আমার আকাশে তারা নেই ২ পর্ব -০৪

#আমার_আকাশে_তারা_নেই ২
#লাবিবা_আল_তাসফি

৪.
“আপনার বাবা আমার প্রেম কাহিনীর সবথেকে বড় ভিলেন ইচ্ছে।”

কথাটা শোনা মাত্র বড়বড় চোখ করে তাকালো ইচ্ছে। কিন্তু উক্ত কথা বলা ব্যক্তি একদম স্বাভাবিক ভাবেই বসে রইল। ইচ্ছে কিছু বলার জন্য মুখ খুলল কিন্তু বলা আর হলোনা। ইহান তার পূর্বেই বলে উঠলো,”এই রুমটার একটা চুলও এদিক ওদিক করবোনা আমি প্রমিস। আপনি নিশ্চিন্তে ফিরে যেতে পারেন।”

খুব স্বাভাবিক ভাবে বলা কথাটাও ইচ্ছের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকলো। লোকটা তাকে একপ্রকার অপমান করলো তবে? সময় ব্যায় না করেই বেরিয়ে এলো চিরেকোঠা থেকে। এই লোকের নাকি তার জন্য এক সমুদ্র পরিমাণ ভালোবাসা। এই কি সেই ভালোবাসার প্রমাণ? রাগ হলো ইচ্ছের। আর এক মুহূর্ত সে এ বাড়িতে এই লোকটিকে সহ্য করবে না। কোনোভাবেই না।

_______________

বসার ঘরে মৃদু গুঞ্জন শুনে সেদিকে আগালো ইচ্ছে। নাজমুল সাহেব এসেছেন। মোশতাক মোড়ল তার সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন। ইচ্ছে মুখ বাকালো। ঐ অসভ্য লোকটার বাবার সাথে এত ভাব করার কি আছে? পর্দার আড়ালে থাকা ইচ্ছেকে নাজমুল সাহেব দেখে ফেললেন। খুব আদুরে ভাবে কাছে ডাকলেন। ইচ্ছেও বাধ্য মেয়ের মতন পাশে এসে বসলো। কিছুক্ষণ কথা বলার পর ইচ্ছের মনে হল নাজমুল সাহেব লোকটা চমৎকার। অমায়িক তার ব্যাবহার। মুগ্ধ হলো ইচ্ছে। কিন্তু কথা হলো এত সুন্দর একটা মানুষের অমন ছেলে হয় কিভাবে? মানে ক্যামনে পসিবল?

সময় কাটলো নদীর স্রোতের মতো। আগমন ঘটেছে শীতের। ইহান আর তার বাবা সেদিন রাতেই ফিরে গেছিলেন। তবে যাওয়ার আগে ইচ্ছের সাথে ইহানের বিয়ে পাকা করে গেলেন। ইচ্ছের একদম মত নেই এ ব্যাপারে কিন্তু সাহস করে বাবাকে তা বলতে পারলো না। এর মাঝে ইহানের পুরো পরিবার এসে একবার ঘুরে গেছিলো ইচ্ছেদের বাড়িতে। যদিও ইহান আসেনি তাদের সাথে। এতে ইচ্ছে বেশ খুশিই হয়েছিল। তবে ইচ্ছে অবাক হয়েছিল এটা ভেবে আজ অবদি ইহান কখনো তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা পর্যন্ত করেনি। এতেও ইচ্ছে বিশেষ পাত্তা দিল না। তার তো একদিক থেকে ভালই হয়েছে।
দেখতে দেখতে কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটিতে পা রাখলো সে। এটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়ালো তার জন্য। বিয়ের কথা উঠলো বাড়িতে। ইহানের পরিবার চাচ্ছে খুব দ্রুত বাড়িতে বৌ তুলতে।
ইচ্ছে বুঝলো এবার বাবাকে বলতে না পারলে আর কখনোই সে এ বিয়েটা ভাঙার সুযোগ পাবেনা। খুব সাহস করে সে বাবাকে জানালো সে এই বিয়ে করতে চায়না। কিন্তু কারণ হিসেবে সে কিছুই বলতে পারলো না। মেয়ের কথার পিঠে মোশতাক মোড়ল বললেন,
“ইহান দেখতে শুনতে ভালো। আচার-ব্যবহার ও অমায়িক। ছটফটে টাইপের না একটু গম্ভীর। ব্যক্তিত্ব নজর কাড়া। তাহলে সমস্যা কোথায়?”

“ঐ গম্ভীরতাই সমস্যা বাবা। অমন একটা মানুষের সাথে সারাজীবন তো দূরে থাক দু মিনিট থাকা শ্বাসরুদ্ধকর।” কথাগুলো মনে মনেই থেকে গেল। বাহিরে উচ্চারিত হতে পারলো না। সে কোমল স্বরে বলল,
“তোমাদের ছেড়ে যেতে মোন চাচ্ছে না।”

মেয়ের কথায় হাসলেন মোশতাক মোড়ল। পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিলেন মেয়ের মাথায়।
“একদিন তো তোমাকে যেতে হতোই মা। সেটা এখন হলে বা সমস্যা কি? বরং আমি একটা সুপাত্রে কন্যা দান করে নিশ্চিতে মরতে পারবো। আর ইহান তেমনি একজন যার হাতে আমি তোমায় অনায়াসে তুলে দিতে পারি।”

বাবার কথার বিপরীতে সে কোন যুক্তি দাঁড় করাতে পারলো না। তার এই কথাকে কেউ আর আমলে নিল না।
সেদিন হঠাৎ ইহানের বাসা থেকে কল এলো। ইরা কল করেছে। কথা বলার মাঝে সে ছক কষলো ইরাকে যদি সে বিয়ের জন্য মানা করে দেয় তাহলে কেমন হয়? কিন্তু সে নিজে জেচে পড়েতো আর বিয়ের কথা তুলতে পারে না। তাই অপেক্ষা করলো ইরার এ বিষয়ে কথা তোলার।

“তারপর আমার একমাত্র ভাবী বলে ফেলো বিয়ের কেমন ফিলিংস হচ্ছে?”

ইচ্ছে খুশি হলো। এটার অপেক্ষাইতো সে করছিল। গলার স্বর খাদে নামিয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে অনুনয় করে বলল,”আপু তুমি একটু সবাইকে বোঝাও প্লিজ।”

“কোন ব্যাপারে?”

“আমি বিয়েটা করতে চাচ্ছি না।”

ইরা যেন চমকে উঠলো। নড়েচড়ে বসে ইচ্ছের কথা শোনার চেষ্টা করলো। বিয়ের আগ মুহূর্তে পাত্রি বেঁকে বসেছে বিয়ে না করার জন্য এটা সত্যিই চিন্তার বিষয়। ইরা ভাইয়ের দিকে তাকালো। সোফায় বসে খুব মোনযোগ সহকারে ল্যাপ্টপে কিছু করছে। দৃষ্টি তার ল্যাপ্টপেই নিবন্ধ। ভাইটা তার নিঃসন্দেহে অতি সুদর্ষণ। কোনো দিক থেকেই কমতি নেই। তাহলে এই মেয়ের কেন এত আপত্তি? ইরা নজর সরিয়ে ইচ্ছের দিকে মনোযোগ দিল।

“এই অমতের কারণ?”

ইচ্ছে কোন ভঙ্গিমা ছাড়াই বলতে শুরু করল,
” নিঃসন্দেহে তোমার ভাই একজন কঠোর মনের মানুষ। গম্ভীর, অহংকারী ধাচের। কথা রসকষহীন। তার সাথে এযাবত আমার দুমিনিট কথা হয়েছিল তাতেই আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। তাহলে এমন একটা মানুষের সাথে সারাটা জীবন কিভাবে পার করবো? তুমিই বলো।”

“আচ্ছা।”

“কি আচ্ছা?”

“আমি চেষ্টা করে দেখবো।”

ইচ্ছে স্বস্তি পেল যেন। ফোন রেখে জানালার পাশে দাঁড়ালো। কিন্তু এই অন্ধকার রাতে কিছুই তার নজরে এলো না। কেবল ভেসে এলো দূর থেকে শেয়ালের ডাক। কেঁপে উঠলো বুক যেন।‌ এই ডাক সে রোজ শুনে তবুও ভয়ের রেশ যেন কাটেনা।

_____________

নতুন দিনের শুরুটা একটু অন্যরকম ভাবেই হয়। বেলা তখন নয়টা কি দশটা। নাহার ব্যস্ত পায়ে ইচ্ছের রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। বারকয়ের দরজায় টোকা দেয় কিন্তু ভেতর থেকে কোন সারা শব্দ পেলাম না। এবার দরজা ধাক্কার সাথে সমান তালে গলা ছেড়ে ডাকতে লাগলেন।

ধামধুম দরজা টাকানোর শব্দে ঘুমের রেশ পুরোপুরি ভাবে কেটে গেল ইচ্ছের। সাথে সাথে ভেসে এলো নাহারের কঠিন গলার স্বর।
“ইচ্ছে? এই মেয়ে মরার মতো ঘুমোচ্ছো নাকি? অসভ্য মেয়ে। দরজা খোলা জলদি। এই ইচ্ছে?”

মস্তিষ্ক সচল হয়ে এলো। ব্যাস্ত পায়ে বেড থেকে নেমে একপ্রকার ছুটে এসে দরজা খুলে দাঁড়ালো। দুরু দুরু বুক নিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। অগ্নি শর্মা হয়ে খুনতা হাতে নাহার তার দিকেই তাকিয়ে আছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। মা এখন এই খুনতা দিয়েই তার পিঠ ম্যাসেজ করবে না তো? ভাবা মাত্র পিঠ বাঁচাতে পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দাঁড়ালো সে। কিন্তু না হয় তেমন কিছুই করলো না। গম্ভীর গলায় বলে গেল-
“পাঁচ মিনিটে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামবে। আমাকে যেন দ্বিতীয়বার উপরে আসতে না হয়।”

নাহার যেতেই ইচ্ছে ধুপ করে বেডে বসে পড়লো। আর একটু হলেই ভয়ে তার প্রাণ পাখিটা দেহ ছেড়ে ওপাড়ে পাড়ি যমাতো। মা টা যে কেন এত ভয়ানক! একটু কম রাগি হলে কি হতো?

পাক্কা দশ মিনিটের মাথায় গুছিয়ে নিচে নামলো ইচ্ছে। টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে। নদী টেলিভিশনে কার্টুন দেখতে দেখতে নাস্তা করছে। এটা তার সেই ছোট্ট কালের স্বভাব। মোশতাক মোড়লের পাশের চেয়ার টেনে বসলো ইচ্ছে। মিস্টি হেসে বাবাকে সকালের শুভেচ্ছা জানালো। বিনিময়ে মোশতাক মোড়ল মেয়ের মাথায় হাত রেখে সুন্দর হাসলেন। আদর করে বললেন,
“শুভ সকাল বড় আম্মা।”

মোশতাক মোড়ল ইচ্ছেকে সবসময় বড় আম্মা বলেই ডাকেন। আর নদীকে ছোট আম্মা। ডাকটা ইচ্ছের ভালো লাগে। কেমন মোন ভালো হয়ে যায় এই ডাকটা শুনলে। হঠাৎ ইচ্ছের মনে হলো বাবার হাসিটা চমৎকার। বাবাদের হাসলে ভালো লাগে। গম্ভীরতা বাবাদের মানায় না। এইতো তার বাবা পুরো গ্রামের মানুষের সামনে গম্ভীর। কেবল তাদের দুই বোনের সামনে কোমল হৃদয়ের চমৎকার একজন বাবা। সন্তানদের সামনে বাবারা কঠিন খোলশ নিবারণ করে কোমলতাকে আগলে নেন। এজন্যই তো পৃথিবীর সকল বাবারাই তার সন্তানদের কাছে সেরা।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here