ওকে জাপটে জরিয়ে ধরে দোয়া কেদেই দিলো। আরাবের প্রত্যেকটা কাজে প্রতিবার নিজেকে আটকানো দায় হয় ওর জন্য। দোয়া জানে,তখন ওই আশেপাশের লোকগুলোর কথা শুনে যাতে ওর মন খারাপ না হয়,ভবিষ্যতে যেনো ওকে এমন কোনো কটু কথা শুনতে না হয়,এজন্যই ও সরাসরি বলেছে এন্টিডোড রংধনুতে না দিতে। আরাবের কথায় এন্টিডোড অন্য কোম্পানিতে দেওয়ায় আরাবের মন খারাপ নেই এটা যে দোয়া বুঝবে,সেটাও জানে আরাব। তবুও এটা বুঝাতে আলাদা,কৃত্রিম হাসি ধরে রেখেছে আরাব। আর সবশেষে,এন্টিডোড অন্য কোম্পানিতে দেওয়ায় দোয়ার গিল্টিফিল কাটাবে বলে ওকে এই আর্ট একাডেমিতে নিয়ে এসেছে। দোয়া হুহু করে কাদতে লাগলো ওর বুকে মুখ গুজে। আরাব ওর চুল মুঠো করে নিয়ে কাতরভাবে বললো,

-কাদছো কেনো দোয়া? কেনো কাদছো? আমার কষ্ট হচ্ছে তো! প্লিজ কেদো না! প্লিজ!

একটা জোরে শ্বাস নিয়ে মাথা তুললো দোয়া। আরাবকে ছেড়ে হাতের পিঠে চোখমুখ মুছে দাড়ালো ও। আরাব মুচকি হাসলো। সালমা বেগমের কাছ থেকে দোয়ার এই আকাআকির সবটা শুনেছিলো ও। দোয়ার দুগাল ধরে বললো,

-তু‌মি এখানে আসবে দোয়া। আগে যেমন আসতে,তেমনই আসবে। আর ছবি আঁকবে। তোমার আঁকা ছবিগুলো যে টাকায় সেল হবে,সে সব টাকা ছেলেমেয়েদের দিয়ে দেওয়া হবে। ঠিক আগের মতো!

আরাবের হাতের উপর হাত রাখলো দোয়া। বললো,

-হ্যাঁ। আসবো আমি! আসবো! তবে তার আগে আমার আরো কিছু দায়িত্ব বাকি আছে আরাব।

আরাব হেসে বললো,

-দিয়ান সুস্থ্য হলেই ওকে বিকেএসপিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে দোয়া। ডোন্ট ওয়ারি। আর মা যেহেতু চিলেকোঠাতেই থাকবেন,ওনার জন্য তোমার বাবার ব্যাংকব্যালেন্স,ফর্মুলা সেলের টাকা,তুমি,আমি আমরা সবাই আছি। তোমার পড়াশোনা বাদ দিয়ে এখানে আসতে হবে না। ফাইনাল এক্সাম পরই না হয় তুমি এখানে এসো? আর রওশন স্যারের ফর্মুলা তো শর্তসাপেক্ষেই মেডিসিন ইন্ডাস্ট্রিতে গেছে। তো ওখানে…

-বাবার ফর্মুলা রংধনু ফার্মাকেমিক্যালসে গেছে আরাব।

আরাব আটকে রইলো কিছুক্ষন। নিমিষেই বিষাদ ছেয়ে গেলো ওর চেহারায়। দোয়ার গাল ছেড়ে অন্যদিক ফিরে শান্তগলায় বললো,

-তোমাকে বলেছিলাম স্বজনপ্রীতি ভুলে যেতে।

দোয়া একদম সামনে এসে দাড়ালো ওর। আবারো ওর দুহাত নিজের গালে নিয়ে বললো,

-আমি স্বজনপ্রীতি দেখাই নি আরাব। আমি তো শুধু আমার বাবার স্বপ্নকে ভালোবেসেছি।

-কিন্তু রংধনু ফার্মাকেমিক্যালসে কোনোদিনও তোমার বাবার স্বপ্নপুরন পসিবল না দোয়া! ওরা কোনোদিনও লোয়েস্ট রেটে এন্টিডোড লঞ্চ করবে না!

-আপনার এই “ওরা” সম্বোধনের দায়িত্বে এখন আমি আরাব।

বিস্ফোরিতো চোখে আরাব তাকালো দোয়ার দিকে। দোয়া মুচকি হেসে বললো,

-আপনার মনে আছে? একবার বলেছিলেন,আপনার বাবাকে নাকি বোঝার কেউ নেই। আপনার বাবা তাকে বোঝার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছে আরাব। গতকাল রাতে যখন তার ঘরে তাকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়েছিলাম,উনি আমাকে মা বলে ডেকেছেন আরাব। উনি কেদেছেন আমার কাছে। স্বীকার করেছেন,তাকে বোঝার সত্যিই কেউ নেই। রংধনু ফার্মাকেমিক্যালসের এমডি পদবীটা তার এই মায়ের কাছে উনি দিয়ে দিয়েছেন আরাব। উনি চান আমি নিজের মতো করে এন্টিডোড লন্চের সবটা লিড করি। সেটা যতো স্বল্পদামে সম্ভব। বিনিময়ে তার এমন কাউকে চাই,যে তাকে বুঝবে,বুঝাবে। তার আমাকে চাই আরাব। তাকে বোঝার মতো এই মাকে চাই তার। আর আমি তাকে মানা করতে পারি নি আরাব। নিজেহাতে এন্টিডোড লন্চ করাবো,বাবাকেও পাশে পাবো,একসাথে দুটো জিনিস পাওয়ার লোভ আমি সামলাতে পারি নি আরাব। লোভী হয়ে গিয়েছি প্রচন্ড! প্রচন্ড লোভী!

আরাবের চোখ খুশির পানিতে ভরে উঠেছে। ঠোট কামড়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে সামলানোর চেষ্টা করছে ও সেই অশ্রুকে। দোয়া কান্নার মধ্যেও হেসে দিয়ে বললো,

-এবার বুঝুন সাইন্টিস্ট মশাই! খুশির কান্না আটকানো কতো কষ্টের!

কয়েকবার দোয়ার চোখেমুখে চুমো দিয়ে হেচকা টানে ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো আরাব। দোয়া ওর বুকে মুখ গুজে রেখে বললো,

-আমি লোকে কি বলে নীতিতে বিশ্বাসী নই আরাব। আমি তো যেটা ঠিক,সেটাই করনীয় নীতিতে বিশ্বাসী। আপনার মতো।

দোয়ার চুলে আরো দুবার চুমো দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো আরাব। কিছুক্ষন পর দোয়া বললো,

-লোকে কি বলবে নাইবা ভাবলেন,রাস্তায় এভাবে জরিয়ে থাকা কি করনীয় আরাব?

আরাব হেসে ছেড়ে দিলো ওকে। দোয়া মুগ্ধ হয়ে ওর হাসিমুখটা দেখতে লাগলো। দুদন্ড দৃষ্টিবিনিময়ের মাঝেই ফোন বেজে উঠলো আরাবের। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলো আরাব। খুশিতে আপ্লুত চেহারায় হঠাৎই কঠোরতা ফুটে উঠলো ওর।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here