এক খোলা অন্তরিক্ষ পর্ব -০৩

#এক_খোলা_অন্তরিক্ষ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩
বাড়ি গিয়ে যখন বাবাকে ফ্লোরে পরে থাকতে দেখল তখন দিন-দুনিয়া ঘুরে উঠল আর্শিয়া ও মৃদুলার। ওরা দুইজন দৌঁড়ে বাবার কাছে গিয়ে দেখল উনি বুকে ব্যাথায় কাতরাচ্ছেন। ফ্লোরে বমিও করেছেন দেখা যাচ্ছে। আর্শিয়া মৃদুলাকে অস্থীর কন্ঠে বলল,

–চাচার বাসায় যা দ্রুত। আরিফকে ফোন করে বল গাড়ির ব্যবস্থা করতে।

মৃদুলা ভয়ে কাঁপছিল। ওর বাবার পর তো বিয়ের পর শ্বশুরকেই বাবার আসনে বসিয়েছিল। এক বাবাকে তো হারিয়েছে এখন আরেক বাবাকে এভাবে দেখে হৃদয় খুব করে কাঁদছে। আর্শিয়া মৃদুলাকে ভয়ার্ত নজরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেই মৃদুলার ফোন নিয়ে চাচাতো ভাই আরিফকে ফোন করে। আরিফ তার চাচার অবস্থা শুনে অতিসত্তর সিএনজি নিয়ে হাজির হয় পনেরো মিনিটের মধ্যে। মৃদুলা ও আর্শিয়া মিলে হাতে পায়ে সরিষার তেল মাখছে আর বাতাস করছে। মাথায় পানিও ঢালছে। সিএনজি এলে দেরি না করে হসপিটালে নিয়ে যায়।

________

নিহাদ হোটেল থেকে বেরিয়ে সোজা তার অফিসে যায়। কিছুক্ষণ পর পিয়ন দিয়ে জেসিকা মানে আশফাক সাহেবের বন্ধুর মেয়েকে তার অফিসরুমে ডেকে পাঠায়। জেসিকাও অফিস দেখাশোনা করে। জেসিকা অনুমতি নিয়ে ভিতরে এসে চেয়ার টেনে বসে হাসি মুখে বলো,

–হাউ ইউ ফিলিং নাউ?

–বেটার। আমি হোটেলরুমে কী করে গেলাম? তুমি নিয়েছিলে?

–ইয়েস।

–বাবা ফোন করেছিল। আর্শিয়া কিসের ভিডিওর কথা বলল? আমি বুঝলাম না কিছু। আমাকে চরিত্রহীন বুঝালো! কী যে হচ্ছে! তারউপর মাথাব্যথা কমছে তো বাড়ছে।

জেসিকা বাঁকা হেসে বলল,
–তাহলে কাজ হয়ে গেছে।

–হোয়াট ডু ইউ মিন? কী কাজ?

–আর্শিয়া উইল হেইট ইউ। তারপর তোমার জীবন থেকে চলে যাবে। তুমিই তো বলেছিলে, আর্শিয়া কাউকে ঘৃণা করলে তাকে জান প্রাণ লাগিয়ে ঘৃণা করে।

নিহাদ অবাক হয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলে,
–হোয়াট!

–ইয়েস। আর্শিয়াকে ভালো রাখতে চাও তো? চাও তো তাকে নিজের জীবন থেকে সরিয়ে ভালো রাখতে? সো দ্যাটস দা ওয়ে!

–তুমি একজেক্টলি কী করেছ?

–নাথিং বাট সো মেনি থিং! লাইক ক্যামেরা লাগিয়ে তোমার শার্ট খুলেছি। আর তোমার সোডাতে একটু কিছু মেশানো ছিল। যার কারণে তুমি হয়তো তখন আমার মধ্যে আর্শিয়াকে দেখে বিড়বিড় করে বলছিলে, ‘আই লাভ ইউ আশু।’ তোমার শার্ট খুলে দিয়ে হোটেল বয়কে বলেছি তোমাকে ঠিক ভাবে শুইয়ে দিতে। ব্যাস! আমি চলে গেছি রিকের কাছে।

নিহাদ মাথা চেপে ধরে বসে আছে। এইটাই তাহলে আসল কারণ! নিহাদ আবারও উত্তেজিত হয়ে বলে উঠে,

–কী করেছ তুমি এটা! তোমার আইডিয়া আছে তুমি কী করেছ! জঘন্যতম ভাবে ওদের সামনে আমায় প্রকাশ করিয়েছ।

–ভালোই তো হলো। এতে আর্শিয়া তোমাকে ছেড়ে দিবে। পরে তুমি তোমার পরিবারকে আসল ঘটনা বলবে। তোমাদের ধর্মে তো একবার ডিভোর্স হলে সেই মানুষটাকে বিয়ে করতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। আই মিন, আরেকজনের থেকেও ডিভোর্স নিতে হয়। তাহলে তো এতো প্রবলেম হবে না। এন্ড মোস্ট ইম্পরট্যান্ট, ইউ হ্যাভ নট দ্যাট মাচ টাইম!

নিহাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে রাখল। সময়! সময় এমন একটা বিষয় যা থাকতে কেউ মূল্য বোঝে না আর না থাকলে আফসোস!

________

ডাক্তার জানায় আশফাক সাহেবের মেজর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। আইসিউতে রাখা হয়েছে তাকে। আরিফ ফোন করে নিহাদের পরিবারকে জানায়। আরিফ কোনো ঘটনা সম্পর্কে অবগত না। রফিক সাহেব তার বেয়াইয়ের হার্ট অ্যাটাকের কথা শোনা মাত্রই তাৎক্ষনিত তার স্ত্রীকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে চলে আসে। আর্শিয়ার চাচা-চাচি, মামা-মামি সবাই এসেছেন। আর্শিয়া হসপিটালের এক চেয়ারে পাথরের মতো বসে আছে। নিজেকে নিজের কাছেই কেমন একটা লাগছে। তার জন্মের সময় মায়ের জড়ায়ু ক্যন্সার ধরা পরে তারপর দুধের শিশুকে ফেলে মা চলে যায় না ফেরার দেশে। কিছু প্রতিবেশিরা তার হাসি-খুশি প্রাণোচ্ছলতা দেখে আগেপাছে নানা কথা বলে। আজকে আবারও তার জন্যই তার বাবার এহেনো অবস্থা সে মনে করছে। তার সাথেই কেনো এমন হয় ভেবে নিষ্পলক নির্নিমেষ চেয়ে আছে।

মৃদুলা ইতোমধ্যে শাহরিফকে ফোন করে জানিয়েছে। শাহরিফ দেশে আসার টিকিট কেটে এখন যাচ্ছে নিহাদের সাথে দেখা করতে। চোখ-মুখে তার রাগের আভাস। নিহাদের অফিস রুমে ঢুকতে প্রকট শব্দে দরজা খুলে ভিতরে নিহাদকে জেসিকার সাথে বসে থাকতে দেখে সোফাতে। শাহরিফের রাগ যেনো মা*থায় চড়ে বসেছে। ক্ষীপ্রতার সাথে গিয়ে নিহাদের কলারে ধরে দাঁড়া করিয়ে ধা*ক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। নিহাদ গিয়ে সোফার হাতলের উপর পরে। জেসিকা ভয়ে বেরিয়ে গেছে। শাহরিফ আবার নিহাদকে উঠিয়ে বলে,

–তোর লজ্জা, কৃতঙ্গতা কিছু নেই? আবারও এই মেয়ের সাথে তুই? আমার বোনের কি দোষ ছিল? বল? নষ্ট করলি কেনো ওর জীবনটা? এখন আমার বাবাও মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লরছে।

নিহাদ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে। শাহরিফ আরেকটা ঘু*ষি দিলে নিহাদ মুখ থুবড়ে ফ্লোরে পরে। নিহাদ কিছু বলতে চাইল কিন্তু কিছু মনে করে চুপ হয়ে গেল। ইতোমধ্যে জেসিকা অফিসের কিছু স্টাফকে নিয়ে হাজির। ওরা শাহরিফকে টেনে ধরে বাহিরে নিয়ে গেছে। জেসিকা নিহাদকে উঠিয়ে জিজ্ঞেসা করল,

–আর ইউ ওকে?

–হুম। একটু একা থাকতে চাই।

জেসিকা বিনা প্রশ্নে বেরিয়ে গেল। নিহাদও দেশে যাবার টিকিট কাটে তবে সেটা পরেরদিনের। নিহাদ ভাবতে থাকে কী থেকে কী হয়ে গেলো! এসব হবে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। খবর নিয়ে জানে যে রাতের ফ্লাইটে শাহরিফ দেশে ফিরবে।

_______

আর্শিয়ার চাচি এসে ওর পাশে বসে। আর্শিয়াকে শান্তনা দিয়ে কিছু খেতে বলে। ওর চোখ-মুখের অবস্থাও সুবিধার না। আর্শিয়া উনাকে কিছু খাবে না বলে পাঠিয়ে দেয়। মৃদুলাও চুপ করে বসে আছে। মৃদুলার মামারাও এসে হাজির। রফিক সাহেব ও তার স্ত্রী হসপিটালে এসে আশফাক সাহেবের খোঁজ খবর নেয়। ডাক্তাররা এখনও কিছু বলতে পারছেন না। আফসানা বেগম গিয়ে আর্শিয়ার পাশে বসেন। আর্শিয়া একবার দেখে কিছু বলল না। তিনি আর্শিয়ার মাথায় হাত রাখলে আর্শিয়া বলে উঠে,

–আমার সাথেই এমন হয় তাই না? আমি অপয়া তাই না?

–নারে মা। তোর কোনো দোষ নেই। ভাগ্যে কার কী আছে কে জানে বল? তোর মতো ভালো মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে পেয়ে যা খুশি হয়েছিলাম এখন ছেলের অপকর্মে আফসোস হচ্ছে। তোর জীবনটা নষ্ট করলাম। আজ আমার ছেলের অপকর্মের জন্যই হয়তো তোর বাবার এই অবস্থা। মাফ করে দিস মা।

আর্শিয়া হাসলো। চুপ করে বসেই রইল। রফিক সাহেব ডাক্তারদের সাথে কথা বলছেন। আরিফ এসে বলল,

–আপু, রাতে আমি থাকব চাচার কাছে। তুমি নাহয় বাড়ি ফিরে যাও।

–না। আমিও থাকব। মৃদুকে বলেছিস বাড়ি যেতে?

–হুম। ভাবি যাবে না বলছে।

–আচ্ছা।

রাত বেড়ে যাচ্ছে তাই আর্শিয়া নিহাদের বাবা-মাকে বললেন,

–তোমরা বাড়ি ফিরে যাও। হসপিটালে এতোজন এলাউ না। আমি, মৃদুলা ও আরিফ থাকব এখানে। ভাইয়াও সকালে চলে আসবে।

–আমি থাকি? তোরা বাচ্চা মানুষ।

রফিক সাহেবের কথার প্রেক্ষিতে আর্শিয়া বলল,
–না। আমরা পারব। জীবনে এতোকিছু ঘটে গেল তারপরেও বাচ্চা তো আর নেই! পারব আমরা।

উনারা আর্শিয়া ও মৃদুলার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here