#আমার_আকাশে_তারা_নেই ২
#লাবিবা_আল_তাসফি
৮.
চৌধুরি বাড়ি আজ রান্নার ঘ্রাণে ম ম করছে। কয়েক পদের রান্না হচ্ছে। ইচ্ছেও টুকটাক কাজ এগিয়ে দিচ্ছে। কোমরে শাড়ির আঁচল গুজে এক হাতে চোখ মুচছে অন্য হাতে পেয়াজ কুচি করছে। এ অবস্থা দেখে শারমিন বেগম ধমকে তাকে রান্নাঘর থেকে বের করে দিয়েছে। ইচ্ছে মোন খারাপ করে চলে এসেছে সেখান থেকে। লাইব্রেরি রুমে উঁকি দিতেই দেখলো নাজমুল সাহেব চশমা চোখে এঁটে খুব মনোযোগ সহকারে ম্যাগাজিন পড়ছে। ইচ্ছের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ধীর পায়ে শ্বশুরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মুখের সামনে থেকে ম্যাগাজিন সরালেন নাজমুল সাহেব। উৎস বধুকে হাসি মুখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেও হাসিমুখে বলল,
“কিছু বলবি মা?”
ইচ্ছে যেন এই অপেক্ষাতেই ছিল। সাথে সাথে উত্তর দিল,
“লুডু খেলবেন বাবা? আজ আমাকে কেউ হারাতে পারবে না।”
নাজমুল সাহেবের চোখ মুখ আরো উজ্জল হয়ে এলো যেমন। তার দুটো ছেলে মেয়ের দুজনই ছোট থেকেই শান্ত প্রকৃতির। ইরা শান্ত হলেও মানুষের সাথে খুব সুন্দর মিশে যেতে পারে। কিন্তু ইহান ভিন্ন। ছোট থেকেই গম্ভীর একরুখে টাইপের। অন্যসব বাড়ি বাচ্চাদের কোলাহলে মুখরিত থাকলেও তার বাড়ি নিরব পুরির মতোই শান্ত থাকতো। যেন এ বাড়িতে মানুষের অস্তিত্ব অবদি নেই। নাজমুল সাহেবের খুব আফসোস ছিল এটা নিয়ে। কিন্তু পুত্রবধূ তার এ আফসোস দূর করলো যেন। কেমন প্রাণবন্ত চঞ্চল মেয়েটা। একাই মাতিয়ে রাখে পুরো বাড়িটা। মেয়েটা যখন খিলখিল শব্দ তুলে হাসে তখন বুক ঠান্ডা হয়ে যায়।
খেলা বেশ জমে উঠেছে। কেউই কারো থেকে কম যায় না। কে জিতবে বলা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। থেকে থেকে উচ্চশব্দে হেসে উঠছে শ্বশুর পুত্রবধূ। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে স্পস্টভাবে সে হাসির ধ্বনি শুনতে পেলেন শারমিন বেগম। মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সংসারটা তার কত সুন্দর। সংসারের এই মানুষগুলোর মুখের দিকে চাকালে হাজার বছর বেঁচে থাকতে মোন চায়। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে আবারো রান্নায় মনোযোগ দিলেন। কাজের মেয়েটাকে তাড়া দিলেন চুলায় মাংস চাপিয়ে দেওয়ার জন্য। অনেক কাজ পরে আছে এখনো।
ইরা হোস্টেল থেকে ফিরছে আজ। এজন্যই এতো আয়োজন। অনেকদিন পর ফিরছে মেয়েটা। ভার্সেটি দূরে হওয়ায় তাকে হোস্টেলে উঠতে হয়েছে। ইচ্ছে-ইহানের বিয়ের কিছুদিন পরেই সে চলে গিয়েছিল। এতদিন পর বাড়ির একজন সদস্যর আগমনে সকলে ভিষণ খুশি। ইচ্ছেও খুব আমেজে আছে। বহুদিন পর গল্প করার মতো কাউকে পাবে। এক টেলিভিশন দেখে আর কত সময় পার করা যায়? অবশ্য ইচ্ছে আরো একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে পড়াশোনা কনটিনিউ করবে। ইহান তো তাকে শুরুতেই বলেছিল কিন্তু সুখে থাকতে ভুতের কিল খাওয়ার মানুষ সে না। খুব সুন্দর করে সে ইহানকে জানিয়ে দিয়েছিল সে এখন বিবাহিত। সংসার স্বামী সামলানো এখন তার একমাত্র দায়িত্ব। এখন সে সংসারে মনোযোগ দিতে চায়। ওসব পড়াশোনা তার কম্য নয়। ইহান ও বিনা বাক্যে মেনে নিয়েছে। যে পড়বে তার নিজেরই যদি বিন্দু মাত্র আগ্রহ না থাকে অপরের আর কি করার থাকে? পড়াশোনা গুলিয়ে তো আর খাওয়ানো যায় না। যদি যেতো তাহলে অবশ্যই ইহান একটা রিস্ক নিতো।
ইচ্ছে এডমিট হওয়ার সিদ্ধান্তটা শিক্ষিত বউ বা মা হওয়ার জন্য নেয়নি। আর না ব্রাইট ফিউচারের উদ্দেশ্যে। তার এই সিদ্ধান্তের পেছনে অনেক বড় একটা যুক্তি রয়েছে আর তা হলো বাড়িতে বসে না থেকে সে ভার্সিটিতে গেলে ওখানে গল্প করার জন্য বন্ধু হবে তখন তার আর এত ঘনঘন মুড সুয়িং হবেনা। তার থেকেও বড় কথা ইহানকে রোজ কষ্ট করে ফুচকা চটপটি কিনে আনতে হবেনা বাসায় ইচ্ছে নিজেই কিনে খেতে পারবে। এগুলো কি যথেষ্ট নয় এডমিটের জন্য?
_____________
“বকুল কে হয় আপনার?”
অফিসে কাজের প্রচুর চাপ। বাড়িতে ফিরেও শান্তি পাচ্ছেনা ইহান। যে সময়টুকু বাড়িতে থাকে তার অর্ধেক সময় কেটে যায় ল্যাপটপের মাঝে মুখ গুজে। আজও তার ব্যাতিক্রম নয়। দরকারি কিছু ফাইল দেখছিল সে ঠিক তখনি তার উড়নচণ্ডী বউ ওরফে প্রেমিকা এসে হাজির। মেয়েটা তাকে একদন্ড শান্তিতে থাকতে দেয় না। একে সামলাতে যেয়ে তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কাজ করাটা দরকার হলেও সে আপাতত ল্যাপটপটা বন্ধ করে পাশে রাখলো। ধীরে সুস্থে পূর্ণ নজরে তাকালো ইচ্ছের দিকে। মেয়েটা মাজায় হাত রেখে গরম চোখে তাকিয়ে আছে। এখনি তাকে টুপ করে গিলে নিবে যেন। এই মেয়ে রাগ করতেও জানে নাকি? ইন্টারেস্টিং!
“তোওও কি বলছিলে যেন?”
“বকুল কে? হু ইজ সি?”
“বকুল?” ইহানের মনে পড়লো না এমন নামের কাউকে। তবুও মনে করার চেষ্টা করল তবে ব্যর্থ হলো। মস্তিষ্ক এমন নামের কাউকে মনে করতে পারলো না। ভ্রু দুইয়ের মাঝে ভাঁজ ফেলে সে ইচ্ছেকে বলল,
“আমি সত্যিই জানিনা।”
“তাহলে সে কেন বলল আপনি তার খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড। রাত জেগে নাকি ফোনালাপ চলতো আপনাদের মাঝে। এগুলো সত্যি?”
ইহানের কপাল আরো খানিকটা কুঁচকে গেল। কোন কথা না বলে ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বসলো। ভঙ্গিমা এমন যে ইচ্ছের কথা তার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস যোগ্য মনে হলো না। কিন্তু ইচ্ছে এখনো ওভাবে দাড়িয়ে আছে। উত্তর না জেনে সে কিছুতেই এখান থেকে নড়বেনা পণ করেছে। বেশ কিছুক্ষণ বাদে ইহান ইচ্ছের দিকে নজর দিলো। ভালোভাবে ইচ্ছেকে পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল,
“প্রেমিকা থেকে হঠাৎ বউতে কনভার্ট কেন হলে বলোতো? ফিলিং সামথিং সামথিং?”
ইচ্ছের রাগী মুখ মুহূর্তেই মিইয়ে গেল। কথার গভীরতা মাপতে বেগ পেতে হয়নি তাকে। কোমল হলো হৃদয়। ফুঁসে ওঠা রাগ গলে পানি হয়ে গেল। ইচ্ছে আর এক মুহূর্তও ইহানের সামনে দাঁড়াতে চাইলো না। আজকাল বড্ড লজ্জা দেয় লোকটা তাকে। সে কি জানে না তার দেওয়া লজ্জা ইচ্ছেকে চরম অস্বস্তিতে ফেলে দেয়? এই যে এখনো ইচ্ছের হাত পা কাঁপছে। বুকের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে। এই অতি সামান্য কথাই তাকে লজ্জার শেষ স্তরে নিয়ে যাচ্ছে। মোন চাইলো ছুটে পালাতে। সে করলোও তাই। দরজা পেরিয়ে বেরোনোর আগে পেছন থেকে ইহানের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল।
“বকুল ওয়াসিফের গফ। দুজনের মাঝে কিছু ঝামেলা চলছিল তাই দুদিন কথা হয়েছিল। দ্যাটস ইট।”
ব্যাস এটুকুই যথেষ্ট ছিল ইচ্ছের জন্য। ইহানের প্রতি ওর অগাধ বিশ্বাস রয়েছে। যেখানে সন্দেহের লেশমাত্র নেই। এটাতো কেবল মোনোতুষ্টি মাত্র। তাছাড়া কোনো মেয়েকে নিয়ে বরকে জেরা করা বউগত অধিকার। এ অধিকার সে কেন লঙ্ঘন করবে? তার স্পাইয়ের নজর সর্বদা ইহানের উপর থাকবে।
__________
ধূসর বিকেল। মেঘেরা ভেসে বেড়াচ্ছে। দল বেঁধে পাখিরা নীড়ে ফিরছে। ধোঁয়া ওঠা এক মগ কফি হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল ইচ্ছে। দৃষ্টি তার দূর আকাশে। গায়ে শীতের কাপড় না থাকায় শীতল হাওয়ায় শিওরে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। ঠান্ডা লাগছে বেশ। ইচ্ছে সেদিকে খেয়াল না দিয়ে আনমনে ঠোঁট ছোয়ালো কফির মগে। চোখ বুঝে স্বাদ নিল কফির। তখনি একজোড়া হাত পেছন থেকে তার গায়ে পাতলা একটি শাল জড়িয়ে দিল। এটার খুব দরকার ছিল। ইচ্ছে ঘাড় ঘরাতেই দেখলে বারান্দার দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইহান। পরনে ফর্মাল পোশাক। চুলগুলো বেশ অগুছালো ভাবে ছড়িয়ে আছে কপালে। চোখে ক্লান্তি থাকলেও ঠোঁট ছেয়ে আছে মিষ্টি হাসিতে। দৃষ্টি তার ইচ্ছেতেই নিবদ্ধ। ইচ্ছে খুশি হলো। এ সময় মানুষটাকে কখনোই পাওয়া যায় না। আজ সে খুব করে মিস করছিল মানুষটাকে। মানুষটা আজই এলো। ইচ্ছে প্রসন্ন হেসে বলল,
“কখন এলেন?”
“এক প্রকৃতি প্রেমি যখন প্রেম উজাড়ে বিভোর ছিল ঠিক তখন।”
চলবে………..
(একটু অসুস্থ বোধ করছি। রি চেইক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখবেন।)