এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব -৪৯+৫০+৫১

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৪৯

মায়ের কোলে মাথা রেখে নিচে বসে দোয়া। সালমা বেগম নিথর হয়ে বসে। তার দৃষ্টি মেঝেতে স্থির। আরাব পাশেই দাড়িতে। অরুনাভ মুখার্জী,স্বস্তিক,তন্নি,তৃষাও আছে। দোয়ার ফোন পেয়ে অরুনাভ মুখার্জী সবাইকে নিয়ে চলে এসেছেন। হসপিটালে আসার কথা শুনেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন সালমা বেগম। অনেককষ্টে তাকে বুঝিয়ে এনেছেন অরুনাভ মুখার্জী। আসার পর দিয়ানকে সাথে করে চলে যায় দুজন ডক্টর। অবুঝের মতোন কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে অস্থির হয়ে পরেন সালমা বেগম। কেনো কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দিয়ানকে। এই ভয়টাই এতোদিন পেয়ে এসেছিলো দোয়া। কিভাবে ভাইয়ের এতোবড় অসুস্থ্যতার কথা মাকে বলবে ও। জলভরা চোখে আরাবের দিকে তাকালে সে মাথা নাড়িয়ে আস্বশ্ত করলো ওকে। দোয়া শক্ত হয়ে মায়ের দুকাধ ধরে বললো,

-শান্ত হও মা।

-দ্ দোয়া? দিয়ানকে কোনো নিয়ে গেলো ডক্টর? হসপিটালে কেনো আসলাম আমরা? দিয়ানকে কেনো নিয়ে গেলো? আ্ আমাকে কিছু বলছিস না কেনো? ওনারা…

দোয়া অসহায় হয়ে পরলো। দুফোটা চোখের জল ফেলে বললো,

-একটু শান্ত হও মা? বলছি সবটা। একটু শান্ত হও?

-আরে বলবি তো দিয়ানকে কোনো নিয়ে গেলো! আসছে না কেনো এখনো? আমরা হসপিটালে থেকে কি করবো? চল চল! দিয়ানকে নিয়ে ফিরবো চল! অরুনাভ দাদা? আপনি চুপ করে কেনো?

চোখ বন্ধ করে একটা ক্ষুদ্রশ্বাস ফেললো আরাব। এগিয়ে গিয়ে সালমা বেগমের সামনে দাড়ালো ও। নিজেকে শক্ত রেখে বললো,

-মা,ওরা দিয়ানের কিছু টেস্ট করাতে গেছে।

অস্থিরতা কমিয়ে শান্তভাবে আরাবের দিকে তাকালেন সালমা বেগম। দোয়া মাথা নিচু করে কাদছে। আরাব জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে সালমা বেগমের দুহাত মুঠো করে নিয়ে বললো,

-আজকে দিয়ানের একটা ছ্ ছোট অপারেশন হবে মা।

বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন সালমা বেগম। দোয়া ওভাবে মাথা নিচু করেই কাদছে। তন্নি তৃষাও বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে ওকে ধরলো। সালমা বেগম কম্পিতকন্ঠে বললো,

-অ্ অপারেশন মানে?

আরাব ওনাকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। আরো শক্ত করে তার হাত মুঠো করে মেঝেতে বসে বললো,

-দিয়ানের হার্টে একটা ছোট ফুটো আছে মা। এজন্যই ওর এতো ফিজিকাল কম্প্লিকেশনস্ ছিলো এতোদিন। এ অপারেশনটা করালেই…

সালমা বেগম দোয়ার দিকে তাকালেন। দোয়া মাথা নিচু করে ফোপাচ্ছে। আরাব আরো কিছু বলছিলো। তা না শুনে সালমা বেগম উঠে দাড়ালেন। দোয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে শান্ত গলায় বললেন,

-তুই আগে থেকেই জানতি দিয়ান স্বাভাবিক না।

-ম্ মা আমি….

দোয়ার নতমস্তকের উত্তর দেখে এবার শব্দ করে কাদতে লাগলেন সালমা বেগম। ওর দুকাধ ধরে ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে বলতে লাগলেন,

-আর কতো? আর কতো করবি তুই? আর কতোভাবে নিজের মাঝে এতোটা শুষে নিবি তুই? খেয়ে না খেয়ে এতো কষ্ট করে এজন্যই বুঝি টাকা জমাচ্ছিলি? এজন্যই বুঝি দিয়ানের কুটোটা ভাঙাও পছন্দ ছিলো না তোর? এজন্যই বুঝি দিয়ানকে কাছছাড়া করতি না তুই? এজন্যই বুঝি সবটা নিজের উপর নিয়ে আমাদেরকে হাসিখুশি রেখে সুস্থ্য রাখার চেষ্টা করছিলি তুই? হ্যাঁ দোয়া? বল?

মাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো দোয়া। গায়ের জোর নিমিষেই নুইয়ে গেলো সালমা বেগমের। ক্লান্ত স্বরে কাদতে লাগলেন উনি। দোয়া মাকে জরিয়ে রেখেই বললো,

-শান্ত হও মা। সব ঠিক হয়ে যাবে। দিয়ানও ঠিক হয়ে যাবে।

সালমা বেগম কাদছেনই। তন্নি তৃষাও মুখ চেপে ধরে কাদছে। স্বস্তিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে গলায় থাকা ওদের পবিত্র চিহ্নটা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে রইলো। দোয়াও কাদছে। আরাব এগিয়ে গিয়ে সালমা বেগমকে দোয়ার থেকে ছাড়িয়ে নিলো। দোয়া জলভরা চোখে তাকালো আরাবের দিকে। ওর চোখমুখও লালচে হয়ে আছে। দোয়া বুঝলো,এই কান্নাকাটিতে আরাবও দুর্বল হয়ে পরছে। দু দন্ড অসহায় দৃষ্টিবিনিময় হলো দুজনের। দোয়া হাত তুলে মুছে নিলো চোখের পানি। কিন্তু আবারো টুপটাপ পানি বেরিয়ে আসলো ওর চোখ থেকে। আরাব চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো। একটা শুকনো ঢোক গিলে সালমা বেগমকে বললো,

-মা? একটু শান্ত হন প্লিজ! কিচ্ছু হবে না দিয়ানের। অপারেশনের পরই পুরোপুরিভাবে ঠিক হয়ে যাবে ও। ভরসা রাখুন।

-আর কাদবেন না মা। প্লিজ আর কাদবেন না!

-এখনই দিয়ানকে এখান দিয়েই ওটিতে নেওয়া হবে মা। আপনি যদি এখনো এভাবে কাদতে থাকেন,নিজেকে সামলাতে না পারেন,দিয়ানকে সামলাবে কে বলুনতো?

মাথা তুলে আরাবের দিকে তাকালেন সালমা বেগম। একটু থেমে থেকে কি বুঝে চোখমুখ মুছে ফেললেন উনি। এগিয়ে গিয়ে দোয়ার কাধে হাত রেখে বললেন,

-কাদিস না দোয়া। সব ঠিক হয়ে যাবে।

কাদতে কাদতেই ঠোটে আশ্বাসের হাসি ফুটালো দোয়া। একটুপরেই হুইলচেয়ারে বসিয়ে দিয়ানকে আনা হলো করিডরে। সবাই ছুটে এগোলো ওর দিকে। দোয়া ভাইয়ের সামনে হাটুগেরে বসে গেলো। দিয়ান আশেপাশের সবার দিকে তাকিয়ে মুখচোখ পরখ করে নিলো একদফা। আলতোভাবে বোনের গালে হাত রেখে বললো,

-কাদিস না আপুনি। আমার কিচ্ছু হবে না।

চিৎকার করে কান্না পাচ্ছিলো দোয়ার। আরাবও ওর পাশে বসে গেলো। দোয়ার হাত একহাতে মুঠো করে নিয়েছে ও। দোয়া তাকালো ওর দিকে। কিন্তু আরাব দিয়ানের দিকে তাকিয়ে ওর একগালে হাত রেখে বললো,

-দ্যাটস্ লাইক দিয়ান! তোমার এখনো অনেককাজ বাকি দিয়ান! আর সেগুলোর জন্য এখন থেকে,এভাবেই স্ট্রং হতে হবে তোমাকে। ইউ আর স্ট্রং রাইট?

মাথা উপরনিচে নাড়ালো দিয়ান। ওর সামনে থেকে সরে দাড়ালো দোয়া আরাব। সালমা বেগমসহ বাকিসবাই শুধু একটা কৃত্রিম হাসিতে ছেড়ে দিলো দিয়ানকে। ছুটতে ছুটতে হসপিটালে ঢুকলো তাজীন নিরব। নিরব এসে সোজা আরাবের পাশে দাড়িয়ে বললো,

-স্যার? দিয়ান?

-সবে ওটিতে নিয়ে গেছে।

কিছুক্ষন দোয়াকে ধরে দাড়িয়ে রইলো তাজীন। কিন্তু হসপিটালে ঢোকার পর থেকে ওর শরীরটাও ভালো লাগছে না। ফিনাইলের গন্ধে গা ঘিনঘিন করছে ওর। মনে হচ্ছে এই বুঝি জ্ঞান হারায়। সহ্য করতে না পেরে মৃদ্যুস্বরে আমি আসছি বলে সরে আসলো ও। একটু আড়াল হতেই মুখ চেপে ধরে ছুট লাগালো।নার্সের থেকে জেনে কোনোমতে ওয়াশরুম খুজে ঢুকে পরলো। বমি হলো ওর কয়েকবার। চোখে মুখে পানির ছিটে দিয়ে শান্ত হলো তাজীন। কিছুক্ষন চুপচাপ আয়নায় তাকিয়ে রইলো নিজের দিকে। ঠোটের কোনে হঠাৎই লজ্জার হাসি ছেয়ে গেলো ওর।

ওটির সামনে সবাই নিরব অস্থিরতার সাথে যুদ্ধ করছে। তৌফিকা,মিসেস ওয়াহিদও এসে পৌছেছে। দুজনেই দোয়া আর ওর মায়ের কাছে। আরাব খানিকটা দুরে দেয়ালে একহাত রেখে দাড়িয়ে। ওর আরেকহাত থেকে রক্ত ঝড়ছে। কিছুক্ষন আগে কয়েকবার দেয়ালে ঘুষি ছুড়েছে ও। রাগের কারন,মুফতাহির। জরুরি কল এটেন্ড করার জন্য কিছুক্ষনের জন্যই সরেছিলো ও। এসে দেখে তৌফিকা এসেছে। আর হঠাৎই কম্প্লিকেশন দেখা দেওয়ায় অপারেশনের মাঝেই মুফতাহিরকে ভেতরে ডেকেছে ডক্টর। কথাটা শুনে ভয়,রাগ চরম পর্যায়ে পৌছেছে ওর। দুবার দরজায় চেচিয়ে বলেছেও,বেরিয়ে আসো মুফতাহির ভাইয়া! কিন্তু লাভ হয়নি। বেরোয়নি ও। মুফহাহিরও হার্টসার্জন,ভেতরে থাকলে ক্ষতি কি? তৌফিকার প্রশ্নে জবাব দিতে পারেনি আরাব। সরে এসেছে ওখান থেকে। ভয় হচ্ছে ওর। মুফতাহির যদি সুমনকে আটকে রাখার জন্য দিয়ানের কোনো ক্ষতি করে দেয়,সেই ভয়! টুইঙ্কেল আশেপাশেই ঘুরছিলো। রক্ত দেখে আরাবের হাত উপরে তুলে বললো,

-তোমার এখানে কি হয়েছে মামা? রক্ত কেনো?

হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রুমাল দিয়ে বেধে নিলো আরাব। ওটির দরজা খোলার শব্দ কানে আসলো ওর। সবাই এগিয়ে আসলো ডক্টরের দিকে। আরাবও ছুট লাগিয়েছে। অর্ধেক পথে এসে দেখলো মুফতাহির মাস্ক খুলে হাতের গ্লাভস খুলতে খুলতে পাশ কাটিয়ে আরেকজন এপ্রোন পরিহিতার পেছনে চলে গেলো। দোয়া ব্যস্তভাবে ডক্টরকে বললো,

-দিয়ান কেমন আছে ডক্টর? কেমন আছে ও এখন? হঠাৎ…হঠাৎ কি এমন কম্প্লিকেশন হয়েছিলো ডক্টর যে মুফতাহির ভাইয়াকেও…

ডক্টর শান্তভাবে বললেন,

-শান্ত হন আপনারা। হসপিটালে,ওটির সামনে ভায়োলেন্স ক্রিয়েট করবেন না প্লিজ।

দোয়া থামলো কিছুটা। সালমা বেগম কাতরভাবে বললেন,

-বলুন না ডক্টর? আমার ছেলেটা কেমন আছে এখন? বলুননা?

-ডোন্ট ওয়ারি মিসেস রওশন। দিয়ান ভালো আছে। হ্যাঁ ওর কেইসটা অনেকটাই জটিল হয়ে গিয়েছিলো অপারেশন চলাকালীন। আমরা তো ভেবেছিলাম…যাইহোক,হি ইজ আউট অফ ডেন্জার নাও। থ্যাংকস টু ডক্টর মুফতাহির। আমরা তো ছিলামই,বাট হি ডিড হিজ বেস্ট!

আরাব আর একবর্নও শোনেনি। ডক্টর ওর চেনাজানা। ইচ্ছে করেই মুফতাহিরকে ছেড়ে ওই ডক্টরের কাছে দিয়ানকে এনেছে ও। তাই ডক্টর মিথ্যে বলবে,এমনটা সম্ভব না। সোজা পাশের করিডরে হাটতে থাকা মুফতাহিরের কাছে গিয়ে বলে উঠলো,

-কেনো ঢুকেছিলে দিয়ানের ওটিতে?

মুফতাহির আরাবের পেছনে চলে যাওয়া ডক্টরের দিকে তাকালো একপলক। তারপর আবারো আরাবের দিকে তাকিয়ে বললো,

-আমাকে ডক্টর বলেছিলো বলেই ঢুকেছিলাম।

-আজ যদি দিয়ানের কোনো ক্ষতি হয়ে যেতো,আমি কোনোদিনও ক্ষমা করতাম না তোমাকে!

মুফতাহির এপ্রোনটা খুলে বাহুতে ঝুলালো। মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো খানিকক্ষন। তারপর আবারো মাথা তুলে বললো,

-দিয়ান এখন ভালো আছে আরাব। তোমার সাথে দোয়ার বিয়ে হয়ে গেছে। রংধনু গ্রুপে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি আমি। তোমার বোন,টুইঙ্কেল সবাই ভালো আছে আরাব। তুমি যা যা চেয়েছিলে,তাই তাই হয়েছে। এবার তো আমার ভাইটাকে ছেড়ে দাও আরাব? এবার অন্তত সুমনকে ছেড়ে দাও?

আরাব শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো। মুফতাহির ধরা গলায় বললো,

-বাবা,মা মারা যাবার পর থেকে আজ অবদি সুমনকে কোনোদিনও কোনো কষ্টে রাখিনি আরাব। ওর জন্য সবকিছু করতে রাজি আছি আমি। ওকে আর কষ্ট দিও না প্লিজ। প্লিজ ছেড়ে দাও ওকে। প্লিজ?

আরাব চোখ সরিয়ে নিলো। বললো,

-ওকে ছাড়লে ও সোজা পুলিশ কাস্টাডিতে যাবে। আর ওখানে যদি ও কোনোভাবে তোমার নাম নেয় তখন?

-পাপ করেছি,শাস্তি তো পেতেই হবে।

হতাশার স্বরে বললো মুফতাহির। আরাব খিচে উঠে ওর কলার চেপে ধরলো। দাতে দাত চেপে বললো,

-শাস্তি শুধু তুমি পেলে তো হতোই! আমি শান্তি পেতাম তাহলে! কিন্তু তোমার পাপের শাস্তি যে আমার বোন,টুইঙ্কেল দুজনকেই সইতে হবে! আর আমি আমার বোনের চোখের জল দেখতে পারবো না মুফতাহির! দেখতে পারবো না! আপুর খুশির জন্য যা করার দরকার আমি করবো! সুমনকে এভাবেই গুম রাখতে হলে,রাখবো! তোমাকে আজীবন এই দুর্বলতায় দুর্বল করে রাখতে হলে রাখবো! আমি জানি আমি ভুল করছি! আমি জানি এতে পুলিশ,দোয়া এমনকি আপুকেও ঠকানো হচ্ছে! কিন্তু তবুও! তবুও তুমি,সুমন দুই ভাই,রওশন স্যারের এন্টিডোড তোমরা প্লান করে চুরি করেছিলে,তাজীনের কাছে সুমনকে নিজের সিভি দিয়ে তুমিই পাঠিয়েছিলে,আপুকে বিয়ে করেছো রংধনু হাসিল করবে বলে,যা যা করেছো তোমরা দুজন,আমি কিছুতেই আপুকে জানতে দেবো না মুফতাহির! এতে যা হবার,হবে! আপুকে কষ্ট পেতে দেখতে পারবো না,দ্যাটস্ ইট!

আরাব ঝারা মেরে ছেড়ে দিলো ওর কলার। পেছন থেকে স্টিলের ট্রে মেঝেতে পরার শব্দ কানে আসলো ওর। পেছন ফিরতেই চারপাশ থমকে গেলো আরাবের। অপরাধীর মতো জলভরা চোখ নামিয়ে নিলো সামনের মানুষটার দিক থেকে। সে মানুষটাও পাথর হয়ে দাড়িয়ে। সবচেয়ে আপন মানুষটার কাছ থেকে পাওয়া বিশ্বাসঘাতকতার আঘাত যে বড্ড গভীরে আঘাত করেছে তাকে। বড্ড গভীরে!
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৫০

-আপনি আমাকে এভাবে অন্ধকারে রাখবেন,এটা আমার ধারনাতেও ছিলো না আরাব।

দোয়া একদম শান্তভাবে বললো। ওর চোখজোড়া ছলছল করছে। আরাব মাথা নিচু করে দাড়িয়ে। চোখ প্রচন্ডরকম ভাবে চুলকাচ্ছে ওর। জোরে শ্বাস ফেলে যেনো কান্নাকে আটকে দিচ্ছে কোনোমতে। দোয়া একপা দুপা করে এগোলো ওর দিকে। আরাবের সামনে দাড়িয়ে বললো,

-আপনাকে মাথা নিচু করে থাকা মানায় না আরাব।

আরাব মাথা তুললো। ওর চোখমুখ দেখে শাড়ির আঁচল খামচে ধরলো দোয়া। নাকচোখ লাল হয়ে আছে। এই বুঝি কান্না বেরিয়ে আসবে। আর সেই কান্নাকে আটকে রেখেছে আরাব। দোয়ার চোখে চোখ রেখে আরাব বললো,

-যা শুনেছো,ঠিকই শুনেছো। হ্যাঁ,আমিই…এ্ এই আমিই অন্ধকারে রেখেছি তোমাকে। তোমার বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী দুজনের একজনের সত্যিটা সবাইকে জানিয়ে তাকে পুলিশের কাছ থেকে আড়াল করেছি,আরেকজনের সত্যিটাই পুরো দুনিয়া থেকে আড়াল করেছি। হ্যাঁ দোয়া,আমি করেছি এমনটা! আমি করেছি!

বলে আবারো চোখ সরিয়ে নিলো আরাব। নাকটা ডলে একটা শুকনো ঢোক গিললো ও। ভয় করছে ওর। দোয়াকে হারানোর ভয়! দোয়ার মতো একটা মেয়ে,যার বিশ্বাস ভালোবাসা জিততে ওকে এতোগুলো পরীক্ষা দিতে হয়েছে,আজ বুঝি তা নিমিষেই শেষ। নিজের বাবার অপমান ঘুচাবে বলে এতোদিন কতোটা অস্থির ছিলো দোয়া,তা জানে ও। সুমনের প্রতি ঠিক কতোটা ঘৃনা দোয়ার,তাও জানে। আর সেই সুমনকে,ওর বাবার বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদেরকে পুলিশ থেকে সরিয়ে রেখেছে আরাব। এর প্রতিত্তরে দোয়া কতোটা কঠোর হতে পারে,আন্দাজে আসছে না আরাবের। সাহস জুগিয়ে আবারো দোয়ার দিকে ফিরতেই দোয়া বললো,

-আমার কাছ থেকে এই মুহুর্তে ঠিক কি আশা করছেন আপনি আরাব? কি করা উচিত আমার এখন?

আরাবের চোখেমুখে বিস্ময়। দোয়া কাতরভাবে বললো,

-আপনাকে এতোটা ভালোবাসি যে আপনার করা কোনো কাজ অন্যায় সেটা ভাবার আগে নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে আরাব!

-নাহ্! দোয়া তুমি…

-কিন্তু আপনি যা করেছেন তা তো অন্যায়,আইনবিরোধী! আপনি অপরাধীকে পুলিশের কাছ থেকে আড়াল করেছেন আরাব! অপরাধকে লুকিয়েছেন আপনি! আপনি অন্যায় করেছেন আরাব! আপনি অন্যায় করেছেন! আপনি এই মুফতাহিরকে…

দোয়ার উচ্চস্বর। আরাব আশেপাশে তাকিয়ে একহাতে কোমড় জরিয়ে ধরলো ওর। আরেকহাতে ওর মুখ চেপে ধরে বললো,

-হ্ হ্যাঁ হ্যা দোয়া! আমি! আমি অন্যায় করেছি! যা করার সব আমি করেছি! সুমনকে আমি‌ গুম করে রেখেছি! ওকে পুলিশের নাগালের বাইরে আমি রেখেছি! ক্ কিন্তু মুফতাহির কিছু করেনি! তুমি কিছু শোনোনি দোয়া! ও কিছু করেনি!

বিস্ফোরিত চোখে তাকালো দোয়া। আরাবের এই রুপের সাথে ওর একদমই জানাশোনা নেই। একদমই না! আরাব চোখ বন্ধ করে সামলালো নিজেকে। দুহাতে দোয়ার দুগাল ধরে কপালে কপাল ঠেকালো ওর। চোখ বন্ধ করে বললো,

-আমাকে একটু বোঝো দোয়া। প্লিজ একটু বোঝো? আমার আর কোনো উপায় ছিলো না বিশ্বাস করো! আর কোনো উপায় ছিলো না! আমি…আমি সুমনকে সাজা দেবো! কঠিন সাজা দেবো ওকে। যখন ও মুফতাহিরের নাম নেবে না এ শর্তে রাজি হয়ে যাবে,তখন ওকে পুলিশের হাতেও তুলে দেবো। কিন্তু মুফতাহিরকে এসবে জড়াতে দিতে পারবো না আমি দোয়া! ওকে…ওকে প্লিজ ক্ষমা করে দাও তুমি দোয়া! প্লিজ ক্ষমা করে দাও! আমার বোনটার জীবন…

দুহাতে আরাবের বুকে মৃদ্যু শক্তিতে ওকে দুরে সরিয়ে দিলো দোয়া। টপটপ করে পানি গরাচ্ছে ওর চোখ দিয়ে। আর তাতে আরাবের ভেতরটা যেনো কেউ টুকরো টুকরো করে কাটছে এমন অনুভব হচ্ছে। কিছুক্ষন চুপচাপ থাকার পর মুফতাহির এগিয়ে বললো,

-আমার কিছু বলার ছিলো। দ্…

-থামুন! একটা কথা বলবেন না আপনি! একটা শব্দও না!

চেচিয়ে মুফতাহিরকে থামিয়ে দিলো দোয়া। মুফতাহির বিস্ময়ে দোয়াকে দেখছে,দোয়ার কঠোরতাকে দেখছে। ওর দিকে ফিরে দোয়া জোর গলাতেই বললো,

-লজ্জা করছে না আপনার এখানে দাড়িয়ে থাকতে? লজ্জা করছে না? আপনি আর আপনার ভাই শুধু এন্টিডোড চুরির প্লান করেন নি,খুন করেছেন আমার বাবাকে! আপনার জন্যই আমার বাবা সুইসাইড করেছিলো! আপনার জন্য আমার পুরো পরিবার শেষ,আপনার জন্য তাজীনের জীবনটা নষ্ট হতে যাচ্ছিলো,আপনার জন্য রংধনুতে এতো ঝামেলা,আর সবচেয়ে বড় কথা,তৌফিকা আপুকে ঠকিয়েছেন আপনি! ঠকিয়েছেন আপুকে! শুধু খুনি নন আপনি! একটা ঠকবাজও! ঠকবাজ!

একশ্বাসে বললো দোয়া। আরাব ওর দিকে এগিয়ে দিশেহারার মতো করে বললো,

-প্লিজ দোয়া,প্লিজ এসব বলো না। আপু শুনলে…

দোয়া আরাবের দিকে এগিয়ে গিয়ে একদম কাছে দাড়ালো আরাবের। দুহাতে ওর শার্ট মুঠো করে নিয়ে বললো,

-সত্যিটা সত্যিই হয় আরাব! তা একদিন না একদিন প্রকাশ পাবেই! আর ভালো এতেই,এই জঘন্য লোকটার সাথে আরো বেশি জরিয়ে যাওয়ার আগে তৌফিকা আপু সবটা জানুক!

আরাব দোয়ার হাত সরিয়ে দিলো। চুল উল্টে ধরে এদিকওদিক হাটলো। তারপর আবারো দোয়ার সামনে দাড়িয়ে জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে বললো,

-আপুর সবটাই ওর সাথে জড়িয়ে আছে দোয়া। সবটাই! তুমিও জানো তা।

দোয়া আটকে গেলো। ও চায় আরাব আইনবিরোধী কিছু না করুক। ও সুমন-মুফতাহিরের শাস্তি চায়,এটা যেমন সত্য,তেমনি তৌফিকাকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে সুখী রাখতে চায় এটাও চরম সত্য। মুফতাহির একটা ছোট শ্বাস ফেলে বললো,

-আরাব? দোয়া ঠিকই বলছে। তৌফিকার সবটা জানা উচিত।

দোয়া আরাব দুজনেই চরম বিস্ময়ে তাকালো ওর দিকে। মুফতাহির মাথা নিচু রেখে বললো,

-আমি নিজেকে নিয়ে কোনো এক্সপ্লেনেশন দিতে চাইনা। হ্যাঁ,মিথ্যে দিয়েই সবটা সাজিয়েছিলাম আমি। তৌফিকাকে বিয়ের কারন,তৌফিক ওয়াহিদের ধনসম্পদ হাত করা। তৌফিকাকে ভালোবেসে বিয়ে করিনি আমি। মিথ্যে বলেছিলাম।

একটু থামলো মুফতাহির। তারপর মাথা তুলে বললো,

-এসব মিথ্যের মাঝেও একটা সত্য ছিলো আরাব। আমি তৌফিকাকে,টুইঙ্কেলকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেও পারিনা। কোনোদিনও ভাবিনি,ওদের থেকে দুরে থাকবো। টুইঙ্কেলকে ছাড়া নিজেকে ভাবতে পারি না। তৌফিকার অভিমান সহ্য করতে পারি না। তাই প্রতিবার যখনই ওর সাথে ঝগড়া হতো,আমি আমার অজান্তেই ওকে গিয়ে সরি বলতাম। আমার অজান্তেই ওকে মানিয়ে বুকে জরিয়ে ধরতাম। বিশ্বাস করো,ওগুলো আমার ইচ্ছাকৃত ছিলো না। হয়তো তাই…হয়তো তাই ওগুলো নাটক ছিলো না!

….

-দোয়ার আত্মসম্মানের দিকে আঙুল তুলেছিলাম বলে তৌফিকা অনেকগুলো দিন আমার সাথে কথা বলেনি আরাব। ঠিকমতো তাকায়নি পর্যন্ত আমার দিকে। তখন আমিও জেদ করে ছিলাম। এই মেয়েটার জন্য সুমনের সত্যি,আমার সত্যি বেরিয়ে আসতে পারে। ওকে রংধনুতে বউ হয়ে আসতে দিতে পারি না আমি। জেদ করে কথা কাটাকাটি করতাম তৌফিকার সাথে। ঝগড়া করতাম। কিন্তু দিনশেষে আমার ভেতরটা কতোটা ফাকাফাকা লাগতো,তা আমিই জানি। তবুও বলবো,ওকে ঠকিয়েছি আমি। ঠকাচ্ছি! ওকে আমি ভালোবাসতে পারি না।

দোয়া আরাব স্তব্ধ হয়ে গেছে। মুফতাহিরের চোখও ভরে উঠেছে এবার। মুখে একটা কৃত্রিম হাসি টেনে বললো,

-ভুল করেছি। আর তার শাস্তিও আমি পাচ্ছি। আমাকে তো ছেড়ে দিয়েছে আরাব। কিন্তু সুমন ঠিক কি অবস্থায় আছে,আরাব ওকে কেমন রেখেছে তার ধারনা আছে আমার। একমাত্র ভাইয়ের যন্ত্রনা আন্দাজ করতে প্রতিমুহুর্তে মরছি আমি। প্রতিমুহুর্তে! আর আমার সাথে এমনটাই হওয়া উচিত। কিন্তু আমি যেমন দোয়ার অপরাধী,তেমন তৌফিকারও। তাই দোয়ার সাথে তৌফিকারও সবটা জানা উচিত আরাব। তুমি…তুমি সুমনকে ছেড়ে দিও। আমার দিকটা পুলিশ দেখে নেবে। তোমার কিছুই বলতে হবে না তৌফিকাকে।

দোয়া আরাবের বিস্ময় কাটছেই‌ না। দুজনের করনীয় কি তাও বুঝে উঠছে না কেউই। আরাব নিজেকে শক্ত করে বললো,

-চলে যাও এখান থেকে।

-কিন্তু আরাব…

-চলে যাও মুফতাহির! প্লিজ গেট লস্ট!

একটু উত্তেজিতভাবে বলে আরাব দেয়ালে একহাত রেখে দাড়ালো। ঠোট কামড়ে চোখ বন্ধ করে কয়েকবার ঘুষি ছুড়লো দেয়ালে। আগের কাটা জায়গাটা আরো আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। বাধা রুমালটা রক্তে ভিজে উঠেছে পুরোটা। দেয়ালেও রক্ত লেগে যাচ্ছে। দোয়া ছুটে গিয়ে থামিয়ে দিলো আরাবকে। সর্বোশক্তিতে ওকে ঠিক পাশের চেয়ারটায় বসিয়ে দিয়ে মিশিয়ে নিলো নিজের সাথে। ওর কাটা হাত আঁচলে চেপে ধরে বললো,

-আপনি এমন করলে কি করে হবে আরাব? আমি তো জানি,আপনি সবরকম পরিস্থিতি সামলাতে জানেন। আপনাকে এমন কি করে দেখবো আমি?

আরাব একহাতে দোয়ার কোমড় জরিয়ে ধরে ওর পেটে মুখ গুজলো। ডুকরে কেদে দিলো আচমকাই। এই মুহুর্তে ওর নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। দোয়া নিজেও ঠোট কামড়ে কাদছে। কাদতে কাদতে আঁচলে আরাবের হাত বেধে দিলো ও। মুফতাহির খানিকটা এগিয়ে বললো,

-নিজেকে কষ্ট দিও না আরাব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব,তৌফিকাকে সত্যের মুখোমুখি হতে দাও। এতেই সবার ভালো।

-আরেকটা কথা বলার ছিলো। দিয়ানের ওটিতে কম্প্লিকেশনস্ তৈরী হয়নি। তৈরী করা হয়েছিলো।

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো দোয়া। আরাবও মুখ তুলে তাকিয়েছে। মুফতাহির বললো,

-দিয়ানের অন পান্প সার্জারি ছিলো। কেউ একজন ইচ্ছে করে হার্ট লাং মেশিনের রেশিও কমবেশি করেছিলো। আর তাতেই…

আরাব উঠে দাড়ালো। দোয়া বিমুঢ়। একবার মুফতাহিরের দিকে তাকিয়ে আবারো আরাবের দিকে ফিরলো ও। আরাব চোখমুখ মুছে,হাত মুঠো করে পা বাড়াচ্ছিলো ওটির দিকে। পেছন থেকে মুফতাহির বলে উঠলো,

-ওটিতে ঢুকে সবটা চেক আপ দেওয়ার পর এক সুপরিচিত এসিটেন্টকে দেখেছি আরাব। এন্ড ইট ওয়াজ জারা।

মুফতাহিরের কথায় দোয়া যেনো রিয়্যাক্ট করাই ভুলে গেছে। ফাকা মস্তিষ্কে আরাবের দিকে তাকালো ও। আরাবের চেহায়ায় ফুটে ওঠা তীব্র রাগটা দেখে আরো এলোমেলো হয়ে ওর চারপাশ।
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৫১

দিয়ানকে ওটি থেকে বের করে বেডে দেওয়া হয়েছে। কেবিনের সামনে দোয়া,সালমা বেগম,তন্নি,তৃষা,অরুনাভ মুখার্জী,স্বস্তিক,তৌফিকা,মিসেস ওয়াহিদ সবাই আছেন। আরাব ব্যতিত। দোয়া একধ্যানে নিচের দিকে তাকিয়ে। ওকে ধরে পাশেই তাজীন বসে। নিরবও আছে এককোনে। অপেক্ষা। কখন দিয়ানকে দেখতে পারবে সেই অপেক্ষায় সব। অনেকটাসময় পর মুফতাহির আসলো। ওকে দেখেই উঠে দাড়ালেন সালমা বেগম। তৌফিকা বললো,

-কি ব্যাপার মুফতাহির? দিয়ানের সেন্স ফেরেনি এখনো?

মাথা নেড়ে না বুঝালো মুফতাহির। সালমা বেগম কিছুটা ভিতু কন্ঠে বললেন,

-ক্ কোনো সমস্যা বাবা? আমার ছেলেটা…

-কোনো সমস্যা নেই আন্টি। দিয়ান একদম ঠিকাছে। যখনতখনই সেন্স চলে আসবে ওর। আপনি ব্যস্ত হবেন না।

দোয়া তাকালো মুফতাহিরের দিকে। এই মানুষটার জন্যই ওর মা আজ বিধবার বেশে। আর এই মানুষটাই আজ ওর মাকে আশ্বাস দিচ্ছে,ব্যস্ত না হতে। তৌফিকা বললো,

-দেখা করতে দেবে কখন?

-ডক্টর চেক আপ করে জানাবে। শান্ত হও।

তখনই‌ করিডরে ডক্টর আসলো। কোনোদিক না তাকিয়ে কেবিনে ঢুকে গেলো সে। করিডরের সবাই নড়েচড়ে উঠে দাড়ালো। কিছুটা সময় পর ডক্টর বেরিয়ে হাসিমুখে বললো,

-দিয়ানের জ্ঞান ফিরেছে। দেখা করতে চাইছে ওর মা আপুনির সাথে।

খুশিতে কেদে দিলেন সালমা বেগম। তন্নি বললো,

-আমিও দেখবো দিয়ানকে।

-আপাতত আমরা দুজনের বেশি কাউকে এলাও করবো না। বাকিসবকে বলবো,বাইরে থেকেই দেখার জন্য।

ডক্টরের কথায় তন্নি আর কিছু বললো না। ডক্টর দোয়াকে বললো,

-দিয়ানের সামনে কিন্তু একদমই ইমোশনাল হওয়া যাবে না দোয়া।

দোয়া মাথা উপরনিচে নাড়ালো। দু ফোটা চোখের জল ফেলে আস্তেধীরে মাকে নিয়ে কেবিনে ঢুকলো ও। চোখ আবারো জলে ভরে উঠলো ওর। ছোট্ট ভাইটা হাসপাতালের বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে। মাথায় হাইজিন ক্যাপ। পাশেই কতোরকমের ডাক্তারী যন্ত্রপাতি। স্যালাইন চলছে। দোয়ার কথা ভেবে সালমা বেগম নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছেন। কাধে হাত রেখে দোয়াকে বললেন এগোতে। একটা শুকনো ঢোক গিলে দোয়া এগোলো। ভাইয়ের কাছে গিয়ে ওর হাত মুঠো করে ক্ষীন কন্ঠে বললো,

-দিয়ান? এই দিয়ান? আপুনি এসেছে দেখ? দিয়ান?

একদমই ধীরে ধীরে চোখ মেললো দিয়ান। বোনকে দেখেই হাসির রেখা আকা হয়ে গেলো ওর শুকনো ঠোটে। কোনোমতে মুখ দিয়ে বের করলো,

-আ্ আমি ভ্ ভালো হয়ে গেছি। তাইনা আপুনি?

কাদতে কাদতে ওর হাত তুলে ধরে কয়েকবার হাতে চুমো দিলো দোয়া। কান্না থামিয়ে আবারো ওর কপালে চুমো দিয়ে বললো,

-হুম। একদম ঠিক আছিস তুই!

-আ্ আমাকে আর ক্রিকেট খেলতে মানা করবি না তো আপুনি?

দোয়া মাথা নেড়ে নেড়ে বললো,

-না। কোনোদিনও মানা করবো না! কোনোদিনও‌ না! তুই খেলবি! যতো খুশি ক্রিকেট খেলবি তুই! আমি বলছি!

দিয়ান হাসলো। চোখ গেলো আচলে মুখ গুজে কাদতে থাকা ওর মায়ের দিকে। ঠোটের হাসিটা রেখেই বললো,

-আমি ঠিক আছি তো মা! কাজলা দিদির পরিবর্তে দিয়ান কবিতার পরিবেশ তৈরী করছো কেনো?

সালমা বেগম এগিয়ে এসে ছেলের চোখেমুখে কয়েকটা চুমো দিয়ে‌ বললেন,

-আর এইসব বলিস না বাবা! মাকে আর কষ্ট দিস না তোরা!

দিয়ান ইশারা করলো মাকে। সালমা বেগম মুখ এগোলেন। মায়ের গালে চুমো দিয়ে দিয়ান ফিসফিসিয়ে বললো,

-মেয়েকে বিয়ে দিয়েছো। ও আর জ্বালাবে না। ছেলেরও একটা ব্যবস্থা করো?

সালমা বেগম হেসে দিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দিয়ানকে ঘুমোতে বললেন তারপর। দিয়ান চোখ বন্ধ করে নিলে ছেলের পাশে বসে মেয়েকে বুকে জরিয়ে রইলেন সালমা বেগম। বুকজুরে শান্তি তার। চুপচাপ মায়ের বুকে মুখ গুজে রইলো দোয়া। আরাব বেরিয়েছে অনেক আগেই। মুফতাহির জারাকে নিয়ে যা বলেছে,তারপর আরাব কি করবে,কোনোকিছু ভাবতে পারছে না ও। না নিজে পেরেছে এখান থেকে সরতে,না পেরেছে আরাবকে আটকাতে। ওর মাথা জুড়ে শুধু একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে,ঠিক কি করতে চলেছে এখন আরাব?

ক্লাস থেকে বেরোচ্ছিলো জারা। একদমই আচমকা ওর সামনে এসে দাড়ালো আরাব। চমকে দুপা পিছিয়ে গেলো জারা। ঘাড় কিঞ্চিত ঘুরিয়ে আরাব নিচদিক তাকিয়ে। জারা বুকে হাত গুজে দাড়িয়ে বাকা হেসে বললো,

-বাবাহ্? বায়োমেডির সাইন্টিস্ট তাহসানুল আরাব আজ হঠাৎ মেডিকেল কলেজে? আমার সামনে?

আরাব চুপ। আরেকটু এগুলো জারা। মুখ এগিয়ে কিছুটা ফিসফিসিয়ে বললো,

-আমার…কাছে?

আরাব রক্তচক্ষু করে তাকালো ওর দিকে। দাতে দাত চেপে সামলেছে নিজেকে ও। জারা ঠোট কামড়ে হেসে পিছিয়ে গেলো। আরাব বললো,

-দিয়ানের ওটিতে কেনো ঢুকেছিলে তুমি জারা?

জারা ওভাবেই ঠোট টিপে হেসে বললো,

-কি? কে দিয়ান? আর আমি কেনো ওটিতে ঢুকবো?

-কারন তুমি চেয়েছিলে দিয়ানের ক্ষতি হোক। আর তাতে আমার আর দোয়ার মাঝে মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং ক্রিয়েট হোক। তাই দিয়ানের হার্ট লাং মেশিনের রেশিও কমবেশি করেছিলে তুমি!

-কিন্তু আমি তো সবে স্টুডেন্ট! সবে পড়ছি ডাক্তারি। আমাকে তো ওটিতে এলাউ করবে না আরাব!

-ঠিক সেজন্যই তুমি আমার কনসাল্টেন্টের এসিসটেন্ট সেজে ওটিতে ঢুকেছিলে। ওকে সেন্সলেস অবস্থায় ওর কেবিনে পাওয়া গেছে।

জারা দুহাতে আরাবের নজর না লাগে এমন একটা ভঙিমা করে বললো,

-হায়য়য়! এজন্যই তোমাকে এতো ভালোবাসি। সব বুঝে যাও! কেনো যেনো আমার বিষয়ে কোনো কিছুই লুকানো থাকে না তোমার কাছে।

এটুকো বলে আগেরবারের মতোই আরেকটু এগিয়ে বললো,

-তা,নিজের বউয়ের বিষয়ে এভাবেই গভীরে খোজ খবর নাও তো?

-স্টপ সেয়িং ননসেন্স জারা!

-ওকে। ওকে। রিলেটেবল কিছু বলি হুম? তো রিলেটেবল বলতেই মনে পরলো,এসব প্রথমে কে বললো তোমাকে?

আরাব চুপ করে ওর ভঙিমা দেখছে শুধু। জারা আবারো বললো,

-ডক্টর সজল মুফতাহির। তাইতো?

-আর তার সাথে রিলেটেড? উমমম…ডক্টর সুমন!

-আর তার সাথে রিলেটেড…দোয়া। সুমনের প্রায় হয়ে যাওয়া,বা কোনো না কোনোভাবে হয়ে যাওয়া…বউ!

আরাব আর সহ্য করতে পারলো না। সর্বশক্তিতে,সশব্দে চড় লাগিয়ে দিলো জারাকে। ও গিয়ে দেয়ালে লেগে গেছে। গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে রইলো জারা। পাশ দিয়ে ওর ক্লাসমেটরা যাচ্ছিলো। আরাবের কাজে ওরা থেমে গেছে। আরাব ওদের উদ্দেশ্য করে জারার দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো,

-স্টে এওয়ে ফ্রম হেয়ার।

মেয়ে দুটো চুপচাপ চলে গেলো। চুলগুলো ঝাড়া মেরে মাথা তুললো জারা। ঠোটে বৃদ্ধাঙুল ছুইয়ে বুঝলো রক্ত পরছে ওর ঠোট থেকে। কিন্তু মুচকি হাসিটা কমলো না ওর। একহাতে চুলগুলো ঘাড়ের সামনে এনে চুল ঠিক করতে করতে বললো,

-তুমি এভাবে আমাকে ছোবে,ভাবিনি আরাব। কিন্তু একটা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে ঢুকে,ওখানকারই এক স্টুডেন্টের গায়ে হাত তোলার পরিনতিটা,তোমার ভাবা উচিত ছিলো।

আরাব বাকা হাসলো। কপাল কুচকে এলো জারার। ও ইচ্ছে করেই দোয়াকে নিয়ে কথাটা বলেছে,যাতে আরাব ব্যস্ত হয়ে ওর সাথে কিছু করে বসে আর তার দায়ে ওকে ফাসাতে পারে। কিন্তু আরাবের হাসিটায় বিস্ময় ধরা পরলো‌ ওর চোখে। কিছু বলতে যাবে, তখনই এক পিয়ন এসে একটা কাগজ ধরলো ওর সামনে। জারাকে লক্ষ্য করে বললো,

-প্রিন্সিপাল এটা দিয়েছে তোমাকে।

আরো বিস্মিত হলো জারা। আরাব ওটা নেওয়ার জন্য ইশারা করলো জারাকে। কাগজটা হাতে নিয়ে পড়তেই চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম ওর। ওকে কলেজ থেকে রাস্টিকেট করা হয়েছে। সাথে ওর ছাত্রীত্বও বাতিল করা হয়েছে। কারন হিসেবে লেখা,ডাক্তার না হয়েও ওটিতে ঢোকা,ডাক্তারকে অজ্ঞান করা আরো অনেককিছু। চোয়াল শক্ত করে ওর দিকে একপা এগোলো আরাব। বললো,

-আরাবের পরিনতি,দোয়া। আর দোয়ার পরিনতি আরাব। আমাকে পরিনতি শেখাতে এসো না জারা।

জারা রাগে কাপছে। আরাব মুচকি হেসে পকেটে দুহাত গুজে বললো,

-এটা তো স্টার্টিং জারা। যে মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্ট নামে দু সেকেন্ড আগে আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছিলে,সেটাই আগে কেড়ে নিলাম তোমার থেকে। এবার বাকি হিসেব মেটানোর পালা। সেদিন দোয়ার হাতে আঘাত করেছিলে তুমি,সেটা দোয়ার কথাতেই ভুলে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু দিয়ানের ওটিতে ঢুকে সেটাকে তুমিই সুদসমেত মনে করিয়ে দিয়েছো। এন্ড নাও,আরাব ইজ নট গোয়িং টু স্পেয়ার ইউ জারা! যা করেছো,তার পরিনতি আমিই কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দেবো তোমাকে! পাক্কাওয়ালা প্রমিস!

আরাব বেরিয়ে আসলো ওখান থেকে। টপটপ করে চোখের পানি পরতে লাগলো জারার। রাগে হাতের কাগজটা মুচড়ে মুঠো করে নিলো ও। অপমান,রাগে যেনো শরীর ফেটে যাচ্ছে ওর। চেচিয়ে কাদতে কাদতে হাটুতে বসে পরলো ওখানেই।

#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here