প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব -২৪+২৫+২৬

#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২৪তম_পর্ব

ধারা রীতিমতো রাগে ফুসছে। তার চোখ মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। অনল মুগ্ধ নজরে তার বউ কে দেখলো কিছুসময়। তারপর এগিয়ে এসে তার চোখে চোখ রেখে নরম স্বরে বললো,
“তা আমার বউ এর ঠিক কেমন রোমান্টিক স্বামী চাই?”

প্রশ্নটি কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই ঝংকার তুললো মস্তিষ্কে। ধারা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার সামনে ঈষৎ ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকা মানবের দিকে৷ শ্যাম মুখশ্রীর মানবটি তার চোখে দৃষ্টি আবদ্ধ করে রেখেছে, ঘোর লাগা সেই দৃষ্টি। চুলগুলো বড্ড অবহেলায় পড়ে রয়েছে তার শ্যাম ললাটে। তার কন্ঠে অসামান্য মাদকতা, তার বা হাতটা ট্রাউজারের পকেটে। ঠোঁটের কোনে লেপ্টে থাকা বাঁকা হাসিতে হাজারো দুষ্টুমি। প্রিন্স উইলিয়ামের মুখশ্রীর দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরটায় চিনচিনে এক সূক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভূত হলো। ব্যাথাটি বিষাদের নয়, বড্ড বিচিত্র সেই ব্যাথা। ব্যাথাও কি সুখময় হয়, হয় হয়তো। ধারা বোবার ন্যায় কিছুসময় চেয়ে রইলো। তার ক্রোধ, রাগ সব যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। প্রিন্স উইলিয়ামের সেই মাদকতা দৃষ্টি তাকে নিঃস্ব করে তুলছে ক্রমশ। অনুভূতি গুলো ভোঁতা হচ্ছে, ধারার মনে হচ্ছে সে কোনো প্রবল ঘোরে বাঁধা পড়েছে। এই ঘোরের নাম জানা নেই, তবে অনলঘোর দিলে হয়তো মন্দ হবে না। অনল আরোও একটু ঝুঁকে এলো। তার উষ্ণ নিঃশ্বাস আঁছড়ে পড়ছে ধারার শুভ্র মুখে। রুক্ষ্ণ বিশাল হাতটি আলতো করে ছুলো তার মুখশ্রী। অসমৃণ আঙ্গুলে ঢগা বিচরণ করছে তার গালে। ঘোরলাগা কন্ঠে বললো,
“কি হলো, বললি না! কেমন রোমান্টিক বর চাই?”

ধারা এখনো নিশ্চুপ। তার শব্দগুলো যেনো সমীরে ভাসছে। হাত বাড়ালেও খুঁজে পাচ্ছে না। আবেশে আবেশিত ধারার গালজোড়া উষ্ণ হয়ে উঠলো মূহুর্তেই। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো মাত্রাতিরিক্ত। চোখে জড়ো হলো এক রাশ লজ্জা। অনলের মাদকতা মেশানো দৃষ্টিতে উঁকি দিচ্ছে কিছু নিষিদ্ধ অভিপ্রায়। সাথে সাথেই ধারা নামিয়ে নিলো দৃষ্টি। পা জোড়া আঁকড়ে ধরলো মেঝে। হাতটা ওড়নার কোনা নিজের মুঠোবন্দি করলো। অনল তার কিশোরী বউ কে দেখছে ঘোরলাগা চোখে। তার দৃষ্টি এসে ঠেকলো ধারার ঈষৎ কম্পনরত গোলাপের ন্যায় ঠোঁটজোড়াতে। ঠোঁটের হাসিখানা বিস্তারিত হলো। বিনা সংকোচে আরোও একটু কাছে এলো সে৷ তাদের মাঝের দূরত্ব নেই এর সমতূল্য। অনল ধারার কানে ঠেকালো মুখ। ফিসফিসিয়ে বললো,
“আমি রোমান্টিক রুপ নিলে সইতে পারবি তো? একটু কাছে আসতেই তো মোমের মতো গলে যাস। লজ্জাবতীর মতো নুয়ে যাস। ভেজা গোলাপের মতো কাঁপিস। আমার অবাধ্য ইচ্ছের জোয়ার সামলাতে পারবি?”
“অসভ্য”

অস্পষ্ট স্বরে কোনোমতে কথাটা মুখ থেকে বের হলো ধারার। লজ্জায় আরোও নুয়ে গেলো সে। অনলের এমন আচারণ যেনো অসহনীয় হয়ে উঠলো। ছোট বক্ষপিঞ্জরটার মাঝে দামাদোল শুরু হয়েছে সেই কখন থেকে। অথচ এই মানুষটির কোনো লজ্জা নেই, নির্লজ্জের মতো কথাগুলো বলছে। ধারা চট করেই খানিকটা সরে যেতে নিলো। কিন্তু সেটা আর হলো না। কারণ লোকটা তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। বাঁকা হাসি হেসে বললো,
“পালাচ্ছিস কেনো? ভয় পাচ্ছিস?”
“ভয় পাবো কেনো? তোমাকে ভয় পাবার কি আছে! বা’ঘ না ভা’ল্লু’ক তুমি?”

ধারা আড়ষ্ট কন্ঠে কথাটা বললো। কিন্তু তাতে থামলো না অনল। বরং তার কোমড়খানা শক্ত বাহুর বেস্টনীতে আবদ্ধ করলো নিবিড় ভাবে। ঝুকে এলো ধারার ঈষৎ কম্পনরত ঠোঁটের দিকে। অনলের মনোবাঞ্ছার আবেশ পেতেই চোখ বুজে নিলো ধারা। এই প্রথম তারা এতো কাছাকাছি। ধারার মনে হলো সময়টা থমকে গেছে। ঘরের নিস্তদ্ধতা বাড়লো। বাহিরের মেঘের ঘর্ষণ ক্ষীন শোনা যাচ্ছে। হয়তো আবারো বৃষ্টি হবে। অনল তার কিশোরী বউ এর উন্মুখ হওয়া মুখশ্রী দেখে নিঃশব্দে হাসলো সে। তারপর সটান হয়ে দাঁড়িয়ে ধারার মাথায় আলতো গা’ট্টা মেরে দূরে সরে গেলো অনল। নির্লিপ্ত ভরাট কন্ঠে বললো,
“মাথাটা ভর্তি নষ্ট চিন্তা! যা, অংক করতে বয়। আজ বাদে কাল পরীক্ষা উনি এসেছে রোমান্টিক বর খুঁজতে”

অনলের কথা শুনতেই বিস্মিত হলো ধারা। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো অনল তার থেকে দূরে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। এতো সময়ের সকল অনুভূতিগুলো যেনো দুম করেই উড়ে গেলো। বুঝতে বাকি রইলো না অনল তার সাথে মজা করছিলো। অনলের এমন কার্যে পূর্বের রাগটা যেনো দ্বিগুন মাত্রায় বাড়লো। কিন্তু লজ্জার কারণে সেটা প্রকাশ করতে পারলো না। অগ্নিদৃষ্টিতে যদি কাউকে পো’ড়া’নো যেতো তাহলে হয়তো অনলকে দৃষ্টিতেই কুপোকাত করতো ধারা। হনহন করে টেবিলের কাছে যেয়ে সজোরে চেয়ারখানা টানলো। ধপ করে বসলো। অনলের সারা সন্ধ্যায় কড়া নোটগুলো চরম বিরক্তি নিয়ে উল্টাতে লাগলো। ধারার রাগী মুখখানা অনলের প্রফুল্লতা বাড়ালো। সে নির্বিকার ভাবে বসলো পাশে। অসহায়ের ভান করে বললো,
“আমার রাগ কাগজের উপর ঝাড়িস না। সে বিকাল থেকে কষ্ট করে বানিয়েছি।”

কথাটার প্রত্যুত্তরে ধারা কেবল জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালো। যার অর্থ, “চুপ না করলে তোমার মাথা ভে’ঙ্গে দিবো”। অনল সন্তপর্ণে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো। মনে মনে বলল,
“আমারও কাছে আসতে ইচ্ছে হয়, তোর মাঝে ডুবে যেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু পরমূহুর্তেই নিজেকে সামলে রাখি, আটকে রাখি। তুই যে বড্ড ছোট রে ধারা। আরেকটু বড় হো! আরেকটু!”

তারপর বা হাত দিয়ে আলতো করে ধারার সামনের চুলগুলো সরিয়ে দেয়। তারপর ভরাট গলায় বলে,
“উপহারটা পাওনা থাকলো। সময় হলে ঠিক পাবি। আর এবার যদি সিজি ৩.২৫ এর বেশি উঠাতে পারিস, আমি তোকে ঘুরতে নিয়ে যাবো। সেদিন কুথাচ্ছিলি, তোর হানিমুন হয় নি! সেই ইচ্ছে পূরণ করে দিবো। কথা দিচ্ছি”

কথাটা শুনতেই ধারা ফট করে তাকালো। অবাক কন্ঠে বললো,
“সত্যি?”
“সত্যি, সত্যি, সত্যি”

ধারার মনে হলো একগুচ্ছ গ্যাস বেলুন যেনো উড়ে গেলো তার মনের আকাশে। অনলের উপর জমা সকল মেকি রাগ কর্পুর হয়ে গেলো। তার মুখখানা মূহুর্তেই চকচক করে উঠলো। যেনো ছোট বাচ্চা বহু চাইবার পর তার পছন্দের খেলনাটি পেয়েছে। ফলে আবেগে আত্মহারা হয়ে অনলকে জড়িয়ে ধরলো সে। ধারার এই কাজে যত না অবাক হলো অনল, তার থেকে অবাক হলো যখন ধারার নরম ঠোঁটজোড়া ছুলো তার গাল। নরম ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া পেতেই ঈষৎ নড়ে চড়ে উঠলো অনল। তার মনে হলো মেরুদন্ড বেয়ে যেনো উষ্ণ রক্ত প্রবাহিত হলো। কিন্তু ধারা নির্বিকার৷ তার ঠোঁটে একরাশ মুগ্ধ হাসি। সুন্দর উৎসাহিত মনে তার জায়গায় ফিরে গেলো। দ্বিগুন উৎসাহে পড়তে লাগলো। অথচ অনল এখনো বসে আছে। তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে দ্বিগুন, কান হয়ে উঠেছে রক্তিম। নারীর উষ্ণ ছোঁয়া বুঝি এমন ই হয়! আর সেই নারী যদি হয় প্রণয়িনী তবে তো কথাই নেই____________

******

পরীক্ষার রুটিন ঝুলছে করিডোরের দেওয়ালে বাধানো কাঠের ফ্রেমে। পরীক্ষার রুটিন মানেই পরীক্ষা শুরু। যা এই জুনের গরমকে করে তুললো আরোও উত্তপ্ত। এই না কিছুদিন আগে শুরু হলো সেমেস্টার। আর এর মাঝে শেষ ও হয়ে গেলো! ভাবা যায়। সময় তো না এ যেনো কোনো রেলগাড়ি। আড্ডা, গল্প, হাসাহাসির মাঝে একটা বছর কেটে যাচ্ছে। এই সেমেস্টার শেষ হলেই বন্ধুমহল উঠে যাবে সেকেন্ড ইয়ারে। তখন তারাও সিনিয়ার। এভাবেই কেটে যাবে এই ভার্সিটির চারটে বছর। চারটে বছর বাদে থেকে যাবে শুধু কিছু হাসি কান্নার স্মৃতি। বন্ধুমহল তাকিয়ে আছে রুটিনের দিকে। নীরব ব্যাতীত বাকি চারটে মুখ উদাস। তাদের মনে হচ্ছে তারা কিছু পারে না। দিগন্ত বলে উঠলো,
“ক্লাস করাচ্ছে করাক না, এই পরীক্ষা নামক ত’লো”য়া’র গলায় ঝো”লা”নো”র কি আছে রে বাপু!”
“ঠিক। ক্লাস করে যেতাম, কি ভালোই না হতো। এখন পড়া লাগবে। আমি শিওর লিনিয়ার এলজ্যাবরা আর ক্যালকুলাস এ আমি ধরা খাবোই খাবো”

দিগন্তের কথার সাথেই সাথেই অভীক তাল মেলালো। মাহি শুধু তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো। এই গণিতের ডিপার্টমেন্টে কেনো ভর্তি হতে গিয়েছে কে জানে। সব যেনো মাথার উপর দিয়ে প্রজেক্টাইল এর মতো উড়ে যায়। এবার সকলে এক সাথে তাকালো নীরবের দিকে। বন্ধুমহলের এই একটা মানুষ ই আছে যা তাদের ডুবন্ত নৌকা বাঁচাতে পারে। নীরব সকলের চাহনী দেখে হতাশ কন্ঠে বললো,
“নোট পেয়ে যাবি কান্দিস না”
“তুমি এতো ভালো কেনো বন্ধু?”

অভীক তার গলা জড়িয়ে বললো। এর মাঝেই তারা শুনতে পেলো কেউ ক্ষীণ কন্ঠে ডাকছে ধারাকে। মাহি এদিক ওদিক চেয়ে বলল,
“ধারা, তোকে ওই অদ্ভুত লোকটা ডাকছে”

কথাটা শুনতেই মাহির দেখানো দিক অনুসরণ করে তাকায় ধারা। স্বয়ংক্রিয় ভাবেই তার মুখ হা হয়ে যায়। অস্পষ্ট স্বরে বলে,
“এই ব্যাটা এখানে কেনো?”

বিল্ডিং এর ঠিক বাহিরে উৎসাহিত মনে দাঁড়িয়ে আছে দীপ্ত। তাকে দেখে স্বভাবতই অবাক হলো ধারা। লোকটির এখানে আসার কথা নয়। শুধু তাই নয়, ধারা তার সাথে পারতে কথা বলে না। সুতরাং তার ভার্সিটির ঠিকানাও লোকটির জানার কথা নয়। ধারাকে দেখতে পেয়ে অতিউৎসাহী মানব হাত উঁচিয়ে ইশারা করছে, শুধু তাই নয় তাকে সজোরে ডাকছেও। ফলে পথযাত্রী শিক্ষার্থী যারা ধারাকে চিনে তারা অবাক নয়নে ধারার দিকে তাকাচ্ছে। ব্যাপারটা লজ্জাজনক। তাই আর না পেরে এগিয়ে যায় ধারা। বন্ধুমহল সাথে যায়। দীপ্তের কাছে যেতেই কাঠ কাঠ গলায় প্রশ্ন ছুড়ে,
“আপনি এখানে কি করছেন?”
“তুমি তো আমাকে সময় দিবে না, তাই ভাবলাম আমি নিজেই তোমার সময়ে ঢুকে পড়ি”

দীপ্তের কথায় ভ্রু কুঞ্চিত হয় ধারার। এক রাশ বিরক্তি মুখে ভেসে উঠে। লোকটি অতি গায়ে পড়া স্বভাব অসহনীয়। এর মাঝেই দিগন্ত প্রশ্ন করে,
“আপনি কে হন?”
“ওহ, লেট মি ইন্ট্রোডিউজ মাইসেল্ফ। আমি দীপ্ত। ধারার…”
“আমাদের অতিথি হন”

দীপ্তের কথা শেষ না হতেই ধারা কথাটা বলে। দীপ্ত ও থেমে যায়। অমলিন হাসি হেসে বলে,
“ইয়াপ”

বন্ধুমহলের সাথে পরিচিত হতে সময় নেয় না দীপ্ত। দীপ্তের মিশুক স্বভাবের কারণে তারাও বেশ ভালো ভাবেই দীপ্তের সাথে আচারণ করে। তবে ব্যাপারটা সহ্য হলো না ধারার। সে বললো,
“দীপ্ত ভাই, আপনি বরং বাড়ি যান। সামনে পরীক্ষা তো নোট গুছিয়ে আমি বাড়ি যাবো”
“দিস ইজ আনফেয়ার। বাসায় তুমি ব্যাস্ততা, পড়াশোনার বাহানা দিয়ে এড়িয়ে যাও। আমি ভাবলাম অন্তত এখন তুমি আমাকে সময় দিবে। এখনো তাই করছো। বিয়ে হয়েছে বলে কি ফ্রেন্ডশিপ করা যাবে না?”

বিয়ে কথাটা বিশাল বজ্রপাতের ন্যায় বন্ধুমহলের মাথায় পড়লো। ধারার এতোদিনের সুপ্ত ঘটনাটা এতো নিপুনভাবে ফাঁস হবে কে জানতো! সকলের মুখে বিস্ময়। নিজেদের বান্ধবীর বিয়ে হয়ে গেছে ব্যাপারটা কেনো মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে ঘর্ষণ তৈরি করেছে। দিগন্তের মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ভার্সিটির প্রথম ভালোলাগার মানুষটির বিয়ে টা যেনো হজম হচ্ছে না। অভীক অবাক কন্ঠে বলল,
“বিয়ে? ধারার?”
“হ্যা, তোমরা জানো না? ধারা বলে নি”

নিজের মিথ্যের হাড়ি সকলের সামনে এভাবে ভেঙ্গে যাবে মোটেই কল্পনা করে নি ধারা। সে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। বুঝতে পারলো দীপ্ত তার বিয়ের কথাটা সম্পূর্ণ বলে দিবে। এবং হলো, দীপ্ত বলতে লাগলো,
“ধারা তো বিবাহিত। ইভেন ওর বরকেও তোমরা চিনো”

বরের নামটি সেই মুখে আনবে। অমনি ধারা তার মুখ চেপে ধরলো। চোখ গরম করে বলল,
“আপনার না শরীর খারাপ, এতো কথা বলাটা ঠিক নয়”

বলেই তাকে টেনে হিচড়ে বেশ দূরে নিয়ে আসে। বন্ধুমহল তখনও নিস্তব্ধ। ধারা এতো বড় খবরটা চেপে গেলো। সাথে সাথেই অভীক তাকালো মাহির দিকে। হিনহিনে কন্ঠে বললো,
“মাহি চু’ন্নী, তুই জানতি তাই না?”

মাহি শুকনো ঢোক গিললো। হ্যা, সে জানতো। কিন্তু এখন স্বীকার গেলে এই হিং’স্র প্রা”ণী তাকে আস্তো রাখবে না। অভীকের প্রশ্নে একই সাথে তাকালো দিগন্ত এবং নীরব। মাহি চট করে নিজের ভোল পাল্টালো। অবাক, বিস্মিত কন্ঠে বলল,
“আমিও তো অবাক, এটা তো একটা ব্রান্ড নিউ ইনফরমেশন। ধারা আমাকেও বলে নি। ব্যাপারটা গোপনীয় হয়তো”

অভিনয় কতটুকু কাজে দিলো জানা নেই। তবে বন্ধুদের তীর্যক শ’কু’নী নজরটা একটু শান্ত হলো।

এদিকে ধারা ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠলো,
“আপনার সমস্যা কি? ওখানে বাজে কথা বলছিলেন কেনো?”

ধারা দীপ্তকে এভাবে টেনে আনবে ব্যাপারটা আকস্মিক ছিলো দীপ্তের কাছে। কিন্তু প্রকাশ করলো না। উলটো বাঁকা হেসে বললো,
“তুমি তোমার বিয়ের কথা ওদের ও জানাও নি”
“আমার বিয়ে, আমার ইচ্ছে। কাকে জানাবো না জানাবো সেটার কৈফিয়ত আপনাকে দিতে হবে?”
“একেবারেই না। তবে মুখটা তো আমার। তাই আমার ইচ্ছে, আমার মুখে কি কথা বের হবে না হবে সেটার কৈফিয়ত ও তোমাকে দিবো না। তবে একটা শর্তে ব্যাপারটা গোপন করে ফেলতে পারি। ওয়ান কন্ডিশন”

ধারার বিরক্তি বাড়লো। সাথে রাগে মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। তার মনে হলো তার শরীর রাগে জ্ব’ল’ছে। নির্লজ্জ লোকটিকে মে’রে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু প্রবাদ আছে “হাতি যখন কাঁদায় পড়ে, চামচিকাও লা’থি মারে”। সেই অনুভূতিটুকুই হচ্ছে ধারার। সে চায় না অনল এবং তার বিয়েটা এখন ই সবাই জানুক। অহেতুক কথায় কথা বাড়বে, উপরন্তু অনল তাদের ক্লাস ও নেই। এই ভার্সিটির নিয়ম, যদি টিচারের ফ্যামিলি ম্যাম্বার ক্লাসে থাকে তবে সেই ক্লাসটির কোর্স টিচার হওয়া যায় না। কিন্তু অনল তাদের কোর্স টিচার। ফলে ব্যাপারটা নিয়ে অহেতুক জলঘোলা হবে। সব ভেবেই দীপ্তকে মা’রা’র পরিকল্পনা ছেড়ে দিলো ধারা। মুখ গোল করে নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। তারপর বলল,
” কি শর্ত?”

ধারাকে বাগে পেয়ে দূর্বোধ্য হাসি হাসলো দীপ্ত। এতোদিনের মনোকামনা তবে পূরণ হলো________

ব্যস্ত শহরের উত্তপ্ত, ভাপ উড়ানো দিনকে নিমিষেই শীতল করে দিলো এক পশলা বৃষ্টি। পিচের রাস্তায় জমলো কর্দমাক্ত পানি। বৃষ্টির কারণে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা গড়ালো। ব্যস্ত শহরের উত্তপ্ত দিনকে ইতি টেনে নেমে এলো শীতল, ঘুটঘুটে সন্ধ্যে। দীপ্তের শর্ত অনুযায়ী তাকে ঢাকা ঘোরালো ধারা। উপায় নেই বলে এই বিরক্তিকর মানুষটির সাথে বিকাল কাটালো সে। তার আজব আজব কৌতুহলের উত্তর দিতে হলো তাকে। মাঝে ইচ্ছে হয়েছিলো বটে, ঝাকড়া চুলগুলো টে’নে ছি’ড়ে ফেলতে। কিন্তু নিজেকে সংযম রাখলো। সন্ধ্যা নামার আগেই ফিরতো। কিন্তু বৃষ্টির জন্য আটকে পড়লো তারা। ফলে বাড়ির কালো কেঁচি গেটে যখন পৌছালো তখন বাজে রাত আটটা। কেঁচি গেট থেকে ঢুকতেই মুখোমুখি হলো শক্ত কঠিন মানবের। রক্তচক্ষু নিয়ে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে অনল। অনলের কঠিন মুখের দিকে তাকাতেই শুকনো ঢোক গিললো ধারা। অনল কোনো প্রশ্ন করলো না, শুধু ক্রোধাগ্নি ছুড়লো দৃষ্টি দিয়ে। দীপ্ত নির্বিকার। অনলের রক্তিম দৃষ্টি তাকে নড়ালো না। বরং হেসে বললো,
“ধারা ধন্যবাদ, আজকের দিনটা সারাজীবন মনে থাকবে”

ধারা উত্তর দিলো না। তার বদলে অনল বরফ শীতল কন্ঠে বললো,
“ধারা, ড্রেস চেঞ্জ করে পড়তে বয় যা”

ধারা মাথা নিচু করে বাড়িতে ঢুকে পড়লো। দীপ্তও তার পিছু পিছু ঢুকতে গেলে বাধা দিলো অনল৷ দীপ্ত চোখে বিস্ময় নিয়ে তাকালে অনল বললো,
“আপনার সাথে কথা আছে”
“বলুন”

দীপ্ত শান্ত গলায় বললো। অনল তার মুখোমুখি অথচ তার মাঝে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। অনল একটু সময় নিয়ে বললো,
“আপনি যে মিথ্যে কথা বলে এখানে ঢুকেছেন কেউ না জানুক আমি জানি। ওই ছিনতাই এর কথাটা সম্পূর্ণ বানোয়াট ছিলো। একটা মুভির লাইন টু লাইন কপি। বাড়ির সবাই বিশ্বাস করলেও আমি কিন্তু করি নি। কারণ মিথ্যের লংকায় একটা সত্যের আগুন ই যথেষ্ট। আপনার সব চুরি হলো, দামি ঘড়িটা থেকে গেলো অদ্ভুত না? যাই হোক, আমি বাধা দেই নি কারণ আপনি দাদাজানের চিকিৎসা করেছিলেন। তবে আপনার মতলব যে খুব সুবিধার নয় সেটা আমি জানি। আজ লুকোচুরি ছেড়ে সরাসরি জানতে চাচ্ছি, কি মতলবে এসেছেন আপনি?…………
#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২৫তম_পর্ব

অনল একটু সময় নিয়ে বললো,
“আপনি যে মিথ্যে কথা বলে এখানে ঢুকেছেন কেউ না জানুক আমি জানি। ওই ছিনতাই এর কথাটা সম্পূর্ণ বানোয়াট ছিলো। একটা মুভির লাইন টু লাইন কপি। বাড়ির সবাই বিশ্বাস করলেও আমি কিন্তু করি নি। কারণ মিথ্যের লংকায় একটা সত্যের আগুন ই যথেষ্ট। আপনার সব চুরি হলো, দামি ঘড়িটা থেকে গেলো অদ্ভুত না? যাই হোক, আমি বাধা দেই নি কারণ আপনি দাদাজানের চিকিৎসা করেছিলেন। তবে আপনার মতলব যে খুব সুবিধার নয় সেটা আমি জানি। আজ লুকোচুরি ছেড়ে সরাসরি জানতে চাচ্ছি, কি মতলবে এসেছেন আপনি?”

অনলের প্রশ্নে ঈষৎ বিস্মিত হলেও ভড়কালো না দীপ্ত। বরং তার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো বিচিত্র হাসি। বিনা সংকোচে সে মুখোমুখি হলো অনলের। নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
“যদি বলি আমার মতলব ধারাকে নিজের করে পাওয়া!”

কথাটি কর্ণকুহরে যেয়ে মস্তিষ্কে ঝংকার তুললো। অনলের মনে হলো কেউ তার হৃদয় খুবলে খাচ্ছে। হৃদয়ের অন্তস্থলে অসহনীয় তীব্র ব্যথার সাথে এক অসামান্য আক্রোশ, ক্রোধ তাকে ঘিরে ধরলো। শান্ত ঝিলের মতো চোখজোড়ায় ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ হারালো না অনল। নিজেকে সংযত রেখে বললো,
“স্বপ্ন দেখা ভালো, তবে অবাস্তব স্বপ্ন দেখা ক্ষতিকর। আমি তাজ্জব হচ্ছি আপনার সাহস দেখে, আমার সামনে আমার বউ এর দিকে কুনজর দিচ্ছেন। অদ্ভুত! আমি ভদ্র মানুষ বলে আমার ভদ্রতার সুযোগ নিবেন না।”
“কিসের বউ! একটা বিয়ে যার ভিত্তি নেই সেটার জোর দেখাচ্ছেন? ইভেন সেলিম আংকেল এই বিয়ে মানেন না! উপরন্তু ধারার বয়স কত! বাংলাদেশের আইনে ও এখনো নাবালিকা। তাহলে কিসের বিয়ে আর কিসের বউ”

অনল এবার কিছুক্ষণ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দীপ্তের দিকে। গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে এক হাত পকেটে পুড়ে শান্ত কন্ঠে বললো,
” আপনার ওই সেলিম আংকেলকে বলে দিবেন তার যা করার করে নিতে। আমার বউ আমার ই থাকবে। অস্ট্রেলিয়ায় বসে হুমড়ি তুমড়ি না করে দেশে এসে মুখোমুখি কথাটা বলতে। যখন আমার ফুপুকে রেখে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করতে ব্যাস্ত ছিলেন, তখন তার ভাবা উচিত ছিলো তার একটা মেয়ে আছে। সুতরাং আই হ্যাড নট ওর্ডারড হিজ গ্লাস অফ অপিনিয়ন। গো টেল হিম৷ আর একদিন সময় দিচ্ছি। আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন। চাচু আর বাবা ঘাড় দিয়ে বের করুক তার পূর্বেই আপনি নিজ থেকে বেরিয়ে যান”

বলেই ভেতরে পা বাড়াতে নিলে দীপ্ত হিনহিনে কন্ঠে বলে উঠে,
“আর ইউ স্ক্যায়ারড অফ মি? ভয় পাচ্ছো সত্যি তোমার ধারাকে নিয়ে ছু মন্তর না হয়ে যাই। অবশ্য হতেই পারো। আফটার অল আমি যা চাই, তা আদায় করেই ছাড়ি”

কথাটা শেষ করতে পারলো না দীপ্ত তার আগেই তার চোয়ালে সজোরে একটা মুষ্টিবদ্ধ হাতের ঘু’ষি এসে পড়লো। আকস্মিক ঘটনায় টাল সামলাতে পারলো না দীপ্ত, ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো। হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অনলের দিকে। তার কপালের শিরা ফুলে উঠেছে। চোখ অগ্নিদৃষ্টি বর্ষণ করছে। ঘটনায় ধাতস্থ হবার আগেই অনল একটু ঝুঁকে তার কলার চেপে ধরলো। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
“এর পর থেকে এই ঘু’ষি’টার কথা স্মরণে রাখবেন। লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি, আমার ভদ্রতার সুযোগ নিবেন না। আমি মানুষটা দুধে ধোওয়া তুলসি পাতা না”

বলেই ছেড়ে দিলো দীপ্তকে। দীপ্তের শুষ্ক ঠোঁটে ফে’টে তরল রক্ত গলগল করে পরছে। সে এখন অনলের কঠিন মুখখানার দিকে তাকিয়ে আছে। এভাবে আহত হবে অকল্পনীয় ছিলো। অনল ভেতরে চলে গেলেও দীপ্ত এখনো সেখানেই বসে রইলো। তার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। হাত দিয়ে র’ক্তটুকু মুছতে মুছতে বললো,
“ইন্টারেস্টিং, এবার খেলা জমবে”

********

বই খুলে হা করে শুন্যের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ধারা। পড়াতে মন বসছে না। তার সম্পূর্ণ ধ্যান ঘুরপাক খাচ্ছে অনল এবং দীপ্তের কথোপকথনের উপর। তাদের মাঝে কি কথোপকথন হচ্ছে ব্যাপারখানা ভেবেই কিঞ্চিত বুক কাঁপছে তার। প্রিন্স উইলিয়ামের রাগ তার জানা। তখন যেভাবে তাকিয়ে ছিলো ধারার মনে হচ্ছিলো যেনো অনলের চোখ থেকে আগুন ঝরছে। ধারার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিলো। তার বারণের স্বত্তেও ধারা শুধু দীপ্তের সাথে কথাই বলে নি তার সাথে বিকেলের সময়টুকু কাটিয়েছে। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও ব্যাপারটাকে এড়াতে পারে নি। কারণ এই দীপ্ত নামক ব্যাক্তিটি তাকে ভীষণ বাজে ভাবে ফাঁসিয়েছে। যথারীতি তাকে ব্লা’ক’মে’ই’ল করেছে। অনলকে জানাবার সুযোগটিও হয় নি তার। অনল কি তাকে ভুল বুঝবে! রাগ করবে তার উপর! অবশ্য রাগ করাটা অস্বাভাবিক হবে না। ব্যাপারটা ভাবতেই হতাশ ধারা মাথা নোয়ালো। বই এর উপর দু এক বার মাথা ঠোকালো। উদ্বিগ্নতা তাকে ঘিরে রেখেছে। মাথাটা চিন্তার ঘোরে ফেটে যাবার জোগাড়। ঠিক সেই সময় সজোরে দরজায় আঘাত করে অনল। হনহন করে ভেতরে প্রবেশ করে সে। তার কঠিন, রক্তিম মুখখানার দিকে তাকাতেই শুকনো ঢোক গিলে ধারা। অনল ধপ করে বসলো বিছানায়। জোরে জোরে বার কয়েক নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু ব্যর্থ হলো। ফলে হনহন করে হেটে ওয়াশরুমে চলে গেলো সে। ধারা তাকে কিছু প্রশ্ন করার সুযোগ পেলো না। নির্বাক দর্শকের মতো শুধু চেয়ে রইলো।

আধ ঘন্টা পর অনল বেরিয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে চুল মুছতে মুছতে। তার চুল বেয়ে জলকনা গড়িয়ে পড়ছে মুখশ্রীতে। কঠিন মুখশ্রী এখনো নির্বিকার। বোঝা যাচ্ছে সে গোসল সেরে এসেছে। শ্যাওলা রঙ্গের টি শার্টটি বুকের কাছে ভেজা। বলিষ্ট বাহুজোড়ার লোমও ভিজে লেপ্টে আছে বাহুর সাথে। ধারা কিছু সময় অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অনলের দিকে। নির্লজ্জ চোখ জোড়া যেনো কিছুতেই দৃষ্টি সরাতে পারছে না। মাঝে মাঝে ধারার অবিশ্বাস্য লাগে, প্রিন্স উইলিয়ামটি তার বর! প্রতিদিন নতুন করে লোকটির প্রতি বিমোহিত হয় সে, প্রতিদিন নতুন করে তার মনকাননে প্রণয়ের সিন্ধুপুষ্প ফুটে। প্রতিদিন নতুন করে লোকটিকে ভালোবাসে। আয়নায় ধারা মুখ খোলা বিমোহিত চেহারাটি দৃষ্টি এড়ায় না অনলের। তখনের ক্রোধ ঠান্ডা পানির প্রভাবে একটু হলেও শান্ত হয়েছে। আয়নার তাকিয়ে নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,
“মুখ বন্ধ কর, মাছি ঢুকে যাবে”

অনলের উক্তি কানে আসতেই স্বম্বিত ফিরে ধারা। সাথে সাথে মুখ বন্ধ করে ফেলে সে। একটু সাহস করে রয়ে সরে বলে,
“তুমি কি রেগে আছো?”

প্রশ্নটি শুনতেই পেছনে তাকায় অনল। উত্তর দেবার পূর্বেই সজোরে চিৎকার শুনতে পায় সে। ধারা ধরফরিয়ে উঠে। অনল টাওয়াল বিছানায় ছুড়েই ছুটে বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। ধারাও বসে থাকে না। সেও পিছু নেয়। ঘর থেকে বের হতেই সুভাসিনীর দেখা পায়। তাকে চিন্তিত দেখায়। উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধায়,
“চিৎকার শুনেছিস?”
“হ্যা, কিন্তু চেঁচালো কে!”
“দীপ্তের ঘর থেকে এলো না!”

হ্যা চিৎকারটি দীপ্তের ঘর থেকেই এসেছে। ইতোমধ্যে বাড়ির বাকিরাও এসে জড়ো হলো। ইলিয়াসের মেজাজ খারাপ। সে খিটখিটে গলায় বলে উঠলো,
“এই বিদেশী তো শান্তি দিচ্ছে না, রাত দুপুরে এভাবে চেঁচাচ্ছে কেনো?”
“পড়ে টরে গেছে কি না, ওর ঘর থেকে বিকট শব্দ এসেছে”

রুবির কথা শুনতেই আর দেরি করলো না অনল। ছুটে গেলো দীপ্তের ঘরে। ঘরের দরজাটি ভেজানো ছিলো। দরজা ঠেলতে তা খুলে গেলো। দরজা খোলার পর যে দৃশ্যের মুখোমুখি হলো তা কল্পনীয়। রীতিমতো বিস্মিত নজরে তাকিয়ে রইলো বাড়ির লোকেরা। দীপ্তের খাটটি বিধ্যস্তভাবে ভাঙ্গা ঠিক মাঝবরাবর। দীপ্তের মাজা আটকে আছে সেই কাঠের ফ্রেমে। চাইলেও মুক্ত হতে পারছে না। উপরন্তু সে পাগলের মতো নিজের গা চুলকোচ্ছে। তার শুভ্র শরীর চুলকাতে চুলকাতে লাল হয়ে গিয়েছে৷ তবুও তার চুলকোনো থামছে না। তাকে পাগলের মতো লাগছে। মাজার ব্যাথা এবং গায়ের অসহনীয় পরিস্থিতি তাকে পাগল প্রায় করে তুলেছে। এই অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হতেই সে আর্তনাদ করে যাচ্ছে। দীপ্তের পরিস্থিতি সেই ফাঁদে পড়া ঘুঘুটির মতো। যে আত্নচিৎকার করে নিজেকে মুক্ত করার অভিপ্রায় রাখে। এতো গুরুতর মূহুর্তেও অনলের কঠিন মুখে হাসি ফুটে উঠলো। অঘোষিত শত্রুর মন্দ দেখতে হয়তো কারোর ই খারাপ লাগে না। ধারা খেয়াল করলো অনল মিটিমিটি হাসছে। কিন্তু সুভাসিনী কন্ঠ শুনতেই হাসি থেমে গেলো। তিনি বলে উঠলেন,
“ওকে ওঠা, মাজা টাজা ভাঙ্গলো কি না দেখ”

অনল অপেক্ষা করলো না। টেনে তুললো দীপ্তকে। দীপ্ত পাগলের মতো নিজেকে চুলকে যাচ্ছে। তাকে জিজ্ঞেস করতেই সে অসহায় কন্ঠে বললো,
“আমি এসে ফ্যান ছেড়ে বসতেই খাট ভেঙ্গে গেলো। আর আমি আটকে গেলাম। মিনিট দশেক বাদেই এই এলার্জি। গা চুলকে লাল হয়ে যাচ্ছে। দিস ইজ ইনটলারেবল। এতো কেনো চুলকাচ্ছে শরীর? আমি তো এলার্জির কিছু খাই নি”

তার স্বীকারোক্তি শেষ হতেই অনল বললো,
“ডাস্ট এলার্জি হতে পারে। আসলে সারাদিন বাহিরে ঘুরেছেন তো। এক কাজ করুন গোসল করে ফ্রেশ হন। আই থিংক সেরে যাবে। না সারলে চুলকানির মলম দিচ্ছি”

দীপ্ত মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। মাজা না ভাঙ্গলেও বেশ ব্যাথা পেয়েছে সে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনো মতে ওয়াশরুম অবধি গেলো সে। দীপ্ত যেতেই অনল এবং ইলিয়াস সজোরে হেসে উঠলো৷ এতো সময় হাসি থামিয়ে রেখে পেট ফুলে গেছিলো তাদের। বিদেশী মানুষের এমন নাজেহাল অবস্থা তাদের বিনোদন ই দিলো। ইলিয়াস হাসতে হাসতে বললো,
“কিভাবে চুলকাচ্ছিলো, যেনো কেউ বিচুটি পাতা ডলে দিয়েছে। ওর অবস্থাটা দেখার মতো ছিলো। একেবারে বিদেশি পাগল”

কথাটি শুনতেই অনলের বুঝতে বাকি রইলো না এই কান্ডটি ঠিক কাদের। দীপ্ত যে খাটটিতে ঘুমায় তার অবস্থা হলেও একেবারে খারাপ হয়। তাই সেটা হুট করে ভেঙ্গে পড়াটা সন্দেহজনক। উপরন্তু কারোর এতোটা ডাস্ট এলার্জি হবে না যে নিজেকে চুলকে র’ক্ত বের করে ফেলার মত অবস্থা হবে। যেখানে দীপ্ত নিজেই বিস্মিত। তাই এটা যে তার প্রখ্যাত বোনেদের বোনদের কাজ অনল নিশ্চিত। তার আন্দাজটি একেবারে ঠিক। এই নিপুন কাজটি জমজের। দীপ্তকে বের হতে দেখেই তারা ফন্দি আটলো আজকের দিনটা কি করে দীপ্তের জন্য বিভীষিকাময় করে তোলা যায়। তারা পুরোনো খাটের ফ্রেমের ঠিক মাঝবরাবর যে কাঠটি থাকে সেটাকে হাতুড়ি দিয়ে অর্ধেক ভাঙ্গা অবস্থায় রেখে রেখে দিলো। ফলে দীপ্তের ভর পড়তেই কাঠটি ভেঙ্গে গেলো। যার ফল খাটের বিধ্যস্ত অবস্থা। উপরন্তু সারা চাঁদরে ছিটিয়ে দিলো ফর্মুলা নাম্বার ৪২০। অতি বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজটি করলো তারা। যেনো কেউ টের ও না পায়। দীপ্তের বিদেশী সিল মোহরের জন্য এবারটিতে ছাড় পেয়ে গেলো। অনল আড়চোখের তাকালো দরজার কাছে শিটিয়ে থাকা অসহায় মুখে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরীদ্বয়ের দিয়ে। মুখটাকে অসহায়ের মতো করে রাখলেও তাদের চোখের উৎফুল্লতা এবং ঠোঁটের কোনে চেপে রাখা বিজয়ী হাসি নজর এড়ালো না অনলের। মনে মনে দীপ্তের ভবিষ্যতের জন্য সন্দেহ ই হলো। অপর দিকে নিজেদের বিশাল সফলতায় একে অপরের সাথে হ্যান্ডশেক করলো৷ আশা ফিসফিসিয়ে বলল,
“চেরাগআলীর জন্য কষ্টই হচ্ছে। এসেছিলো দেশ ভ্রমণে। এখন হাসপাতাল ভ্রমণ করতে হবে”
“বেঁচারা, সে তো জানতো না তার সাক্ষাত কাদের সাথে হবে। এসেছিলো মানুষ হয়ে, ফিরবে কি হয়ে সেটা আল্লাহ ই জানে”

বলেই দুজন হাসতে লাগলো। এশা আশার খপ্পরে পড়ে বেঁচারা সত্যি নাজেহাল। ওয়াশরুম থেকে গোসল করে এসে চুলকানি থামলো কিছু ব্যাথা না। সারা শরীর লাল হয়ে আছে তার। চুলকে চুলকে মুখটা ফুলে গিয়েছে। উপরন্তু খাটটাও ভাঙ্গা। অনল এবং ইলিয়াস মিলে খাট সরিয়ে যাজিম বিছিয়ে দিলো। বেচারাকে রাতটা মাটিতেই কাটাতে হবে। কিছুই করার নেই। মাজা ব্যাথা নিয়ে মাটিতে থাকলেও এ বাড়ি ছাড়বে না সে।

দীপ্তের ব্যবস্থা করে ঘরে ফিরলো অনল। ধারাও ফিরলো তার পিছু পিছু। মনে হাজারো প্রশ্ন দলা পেকে আছে তার। অনলের কাছে উত্তর পাওয়া বাকি। তাই দেরি না করেই বলে উঠলো,
“আমি ইচ্ছে করে যাই নি লোকটির সাথে। সে আমাকে ব্লা’ক’মে’ই’ল করেছিলো। আসলে বন্ধুদের সামনে আমার বিয়ের কথাটা এমন ভাবে তুললো আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। উপরন্তু তোমার নাম জানাজানি হলে ব্যাপারটা জলঘোলা হবে। তাই আমি উনার শর্তে রাজি হয়েছি। প্লিজ আমার উপর রাগ করো না”

এক নিঃশ্বাসে কথাটা বলে নতমস্তক দাঁড়িয়ে রইলো ধারা। অনলের রাগ উগরানোর অপেক্ষা করতে লাগলো সে। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটলো না। বরং অনল তার হাত টেনে বক্ষস্থলে মিশিয়ে নিলো। শক্ত বেষ্টনীতে নিবিড়ভাবে আবদ্ধ করে রাখলো। ললাটে উষ্ণ পরশ দিয়ে বললো,
“তোর কেনো মনে হলো আমি তোর উপর রাগ করবো যেখানে আমি সবটা জানি!”…………
#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২৬তম_পর্ব

এক নিঃশ্বাসে কথাটা বলে নতমস্তক দাঁড়িয়ে রইলো ধারা। অনলের রাগ উগরানোর অপেক্ষা করতে লাগলো সে। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটলো না। বরং অনল তার হাত টেনে বক্ষস্থলে মিশিয়ে নিলো। শক্ত বেষ্টনীতে নিবিড়ভাবে আবদ্ধ করে রাখলো। ললাটে উষ্ণ পরশ দিয়ে বললো,
“তোর কেনো মনে হলো আমি তোর উপর রাগ করবো যেখানে আমি সবটা জানি!”

অনলের কথাটা বুঝতে সময় নিলো ধারার মস্তিষ্ক। মাথা উঁচিয়ে ফ্যালফ্যালিয়ে চাইলো সে। অনলের শান্ত মুখশ্রীর স্নিগ্ধ মনোমুগ্ধকর হাসি কিছুটা হলেও অবাক করলো ধারাকে। ভেবেছিলো অনল আক্রোশ উগরাবে। সে প্রস্তুত ও ছিলো, দোষ করলে তো শাস্তি মাথা পেতে নিতেই হয়। কিন্তু অনলের মোলায়েম কন্ঠ এবং স্নিগ্ধ স্নেহ তাকে বিস্মিত করলো। অবাক কন্ঠে বললো,
“তুমি জানতে? তুমি রাগ করো নি?”
“না করি নি, না জানা থাকলে হয়তো রাগ করতাম। তুই যখন দীপ্তকে নিয়ে কলেজ থেকে বেড়িয়ে যাস, সেই ফাঁকে মাহি আমার রুমে আসে। দীপ্তের সম্পূর্ণ কথাটা বলে আমায়। তখন ই বুঝতে পারি ওর সাথে যাবার কোনো তো কারণ অবশ্যই আছে। কারণ, আমার ধারা না ভেবে কোনো কাজ করে না”
“এতোটা বিশ্বাস করো আমায়?”
“অবিশ্বাস করা উচিত বুঝি?”

অনল হাসলো; অমলিন, স্নিগ্ধ মোলায়েম হাসি। ধারা মাথা ঠেকালো অনলের বলিষ্ট বুকে। দু হাত ধরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। নিস্তব্ধ ঘর, পুরোনো ফ্যানের শব্দ ব্যাতীত কোনো শব্দ নেই। বাহিরেও নিস্তব্ধতা। যেনো সারা শহর ডুবে আছে কোনো ঘোরে। অনল ভাঙ্গলো নিস্তব্ধতা, নরম স্বরে বললো,
“আর কটা দিন, এর পর তোর সেমিস্টার শেষ আর আমার কোর্স ও। ইনশাআল্লাহ এর পর আর লুকোচুরি করতে হবে না। আমি আর তোদের কোর্সও নিবো না। তখন তুই নির্ভয়ে বলতে পারবি, আমি তোর; শুধু তোর”
“সেই দিনটির অপেক্ষা। আমি চাই না, আমার জন্য তোমাকে গায়ে কোনো কলঙ্ক লাগুক”

ধীর কন্ঠে কথাটা বললো ধারা। অনলের হাসি প্রাসারিত হলো। দুহাতে আলতো করে তুলে ধরলো তারা মুখশ্রী। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,
“মাঝে মাঝে প্রশ্ন হয়, কেনো এই ছোট মেয়েটির প্রেমে পড়লাম। কেনো এতো মায়ায় জড়ালাম। পরমূহুর্তে না চাইতেই উত্তর পেয়ে যাই। আজ তোর কাছে একটা আবদার করলে রাখবি?”
“বলেই দেখো”
“মনটা বেহায়া হয়ে উঠছে। অনুভূতিগুলো হাহাকার শুরু করেছে। অন্তস্থলে জমিয়ে রাখা এক বিন্দু শীতল প্রণয় এখন প্রহেলিকার রুপ নিয়েছে। অবাধ্য ইচ্ছেরা জোয়ার তুলেছে ধারা। আমার মন কাননের ভেজা প্রণয় গোলাপটি তোমায় দিলাম, তুমি কি ফিরিয়ে দিবে নাকি রেখে নিভৃত যতনে?”

অনলের ঘোরলাগা কন্ঠের “তুমি”টুকুর মাঝে এতো মাদকতা থাকবে জানা ছিলো না। যেনো সম্মোহনী ডাক। এই প্রথম অনলের কন্ঠে তুমি টুকু শুনলো সে। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো অনলের মুখশ্রীর দিকে। তার নেশাগ্রস্থ চাহনী, অস্থির মুখশ্রীর পানে তাকিয়ে থাকা গেলো না। গলা শুকিয়ে এলো, হৃদস্পন্দন হয়ে উঠলো লাগামহীন। ঠোঁট ভেজালো ধারা। বলতে ইচ্ছে হলো,
” রেখে নিবো যতনে”

কিন্তু মুখ থেকে কথা বের হলো না। শুধু মাথাটা উপর নিচ নামিয়েই মুখ লুকালো অনলের বক্ষস্থলে। অনল নিঃশব্দে হাসলো। বাহিরে আজ পূর্ণচন্দ্র, তবে নিকষকালো মেঘের আড়ালে রুপালী চাঁদটি যেনো ঘা ঢাকা দিয়েছে। তাই স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নাটি শুধু মেঘের মাঝেই আবদ্ধ। অনলের মনে হলো তার একান্ত চন্দ্রটি আজ নিজেকে অনলের মাঝে লুকিয়ে রেখেছে। তাই সেই জ্যোৎস্নাটিও তার মাঝে আবদ্ধ। নিষিদ্ধ ইচ্ছের জোয়ারকে আজ বাঁধা দিলো না অনল। কোলে তুলে নিলো নিজের শশীকে। তারপর সে প্রস্থান করলো বিছানার দিকে।

নিগূঢ় রাত, নিস্তব্ধতায় ডুবে আছে শীতল ঘরটি। ফ্যানটির ক্যাচর ক্যাচর শব্দ কিছুটা ক্ষীণ। মাঝে কিছু তপ্ত নিঃশ্বাস, কিছু নিষিদ্ধ বাসনা এবং এক বিন্ধু স্নিগ্ধ প্রণয়। একে অপরের মাঝে লেপ্টে আছে মানব মানবী। নিজের ছোট বউটিকে পরম স্নেহে বুকের সাথে মিশিয়ে রেখে অনল। ক্লান্ত ধারা ঘুমেমগ্ন। কিন্তু অনলের চোখে ঘুম নেই। সে চিন্তিত। চিন্তিত দুজন মানুষের জন্য, দীপ্ত এবং সেলিম সাহেব। এই দুজনের উদ্দেশ্য অজানা। ভোরের আলো ফুটতে বহু দেরি। কেবল রাতের শেষ প্রহর। অনল ও ক্লান্ত। ধারাকে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরলো সে। শুভ্র কপালে উষ্ণ পরশ ছুঁয়ে বললো,
“তুই চিন্তা করিস না, যে যাই করুক আমি তোকে আমার থেকে দূরে যেতে দিবো না”

এরমাঝেই ঈষৎ কেঁপে উঠলো ধারা। অনল বুঝলো তার বউ এর ঠান্ডা লাগছে। কাঁথাটা টেনে দিলো সে৷ তারপর ঘুমে ক্লান্ত চোখজোঁড়া বুঝলো। সাথে সাথেই রাজ্যের ঘুম তাকে ঘিরে ধরলো।

*******

সকাল কো’টা বাজে জানা নেই। মোটা পর্দায় ঘেরা ঘরটিতে এখনো সূর্যালোক ঢুকে পারে নি। ফলে ঘরটি এখনো আঁধারে ঘিরে আছে। ধারার চোখ খুললো। পিটপিট করে চাইলো আশেপাশে। সর্বপ্রথম যা নজরে পড়লো তা হলো অনলের ঘুমন্ত মুখশ্রী। শান্ত, স্নিগ্ধ, শীতল মুখশ্রী। পরমূহুর্তেই গতরাতের কথা স্মরণ হলো। তীব্র লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠলো তার গাল। তবুও ঠোঁটের হাসি টুকু যেনো এখনো প্রাণবন্ত। সে উঠে ওয়াশরুমে গেলো। মিনিট পনেরো বাদে যখন বের হলো তখন অনল গভীর ঘুমে। হুট করেই মাথায় চাপলো দুষ্ট বুদ্ধি। ধীর পায়ে তার পাশে বসলো। গামছায় বাধা ভেজা চুলগুলো ঝাড়া দিলো ঠিক অনলের মুখের উপর। পানির ছিটা মুখে এসে পড়তেই ঘুমটা নড়বড়ে হলো অনলের। ভ্রু কুচকে বিরক্তি প্রকাশ করলো সে। কিন্তু চোখ খুললো না। ধারা মিটিমিটি হেসে পুনরায় একই কাজ করলো। এবার অনল চোখ খুলে তাকালো। ধারা উঠে যেতে নিলেই খপ করে হাতটা ধরে নিলো অনল। হ্যাচকা টানে ধারাকে নিজের কাছে নিয়ে এলো। শান্ত কন্ঠে বললো,
“ঘুমন্ত আমাকে জ্বালিয়ে তো বিশাল এভারেস্ট জয় করেছিলি, তা থামলি কেনো?”
“ছাড়ো, লাগছে”
“ছাড়বো কেনো? আমিও দেখি আমার বউটির পেটে কত দুষ্টুবুদ্ধি”

বলেই ধারা কোমড়ের হালকা চাপ দিলো অনল। ধারা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো, তবে ব্যর্থ হলো। তখন অসহায়ের ন্যায় বললো,
“ভুল হয়েছে, আর করবো না”
“তা বললে তো হচ্ছে না শাস্তি তো পাওনা”
“কি শাস্তি?”
“বেশি কিছু না, শুধু একটা শীতল চুমু”

বলেই এগিয়ে আসতে নিলেই ধারা তাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে। এক মূহুর্ত ঘরে থাকা ভয়ংকর তাই দেরি না করেই ঘর থেকে পালিয়ে যায় সে। অনল মুখে বাঁকা হাসি টেনে বলে,
“শোধ তো আমি নিবোই”

খাবার টেবিলে পৌছাতেই জম্পেস খবর পাওয়া গেলো। যা অনলকে বেশ অবাক করলো। দীপ্ত সকাল হতেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। লাগেজ তার এমনিতেও ছিলো না। ফলে সকাল হতেই নিজের সেই প্রথম দিনের শার্ট এবং প্যান্টটি পড়ে বেশ ফিটবাবুর মতো সে তৈরি হয়ে গেলো। অনল ধারা ব্যতীত সকলকেই বসার ঘরেই পেলো সে। তাদের কাছে বিদায় নিয়ে বললো,
“সকালে বাবাকে ফোন করেছিলাম, উনি আমার সব জিনিস পাঠিয়ে দিয়েছেন তার এসিস্ট্যান্টকে দিয়ে। সুতরাং এ বাড়িতে থাকার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। ভাগ্যে থাকলে আমাদের আবার দেখা হবে”

ছেলেটি নাকি খায় ও নি। ভদ্রতার খাতিরে সুভাসিনী বলেছিলো,
“তুমি একদিন থেকে যাও, কাল যা হলো। তোমার মাজার ব্যাথা তো সাড়ে নি”

প্রত্যুত্তরে হেসে বললো,
“আপনাদের আপ্প্যায়নে আমি সত্যি স্যাটিসফাইড, অজানা ছেলের প্রতি এতো ভালোবাসা কেউ দেখায় না। আর মাজার ব্যাথা এখন নেই। রাতে ঔষধ খেয়েছিলাম। আমাকে নিয়ে ভাববেন না৷ আসি আমি”

বলেই দীপ্ত চলে গেলো। ছেলেটি ঝড়ের মতো এসেছিলো, আবার দক্ষিণা বাতাসের মতোই চলে গেলো। এতে অবশ্য জামাল সাহেব বেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। ছেলেটি সেলিমের পরিচিত না হলে তার সাথে ভালো খাতির ই হতো তার। কিন্তু আফসোস সে সেলিম সাহেবের পরিচিত। দীপ্তের যাওয়াতে সবচেয়ে বেশি দুঃখী মনে হলো জমজদের। সে দ’স্যিরা শান্ত থাকে না তাদের দেখা গেলো পা ছড়িয়ে বসার ঘরের কার্পেটের উপর বসে থাকতে।মুখজোড়া লম্বাটে হয়ে আছে। অনল তাদের মুখ দেখেই বললো,
“কি রে! এমন বাংলার পাঁচের মতো মুখ ঝুলিয়ে আছিস কেনো?”

উত্তরে এশা উদাস কন্ঠে বললো,
“দীপ্ত ভাইয়ের স্বাগতমে কতোকিছু ভেবেছিলাম, কিন্তু উনি বিনা নোটিসেই চলে গেলেন। কষ্ট লাগবে না?”
“তুমি বুঝবে না অনল ভাই, পাষাণরা বুঝে না। মানুষটাকে তো ভালো করে খাতির ই করা হলো না। ধ্যাত, এমন ভালো মানুষ কি পাওয়া যায়?”

এশার কথার সাথে তাল মিলিয়ে আশা বলে উঠে। বোনেদের এমন কথায় রীতিমতো অবাক অনল এবং ধারা। অনল ভ্রু কুচকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলো জমজদের দিকে। তাদের মুখ এখনো তেমন ই। তারা যেনো সত্যি মর্মাহত। তাদের দুঃখ যেনো অতুলনীয়। থেকে থেকে তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। দীপ্তের পালিয়ে যাওয়ার হরেক কারণের মাঝে একটি যে জমজরা ছিলো সেটা বুঝতে ভুল হলো না অনলের। তারা যে বেচারার স্বাগতমে আর কতো কি রেখেছিলো শুধু উপর ওয়ালাই জানেন। ভাগ্যিস পালিয়ে গেছে সে। তবে দীপ্তের এমন ভাবে চলে যাওয়াটা বেশ অবাক ই করলো ধারা এবং অনলকে। অনলের হুমকিতে চলে গেছে এমনটা হবার সম্ভাবনা কম। তবে কি তার স্বার্থ উদ্ধার হয়ে গিয়েছে! অনল বেশি মাথা ঘামালো না, লোকটি গিয়েছে সেটা স্বস্তির ব্যাপার। কারণ ধারাকে হারাবার ভয়টা এখন ক্ষীণ থেকে ক্ষীনতর হয়ে যাচ্ছে। অনলের মুখে একচিলতে হাসি দেখে ধারা শুধালো,
“কি হয়েছে? হাসো কেনো?”
“কিছু না, এমনি”

*****

অবশেষে এক এক করে শেষ হলো ধারার পরীক্ষা, বিশদিনের টানা পরিশ্রমের পর শেষ হলো পাঁচটি পরীক্ষা। আজ শেষ পরীক্ষা। এই পরীক্ষার খ’ড়া’র থেকে মুক্তি পাবার আনন্দ ই আলাদা। এখন তারা আর ফার্স্ট ইয়ারে নেই। হয়ে গিয়েছে সিনিয়র। অবশ্য জুনিয়রদের ক্লাস শুরু হতে দেরি আছে। তবুও বেশ দাপটে ভাব চলে এসেছে। বন্ধুমহলে বেশ উৎসাহ। ভেবেছিলো অনল স্যার তাদের নাকানি চুবানি খাওয়াবে কিন্তু তেমন কিছু হয় নি। লেকচারের মধ্যেই তার প্রশ্ন হয়েছে। অন্য সকল কোর্স ও মন্দ যায় নি। নীরবের পাশাপাশি সবার পরীক্ষাই ভালো গিয়েছে। তবে বেশি ভালো গিয়েছে ধারার। প্রিন্স উইলিয়ামের কড়া শাসনের মাঝে ধারার পরীক্ষা খারাপ হবার কারণ নেই। ধারাও অনেক কষ্ট করেছিলো যেনো সিজিটা ৩.২৫ এর বেশি হয়। তাহলে প্রিন্স উইলিয়ামকে যেয়ে বলবে,
“চলো, এবার ঘুরতে নিয়ে চলো”

ব্যাপারটা ভাবতেই মন খুশি হয়ে উঠলো ধারার। অভীক তো পারলে নীরবকে মাথায় তুলে নেয়। আবেগী স্বরে বললো,
“দোস্ত তোর জন্য এ যাত্রায় আমি পার হয়ে যামু। তোরে তো একুশটা তোপের সালামি দিতে মন চাচ্ছে। বল দোস্ত কি চাই তোর?”
“কিছু না তুই এবার নিজের বাড়ি যায়ে আমাকে স্বাধীন কর”

হতাশ কন্ঠে বললো নীরব। বলবে নাই বা কেনো। এই পরীক্ষার উছিলায় গত বিশদিন যাবৎ অভীক তার মেসেই পড়ে রয়েছে। খাচ্ছে, দাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে। ছোট খাটে বিশাল দেহী মানুষটা হাত পা ছুড়ে যখন শোয়, তখন জীর্ণকায় নীরবকে বাধ্য হয়ে মাটিতে ঘুমাতে হয়। শুধু তাই নয়, রীতিমতো নীরবের পরিপাটি ঘরটিকে একটা গোয়াল ঘর বানিয়ে রেখেছে নিজের ময়লা কাপড়ে। উপরন্তু রাত বিরাতে ভরপেট খেয়ে বায়ুদূষণের কথা নাই বা তুললো। এয়ার ফ্রেশনার কিনতে কিনতে নীরব ফকির প্রায়। বন্ধু বিধায় লা’থি মেরে বের করতে পারলো না নীরব। ফলে এই পরীক্ষা শেষ হওয়ার আনন্দের থেকে অভীকের অত্যাচারের ইতি হবার আনন্দটাই নীরবের মাঝে বেশি। বন্ধুমহলের সকলের মাঝে উৎসাহ দেখা গেলেও দিগন্তকে দেখালো শান্ত। কেউ ব্যাপারটা আমলে না তুললেও মাহি ঠিক ই তুললো। হুট করেই বলে উঠলো,
“কিরে বিবিসি, তোর মুখ শুকনো কেনো? কোনো নতুন খবর টবর নেই নাকি?”

মাহির হাসির ছলে বলা কথাটা দিগন্ত যে অন্যভাবে নিবে জানা ছিলো না কারোর ই। সে বিচিত্রভাবে হাসলো। তারপর নিস্প্রভ কন্ঠে বললো,
“খবর তো অনেক ই আছে। কিছু খবর তো এমন যা মাটি কাঁপিয়ে দিবে। কিন্তু তোরা সেই খবরটা শুনতে চাস কি না সেটা হচ্ছে ফ্যাক্ট”
“এভাবে বলছিস কেনো? তোর মন খারাপ বিধায় আমি কথাটা তুললাম”
“ওহ! তাই বুঝি”

টিটকারির স্বরে বললো দিগন্ত। ধারার বিয়ের খবরটি শুনবার পর থেকেই দিগন্তের মাঝে একটা অভূতপূর্ব পরিবর্তন লক্ষয় করা গেছে। সে তুলনামূলক শান্ত এবং মনমরা হয়ে গেছে। প্রাণঞ্জ্বল, চো’গ’ল’খো’র দিগন্তটি যেনো কোথাও মিলিয়ে গেছে। দীপ্ত কথাটি ফাঁস করার পরদিন ধারা সকলকে খুলে বললো ঘটনা। হুট করে বিয়েটা নিজের ই মানতে আপত্তি হচ্ছিলো তাই কাউকেই জানায় নি সে। ধারার স্বীকারোক্তিতে সকলে মেনেও নিলো। ধারাকে বরের নাম শুধাতেই সে বললো,
“সময় হলে ঠিক পরিচয় করিয়ে দিবো। একটু সময় দে”

অভীক বা নীরব ধারার সিদ্ধান্তে ভেটো দিলো না। কিন্তু এর মাঝে দিগন্তকে দেখা যায় মৌন। তার যেনো কোনো কিছুতেই কোনো গুরুত্ব নেই। ব্যাপারটা নীরব ঠিক ই বুঝতে পারে। কারণ দিগন্তের মনের ব্যাপারটা তার অজানা ছিলো না। দিগন্তকে বোঝাবার চেষ্টাও করে সে। দিগন্ত তখনও থাকে শান্ত। তবে আজ তার কথার সুর যেনো অন্যরকম। ফলে মাহির সাধারণ কথায় তার প্রতিক্রিয়া মারাত্মক। অভীক খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বলে,
“আচ্ছা, গোলগোল না ঘুরিয়ে ঝেড়ে কাশ। তোর ঝামেলাটা কোথায় হচ্ছে?”
“আমার কি ঝামেলা হবে! আমি তো মাহির কথার উত্তর দিয়েছি। কি মাহি! আমি কি বলবো খবরটা? অবশ্য ধারার আপত্তি না থাকলে বলতেই পারি”

দিগন্তের কথার ভোল সন্দীহান ঠেকলো। ধারাকে ঠেস মেরে যখন কথাটা বললো, তখন ই বন্ধুমহলের উত্তেজনা বাড়লো। ধারার ভ্রু কুচকে এলো, শান্ত কন্ঠে বললো,
“দিগন্ত তোর এই কথাগুলো সত্যি আমরা বুঝছি না। যা বলার বলেই ফেল না, অহেতুক কথা প্যাচাচ্ছিস কেনো?”
“আমি প্যাচাচ্ছি নাকি তুই রীতিমতো ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস! তোর মিস্ট্রি বরটি যে অনল স্যার সেটা বলতে কিসের আপত্তি বলতো!…………….

চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here