সেই মেয়েটি আমি নই _ ৬ষ্ট পর্ব
তুলির ফোনালাপের কিছুই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না বিছানা থেকে। তবুও অতি উৎসুক হয়ে ইশতিয়াক শুনতে গেল না। চোখবুজে চুপচাপ শুয়ে রইল বিছানায়। এক অজানা ভয়ানক আশংকায় বুক ধুকপুক করছে। এই আশংকার মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস হয়ে উঠেনি তার। যতটুকু পারা যায় দূরে থাকবে, একসময় হয়তো সবকিছু তার অগোচরেই ঠিক হয়ে যাবে।
খানিক পর টের পায় তুলি তার পাশে এসে শুয়েছে। চোখবুজেই থাকে সে। এভাবে দু’জনই পুনরায় গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।
ভোরে ইশতিয়াকের ঘুম ভাঙে কপালে কারও হাতের কোমল স্পর্শে। সে ঘুম ঘুম চোখ মেলে তাকায়। তুলি মিষ্টি করে ডাকে,
– ‘উঠুন, নাশতা করবেন।’
বেলকনির দরজা ভেজানো। রাতে বোধহয় তুলি লাগিয়ে আসেনি। দরজার ফাঁক গলে ভোরের মিহি আলো টাইলসে এসে পিছলে পড়ে নৃত্য করছে। সেই আলোয় তুলির চুলগুলো দেখাচ্ছে হালকা লালচে। কি মিষ্টি মুখশ্রী। চুল, ঠোঁট সবকিছুই কেমন মোহময়। ভোরের পবিত্র স্নিগ্ধ চেহারা। যেন সদ্য প্রস্ফুটিত ফুল।
ইশতিয়াক তাকে টেনে বুকে এনে গলায়, চোখে, মুখে এলোপাথাড়ি চুমু খায়। তুলি খিলখিল করে হেঁসে উঠে।
– ‘ছাড়ুন তো, সাত-সকালে কি শুরু করছেন।’
ইশতিয়াক বাধ্য ছেলের মতো ছেড়ে দেয়। বাথরুমে আসে ফ্রেশ হতে। ইশতিয়াকের মনে হলো তুলিকে ছাড়তে বলার সঙ্গে সঙ্গে সে অন্যদিন ছাড়ে না। আজ কেন এমন করলো? তার উপর কি অজানা আশংকার প্রভাব পড়েছে? ঘুড়ির সুতো কি কাটা পড়েছে? ছন্দ কি পতন হচ্ছে? তা হতে পারে না। সে সব সময় একইভাবে তুলিকে ভালোবেসে যাবে। বাথরুম থেকে বের হতেই তুলি টাওয়েল নিয়ে এগিয়ে এলো। ইশতিয়াক হাত বাড়ায়। তুলি পলকে সরিয়ে নেয় টাওয়েল। চোখভর্তি মমতা নিয়ে বুকের কাছাকাছি এসে নিজেই মুছিয়ে দেয় মুখ।
ইশতিয়াকের এই মুহূর্তে তুলির কোমড় জড়িয়ে ধরা উচিত। আদান-প্রদান করা উচিত প্রণয়বাক্য। সম্পর্কে কোনো অশুভ অশংকার প্রভাব পড়তে দেবে না সে। তুলিকে একইভাবে ভালোবেসে যাবে। ইশতিয়াক কোমড় জড়িয়ে ধরে টেনে কাছে নিয়ে কানে ফিসফিস করে বলে,
– ‘জানো, আমি তো বিয়েই করতে চাইতাম না। আমার সঙ্গে কেউ এক বিছানায় থাকবে। আমার সবকিছু ব্যবহার করবে। মানে সর্বপরি আমার সঙ্গেই কেউ আছে। এগুলো আমি মানতে পারতাম না।’
– ‘বলো কি!’
– ‘হ্যাঁ ম্যাডাম। আমি আলাদা বাসা নিয়ে থাকি কেন? বাড়ির কারও সঙ্গে যায় না তাই। সবার সঙ্গে ঝামেলা হয়। আমার বিছানায় কেউ শুইলে মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। আমার প্লেট, গ্লাস সব আলাদা থাকতো।’
– ‘বাবা তাই না-কি। কিন্তু আমার সঙ্গে তো সবই ঠিক আছে। মনে হচ্ছে এত ভালো বর পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি হয় না।’
– ‘শুধু তোমার সঙ্গে আমি এমন। তোমাকে দেখেই প্রথম ভেবেছিলাম বিয়ে করবো। এর আগে চিরকুমার থাকার সিদ্ধান্ত ছিল।
কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের একটা উক্তি আছে, “সবাই তোমাকে কষ্ট দিবে, তোমাকে শুধু এমন একজন কে খুঁজে নিতে হবে যার দেয়া কষ্ট তুমি সহ্য করতে পারবে” তুমিই আমার সেই মানুষ। যার সবকিছু আমার কাছে সহনীয়।’
– ‘কিন্তু আপনি যেগুলো বলেছেন। তাতে তো মনে হয় না কেউ আপনাকে কষ্ট দেয়, মিছেমিছি আপনিই কষ্ট পান। মানুষ সামাজিক জীব। আদিকাল থেকে দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। কিন্তু আপনার বিছানায় কেউ থাকতে পারবে না। প্লেটে হাত দিতে পারবে না, তা কি হয়?’
– ‘এসব আমি জানি, তবুও আমি কেন যেন মেনে নিতে পারি না। কিন্তু তোমার বেলায় সবকিছু ঠিকঠাক। জানো, তোমাদের বাসায় যখন থাকতাম। একদিন বাথরুমে গিয়ে মাথায় শ্যাম্পু দিয়েছি তখনই দেখি পানি নাই। আঙ্কেলের ফোনে কল দিচ্ছি রিসিভ হয় না। তারপর মাথা ধুয়ে গামছা গায়ে দিয়ে তোমাদের কলিংবেল চাপলাম। তখন তুমি দরজা খুলে দিলে, মনে আছে?’
– ‘হ্যাঁ, একদম মনে আছে। কিন্তু এখন তো ছাড়ুন আমাকে। জড়িয়ে ধরে আর কতক্ষণ থাকবেন?’
– ‘আরে আগে শুনো, তখন তুমি দরজা খুলে দিয়ে আমার অবস্থা দেখে মুখ টিপে হেসেছিলে না?’
– ‘হুম, কিন্তু নাশতা করে নিন, তারপর শুনবো।’
– ‘ব্যস্ত হইয়ো না তো, আগে শুনবে তো। মুখ টিপে হাসলে তখন তোমার গালের মাংস ডিমের কুসুমের মতো একপাশে দলা পাকায়..।’
তুলি পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে বললো,
– ‘মানে?’
– ‘আরে তুমি মুখ টিপে হাসলে গালের মাংস চোখের নিচের ওদিকে এইযে এই জায়গায় গিয়ে ডিমের কুসুমের মতো হয়ে যায়। সেদিন দেখেই আমার কামড় দিতে ইচ্ছা করেছিল।’
তুলি কাঁচভাঙা হাসিতে ফেটে পড়ে।
– ‘তারপর?’
– ‘তারপর ভাবলাম এই মেয়েকেই বিয়ে করবো। যখন ব্যাংকে চাকরি হলো তখনই নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম।’
– ‘ঠিক আছে জনাব, কিন্তু এখন নাশতা করুন।’
– ‘হ্যাঁ চলো।’
ইশতিয়াকের মুখোমুখি বসার জন্য তুলি সামনের চেয়ার টানতেই টুংটাং শব্দ করে চেয়ার থেকে চামচ পড়ল মেঝেতে। চামচ এখানে কখন রেখেছিল কে জানে। মাথা নুইয়ে তুলতে গিয়ে ইশতিয়াকের নগ্ন পায়ের দিকে চোখ যায়। একপায়ের ওপর আরেক পা রাখা। কি নান্দনিক দৃশ্য। ফরসা পায়ের বুড়ো আঙুলে পাতলা লোম। পুরুষ মানুষের পাও এতো সুন্দর হয় বুঝি? তুলির ইচ্ছা করছে পা দু’টো কোলে তুলে বিড়ালের মতোন আদর করতে।
– ‘কি হলো টেবিলের নিচে ঘুমিয়ে গেলে না-কি।’
তুলি মুচকি হেঁসে উঠতে উঠতে বললো,
– ‘চুম্বকে আঁটকে রেখেছে।’
– ‘কিসব আবোল-তাবোল বলো।’
– ‘আচ্ছা আপনার পা লম্বা করে আমার কোলে রাখবেন?’
ইশতিয়াক ভুরু কুঁচকে বললো,
– ‘কিভাবে?’
– ‘চেয়ারে বসে আছেন তো। সেখান থেকে বসে আমার কোলে রাখবেন পা।’
– ‘তা কেন।’
– ‘রাখুন না প্লিজ।’
ইশতিয়াক পা লম্বা করে কোলে দেয়। তুলি বা হাতে দু’পা জড়িয়ে ধরে বসে।
– ‘প্রতিদিন এভাবে খাব। আপনি পা কোলে দেবেন।’
ইশতিয়াক মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘কিন্তু আরও কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে আমার পা অবশ হয়ে যাবে। তখন আবার পঙ্গু বলে ছেড়ে চলে যাবে।’
তুলি মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘তা কেন?’
– ‘আমার উরু টেবিলে বেজে গেছে।’
– ‘ইশ আচ্ছা নামান।’
ইশতিয়াক পা নামাতেই তুলি নিজের পা জুতো থেকে বের করে ইশতিয়াকের পায়ের পাতায় রাখে।
– ‘একবার আপনার পা উপরে থাকবে, আরেকবার আমার পা।’
– ‘আচ্ছা।’
– ‘দেখুন ছুটির দু’দিন কেমন চলে যাচ্ছে। কাল থেকে আবার তোমার অফিস।’
ইশতিয়াক কিছু বললো না। খানিক পর তুলি পুনরায় বললো,
– ‘এই শুনুন না, আজ তো শনিবার। আপনার অফিস ছুটি আছে। চলুন না আমাদের বাসায়। আম্মুকে দেখতে ইচ্ছা করছে।’
ইশতিয়াক খানিক ভেবে বললো,
– ‘তোমাকে দিয়ে চলে আসবো। যখন বলবে আবার গিয়ে নিয়ে আসবো।’
– ‘আপনার একা থাকতে সমস্যা হবে না?’
– ‘না, একা থেকে আমি অভ্যস্ত। তবে তোমাকে মিস করবো। আর মিস করলেই চলে যাব সমস্যা নেই।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে জনাব।’
দুপুরে দু’জন বের হয় রিকশা নিয়ে।
– ‘মামা মুগদা যাওয়ার আগে একটা মিষ্টি-মাস্টির দোকান দেখে থামাবেন।’
তুলি চোখ পাকিয়ে বললো,
– ‘তা কেন?’
– ‘দামান যাবে শ্বশুরবাড়ি।’
– ‘ধ্যাৎ আমাদের বাড়িতে বাচ্চা-কাচ্চাও নেই। এসব লাগবে না।’
– ‘তুমিই তো ওই বাড়ির বাচ্চা। যে কি-না খেতে বসে বলে পা কোলে দিন। যেন না দিলে খাবে না৷’
তুলি ফিক করে হাসে।
– ‘তাই বলে বাচ্চা মেয়ে?’
– ‘তো বাচ্চা মেয়ে না? বাচ্চা ছাড়া কেউ বলবে ‘একবার আপনার পা উপরে থাকবে, আরেকবার আমার পা।’
তুলি মুখে হাত দিয়ে খিলখিল করে হাসে,
– ‘তো আমি বাচ্চা হলে কি হলো?’
– ‘বাচ্চা বলেই তুমি যে কয়দিন থাকবে, তারজন্য আইস্ক্রিম, চকলেট এসব নিব।’
দোকানের কাজ সেরে দু’জন খুনসুটি করতে করতে চলে এলো মুগদা। তুলি আগে গেইট খুলে ভেতরে গেল। এখান থেকে প্যাসেজ গিয়ে লেগেছে মেইন দরজায়। বাঁ পাশে বাউন্ডারি ঘেঁষে কিছু ফুল গাছ আর টবে চারা দেখা যাচ্ছে।
তুলি কলিংবেল চাপতেই কাজের মেয়ে এসে দরজা খুলে দিয়ে ‘আপা আসছে’ বলে জড়িয়ে ধরলো তুলিকে। ইশতিয়াক ব্যাগ-প্যাক দিল ওর কাছে। তাকে সিটিং রুমে বসিয়ে তুলি ভেতরে গেল। তুলির মা হুস্না বেগম এলেন। ইশতিয়াক সালাম দিল।
– ‘তোমরা আসবে জানতাম না বাবা। বোকা মেয়েটাও বলেনি। জানলে ওর বাবা বাসায় থাকতেন। তুমিও না-কি আজ থাকবে না।’
– ‘সমস্যা নেই আম্মু, আমি আবার নিতে আসবো তো।’
– ‘থাকবে না কেন বাবা, এখান থেকে তো একটু আগে বের হলে অফিসে যেতে পারবে।’
– ‘আজ একটু কাজ আছে।’
কুশল বিনিময় শেষে তুলি সহ তারা চলে গেলেন।
ইশতিয়াক সিটিং রুমে বসে টিভি দেখছে। কাজের মেয়ে নাশতা দিয়ে গেল। তুলি একটু পরই শাড়ি চেঞ্জ করে সেলোয়ার-কামিজ পরে এলো।
– ‘আহ সেলোয়ার-কামিজ পরতে কি আরাম।’
ইশতিয়াক মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘তাহলে তাই পরবে, শাড়ি পরো কেন?’
– ‘আপনার জন্যই।’
– ‘আমি কিন্তু বেশিক্ষণ বসবো না।’
– ‘কি বলেন খেয়ে-দেয়ে যাবেন।’
– ‘আরে না, আমার কলিগদের সঙ্গে আজ আড্ডা দেবো।’
– ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে।’
– ‘কিন্তু বিদায় তো এখান থেকে নেয়া যাবে না।’
– ‘আব্বু কখন ফিরবে ঠিক নাই। আর আম্মুকে ডেকে দিচ্ছি।’
– ‘আরে না, সেটা না।’
– ‘তো?’
– ‘তোমার রুমে নিয়ে চলো।’
তুলি চোখ পাকিয়ে বললো,
– ‘কেন?’
– ‘বিদায় নেব।’
– ‘তারজন্য রুমে যাওয়ার কি আছে?’
– ‘রুমে নেয়া কি নিষেধ? তাহলে থাক।’
– ‘আরে না চলুন।’
ইশতিয়াক রুমে এসেই দরজা লাগিয়ে দেয় ভেতর থেকে। তুলি আঁতকে উঠে বলে,
– ‘এটা কি হলো?’
ইশতিয়াক মুচকি হেঁসে ওর দিকে এগিয়ে গেল৷ তুলি পিছু যেতে যেতে খাটের কাছে গিয়ে আঁটকে যায়। ইশতিয়াক ওর মুখটা আঁজলা করে ধরে। চোখে চোখ রেখে শ্লথ গতিতে দু’জনের ঠোঁট ঢুকে পড়ে অপর ঠোঁটে। তুলি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ইশতিয়াকের পুরো মুখে চুমু খায়।
– ‘ঠিক আছে এবার যেতে পারি, বিদায় নেয়া হয়ে গেছে।’
ইশতিয়াক পা বাড়িয়ে দরজা খোলার আগেই আবার তুলি জাপ্টে ধরে পেছন থেকে। পিঠে গাল চেপে ধরে থাকে।
– ‘কি হলো?’
তুলি অস্ফুটে বলে,
– ‘যেতে দিতে ইচ্ছা করছে না, থেকে যান প্লিজ।’
ইশতিয়াক ঘুরে তাকে বুকে জড়িয়ে নেয়৷
– ‘আমি কাল আবার অফিস থেকে সোজা চলে আসবো ম্যাডাম, এখন যাই।’
তুলি মাথা তুলে তাকিয়ে বললো,
– ‘আচ্ছা যান, কিন্তু কাল রাতে শিওর আসবেন।’
‘আচ্ছা’ বলে ইশতিয়াক আবার কপালে চুমু খেয়ে বের হয়ে গেল।
ইশতিয়াক কলিগদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে রাতে ফিরেছে বাসায়। খাওয়ার ঝামেলা বাইরেই চুকিয়ে এসেছে। এখন হাত-মুখ ধুয়ে লম্বা ঘুম দেবে। বিছানায় যেতেই এলো তার মায়ের কল। ভালো-মন্দ কথা বলে ফোন রেখে ঘুমিয়ে যায়। ঘুম ভাঙলো অচেনা নাম্বার থেকে কল পেয়ে। ইশতিয়াক তাকিয়ে দেখে ঘড়িতে সাতটা বাজে। বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করলো।
– ‘হ্যালো।’
– ‘আসসালামু আলাইকুম ভাই, আমি রফিক। ওইদিন কাশবনে পুলিশের সঙ্গে ছিলাম। পরনে ছিল হলুদ গেঞ্জি।’
__চলবে__
সেই মেয়েটি আমি নই
লেখা: জবরুল ইসলাম