#শুধু_তুই
—-(সিজন২)
#পর্বঃ১১
#Rifat_Amin
উত্তপ্ত দুপুর। সূর্যের প্রখর তাপে পুরো ঢাকাবাসীর নাস্তানাবুদ অবস্থা। আজ এতোই সুর্যের তাপ যে মানুষজন ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস পাচ্ছে না। তবে ভীষণ দরকারে বের হলেও ছাতাবিহীন তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। অথচ উত্তপ্ত পিচের উপর চলমান রিক্সাগুলো ঠিকই সুর্য রশ্মিকে দমন করে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে ছুটছে।
এখন ফাল্গুনের শেষদিনগুলো চলছে। অথচ বৈশাখ আসতে না আসতেই মানুষজন বৈশাখের ছোঁয়া অনুভব করছে। চারপাশে শুধু রোদের প্রখরতার ছাপ। সেই রোদের মাঝেই পিচঢালা রাস্তার জ্যামে আটকে পড়েছি আমরা। এই গরমে সবার হুলুস্থুল অবস্থা! প্রহরভাই দুমিনিট পরপর মিনারেল ওয়াটারে ঢোক গিলছেন। ভাগ্যিস এসিটা অন করা! নাহলে এতক্ষণে শেষ হয়ে যেতাম। আমি উনার দিকে দৃষ্টি রাখলাম। এখনো শরীরে সাদা শার্ট। যদিও আগেরটা নয়! আচ্ছা প্রহরভাইয়ের কি শুভ্র কালার খুব পছন্দ? আজকাল খুবই এই কালারের ড্রেসআপ নিচ্ছেন উনি? আমি কৌতুহল দমাতে না পেরে বললাম,
‘ শুভ্র কালারটা কি আপনার খুব পছন্দ? ‘ (আমি)
উনি আরেকবার পানি খেয়ে বললেন,
‘ না ‘ (প্রহর)
‘তবে এতো পরেন কেন? ‘ (আমি)
‘কেনো তোর সমস্যা? চোখে সমস্যা হয়? নাকি শরীর খারাপ হয়? (প্রহর)
‘উফফফ। আপনি বড্ড বেশী কথা বলেন। আচ্ছা আর কতক্ষণ লাগবে বাসা পৌঁছুতে? ‘ (আমি)
প্রহরভাই এবার আমার দিকে দৃষ্টি রাখলেন। ভীষণ গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
‘ আগে বল, প্রশ্নটা করা তোর উচিত হয়েছে কি না? তুই জানিস, এই জ্যাম যতক্ষণে না কাটবে, তার এক সেকেন্ড আগেও এখান থেকে বের হতে পারবো না আমরা। তাহলে এরকম একটা উদ্ভট প্রশ্ন করলি কেন? ‘ (প্রহর)
আমি বিরক্ত হলাম। গরমে শরীরে তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেখানে উনার পিন্চ করা জবাবগুলো শরীরের তাপ যেনো আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমি কঠিনচোখে তাকিয়ে বললাম,
‘আপনার প্যাঁচ লাগানো মনের মতো কি আমার মন? আমি বাবা সহজসরল মানুষ!’ (আমি)
ঠিক তখনি প্রহরভাইয়ের ফোন বেজে উঠলো। জ্যামটা একটু কেটেছে। সামনের গাড়িগুলো আস্তে আস্তে চলতে শুরু করেছে। প্রহরভাই ফোনটা রিসিভ করে কানে নিয়ে বললেন,
‘ হ্যাঁ! প্রেম বল ‘ (প্রহর)
ফোনের ওপাশে প্রেমের আওয়াজ শুনতে পেলাম না। প্রহরভাই একটু বিরতি নিয়ে আবারো বললেন,
‘ হ্যাঁ, রশ্নি আমার সাথেই আছে। আচ্ছা তুই টেনশন করিস না। তুই যে বিষয়ে জানতে চাচ্ছিস তা আমি জানি। বাসায় আয়, বিকালে আমি চিটাগং রওনা দিবো, আমার সাথে তুইও যাচ্ছিস। ‘ (প্রহর)
একটু পর ফোনের আলাপ শেষ করলেন প্রহরভাই। সামনের জ্যাম কেটে গেছে দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
‘বাঁচলাম বাবা। কখন বাসা যাবো আর কখন চিটাগং যাবো? ‘ (প্রহর)
আমি আর কোনো জবাব দিলাম না। উনিও আর কোনো কথা না বলে গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলেন। একটু পর ফাইনালি বাসা পৌঁছাতে পারলাম আমরা। হঠাৎ একটা কথা মনে আসলো ‘আচ্ছা কাল আমরা কেনো বাইরে গিয়েছিলাম? উদ্দেশ্যটাই বা কি? প্রহরভাই বা কেনো আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন? “বাসায় যদি জিজ্ঞেস করে কি জবাব দিবেন উনি? ”
—-
‘আচ্ছা তোর সমস্যাটা কি বলবি? ছেলেটা হ্যান্ডসাম, ভালো চাকরিও করে। তাহলে আমি কি ধরে নেবো ঐ বাজে ছেলেটার সাথে তোর কোনো সম্পর্ক আছে? ‘ (সানভি)
সানভির প্রশ্নে অকূলপাথারে পরে গেলো সারা। এবার দেখছি সবাই একেবারে বিয়ে দিতে জেঁকে বসেছে। সারা ইতস্তত করে বললো,
‘ প্রেম কোনো বাজে ছেলে নয় ভাইয়া। ‘ (সারা)
‘ বেশী কথা বললে এক থা’প্পড় খাবি বলেদিলাম। এই বিয়েটা হচ্ছে! এটাই ফাইনাল। ‘ (সানভি)
সারা অধৈর্য্য হয়ে বললো,
‘ বললাম না বিয়ে করবো না। তোমরা কি জোর করে বিয়ে দেবে নাকি আমাকে?’ (সারা)
ঠিক তখনি সারার রুমে ঢুকলো ওর আম্মু। সারার মুখ থেকে এমন কথা শোনামাত্র তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললো,
‘ দরকার হলে তাই দিবো। আর একবার বিয়ে না করে দেখ৷ এক থাপ্প’ড়ে দাঁত ফা’লায় দেবো তোর। ‘ (আম্মু)
সানভি আর ওর আম্মুর কথার চাপে মাথা চেপে বসে রইলো সারা। মায়ের সেই প্রশ্নের জবাবে চিৎকার করে বললো,
‘ হ্যাঁ! এই বিয়ে করবো না মানে করবো না। আমি শুধু প্রেমকেই বিয়ে করবো। শুনছো ভালো করে? আমি বিয়ে করলে একমাত্র প্রেমকেই করবো ‘ (সারা)
সারার কথা শুনে ওর আম্মুর রাগ এবার আকাশ ছুঁলো। বিছানায় এগিয়ে গিয়ে দিকবিদিক চিন্তা না করে সজোড়ে দুটো থা’প্পড় বসিয়ে দিলো গালে। মহুর্তেই নিস্তব্ধ হলো পরিবেশ। মায়ের হাতে কড়া থাপ্প’ড় খেয়ে নিশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হলো সারার। তবুও চোখের পানি যেনো বের হলো না! সানভি এগিয়ে এসে ওর মা’কে আটকে বললো,
‘ তুমি শান্ত হও মা। দরকার হলে লোক ঠিক করে ঐ ছেলেকে রা’স্তায় মা’রবো আমি। আর এই মেয়েকে তো আমি বিয়ে দিয়েই ছাড়বো এবার। আজই বিয়ে হবে! বাবাকে কল দাও তুমি ‘ (সানভি)
সারার মা তবুও শুনলো না। বিছানার পাশে রাখা টেবিলল্যাম্প দিয়েই মাথায় আ’ঘাত করলো এবার। সাথে সাথেই ‘আম্মু’ বলে চিৎকার দিলো সারা। দুচোখ ফেটে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়লো। মাথায় তীব্র আঘাতে মহুর্তেই জ্ঞান হারালো সারা।
——
তিনতলা বাড়িটার নিচে প্রাইভেট কারে বসে আছে মাহিম শেখ। হাতে রাখা জলন্ত সিগারেট। তার পাশেই ড্রাইভিং সিটে বসে আছে মাহিমের এসিস্ট্যান্ট প্রকাশ দে। সে সিগারেটের গন্ধ একদম সহ্য করতে পারে না। তবুও স্যারকে তো আর সিগারেট খেতে মানা করা যায় না। সে সাইডের গ্লাসটা নামিয়ে দিয়ে বললো,
‘ স্যার! এখন কোথায় যাবো আমরা? ‘ (প্রকাশ)
মাহিম সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বললো,
‘ স্টার্ট করে যেদিকে মন চায় যাও। আমি বলে দিচ্ছি তারপর’ (মাহিম)
স্যারের কথামতো গাড়ি চালাতে শুরু করলো প্রকাশ। একটু পর গাড়িটা মেইন রোডে উঠে গেলে প্রকাশ বললো,
‘ স্যার, শুনলাম প্রহর খান নাকি আজ চিটাগং যাচ্ছে। কনসার্ট এটেন্ড করতে ‘ (প্রকাশ)
‘ একদম ঠিক শুনেছো ‘ (মাহিম)
সিগারেটের ধোঁয়া গ্লাসের বাইরে ছেড়ে হালকা শব্দ করে হাসলো মাহিম। প্রকাশ খানিকটা ভয় পেলো সেই হাসিতে। তবুও সাহস নিয়ে বললো,
‘ স্যার, এবার কি কিছু করবেন ভেবেছেন? তবে আমার মনে হয় প্রহর খুব একটা কাঁচা খেলোয়াড় না’ (প্রকাশ)
মাহিম সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেললো। হঠাৎই মুখটা শক্ত করে বললো,
‘ কাঁচা খেলোয়ার হলে কি আমি প্রতিযোগিতায় হেরে যাই? বড্ড পাঁকা সে। ‘ (মাহিম)
কথাটা বলে নিশ্চুপ থাকলো মাহিম। মনে পরে গেলো চারবছর আগের সেই দিনটা। সেদিন ছিলো এক ভীষণ বর্ষার রাত। টিএসসির মোরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাংলাদেশের টপ টেন সিংগার নির্বাচিত অনুষ্ঠান। আমি আর প্রহর ছিলাম সব থেকে প্রতিভাবান আধুনিক গানের শিল্পী। তবে সব কিছুতে প্রহর আমার একটু হলেও এগিয়ে ছিলো। পড়াশোনা থেকে শুরু করে এই গানের যায়গাটাও সে রপ্ত করেছে ভালো করেই। আমি আর প্রহর স্কুল, কলেজের সব অনুষ্ঠানে নাম লেখাতাম। আমাদের মাঝে কোনোকালেই বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়নি। যেদিন ওর সাথে প্রথম ক্লাস ৬ এ ভর্তি হলাম। সেদিনই ফার্স্ট ব্রেঞ্চে বসা নিয়ে একপ্রকার মা’রামা’রি বেঁধে গেলো। তবে সেটা ছিলো জাস্ট স্টার্টিং। তারপর এলো স্বাধীনতা দিবসে ফুটবল প্রতিযোগীতা। সেখানে ওকে প্রচন্ড রাগে ল্যাং মে’রে ফালায় দিয়ে দন্দটা খুব ভালো করেই বেঁধে গিয়েছিলো। তারপর শুরু হলো সব যায়গায় ছোটোখাটো মারামারি। একদিন ওকে রাস্তায় একা পেয়ে বন্ধুদের সাথে নিয়ে অনেক মা’র মা’রলাম। ভেবেছিলাম বাবার কাছে বিচার আসবে। কিন্তু তা হয়নি। প্রহর তারপর থেকে খুব গম্ভীর হয়ে গেলো। পড়াশোনায় তীব্র ঝোক সৃষ্টি করলো। আমি ক্লাসের টপ টেন স্টুডেন্টর মাঝে থাকলেও ওর সাথে পাঙ্গা নেয়ার জন্য প্রচুর স্টাডি শুরু করলাম৷ তবুও কাজের কাজ হলো না। ওর রোল হলো এক, আর আমার দুই। কিছুতেই ওকে ছাড়িয়ে যেতে পারছিলাম না। তখন আমার মাথায় শুধু ওকে ক্ষতি করার ভাবনা ঢুকে যায়। কিন্তু তাঁর আগেই সে হয়ে উঠেছিলো পাঁকা খেলোয়াড়। নিজেকে গড়ে তুললো অনন্য এক প্রহর রূপে।
‘ স্যার, এবার কোথায় যাবো? ‘ (প্রকাশ)
প্রকাশের কথায় ভাবনায় ছেদ ঘটলো মাহিমের। পকেট থেকে আবারো সিগারেট বের করে আগুন ধরালো। অতঃপর শান্ত কন্ঠে বললো,
‘ এখন বাড়ি ফিরে চলো প্রকাশ। ছেলেদের খবর দাও। এটাই যেনো হয় প্রহরের শেষ কনসার্ট। ডেড’বডি দেখতে চাই আমি। এট এনি কস্ট ‘ (মাহিম)
মাহিমের কথা শুনে গলা শুকিয়ে গেলো প্রকাশের। কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,
‘ ভেবে বলছেন তো স্যার? ‘ (প্রকাশ)
মাহিম ভ্রু কুঁচকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো। প্রকাশ সেই দৃষ্টিতে হিংসা, ক্ষোভ, কঠোরতা ছাড়া কিছুই দেখলো না।
#শুধু_তুই
—-(সিজন২)
#পর্বঃ১২
#Rifat_Amin
কাজি অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচ, ছয়টা মাইক্রো জিপ। তার একটাতে খুঃখ ও ভাড়াক্রান্ত মন নিয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছি আমি। আর আমার পাশে ড্রাইভিং সিটে বসে আছেন প্রহরভাই। উনার দিকে তাকালেই মনে হচ্ছে উনার মনে লাড্ডু ফুটছে। একটু আগে প্রেমের বিয়ে হলো। আমার একটা মাত্র ভাই, আহা! কত আশা করেছিলাম যে ধুমধাম করে বিয়ে হবে। কত নাচ, গান, পার্টি হবে। তা আর হলো কই? হঠাৎ প্রহরভাই শুনলো সারা আপুর বাসায় নাকি বিয়ের চাপ দিচ্ছে। আর দেরী কেনো? এখনি পালিয়ে বিয়ে হবে। সব দোষ এই প্রহরভাইয়ের! আমি গোমরামুখো হয়ে বসে থাকতেই উনি আমার দিকে একবার শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন। অতঃপর বললেন,
‘ কি ম্যাডাম, ভাইয়ের বিয়েতে খুশি হলেন না যে? নাকি নিজেও বিয়ে করতে চান? অবশ্য আগে বললে হতো। ভালো একটা পাত্র পাত্র ম্যানেজ করে দিতাম। ‘ (প্রহর)
উনার অসহ্যমার্কা কথায় বেশ বিরক্ত হলাম। কঠোরকন্ঠে জবাব দিলাম,
‘ আপনি দু লাইন বেশী বুঝেন প্রহরভাই। এত বুঝা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এতই যখন আমার বিয়ের কথা ভাবছেন, তো আপনি নিজেই একটা বিয়ে করে নেন। দেখা গেলো বুড়ো হলে কেউ বিয়ে করছে না। ‘ (আমি)
উনি যেনো আকাশ থেকে পড়লেন। বিষ্ময়কন্ঠে জবাব দিলেন,
‘ কি বললি তুই? আমি তোকে বিয়ে করবো? অসম্ভব। দরকার হলে চিরকুমার থাকবো, তবুও তোর মতো রাক্ষসী’কে বিয়ে করবো না। নেভার এভার’ (প্রহর)
আশ্চর্য! আমাকে বিয়ে করতে বললাম কখন? মাথার সাথে সাথে কানটাও গেছে নাকি? উনার কাছ থেকে নিজের এমন প্রশংসা শুনে কান দিয়ে ধোঁয়া বের হলো যেনো। কোনোমতে নিজের রাগটা দমিয়ে বললাম,
‘ আশ্চর্য! মাথা খারাপ নাকি আপনার? আমি বললাম কি আর আপনি বুঝলেন কি? আর ভুলেও আমাকে রাক্ষসী সম্মোধন করবেন না। ভালো হবে না বলে দিলাম। ‘ (আমি)
‘ দেখ, আমি নিরপেক্ষ মানুষ। ভদ্র মেয়েকে ভদ্র বলি আর উগ্র মেয়েকে রাক্ষসী বলি৷ এটাই বলা স্বাভাবিক তাই না? ‘ (প্রহর)
আমি আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলাম না। রাগটা আকাশ ছুঁতেই সামনে রাখা খালি পানির বোতলটা দিয়ে মা’রতে উদ্যত হলাম। কিন্তু আমার ভাগ্য এতই খারাপ যে ঠিক তখনি গ্লাসের বাইরে এসে হাজির হলেন মিল্লাত ভাই। সাদা পান্জাবীতে এক পার্ফেক্ট মানব। আমাকে দেখেই চমকে উঠে বললেন,
‘ আরে থামো থামো রশ্নি। কি করছো কি? নিরীহ ছেলেটাকে এভাবে কেউ মা’রে? ‘ (মিল্লাত)
মিল্লাত ভাই সামনে পরার সাথে সাথেই আমার রাগে ভাটা পরলো। পিছিয়ে এসে নিজের সিটে বসে পড়লাম। প্রহরভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি একটু বিষ্ময় দৃষ্টিতেই যেনো তাকিয়ে আছেন। কখনো ভাবতে পারেননি আমি এই সাংঘাতিক কাজটা করতে পারি। আমি মিল্লাতভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কপট রাগের স্বরে বললাম,
‘ আপনার বন্ধুকে এখন নিরীহ বলছেন? অবশ্য বলার’ই কথা। সবাই স্বার্থপর এই দুনিয়ায় ‘ (আমি)
‘ আচ্ছা আর ব্লাক’মেইল করতে হবে না পিচ্চু। এখন বলো, কি করেছে আমার বন্ধু? যার দরুণ আক্রমণ করতে বসেছো? ‘ (মিল্লাত)
‘কি করেনি সেটা বলেন। বারবার বলছে..’ (আমি)
কথাটা শেষ করতে পারলাম না। অমনেই চুপ করে রইলাম। এসব কথা কেমনে বলি মিল্লাত ভাইকে? ঠিক তখনি প্রহরভাই সুযোগ পেয়ে বললেন,
‘ বল, বল। কি করেছি আমি? ‘ (প্রহর)
আমি জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে রইলাম। উনি যে সুযোগে সৎ ব্যাবহার করছেন তা ভালো করেই বুঝতে পারছি। মিল্লাত ভাই হেসে আমার হাতে চকলেট এগিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ হইছে। আর বলতে হবে না আমাকে। তোমরা আগের মতোই আছো। বড় হওয়ার নাম গন্ধ নাই ‘ (মিল্লাত)
প্রহরভাই কথার বিরোধীতা করে বললেন,
‘ কাকে ভয় দেখায় এই মেয়ে মিল্লাত? রকস্টার প্রহর খানকে? তুই জানিস, আমি এখনি যদি কার থেকে নেমে পড়ি। তাহলে মেয়েদের লাইন পড়ে যাবে। দশ বারোটা তো এমনেই প্রোপোজ করবে। ‘ (প্রহর)
মিল্লাত ভাই জবাব না দিয়ে হেসে বললেন,
‘ আচ্ছা ওসব কথা বাদ দে। এখন তোকেই ড্রাইভ করে বাকিটা পথ যেতে হবে। আমি প্রেম আর সারাকে নিয়ে রওনা দিচ্ছি। তোর গাড়ির সামনে থাকবে দুটো গার্ড কার। আর আমার গাড়ির পেছনে থাকবে দুটো গার্ড কার। ‘ (মিল্লাত)
‘ আচ্ছা সাবধানে আয়। তবে ভুলেও যেনো কেউ না জানে পালিয়ে বিয়ে হয়েছে। তাহলে মিডিয়া কিন্তু আমাকে ছাড়বে না। ‘ (প্রহর)
‘ সব কাজ হয়ে গেছে। তুই নিশ্চিন্তে থাক। আমাদের গাড়িতে প্রেমের ফ্রেন্ড ফারহানও আছে। আচ্ছা থাকো পিচ্চু। ‘ (মিল্লাত)
শেষ কথাটা আমার দিকে তাকিয়ে বলে চলে গেলেন মিল্লাত ভাই। অতঃপর উনার ইশারায় সামনে থাকা গাড়িদুটো চলতে শুরু করলো। প্রহরভাইও কথা না বলে গাড়িটা স্টার্ট করে চালাতে শুরু করলেন। লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে দেখলাম পেছনে আরো তিনটে গাড়ি আসছে। এখন আমরা আছি ফেনী জেলার একেবারে কেন্দ্রে। চিটাগং পৌঁছুতে আর বেশী লেট হবে না বলেই মনে হয়। ইতোমধ্যে সুর্যটা তার সমস্ত শক্তি হারিয়ে পশ্চিম আকাশে ধলে পড়েছে। মানুষের যৌবনে এসে যেমন শরীরে শক্তি ভরাট থাকে৷ কাউকে পড়োয়া করে না। কিন্তু শেষ বয়সে এসে ঠিকই আর শক্তি হারিয়ে যায়। নিস্তেজ হয়ে যায়। অথচ সবাই তাকে সম্মান করে, শ্রদ্ধা করে। তার বিগতদিনের কর্ম অনুযায়ী মানুষের মাঝে আলোচনা সমালোচনা হয়। ঠিক তেমনি হেলে পরা সুর্যটাকে মানুষের বৃদ্ধ সময় বলে মনে হচ্ছে। সারাটা দিন তার প্রখরতায় অতিষ্ঠ ছিলাম আমরা। অথচ এখন? নেই তার কোনো শক্তি, না তাপ। কিন্তু কাউকে জিজ্ঞেস করলেই বলবে ‘ আজ বড্ড গরম ছিলো ‘।
——
চিটাগংয়ে এসে সব থেকে সুন্দর একটা রিসোর্টে উঠেছি আমরা। পরশু প্রহরভাইয়ের কনসার্ট। তাই আজ তারাহুরো করে আসতে হলো। যেনো কালকের দিনটা বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ পান উনি। উঠা কথা ছিলো হোটেলে। কিন্তু মাঝখানে প্রেমের বিয়ে হওয়ার ফলে সব কিছু যেনো এলোমেলো হয়ে গেলো। কে জানতো প্রেমের বিয়ে হবে? গাড়িতে উঠার আগেও এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র আশংকা করেনি কেউ। তারপর প্রেমের কাছ থেকে সারা আপুর বিষয়টা জানতে পেরে প্রহরভাই হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলেন বিয়ে হবে। সেটা পথিমধ্যেই। জন্ম, মৃ’ত্যু, বিয়ে সব এক আল্লাহর ইচ্ছেই হয়। তা এই প্রথম প্রমাণ পেলাম। আমি আর বাঁধা দিতে পারলাম না। দিলেও কি উনি সেটা শুনতেন? নিশ্চই আবার ক্ষেপাতেন আমায়।
এখন শুধু একটাই ভয়। সারার পরিবার না খারাপ কিছু করে ফেলে। বড় বিজনেস ম্যানের মেয়ে বলে কথা! তবে প্রহরভাই বিষয়টা হ্যান্ডেল করলে সমস্যা হবে না।
সব গাড়িগুলো রিসোর্টের ভেতরে ঢুকানো হয়েছে। এবং গার্ডসগুলোকে আলাদা একটা রিসোর্টের ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন প্রহরভাই। আমরা এখানে মনে হয় মোট তিনদিন থাকবো। আজকের রাতটা, আর কাল একটু ঘোরাঘুরি করে পরশু প্রহরভাইয়ের কনসার্ট দেখবো। অতঃপর পরের দিন এখান থেকে চলে যাবো।
রুম নেয়া হয়েছে মোট পাঁচটা। আমি, প্রহরভাই, মিল্লাতভাই, প্রেমের বন্ধু ফারহান ভাই। এই চারজনের জন্য আলাদা আলাদা চারটা। শুধু প্রেম আর সারার জন্য একটা বিশেষ রুম বুক করা হয়েছে। ওখানে ওরা দুজন থাকবে।
এখন সময় রাত ৯ টা ৪। চারপাশে ঘনকালো অন্ধকার। তার মাঝেই আবার ছোট বড় অসংখ্য রঙ্গিন লাইটিংয়ে সজ্জিত। হালকা ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। কতদিন পর যে এই গ্রামীণ পরিবেশের স্বাদ অন্বেশন করলাম। কে জানে? তবে প্রহরভাইকে থ্যাংস জানাতেই হচ্ছে। এখানে বসে পরিবেশটা উপভোগ করতে বেশ লাগছে। ঠিক তখনি আমার পাশে গিটার নিয়ে বসে পড়লেন প্রহরভাই। একে একে সবাই এলো। সারা, ফারহান, মিল্লাতভাই। কিন্তু প্রেমকে দেখলাম না। সারা আমার সামনে বসতেই বললাম,
‘ প্রেম কই ভাবি? ‘ (আমি)
আমার কাছ থেকে ভাবি ডাকটা শুনেই বেশ লজ্জা পেলো। জবাব দিতে উদ্যত হবে তার আগেই ফারহান বললো,
‘ ও একটু বাথরুম গেছে। আজ বাসররাত বলে কথা। আগে ভাগেই সব কাজ সেড়ে ফেলা জরুরী নয় কি? ‘ (ফারহান)
ফারহান ভাইয়ের কথায় সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। গম্ভীর মানব প্রহরভাইও বাদ গেলো না। কিন্তু সারা আপু লজ্জায় পারে মাটির ভীতর ঢুকে যায়। এই ফারহান ছাগলকে সে ভালো করে চিনে। কিছুক্ষণ হালকা কথাবার্তা বলার পর ফারহান ভাই আবদার করলো,
‘ আজ কতদিন পর আপনাকে দেখলাম ভাই। প্রেমের বিয়ে উপলক্ষে একটা গান শুনান আমাদের প্লিজ’ (ফারহান)
মিল্লাতভাইও তাল মিলিয়ে বললো,
‘ হুম হুম। তুই অমাবস্যার চাঁদ বলে কথা কথা। আজ একটা গান শুনিয়েই দে। বলা তো যায় না। কখন আবার নিউইয়র্কের ধলা মেয়ের টানে ছুটে যাস সেখানে। ‘ (মিল্লাত)
মিল্লাতভাইয়ের কথায় হেসে ফেললো সবাই। কিন্তু সেই ছোট্ট কথা আমার ছোট্ট মনে যেনো তীরের মতো বিঁধলো। নিজের এই পাগলামোতে নিজেই বিরক্ত হলাম।
” তুমি আর তো কারো নও শুধু আমার
যত দূরে সরে যাও রবে আমার
স্তব্ধ সময়টাকে ধরে রেখে,
স্মৃতির পাতায় শুধু
তুমি আমার
কেন আজ এত একা আমি ?
আলো হয়ে দূরে তুমি !
আলো-আলো আমি কখনো খুঁজে পাবনা
চাঁদের আলো তুমি কখনো আমার হবে না
আলো-আলো আমি কখনো খুঁজে পাবনা
চাঁদের আলো তুমি কখনো আমার হবে না, হবে না, হবে না, হবে না,,,,,,,,,
রুমন্থন করি ফেলে আসা
দৃশ্যপট স্বপ্নে আঁকা
লুকিয়ে তুমি কোন সূদূরে
হয়ত ভবিষ্যতরে আড়ালে
ঘাসের চাদরে শুয়ে একা
আকাশের পানে চেয়ে জেগে থাকা
তবে আজ এত একা কেন ?
আলো হয়ে দূরে তুমি
আলো-আলো আমি কখনো খুঁজে পাবনা
চাঁদের আলো তুমি কখনো আমার হবে না
আলো-আলো আমি কখনো খুঁজে পাবনা
চাঁদের আলো তুমি কখনো আমার হবে না, হবে না, হবে না, হবে না………”
গানটা শেষ করার সাথে সাথেই সবাই হাততালি দিয়ে অনেক প্রশংসা করলো। সারা আপুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি ফোনের ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও কমপ্লিট করলেন। অতঃপর বললেন,
‘ ভাইয়া এটা আমার ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড দেবো? ‘ (সারা)
সারার এমন সহজ সরল মনোভাবে সবাই হেসে ফেললো,
‘ সিওর। হোয়াই নট? তবে ইউটিউব চ্যানেল থেকে ইনকাম করলে তার ফিফটি পার্সেন্ট আমাকে দিতে হবে কিন্তু ‘ (প্রহর)
আবারো হেসে ফেললো সবাই। আমি নিশ্চুপ বসে রইলাম। শুধু উনার গানের অর্থ অনুধাবন করার চেষ্টা করলাম। তাহসান ভাইয়ার গানটা জোস! নাকি প্রহরভাইয়ের কন্ঠে শুনলাম বলেই এত ভালো লাগছে?
চলবে?
চলবে?