#হৃদমাঝারে – [০৬]
ফারহান মুনের দুই বাহু শক্তকরে চেপে ধরে ওর দিকে কটমট করে তাকায়। কিছু বলতে যাবে তখনি মুন ব্যথায় কুঁকড়িয়ে উঠে। আহ, চোখ বন্ধ করে নেয় মুন। আকস্মিক ফারহান ওকে ছেড়ে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে বলল,
– সরি, তোমার লেগেছে খুব। ফারহানের চোখ-মুখে আতঙ্ক স্পষ্ট। সে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মুনের দিকে। ফারহানের এমন কান্ডে অবাক হয়ে যায় মুন। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ফারহানের চোখের দিকে। বেশ ভালো লাগছে মুনের। ফারহান ওকে নিয়ে এখনো ভাবে। না হলে মুনের একটু ব্যথায় ফারহান এভাবে রিএক্ট করত না। মুনের চোখের কোনে অশ্রুর ভীড় জমে যায়। ফারহান এখনো তাকিয়ে আছে মুনের চোখের দিকে। দুজন যেন দুজনের চোখে হাড়িয়ে গেছে। ফারহানের ধ্যান ভাঙ্গে ওর মোবাইলের রিংটোনের শব্দে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখলো স্কিনে মিদুলের নামটা জ্বলমল করছে। ফারহান কলটা রিসিভ করে কানের কাছে ধরতেই ওপাশ থেকে কি বলল বুঝতে পারলো না মুন। তবে লোকটার কথা শুনে যে ফারহান অবাক হয়েছে সেটা বুজতে বাকি রইলো না। ফারহান বলল,
– আমি আসছি। আর তুমি সবাইকে নিয়ে পৌঁছে যাও। সাবধানে যেও।
কথাটা বলেই কল কেটে দেয় ফারহান। তারপর আবার অন্য একজনকে কল করে। মুন অবাক হয়ে সবটা দেখে যাচ্ছে। কিন্তু ফারহান সে একেবারে জন্যেও মুনের দিকে তাকাচ্ছে না। ওর সামনে যে মুন দাঁড়িয়ে আছে সেটা হয়তো ফারহান ভুলেই গিয়েছে। এবার ফারহান কথা বলতে লাগলো,
– স্যার, আমার পুলিশ ফোর্স লাগবে। ইমারজেন্সি। তারপর কথা বলতে বলতে চলে যায় ফারহান। যাওয়ার আগে একবারও সে মুনের দিকে তাকায় নি। মুন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ফারহানের চলে যাওয়ার দিকে।
নিচে এসে ফয়সাল সাদিককে জানিয়ে সে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরে। গাড়িতে বসে আগে নিজের গায়ের কোটটা খুলে পাশের সিটে রাখে। পলাশ আর মিদুলকে কল করে সে তার গাড়ি স্টার্ট দেয়। ফুল স্পিডে গাড়ি চলছে ফারহানের। এই শহরের প্রতিটা অলিগলি চেনা ফারহানের তাই গাড়ি হাই স্পিডে চললেও ওর কোন অসুবিধা হচ্ছে না। গড়িটা এমন ভাবে চলছে মনে হচ্ছে, নাম মাত্র মাটি ছুয়ে উড়ে যাচ্ছে গাড়িটা। প্রায় আধঘণ্টা ড্রাইভ করার পর গাড়ি এসে থামলো একটা চলন্ত ট্রাকের সামনে। এক্সিডেন্টের ভয়ে ট্রাকটাও থামিয়ে দেয় ট্রাক ডাইভার। তারপরেই ট্রাকের পিছনে এসে থামে আরো দুটো গাড়ি। একটা পুলিশের গাড়ি। একে একে সবাই গাড়ি থেকে নেমে ট্রাকের কাছে আসতেই দেখলো ট্রাক ড্রাইভার নেই। সে পালিয়েছে। মিদুল ফারহানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– স্যার, ড্রাইভার পালিয়েছে?
কথাটা শুনে ফারহান দৌড়ে ট্রাকে উঠে। ড্রাইভারকে না পেয়ে রাগে গাড়িতে পরপর কয়েকটা লাথি মারে।উহ্ শিট। তারপর গাড়ির পিছনে উঠে। আর সেখান থেকে সতেরো জন শিশুকে উদ্ধার করে। তার মধ্যে দুজন একেবারেই ছোট। সদ্য হাটতে শিখেছে এমন শিশু। পুলিশ সবাইকে গাড়ি থেকে বের করে। আর শিশু দুটোকে নিয়ে ফারহানের সামনে আসে। বাচ্চাদুটোকে দেখে ফারহানের বুক কেপে উঠে। ছুয়ে দেখার জন্যে হাত বাড়ালে ওর হাতটা কেপে উঠে। নামিয়ে নেয় হাতটা। অজান্তেই চোখের কোনে জল এসে যায়।
– মানুষ কতটা হা*রামি। কি করে পারে এই শিশুদের অন্যদেশ পাচার করতে। মিদুলের কথায় তাল মিলিয়ে পলাশ বলে উঠে,
– এরা মানুষ নাকি। এরা একেকটা কু*ত্তা*র বাচ্চা। কু*ত্তা*র রক্ত বয়ছে ওদের শরীরে। তাইতো এমন কাজ করতে পারে। মানুষের বা*চ্চা হলে এমক কাজ করার কথা জিবনেও ভাবতে পারতো।
– হুম রে এরা মানুষ নয়। (মিদুল)
ফারহানকে এভাবে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিদুল ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
– স্যার এনি প্রবলেম?
ফারহান মাথা নাড়িয়ে না সূচক জবাব দেয়। স্বস্তির শ্বাস ফেলে মিদুল। ফারহান মিদুলকে জিগ্যেস করে,
– গাড়িটা কোথা থেকে ছেড়েছে?
– স্যার, এটা বেনামী গাড়ি। সোর্স দেওয়া না।
– গাড়ির মালিককে খুজে বের করো। তারপর সে নিজেই গাড়ির নাম্বারটা দেখে পুলিশকে বলে গাড়িটা পুলিশস্টনে নিয়ে যেতে সাথে বাচ্চাদের ও। শিমুল সব বাচ্চাদের নিয়ে যায় পুলিশস্টেশনে। মিদুলের মোহনা পলাশা আর দিয়া চলে যায় ক্রাইম ব্রাঞ্চে। সেখান থেকেই যা করার করতে হবে। সবাই চলে যাওয়ার পর ফারহান গাড়ি নিয়ে সোজা চলে যায় ঝিলের ধারে। ফারহানের মাখ খারাপ থাকে সে এখানে এসে বসে থাকে। ঝিলের ধারে বসে একের পর এক ঢিল ছুড়ে মারছে পানিতে। যার ফলে একটু শব্দ হয়ে পানিতে তরঙ্গের সৃষ্টি হচ্ছে। ফারহানের মাথায় নানা প্রশ্ন লঘুপাক খাচ্ছে। কে করছে একমন জঘন্যতম কাজ। তাছাড়া শিশুদুটো ওরাই বা কারা? এত ছোট বাচ্চা-ই বা বিদেশে কেন পাচার করা হচ্ছে? তাছাড়া যত বেআইনি কাজ কারবার তো সব তো রাতের আধারে হয়ে থাকে তাহলে দিনের আলোয় এই ট্রাকটা কি করছে? এর পিছনে কে আছে? বাচ্চাদের কথা মনে পড়তেই ফারহানের বুকটা কেপে উঠে। কিছুক্ষণ পর পলাশ কল করে। ফারহান কলটা রিসিভ করে গম্ভীর গলায় বলে,
– কিছু জানতে পারলে?
– স্যার, আমরা গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নাম্বার চেক করেছি। কিন্তু স্যার, গাড়িটা এই শহরের কারো নয়।
– মানে?
– রেজিস্ট্রেশন অনুযায়ী গাড়ির মালিক আতাউর রহমান। যে একটা গ্রামে বাস করে।
– মিদুক আর মোহনাকে সাথে নিয়ে সেই গ্রামে চলে যাও। গাড়ির মালিকের খোজ নাও। ড্রাইভারকে খুজে বের করো।
– ওকে স্যার।
তারপর আরো কিছুক্ষণ ঝিলের পাড়ে বসে থেকে সে ফিরে যায় মুনদের বাসায়। ওখানে যে আজ ওর ভাইয়ের আকদ। আপাদত ফারহান সব ভুলে অনুষ্ঠানে মন দিয়েছে। অর্ণা আর রওনাকের যখন আংটি পড়ানো হচ্ছিলো তখন মুন ও ফারহান দুজনেই একে অপরের দিকে তাকায়। একজনের চোখে অনুতাপ আর অন্যজনের চোখে ছিলো হাজারো অভিযোগ। মুনের এই দৃষ্টি উপেক্ষা করে ফারহান সেখান থেকে চলে আসে বাহিরে। গাড়িতে বসে গাড়ির স্টিয়ারিং এ জোরে পাঞ্চ মারে। বড় বড় করে শ্বাস নিয়ে নিজেই বলে উঠে,
– নাহ্ ফারহান নাহ্। এটা তুই ঠিক করছিস না। এই মেয়েটা তোকে ঠকিয়েছে। এ কাউকে ভালোবাসতে পারে না। এ তো শুধু জানে,,, আচ্ছা তুই কেন এত ভাবছিস? তোর মনে ওই মেয়েটার জন্যে কোন অনুভূতি নেই।
স্টিয়ারিং এ মাথা রেখে চুপচাপ বসে থাকে ফারহান। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ওর ওই বাচ্চা গুলোর কথা মনে পড়ে। আর সাথে সাথে পকেট থেকে মোবাইল বের করে শিমুলকে একটা কল দেয়। শিমুল কল রিসিভ করতেই ফারহান বলে উঠলো,
– বাচ্চাগুলো কি খবর?
– সবাইকে তাদের পরিবারে কাছে পৌছে দেওয়া হয়েছে। আসলে আশেপাশে থানারা এঅব্দি যতগুলো মিছিং ডাইরি ছিলো তাদের সবাইকে থানায় আনা হয়েছিলো। আর তারা সবাই তাদের নিজনিজ সন্তানকে নিয়ে চলে যায়। কিন্তু, শিমুলের গলাটা ভাড়ি। ওই শিশু বাচ্চাদুটোর পরিবারের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।
ফারহান কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। চোখ বন্ধ করতে বাচ্চাদুটোর চেহারা ভেসে উঠলো তার চোখের সামনে।চট করে চোখ খুলে তারপরেই বলে উঠলো,
– আশেপাশে যতগুলো হসপিটাল নার্সিংহোম আছে সব কটা জায়গায় খোজ নাও। কোন ভালো খবর পেলেও পেতে পারো।
– আপনি একবার থানায় আসবেন?
– ওকে আসছি।
ফারহান কলটা কেটে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়। আর এদিকে দুটো চোখ যে ওকে খুজে চলেছে কখন থেকে। মুন প্রায় পুরো বাড়ি ওকে খুজে নিয়েছে কিন্তু কোথাও ফারহানের দেখা মিলছে না। মুনকে এমন উসকোখুসকো দেখে আকাশ ওকে হাত ধরে টেনে নিয়ে পাশের চেয়ারে বসিয়ে নিজেও বসে। তারপর মুনের হাত ধরে বলে,
– কি হয়েছে মুন? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
– ফা-ফারহানকে কোথাও দেখতে পারছি না। আমি চোখে চোখে অভিমান দেখেছি। আচ্ছা আমার উপর রাগ করে ফারহান অনুষ্ঠান ছেড়ে চলে গেল নাকি? মব খারাপ মুনের।
আকাশ কিছু বলে না। শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আর তাকিয়ে থাকে মুনের মুখপানে।
চলবে,,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।
[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন ]