–” এই অভি,আরে এই অভি পাতাটা উল্টা না আর একবার।”
পিছন থেকে ফিসফিসিয়ে এলো কন্ঠস্বরটা। অভি ঘাড় গুঁজে চুপ করে রইলো, পিছন ফিরে তাকালো না। ঠিক তখনি আবারো ফিসফিসিয়ে এলো কন্ঠস্বরটা। এবার শব্দ,বর্ণ এমনকি বাক্য সম্পূর্ণটাই আলাদা।
–” বিশ্বাস কর তখন একটুও দেখতে পারি নি। এই তোর কসম কেটে বলছি।”
কসমের কথা শুনে মেজাজটা খিচঁড়ে গেলো অভির। অভি বিরক্ত হয়ে আড় চোখে একবার তাকালো অবিনাশ স্যারের দিকে। অবিনাশ হালদার অভিদের স্কুলের গনিতের শিক্ষক। এমনিতে স্বভাবে অবিনাশ বাবু ঠান্ডা শান্ত স্বভাবের হলেও রেগে গেলে আগুন হয়ে যান। তখন আর দিন দুনিয়া খেয়াল থাকে না ওনার। পরিক্ষার হলে অন্য শিক্ষকদের মতো তিনি কড়া গার্ড দেন না তবে কেউ যদি বেয়াদবি করে তবে তার হিসেব আলাদা। এই যেমন এখন তিনি চারকোনা কাঠের টেবিলের মাথা রেখে চুপচাপ বসে আছেন আর মাঝে মাঝে গোল গোল চোখ দিয়ে একবার শিক্ষার্থীদের দিকে তাকাচ্ছেন।
–” আরে ওদিকে কি তাকাচ্ছিস, ও ব্যাটা দেখবে না। দেখছিস না কেমন চুপচাপ বসে বসে ধ্যান করছে। তুই বরং খাতার পাতাটা উল্টা। এখন পর্যন্ত কিছুই লেখতে পারি নি, আমার যে কি হবে আজ । তুইও…..
আর কথা বাড়ায় না অভি। চট করে খাতার পাতা উল্টিয়ে রেখে দেয়। অভি জানে মেহুলের মাথায় সিট আছে। তাইতো একবার কথা শুরু করলে আর থামতে চায় না।
–” এই তৃতীয় লাইনটা কি লিখেছিস রে? কিছুই বুঝতে পারছি না। তোকে কতবার বলেছি যে হাতের লেখা একটু বড় করবে আর ওভাবে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে লিখবি না। আমার বুঝতে বড্ড অসুবিধা হয়। ”
অভি দম খিচঁড়ে চুপচাপ বসে থাকে। মাথা ভেতর চিনচিনে রাগের সৃষ্টি হচ্ছে। অভি নিজেকে সামলিয়ে আবারো লেখা শুরু করলো। মেহুলের কথা কানেই তুললো না ও। মেহুল অভির রাগের কারন বুঝতে পেরে বলল,
–” সরি সরি সরি আর এভাবে তোকে বলবো না বাবু। তবুও এ বারের মতো আমায় বাঁচিয়ে নে। তুই তো জানিস পরিক্ষায় ভালো না করলে মা আমাকে ঠেঙ্গাবে।”
অভি এবার খানিকটা বিরক্ত হলো। মেহুলের যে লাজ, লজ্জা,ভয় ,ডর কিছুই নেই এ কথা জানে অভি। অভি ধপ করে খাতার পাতা বন্ধ করে মেহুলের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
–” এই তুই কি রে? পরিক্ষা শুরু থেকে শুধু দেখেই যাচ্ছিস, এখন অব্দি নিজের জ্ঞানে দুই একটা শব্দও তো বোধহয় লেখতে পারিস নি।”
ঠোঁটটা জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে মেহুল আকাশকে বলল,
–” এই যা তো, কয়েকটা প্রশ্নের উওরই তো দেখিয়েছিস। তবুও এমন একটা ভাব করছিস যেন কি না কি দেখাচ্ছিস।”
মেহুলের এমন ভেঙ্গিয়ে বলা কথাগুলো শুনে অভির থিতিয়ে রাখা রাগটা আবারো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠল। রাগত স্বরে একটু জোরেই বলল,
–” মারবো টেনে এক চড় তখন দেখবি….
অভির কথা মাঝপথেই থেমে যায় একটা গম্ভির স্বর শুনে।
–” বলছি তোমরা কি তোমাদের বাকি আলাপ এইখানেই শেষ করবে? করলে বলো , আমি বেরিয়ে যাই।”
গম্ভির কন্ঠস্বর শুনে আর কোন বাড়তি কথা বলে নি অভি। সামনের দিকে ঘুরে বসেছিল কিন্তু বাঁধ সাধে মেহুল। এইটা তো সবাই জানে যে পরিক্ষার হলে দেখানোর সময় স্যারের কাছে ধরা পরলে মলিন মুখে হাজার বার স্যারকে অনুরোধ করতে হয় যেন স্যার বাকি পরিক্ষাটা দিতে দেয় । মেহুল করেছে ঠিক তার উল্টো। অবিনাশ স্যারকে আবোলতাবোল বলে আরো বেশি রাগিয়ে দিয়েছে। ফলস্বরূপ আজ আর বাকি পরিক্ষা দেওয়া হয় নি দুজনের। ঘাড় ধরে পরিক্ষার হল দেখে ওদের বের করে দিয়েছে অবিনাশ স্যার। পরিক্ষা দিতে না পারায় অভি মেহুলকে রেখে আগেই বেরিয়ে এলো। অভিদের স্কুলের মাঠের একপাশে এক বিশাল বড় কৃষ্ণচূড়ার গাছ রয়েছে। অভি হল থেকে বেরিয়ে সেই গাছের নিচে এসে দাঁড়ালো। মনে মনে বেশ কয়েকটা গালি দিলো মেহুলকে। কি দরকার ছিল স্যারকে রাগানোর। যেটুকু লিখেছে তাতে পাশ হবে কি না সন্দেহ অথচ আজকের প্রশ্নটা বেশ কমন পড়েছিল অভি। বাড়িতে গিয়ে নির্ঘাত মায়ের হাতে বেদম ঠেঙ্গানি খাবে আজ সে।
–” কি ভাবছো লাল্টু?”
মেহুলের হেঁয়ালি কথায় রেগে যায় অভি। মনে মনে বলে,
–” বাঁদরি , অসভ্য ছোট লোক মেয়ে একটা।”
মেহুল হয়তো অভির মনের কথাগুলো বুঝতে পারে। তাই অভির পাশে এসে ওর কাঁধে হাত রেখে বলে,
–” গালি দিচ্ছিস বুঝি? দে না আরো দে। ওসব ছোট বেলা থেকে শুনে শুনে অভ্যেস হয়ে গেছে। তুই বরং অন্য কিছু ট্রাই কর।”
অভি কিছু বলে না । গটগট করে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে চলে যায় মেইন রোড বরাবর। মেহুলও অভির পিছু পিছু আসে। অভি যখন রাস্তা পার হতে যাবে ঠিক তখনি অভির বাম হাতে টান পরে। অভি বাম দিকে মুখ ফিরাতেই মেহুল হাতের আঙ্গুল দিয়ে দূরের একটা দোকান ইশারা করে বলে,
–“এই অভি আচার খাবি?”
অভি হাত ছাড়িয়ে নেয় মেয়েটির কাছ থেকে তারপর মাথা দুইদিক নাড়িয়ে বলে,
–” একদমই না , ওসব পঁচা বাসি খাবার আমি খাবো না। আর তোর মতো উড়নচন্ডির সাথে তো আরো খাবো না।”
মেহুল আবারো অভির হাত ধরে বলল,
–” এরে বাবা তুই যদি না খাস তবে তো আমি পাপী হয়ে যাবো। ভয়ংকর এক পাপ লাগবে আমার গায়ে। হাজার হলেও পরিক্ষার হলে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিস আমায়। তোকে কি আর না খাইয়ে ছাড়তে পারি বল। হাজার হলেও তুই উচ্চবিত্ত বামনের ছেলে আর আমি হলাম কি না একটা সাঁওতাল মেয়ে। একেবারে নিচু জাত।”
–” কানের গড়ায় এমন একটা চটকানি মারবো না যে নিজের নামই ভুলে যাবি তুই। আমি যাবো না তোর সাথে আর শোন বাড়ি গিয়ে আমি কাকিমাকে বলে দিবো সবটা।”
–” পা দুটো ভেঙে নলা করে দিবো আমি তোর। বেয়াদব ছেলে কোথাকার। স্কুলে আসার সময় কামরাঙ্গা দেখে এসেছি দোকানে ,নিশ্চয়ই এতক্ষনে সেগুলো কেটে রেখে দিয়েছে। চল মনা কাকার দোকানে, চল বলছি।”
কথাটা বলেই অভির হাত ধরে মেহুল ছুট লাগালো রাস্তার পাশের ছোট্ট দোকানটায়।
অভি দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে জোরে বলতে লাগলো,
–” হ্যা রে মেহুল খাওয়া ছাড়া আর কিছু মাথায় থাকে না তোর। সব সময় শুধু খাওয়া আর খাওয়া। গতকাল তোকে পড়ার কথা জিজ্ঞেস করায় বললি সব পড়া নাকি তোর শেষ, এখন নাকি পরিক্ষার হলে গিয়ে খাতায় পাতা ভরে একেবারে গট গট করে লিখে দিবি। এই তোর গটগট করে লেখার নমুনা। একটা অক্ষরও তুই নিজের জ্ঞানে লিখিস নি তুই। বইয়ের এক দুই পাতা
উল্টিয়েও তো দেখতে পারিস।”
–” এজন্য তো তুই আছিস ডালিং। আমার একমাত্র অন্ধের যষ্ঠি। ”
–” তোর ন্যাকামি শেষ হয়েছে? তবে খাওয়া এবার।”
এরপর আর কোনো কথা হয় না দুজনে মাঝে। হাত ধরে ওরা দুজনে হেঁটে চলে রাস্তা বরাবর, মনা কাকার দোকানের দিকে।
মনা কাকার দোকান ওদের স্কুলের স্থায়ী ছোট ক্যান্টিনের মতো। কি নেই সেই দোকানে। বাদামভাজা, আচার, আলু কাবরি, কদবেল, কামরাঙ্গা, ঝালমুড়ি, ফুচকা, চটপটি কি নেই সেখানে। বড় অমায়িক ভদ্রলোক মনা কাকা। সবার সাথেই হাসি মুখে কথা বলে। কখনো কোন দিন মনা কাকাকে কারো সাথে কথা কাটাকাটি করতে দেখে নি ওরা।
ছোট ছাউনির ভেতরে ঢুকেই মেহুল হাঁক ছাড়ল,
–” কাকা একটু টকটক ঝাল ঝাল করে কামারাঙ্গা মেখে দাও তো।”
মনা কাকা ওনার স্বভাবতই মিষ্টি হাসলেন খানিকটা। তারপর ঝটপট হাত চালাতে লাগলেন। মেহুল ও অভি ছাউনির ভেতরের রাখা টুলগুলোতে গিয়ে বসলো। মনা কাকার দোকানে তখন ব্যাপক ভিড়। অভিরা বসার মিনিট খানেক পরেই মনা কাকা দুটো ঠোঙ্গা হাতে ওদের কাছে এলো। অভি আর মেহুল মনা কাকার হাত থেকে ঠোঙ্গা দুটো নিতেই মনা কাকা বলে উঠল,
–” এই আইজ না তোমাগোর পরিক্ষা আছিলো? তোমরা পরিক্ষা না দিয়া এইহানে কি করো?”
অভি মনা কাকার কথা শুনে চোখ রাঙায় মেহুলকে। মেহুল অভিকে পাত্তা না দিয়ে মনা কাকার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
–” পরিক্ষা দিয়েছি তো। আজ এতো ভালো পরিক্ষা দিয়েছি যে সবার আগে বেরিয়ে এসেছি আমরা। ”
–” তা পরিক্ষা ভালো হইছে তো মা?”
–” ফাটাফাটি হয়েছে কাকা।”
মনা কাকা চলে যায়। অভি রেগে মেগে মেহুলের পিঠে দুম করে একটা কিল বসিয়ে দেয়। মেহুল ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠে পরমুহূর্তেই খাওয়ায় মন দেয় যেন কিছুই হয়নি। অভিও মেহুলের দেখাদেখি কামরাঙা মুখে দেয় কিন্তু ঝালের চোটে অভির চোখে পানি চলে আসে। মেহুল অভির অবস্থা দেখে মিটিয়ে হেসে বলে,
–” কিরে কাকাকে আরো একটু ঝাল দিতে বলবো নাকি?”
–” পিঠে কি আবারো দুম করে তাল খেতে ইচ্ছে হয়েছে?”
–” ছি ছি আগে তোর ঐ নাকে দেওয়া হাতটা ধুয়ে আয় ,তারপর আমার গায়ে হাত দিবি।”
–” তবে রে।”
–” খবরদার তোর ঐ হাত যদি আমার গা ধুয়েছে ,তবে বুঝবি আমি কি জিনিস।”
কথাটা বলেই মেহুল আবারো হাঁক ছেড়ে বলল,
–” ও কাকা আমাকে আরো একটু ঝাল দাও তো। বাচ্চা পোলাপানরা আবার ঝাল খেতে পারে না।”
নিরবে অপমানটা সহ্য করে নিল অভি। ভুল কিছু বলে নি মেহুল। ঝাল একেবারেই সহ্য করতে পারে না অভি। ঝালের বদলে যদি রসগোল্লা দেওয়া হয় অভিকে তবে অভি একায় এক হাড়ি নামিয়ে ফেলতে পারবে। রসগোল্লার কথা মনে হতেই অভির চোখ চকচক করে উঠলো। হাতে কামরাঙ্গার ঠোঙ্গা নিয়ে দুজনে এলোমেলো পায়ে এগিয়ে চলল বাড়ির দিকে।
চলবে
#বসন্ত_বিলাস
#আমিনা_আফরোজ
#সূচনা পর্ব
(আসসালামু আলাইকুম। নতুন গল্প শুরু করলাম। গল্পটি ভালো লাগলে কমেন্টে জানাবেন আর ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন)