#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ২৩
“এমনি করে কালো কাজল মেঘ
জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশান কোণে
এমনি করে কালো কোমল ছায়া
আষাঢ় মাসে নামে তমাল-বনে
এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে
হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে
এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে
হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ
কৃষ্ণকলি আমি তারে বলি।”
বারান্দায় পা মেলে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে হৃদয়ে ঝংকার তোলা সুরে গা ভাসাল তপা। একেকটা শব্দ শ্রবণেন্দ্রিয় হয়ে সোজা হৃদপিন্ডে গিয়ে ধাক্কা মারছে। হামলে পড়ছে। নরম মাংসপিণ্ডকে ক্ষতবিক্ষত করছে।
তপা অনিমেষ চেয়ে রইল। এই গানটা সে দ্বিতীয় বার শুনলো। প্রথম বারেও বক্ষস্থলে ঠিক এভাবেই কাঁপন ধরে ছিল। তবে তখন সে ছিল অচেনা মানুষ। সম্পূর্ণ অচেনা নয়। খানিকটা চেনা, খানিকটা পরিচিত। বাকি পুরোটাই অচেনা। খোলসে আবৃত একটি পদার্থের ন্যায়।
তবে আজ লোকটা পরিচিত। সবচেয়ে আপনজন। সবচেয়ে কাছের।
সুরের ঝংকার শেষে পলক চোখ পিটপিট করে তাকাল তপার দিকে। মৃদু আওয়াজ তুলে ডাকল,
“কৃষ্ণময়ী।”
তপা তাকাল না পলকের দিকে। রান্নাঘরের ঘটনার পর তপা পলকের চোখে চোখ মেলাতে পারছে না। লজ্জারা ঘিরে রেখেছে তাকে।
বাইরে নজর রেখেই বলল,
“হুম।”
“আমার সাথে বুড়ো হবে?”
তপা কেঁপে উঠল। কিছু বলল না। তবে মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল।
পলক আবারও বলল,
“বলো না কৃষ্ণময়ী। হবে আমার সাথে বুড়ো? তোমার টানটান চামড়ায় যখন বার্ধক্যের ছাপ পড়বে তখনো আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকব। ঠিক এখন যেভাবে আছি।”
তপা মুখ তুলে তাকাল। পলকের চাহনি দেখে গাল গরম হয়ে উঠল তার। দ্রুত উঠে রুমে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। পলক বা হাত বাড়িয়ে তপার হাত টেনে আটকে দিল। হ্যাচকা টানে পুনরায় জায়গায় বসিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু সামলাতে না পেরে তপা গিয়ে পড়ল পলকের উরুর উপর। আবার চলে যেতে চাইলে পলক কোমর আঁকড়ে ধরে রাখল। কোলের উপর বসে তপা চলে যাওয়ার জন্য ছটফট করছে। পলক অপলক চেয়ে আছে তপার মুখের দিকে। চাহনি সহ্য করতে না পেরে চোখ বন্ধ করে ফেলল তপা।
পলক নিচু গলায় বলল,
“তাকাও।”
তপা তাকাল না। তবে কেঁপে উঠল এত কাছ থেকে পলকের কণ্ঠ শুনে।
কোমরে রাখা হাতটা স্লাইড করে চেপে ধরতেই তপা পলকের হাত ধরে ফেলল। পলক তখনো তপার বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে। মুখ এগিয়ে চোখের পাতায় ছুঁয়ে দিল। তপার হাত পলকের কাঁধ খামচে ধরল শক্ত করে। টিশার্ট পেরিয়ে ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছে কাঁধের চামড়াটুকু। সেদিকে খেয়ালে নেই দুজনের কেউই। একহাত গ্রীবাদেশে গলিয়ে আঙুল ছুঁয়ে দিল তপার অধরে। মৃদু কম্পনরত ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলল পলক।
তপা পিটপিট করে তাকাল। পলকের চোখ তখন নেশাগ্রস্ত যুবকের ন্যায়। চিবুকে ঠোঁট ছুঁয়ে গভীর আকুতি নিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
“একটুখানি জান প্লিজ।”
তপা আবারও চোখ বন্ধ করে ফেলল। পলকের আঙুল তখন তপার কম্পনরত অধরে ছুঁয়ে দিতে ব্যস্ত।
পলক এগিয়ে গেল। ঘুচিয়ে দিল দুজনের মধ্যকার দুরত্ব। ছুঁয়ে গেল অধরের সাথে অধর। একবার, বারবার, বহুবার।
“বাবা আমি বিয়ে করতে চাই।”
মোর্শেদুল হক ছেলের মুখে সরাসরি বিয়ের কথা শুনে অবাক হলেন। ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“বিয়ে করবি ভালো কথা। তা কাকে করবি শুনি?”
একমূহুর্ত দেরি করল না সিজান। তৎক্ষনাৎ বলল,
“পৃথা কে।”
হাজেরা বেগম পাশেই ছিলেন। অবাক হয়ে বললেন,
“আমাদের পৃথা?”
সিজান মাথা নাড়ালো।
মোর্শেদুল হক বললেন,
“ছেলে মেয়েদের কোনো খবরই তো তুমি রাখো না। এমনকি তোমার ছেলে যে এতগুলো বছর ধরে মরণ যন্ত্রণা সহ্য করছিল সেটাও তুমি জানো না। তপা নাহয় অন্যের মেয়ে ছিল। কিন্তু সিজান তো তোমার নাড়ী ছেড়া ধন। তার প্রতিও তুমি সঠিক কর্তব্য পালন করতে পারো নি। তোমার আছে কেবল ভাইয়ের চিন্তা। একদিন তুমি পস্তাবে। মিলিয়ে নিও আমার কথা।”
হাজেরা বেগম কিছু বুঝলেন না। প্রশ্ন করতে চাইলে সিজান থামিয়ে দিয়ে বলল,
“এতকথা রাখো মা। খালামণিকে বলো তুমি বিয়ের কথা। ভাইয়াকেও বলো। বলবে কাল আমরা যাব কথা বলতে।”
হাজেরা বেগম অবাক হয়ে বললেন,
“এত তাড়াহুড়ো কেন তোর? ধীরে সুস্থে বলি।”
মোর্শেদুল হক স্ত্রীর দিকে বিরক্ত চাহনি দিয়ে বললেন,
“তুমি বলবে? নয়তো ফোন আমাকে দাও আমি বলছি।”
হাজেরা বেগম ভেংচি কেটে চলে গেলেন কথা বলতে।
“এই পিথাগোরাসের উপপাদ্য শুনতে পাচ্ছিস? বিয়ের জন্য তৈরী হ বেয়াদব মেয়ে। এক্ষুনি তোর কানেও খবর যাবে। মা কল দিয়েছে খালামণিকে। কাল হয়তো যাব তোকে চাইতে। একবার বিয়ে হোক। তোর বিয়ের শখ আমি মিটিয়ে দিব অসভ্য মেয়ে। আমাকে নির্লজ্জের মত বাবাকে বলতে হলো বিয়ের কথা। এর শাস্তি তো তুই পাবি।”
পৃথা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।
সিজান কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল,
“দাঁত বার করে হাসছিস তো। তোর সাদা দাঁতগুলো আমি সাঁড়াশি দিয়ে গুনে গুনে তুলে ফেলব।”
পৃথা হাসি থামিয়ে বলল,
“তাহলে আমি খাব কি করে? খাবার চিবিয়ে খেতে হবে না?”
“কেন আমি চিবিয়ে দেব। তুই খাবি।”
“ইয়াক। দূরে গিয়ে মরো তুমি।”
সিজান শব্দ করে হেসে ফেলল। এরপর চলতে থাকল হাজারো কথা। চলতে থাকল খুনসুটিময় ভালবাসা।
তপা দরজা বন্ধ করে বসে আছে অনেকক্ষণ। পলক বিছানায় আধশোয়া হয়ে অপেক্ষা করছে দরজা খোলার। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মূহুর্ত কতক্ষণে আসবে জানে না সে। এদিকে পেটে তার ইঁদুর দৌড়াচ্ছে খিদেতে। বাধ্য হয়ে উঠে বসল সে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল বন্ধ দরজার দিকে। দুবার নক করল। ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই।
পলক গলা বাড়িয়ে ডাকল। তবুও তপা উত্তর দিল না। ঠায় বসে আছে বিছানায় পা ঝুলিয়ে।
“তিয়াশা বাইরে এসো। ক্ষুধা পেয়েছে তো আমার।”
তপা নড়েচড়ে বসল। এগারোটা বাজতে চলল। ক্ষুধা লাগাটাই স্বাভাবিক। বিছানা থেকে পা মেঝেতে নামাতেই আবারও ভেসে এলো পলকের কণ্ঠস্বর।
” আর কিছু করব না তো । বাইরে এসো।”
তপা হেসে ফেলল। মৃদু পায়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। খুট করে শব্দ করে খুলে ফেলল দরজাটা। দৃশ্যমান হলো পলকের অবয়ব। পলক তাকাল তপার মুখশ্রীতে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তপা। পলক আর ঘাঁটাল না। নিঃশব্দে গিয়ে দরজাটা তালাবদ্ধ করে দিল। তপা অবাক হয়ে তাকাল। পলক মুচকি হেসে এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“এখন কি করবে? কোথায় যাবে?”
তপা অসহায় মুখ করে তাকাল। পলক শব্দ করে হাসল। তপাকে ডাইনিংয়ে নিয়ে যেতে উদ্ধত হয়ে বলল,
“নিশ্চিন্তে খাবে চলো। আর কিছু করব না।”
পরের দিন সকাল বেলা। তপা বিছানায় বসে ফোন ঘাঁটছে। পলক ঘুমিয়ে আছে তখনো। মোবাইল স্কিনে পৃথার নাম্বার ভেসে উঠতে দেখে মুচকি হেসে ফোন কানে তুলে নিল।
পৃথা একটু কথা বলেই মায়ের কাছে ধরিয়ে দিল। আয়েশা কুশলাদি বিনিময়ের পর বলল,
“তপা মা চলে আসিস তো সকাল সকাল। পৃথা কে দেখতে আসবে। বলতে পারিস বিয়ে ঠিক করতে আসবে।”
তপা চমকে উঠল। পৃথার বিয়ে হয়ে গেলে ভাইয়ের কি হবে ভেবে।
তপা কে চুপ থাকতে দেখে আয়েশা আবারও বলল,
“কিরে আসবি তো?”
“তা আসব। কিন্তু আন্টি তপা বিয়েতে রাজি?”
আয়েশা মুচকি হাসলেন তপার কণ্ঠ শুনে। মেয়ে তার বান্ধবীর জন্য চিন্তায় পরে গেছে বুঝতে পারলেন। কিন্তু তিনি সেটা তপা কে বুঝতে না দিয়ে বললেন,
“রাজি হবে না কেন? সিজান ভালো ছেলে। পৃথা কে নিশ্চয়ই ভাল রাখবে।”
তপা অবিশ্বাস্য সুরে বলল,
“ভাইয়ের সাথে বিয়ে হবে?”
“কেন তুই রাজি না?”
তপা উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলল,
“একশ বার রাজি আন্টি। আমি কিছুক্ষণ পরই চলে আসব।”
আয়েশা হাসলেন। বললেন,
“আচ্ছা। তাহলে রাখি। পলক কেও তো বলতে হবে। ও কি তোর ওখানে?”
তপা লজ্জা পেল। মিনমিনে গলায় বলল,
“হ্যা আন্টি। ঘুমোচ্ছে।”
আয়েশা প্রসন্ন হলেন। বললেন,
“ডেকে দিবি? নাকি পরে কল দেব?”
“ডাকছি আমি। একমিনিট অপেক্ষা করো আন্টি।”
তপা ফোন হোল্ড করে রেখে মৃদু স্বরে ডাকল পলক কে। দুবার ডাকতেই চোখ পিটপিট করে তাকাল। ঘুম জড়ানো গলায় বলল,
“এখনই ডাকছো কেন বউ? রাতে ঘুমাতে পারি নি আমি। ঘুমাতে দাও।”
তপা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“রাতে ঘুমাতে পারেন নি কেন? কোন গোয়ালে গরু চুরি করতে গিয়েছিলেন?”
পলক হাত টেনে শুয়িয়ে দিয়ে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরে বলল,
“বউয়ের ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখতে ব্যস্ত ছিলাম বউ। বউ তো আর আমার যন্ত্রণা বুঝে না। সে তো পরে পরে ঘুমাচ্ছিল। আমি বেচারা ঘুম ফেলে বউ পাহারা দিচ্ছিলাম।”
তপা নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে বলল,
“আন্টি কল দিয়েছে। লাইনে আছে। আপনি কথা বলুন। তারপর এসব জড়াজড়ি করুন প্লিজ।”
পলক শুনল। তবে তপাকে ছাড়ল না। হাত বাড়িয়ে ফোন এনে কথা বলল। জানালো দুপুরের আগেই চলে আসবে দুজনে।
ফোন রেখে নজর দিল তপার দিকে। তপা চোখ পিটপিট করে বলল,
“কি?”
পলক ঠোঁট কামড়ে হাসল। বলল,
“জড়াজড়ি করব।”
পৃথার রুমের বেহাল দশা। রেডি হওয়ার চক্করে পুরো বিছানার নাজেহাল অবস্থা করে ফেলেছে পৃথা। তপা মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে । পৃথা কিছুক্ষণ পর পর তপার সামনে ঘুরেফিরে দেখিয়ে বলছে,
“দেখতো সুন্দর লাগছে না?”
তপা কেবল মাথা নাড়িয়ে সায় জানাচ্ছিল। কিন্তু শেষবার মলিন গলায় বলল,
“ভাই যদি তোর রুমের এই অবস্থা দেখে তোকে রেখে পালাবে। ভাই কিন্তু প্রচন্ড গোছানো স্বভাবের।”
পৃথা মলিন হেসে বলল,
“আমিও তো গুছিয়েই রাখি সব। কিন্তু আজ কিভাবে যেন অগোছালো হয়ে গেছে।”
তপা হাসল। মেয়েটা এক্সাইটমেন্ট ধরে রাখতে পারছে না। তিন বছরে মেয়েটা নিজের অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলেছিল। নিজের চঞ্চলতা ভুলে শান্ত হয়ে গিয়েছিল। জিন্দা লাশের মত।
তপা কাজল নিল কড়ি আঙুলে। পৃথার কানের পেছনে কাজল ছুঁয়িয়ে বলল,
“আমার বাচ্চাটার সুখে যেন কারও নজর না লাগে।”
পৃথা হাসল। দু’হাতে জড়িয়ে ধরল। সাথে সাথে ছেড়েও দিল। চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“তোর শরীর থেকে মেল পারফিউমের ঘ্রাণ আসছে কেন?”
তপা লাজুক হাসল। মাথা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে লজ্জা থেকে নিজেকে আঁটকে রাখতে চাইল।
পৃথা আবারও বলল,
“এটা পলক ভাইয়ার পারফিউমের ঘ্রাণ?”
তপা মৃদু স্বরে বলল,
“হ্যা। কি হয়েছে বল তো। আমি আমার পারফিউম খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই নিচে এসে উনারটা লাগিয়েছি।”
পৃথা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
“তুই আবার কবে থেকে পারফিউম দিস?”
তপা হার মানার ভঙ্গিতে বলল,
“আম্মা মাফ কর আমারে। আমি রেডি হওয়ার পর উনি এসে জড়িয়ে ধরেছিল। মাত্রই পারফিউম লাগিয়েছিল। তাই ঘ্রাণ আমার জামায়ও লেগে গেছে। বুঝতে পেরেছিস। আর মাথা খাবি না। চুপচাপ বসে থাক।”
পৃথা কিছু বলতে চাইল।
তপা আঙুল উঁচিয়ে বলল,
“নো মোর কোয়শ্চেন।”
রান্নাঘর থেকে পৃথার রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় তপা। কিছুদূর চলেও যায়। কিন্তু অদূরেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মামুনকে আসতে দেখে তপা থমকে দাঁড়ালো। তপা ভাবেও নি এভাবে অতীতের কাটা বর্তমানে এসে ফুটবে। তপা পেছন ফিরে চলে যেতে শুরু করল। আবার ভাবল কতদিন এভাবে লুকিয়ে থাকবে। পালিয়ে বেড়াবে ভয় পেয়ে। নিজের ট্রমাটিক সিচুয়েশন থেকে অতিদ্রুত বের হতে হবে। পলক কে একটা সুস্থ দাম্পত্য জীবন উপহার দিতে হবে। চোখ বন্ধ করে জোরে নিশ্বাস ছাড়ল তপা। নিজেকে শক্ত করে সামনে ফিরল আবার। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যেতে শুরু করল। আর কয়েক কদম এগিয়ে গেলেই মুখোমুখি হবে সে বিকৃত মস্তিষ্কের লোকটার। ঠিক সেই মূহুর্তে পলক এসে তপার বাহু আঁকড়ে ধরল। একহাতে জড়িয়ে নিল নিজের সাথে। মামুন হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পলকের হাতের দিকে। পলক তপার চোখে চোখ রেখে সাহস সঞ্চার করল। তপা অসহায় চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসল। পায়ে পায়ে চলে গেল মামুনের সামনে থেকে।
মামুন ঘুরে দাঁড়িয়ে তপার চলে যাওয়া দেখল। হিংস্র দৃষ্টিতে হিংস্রতা খেলা করছে তার।
পলকও একবার পেছন ফিরল। তার চোখে খেলা করছে অন্য কিছু। তার কৃষ্ণময়ীর উপর হওয়া অত্যাচারের বিনিময় করার সময় চলে এসেছে বোধহয়। শান্ত দৃষ্টিতে দেখল মামুনের পা থেকে মাথা অবধি। পরক্ষণেই ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল ক্রুর হাসি।
#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ২৪
এক ঘর লোকের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তপা। পাশে ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে হাজেরা বেগম কে দেখছে পলক। প্রান্তও দুহাত মুঠো করে নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করে চলেছে। বোনের বিয়ের কথা চলছে। তার নিশ্চয়ই মাথা গরম করা সাজে না। শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটলেও দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিল সে। সিজান আপাতত নেই সেখানে। থাকলে হয়তো এতক্ষণে তুলকালাম বেঁধে যেত।
হাজেরা বেগম পলকের দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তপার দিকে তাকাল। গলায় স্পষ্ট বিদ্রূপাত্নক অভিসন্ধি ফুটিয়ে বলল,
” বাহ! এলেম আছে তোর। এত বশ করেছিস যে আমাকে চোখ রাঙাচ্ছে। ভালো ভালো। কালে কালে আর কত কি যে দেখবো কে জানে। নষ্টা মেয়েমানুষ কোথাকার।”
কথা শেষ হতেই ঘর কাঁপিয়ে স্বশব্দে চড় পড়ল হাজেরা বেগমের গালে। ঘটনার আকষ্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে সবাই। হাজেরা বেগম গালে হাত দিতেও ভুলে গেলেন। মাথাটা ভো ভো করছে তার। গালের চামড়াটুকুও তীব্রভাবে জ্বলছে। তেজস্বী দৃষ্টিতে হাতের মালিকের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল আয়েশা অগ্নিমূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। মূহুর্তেই চোখজোড়া ছলছল হয়ে গেল তার।শেষে কিনা একঘর লোকের সামনে তার নিজের মায়ের পেটের বোন তার গায়ে হাত তুলল। অপমান সইতে না পেরে ধপ করে বসে পড়ল সোফার ওপর। ডুকরে কেঁদে উঠল তৎক্ষনাৎ। আঘাতে, অপমানে, লজ্জায়।
আয়েশা এতটুকুতে থামলেন না। তপার হাত টেনে সামনে এনে দাঁড় করালেন। তপা তখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। আয়েশা তপার মুখ টা ধরে উঁচু করলেন। কঠোর গলায় বললেন,
“মাথা উঁচু করে দাঁড়া। তুই কেন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকবি? তুই অন্যায় করেছিস? করিস নি তো। তবে তুই কেন মাথা নিচু করে আছিস? আর যেন মাথা নিচু না দেখি।”
বলে মিনিট খানেক থামলেন তিনি। হাজেরা বেগমের দিকে তাকিয়ে পুনরায় বললেন,
“তুই কি বলেছিলি ওকে? ও নষ্টা মেয়ে মানুষ? ওর এলেম আছে ছেলে বশ করার। তাই না? কার জন্য তুই ওকে নষ্টা বললি জানিস? পলক কে চিনিস তুই?”
হাজেরা দমে গেলেন না। হেরে যেতে তিনি শেখেন নি। তাই দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
“চিনি। সেদিন ও ওই ছেলে কে নিয়ে আমার বাড়িতে গিয়েছিল। আজও এখানে এসেছে। শুধু আসেই নি। ঘরে দরজা বন্ধ করে ভেতরে দুজনে একা ছিল। একবার প্রান্ত একবার এই ছেলে ওকে নষ্টা বলব না তো কি বলব?”
ঘটনার শুরু কিছুক্ষণ আগে। মামুনের সামনে থেকে তপা কে শান্ত ভাবে নিয়ে গেলেও রুমে যেতেই তপা ডুকরে কেঁদে উঠল। ঘৃণার নিজের গায়ের চামড়া খামচাতে শুরু করলে পলক তাকে সামলাতে বাহুডোরে আঁটকে নিল। এতে তপা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলে দিশেহারা বোধ করল সে। কান্নার শব্দ বাইরে গেলে ব্যাপারটা নিয়ে ঘাটাঘাটি হবে বিধায় দরজা বন্ধ করে তপার কাছে গেল। অনেকক্ষন সময় নিয়ে ধীরে ধীরে শান্ত করল তাকে। একপর্যায়ে তপা ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমন্ত মুখশ্রীতে একবার নজর বুলিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো পলক। এই ঘটনা বাইরে থেকে দেখলেন হাজেরা বেগম। মূহুর্তেই তিলকে তাল বানিয়ে ফেললেন। আক্রমণ চালালেন ঘুমন্ত তপার উপর। চুল ধরে মাথা উঁচু করতেই তপার ঘুম ছুটে গেল। মৃদু আর্তনাদ করে চোখ খুলল তপা।
হাজেরা বেগম চুল ছেড়ে হাত ধরে বিছানা থেকে নামিয়ে আনলেন। বললেন,
“আমার বাড়ি নোংরা করে তোর শান্তি হয় নি? আমার বোনের বাড়িও নোংরা করতে চলে এসেছিস।লজ্জা করে নারে তোর? এত নোংরা মেয়েমানুষ ভাবতেই আমার গা গুলিয়ে উঠছে। এই তোকে আমি আমার বাড়িতে জায়গা দিয়েছিলাম। ভাবতেই নিজের উপর ঘেন্না লাগছে আমার।”
তপা কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। হাজেরা বেগম পুনরায় বললেন,
“এই আন্ধার চেহারা নিয়ে চান্দের মতো ছেলের মাথা ঘুরাইলি কেমনে তুই? সবই কি শরীরের খেল? আমার সিজান নেহাৎই ভাল। ওসবে পাত্তা দেয় নি তাই বেঁচে গেছে। আমার সাত পুরুষের কপাল। তোর মত কলঙ্কিনীর খপ্পরে আমার সিজান টা পরে নাই।”
তপা হাত জোর করে অনুরোধের সুরে বলল,
“মামী দোহাই তোমার। এত নোংরা কথা তুমি উচ্চারণও করো না। আমি কি করেছি সেটা তো একবার বলো। তারপর যা বলার বলো। আমি কিচ্ছু বলব না।”
হাজেরা বেগম গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বললেন,
“এতক্ষণ বন্ধ ঘরে ওই ছেলের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে এখন অবুঝ সাজছিস তুই? চড়িয়ে তোর ভং আমি ছুটিয়ে দেব বেয়াদব। সেদিনও প্রান্তর ঘাড়ে দোষ চাপাতে অজ্ঞান হওয়ার ভান করছিলি। আজ আবার একই কাহিনী করলি। লজ্জা নেই না তোর। আর ওই ছেলেরও বলিহারি। এই নির্লজ্জ, চরিত্রহীন মেয়ের পাল্লায় পড়ল। তাও যদি দেখতে ভালো হইতো।”
আরও কিছু বলতে চাইছিলেন হাজেরা বেগম। কিন্তু তার আগেই স্বশব্দে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল পলক। তপার কাছে গিয়ে কান্নারত মুখশ্রী দেখে সিংহের ন্যায় গর্জন করে উঠল। শব্দ শুনে বাড়িতে অবস্থানরত আত্নীয়স্বজন হুরমুরিয়ে প্রবেশ করল সেখানে। কেবল বাদ রয়ে গেল সিজান ও মোর্শেদুল হক। তারা বাড়ির বাইরে থাকায় জানতে পারে নি কিছুই।
আয়েশা সবটা পলকের কাছে শুনে রক্তচক্ষু করে তাকিয়ে বলল,
“আজ এখানে তৃতীয় কেউ কথা বলবে না। আমি হাজেরার সাথে কথা বলব। কেউ যেন টু শব্দটিও না করে।।”
হাজেরার দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলল,
“কি হয়েছে এখন বল আমাকে। কি দেখেছিস।”
হাজেরা বেগম আয়েশার কথায় পাত্তা না দিয়ে পলকের দিকে তাকাল। পলকের দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বলল,
“বাহ। এলেম আছে তোর। এত বশ করেছিস যে আমাকে চোখ রাঙাচ্ছে। ভালো ভালো। কালে কালে আর কত কি দেখব কে জানে। নষ্টা মেয়েমানুষ কোথাকার।”
আয়েশা নিজেকে যথেষ্ট শান্ত করার চেষ্টা করলেন। জোরে জোরে শ্বাস ফেললেন।
“তুই মোর্শেদ ভাইয়ের সাথে একা ঘরে কতশত রাত কাটিয়েছিস হিসেব আছে?”
হাজেরা স্তব্ধ হয়ে গেলেন বোনের এহেন কথা শুনে। নিচু গলায় বললেন,
“কি সব বলছিস তুই সবার সামনে?”
আয়েশা হাত উঁচু করে বললেন,
“আমি যা জানতে চাইছি ঠিকঠাক উত্তর দে। নয়তো বাকি গালটাতেও আমার হাত পরে যাবে।”
হাজেরা ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন,
“সে আমার স্বামী।”
আয়েশা উচ্চ স্বরে হাসলেন। বললেন,
“স্বামীর সাথে রাত কাটালে যদি নষ্টা মেয়েমানুষ না হয় তবে স্বামীর সাথে এক ঘরে দিনের বেলায় কিছুক্ষণ থাকলে নষ্টা হলো কি করে?”
হাজেরা বেগম চমকালেন। ভরা মজলিসে নাক কাটা গেল তার। কিন্তু দমবার পাত্রী তিনি নন। কন্ঠে আবার দৃঢতা ফুটিয়ে বললেন,
“আমাকে জানায় নি বিয়ের কথা। আমি তো এসব ভাবতেই পারি। এতে আমার কি দোষ? আর এ নাহয় স্বামী। কিন্তু প্রান্ত? প্রান্তর সাথে কি ছিল ওর? সেটা তো নষ্টামিই ছিল।”
পলক কিছু বলার জন্য এগিয়ে গেল। আয়েশা হাত উঁচু করে থামিয়ে দিলেন। পলক দমে গেল। মুখের উপর কথা বলাটা তার কোনো কালেই পছন্দনীয় ছিল না। সে যদি হয় মায়ের মত নমনীয়, মমতাময়ী।
আয়েশা তাচ্ছিল্য হেসে বললেন,
“তোকে জানায় নি। তুই কি সত্যিই জানার ভাগিদার? কি করেছিস মেয়েটির জন্য? কিচ্ছু না। উল্টো তার জীবন টা নরক করে দিয়েছিস তোরা। সত্যি সত্যি কি জানার কথা ওর বিয়ে সম্পর্কে ? যাকে জানানোর তার অনুমতি নিয়েই বিয়ে হয়েছে। তোর ছেলেটাও কিন্তু সাক্ষী। তোর স্বামী জানে। তোর ছেলেও জানে। জানিস না শুধু তোরা দুই কুলাঙ্গার ভাইবোন। আর রইল বাকি প্রান্ত? পৃথা আর প্রান্তর যেমন সম্পর্ক, তপারও তাই। আমি নিজে ওদের বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। জানিস কি বলল? ওরা আলাদা মায়ের পেটে জন্মই নিয়েছে কেবল। কিন্তু ওরা ভাইবোন। রক্তের সম্পর্ক নাই থাকতে পারে, আত্মার সম্পর্ক আছে ওদের। আপন ভাইবোনের মত। মত না রে। ওরা আপনই। তুই বলতো যদি ওদের মধ্যে তোর ধারণা মত সম্পর্ক থেকেই থাকত তবে ওরা কেন বিয়ে করল না। বলতে পারবি? উত্তর আছে তোর কাছে?”
হাজেরা বেগম অথৈজলে সাঁতরে বেড়াচ্ছেন উত্তরের আশায়। তেমন সুবিধা করতে পারলেন না। তবুও বললেন,
“তবে প্রান্ত যে ঘনঘন যেতো আমার বাড়ি। সেটা তো কেবল তপার জন্যই।”
আয়েশা দুঃখের মাঝেও হাসলেন।
“তোর ছেলে যে ছোট্ট বেলা থেকে পৃথার জন্য পাগল ছিল। কতশত রাত দিন ওরা একসাথে থেকেছে। ওদের কি নোংরা বলেছিস?”
হাজেরা বেগম করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন,
“ওদের ব্যাপার আলাদা।”
“ওহ! ওদের ব্যাপার আলাদা। কারণ ওরা তোর আর আমার সন্তান। কিন্তু তপার তো কেউ নেই তাই তপা যাই করুক সেটা নষ্টামি। আর তোর ছেলের জন্য সেটা প্রেম তাই তো?”
হাজেরা বেগম মিনিট খানেক ভেবে বললেন,
“আমি মানছি প্রান্ত নির্দোষ। কিন্তু সেদিন কেউ তো ছিল তপার সাথে। কারো সাথে তো নোংরা কাজ ঠিকই করছিল ও। সেটা কে ছিল? আর প্রান্তই বা কিভাবে গেল ওখানে? নিজের চোখকে তো আমি অবিশ্বাস করতে পারি না।”
আয়েশা চোখ মুখ শক্ত করে বললেন,
“তপা কে ধর্ষণ করার চেষ্টা করা হয়েছিল হাজেরা।”
হাজেরা বেগম চমকালেন। এরকম ঘটনা কে করতে পারে ভাবতে গিয়ে তার মাথা শূন্য শূন্য লাগছে।
কোনোমতে বললেন,
“কে ছিল সে?”
আয়েশা মিনিট খানেক মৌন থেকে বললেন,
“সইতে পারবি তো?”
হাজেরা বেগম দমে গেলেন। থরথর করে কাঁপতে লাগল শরীর। সোফায় বসে ভাবতে শুরু করলেন তপার ওই বাড়িতে আসার পরের একের পর এক ঘটনা। একজায়গায় গিয়ে আঁটকে গেল তার ভাবনাগুলো। ‘ব্যাড টাচ’। টনক নড়ল হাজেরা বেগমের। অনবরত কানের ভেতরে প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করল শব্দ দুটো।
কাঁপা কাঁপা গলায় শুধালেন,
“কে?”
আয়েশা রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন,
“তুই যাকে ভাবছিস। তোর আদরের ভাই। দুধকলা দিয়ে পোষা কালসাপ।”
হাজেরা বেগম স্তব্ধ হয়ে গেছেন। নিজের কান কে তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। যার জন্য, যার কথা শুনে তপার সাথে এত জঘন্য ব্যবহার করেছে সেই আজ অপরাধী। ঘৃণ্য অপরাধী। আদৌ এই অপরাধের কোনো ক্ষমা হয় কিনা জানা নেই তার।
দ্বিতীয় বারের মত তাজমহলে এসেছে তপা। বাগানের মাঝ বরাবর রাস্তায় দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিল সে। বাড়ির মানুষের মত পরিবেশটাও শান্ত, মায়াময়। অবশ্য তপা চিনেই কেবল পায়েল কে। সেটাও আবার একবার কথা হয়েছে। তবুও যেন মানুষটার উত্তম ব্যবহারের রেশ রয়ে গেছে তপার মনে।
সেদিনের মত আজও দরজার ওপারে হাস্যজ্জল মুখটাই দেখতে পেল তপা। বিনিময়ে তপার মুখটাও হাসিতে ভরে গেল। তথাকথিত ভাবেই তপা প্রবেশাধিকার পেল। ড্রয়িং রুমে বসে সুখ দুঃখের আলাপ সেরে নিলেন দুজনে।
পায়েল খানিকক্ষণ তপার দিকে তাকিয়ে থেকে পড়ন্ত বিকেলের নরম আলোর মত কোমল গলায় বললেন,
“তোমাকে অন্য রকম লাগছে আজ। কেন বলোতো?”
তপা বুঝতে পারল না এমন প্রশ্নের কারণ। উত্তর কি হতে পারে সেটাও জানা নেই তার। তাই প্রশ্ন সূচক চাহনিতে তাকাল। বলল,
“কি রকম লাগছে আন্টি?”
পায়েল তাজওয়ার স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন তপার দিকে। মিনিট খানেক তাকিয়েই রইলেন। তারপর খুঁজে পেলেন কাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন। চোখ ছোট ছোট করে বললেন,
“বিয়ে করেছো?”
তপা এহেন প্রশ্নে চমকে উঠল। লজ্জাও পেল একটুখানি। মনে মনে ভাবল, চেহারায় কি কাবিননামার ফটোকপি দেখা যাচ্ছে নাকি। আশ্চর্য।
কিন্তু মুখে বলল,
“বুঝলেন কি করে?”
পায়েল মুচকি হেসে বললেন,
“তোমার মুখ দেখে মনে হলো। হয়তোবা নাকফুলটার জন্য।”
তপা ঈষৎ লজ্জা পেল। পর মূহুর্তেই মনে পড়ল পলকের পাগলামির কথা। লজ্জায় মাথা নিচু করে হাসল সে।
পায়েল অবাক হয়ে চেয়ে রইল। বলল,
“এমা তুমি তো ব্লাশ করছো। লাভ ম্যারেজ নাকি? বর খুব ভালবাসে?”
তপা লজ্জায় মরে যায় যায় অবস্থা। মুখে কোনো শব্দ করছে না দেখে পায়েল পুনরায় বলল,
“আমাকে মা ভেবে বলতেই পারো। আমি তো তোমাকে মেয়েই ভাবি। দেখ না জোর করে বসিয়ে রেখে কথা বলি। তুমি হয়তো বিরক্ত হও এটা ভেবে যে মহিলার কোনো কাজ নেই। খালি আজাইরা বকবক করে।”
তপা মুখ তুলে তাকাল। তাড়াহুড়ো করে বলল,
“এরকম কিছু না আন্টি। আমারও আপনার সাথে গল্প করতে ভাল লাগে। সেজন্যই তো আজও আমিই কেক ডেলিভারি দিতে এসেছি। ডেলিভারি বয় ছিল তবুও। আসল উদ্দেশ্য তো আপনার সান্নিধ্য পাওয়া।”
পায়েল তাজওয়ার মুচকি হাসলেন।
তপা পুনরায় বলল,
“লাভ ম্যারেজ আন্টি। তবে আমি এখনো জানিনা ভালবাসি কিনা। তবে তাকে হারালে বোধহয় আর বাঁচব না। ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে সে আমার জীবনের সাথে।নিঃসঙ্গ জীবনের সেই একমাত্র আঁকড়ে ধরার মত মানুষ। এটাকে ভালবাসা বলে কিনা জানিনা। তবে সে ভালবাসে। একটু বেশিই ভালবাসে। তাই তো প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে।”
পায়েল তাজওয়ার ভাবুক হয়ে বললেন,
“প্রকৃতির বিরুদ্ধে বলছো কেন?”
তপা মৃদু হেসে বলল,
“আমার গায়ের রঙ দেখেছেন তো। কালো। লোকের কাছে এটা বিতিকিচ্ছিরি। কিন্তু সে চাঁদের মত। আমি অমাবস্যা হলে সে পূর্নিমা। এটা প্রকৃতির বিরুদ্ধে নয়?”
“তুমি শ্যামা। মায়বতী। তুমি জানো তোমার মুখের আদল কতটা মায়া দিয়ে গড়া? কেবল গায়ের রঙ দিয়ে মানুষ বিচার করতে নেই মা। মানুষের প্রকৃত সৌন্দর্য তার মনের। আমি তোমাকে যতটুকু চিনেছি তুমি সেদিক থেকে সবার চেয়ে এগিয়ে। তাহলে কি বলবে? জানিনা সেই সৌভাগ্যবান কে, যে তোমাকে পেয়েছে। তবে আমার আফসোস হচ্ছে জানো। কেন আরও আগে আমাদের পরিচয় হলো না।”
তপা অবাক হয়ে চেয়ে রইল। এমনও মানুষ হয়?
পায়েল পুনরায় বললেন,
“বিয়ে তো হয়ে গেছে। চেষ্টা করবে স্বামীকে ভালবাসতে। তারা তো কেবল ভালবাসারই আশা করে। তুমিই বললে প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করেছে। তারমানে মারাত্মক ভাবে ভালবাসে তোমাকে। তোমারও উচিৎ তার প্রাপ্য ভালবাসাটুকু তাকে প্রদান করা। কার্পন্য করো না কেমন?”
তপা লাজুক হেসে মাথা নাড়ালো। পায়েল তাজওয়ার ও মৃদু হাসলেন। বললেন,
“তাকে একবার নিয়ে এসো এখানে। দেখে চোখ জুড়াবো।”
তপা মাথা দুলিয়ে সায় জানালো। মনে মনে বলল,
“আপনি যদি পুরোটা জানতে পারতেন তবে বুঝতে পারতেন প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করার কথা কেন বলেছি। কিন্তু আফসোস বলতে পারলাম না আমি। জানলে হয়তো তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আরও বেড়ে যেত।”
অফিসে বসে ধ্যানমগ্ন হয়ে ল্যাপটবে চোখ বুলাচ্ছিল পলক। কিছু সমস্যার সমাধান করার প্রয়াস চালাচ্ছিল সে। হঠাৎ মনোযোগ বিঘ্ন ঘটে ফোনের শব্দে। স্কিনে সজলের নাম্বার দেখে মূহুর্তেই মেজাজটা বিগড়ে যায় তার। কিছু উচ্চ বাক্য শুনিয়ে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছে নিয়ে মোবাইল স্কিনে স্লাইড করে কানে তুলে নিল সে।
কিন্তু মুখে শব্দ বের করার আগেই সজল হন্তদন্ত হয়ে বলল,
“ভাই, ভাবি কোথায় ?”
পলক ভ্রু কুঁচকে ফেলল। সিরিয়াসলি ভাবির খবর নিতে গাম্বাটটা অফিস টাইমে কল দিয়েছে। পরক্ষণেই কিঞ্চিৎ উত্তেজিত শোনা গেল সজলের কণ্ঠ।
“ভাই, ভাবী কোথায়? ভার্সিটিতে আসে নি তো?”
পলক চমকাল। কি হয়েছে ভার্সিটিতে?
উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
“কি হয়েছে ভার্সিটিতে?”
বলেই ঘড়ির দিকে তাকাল। পুনরায় বলল,
“তপা ভার্সিটিতেই আছে এখনো। কি হয়েছে বলবি তো।”
“ঝামেলা হইয়া গেছে ভাই। আততায়ীরা হামলা করেছে। টিভিতে দেখাচ্ছে।”
পলক রিমোট হাতে নিতে নিতে বলল,
“তুই কোথায়?”
সজল ব্যাথিত গলায় বলল,
“আমি আঁটকে গেছি ভাই। ক্যান্টিনের দরজা বন্ধ কইরা আঁটকাইয়া দিছে হারামজাদারা।”
পলক ফোন কেটে দ্রুত তপা কে কল দিল। দুবার বেজে কেটে গেল। এরমধ্যে টিভি স্কিনে ভার্সিটির ভয়ংকর দৃশ্য অবলোকন করে নিয়েছে সে। কল করতে করতেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ল অফিস থেকে।
চতুর্থ বারে কল ধরল তপা। শান্ত কণ্ঠে বলল,
“হ্যা বলুন।”
পলক তপার কণ্ঠ শুনে খানিকটা স্বস্তি পেল। বলল,
“তুমি কোথায়?”
তপা নিজেকে শান্ত রেখেই বলল,
“ক্লাসে। কেন কি হয়েছে?”
পলক চমকে উঠল তপার অবস্থান ভার্সিটি তে শুনে। তীব্র অধিকার বোধ নিয়ে বলল,
“যেখানে আছো ওখানেই থাকবে। খবরদার বের হবে না। আমি এক্ষুনি আসছি।”
তপা কেঁপে উঠল। এতক্ষণ যাবত নিজেকে শান্ত রাখার প্রচেষ্টা মূহুর্তেই চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গড়িয়ে পড়ল ভূপৃষ্ঠে।
উত্তেজিত গলায় বলল,
“আপনি আসবেন না। এখানের অবস্থা ভালো না। আসবেন না আপনি। দোহাই আপনার…”
পুরো কথা শেষ করার আগেই পলক গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আমি আসছি।”
স্তব্ধ হয়ে গেল তপা। হাত পা ক্রমশ কাঁপতে শুরু করেছে তার। সে তো দিব্যি সুস্থ স্বাভাবিক আছে। নিরাপদে আছে। কিন্তু পলক তো ঝামেলা হওয়া জায়গা পেরিয়ে আসবে। যদি কিছু হয়ে যায়? তপা স্থির থাকতে পারল না। নিষেধ সত্বেও বেরিয়ে এলো দ্রুত পায়ে। ছয়তলা থেকে লিফটের অপেক্ষা না করে সিঁড়ি বেয়ে। ক্রমশ এগিয়ে গেল মাঠের দিকে।
পলক দিকবিদিকশুন্য হয়ে কেবল ভার্সিটির দিকেই চালনা করছে নিজের শখের বাইকের চাকা। সর্বোচ্চ গতিতে ছুঁটে চলেছে নিজ গন্তব্যে। জানা নেই কি আছে ভবিতব্যে।
চলবে…