প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব -২২

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-২২

সৌহার্দ্যের হাতটা তরীর মাথা থেকে চুল বেয়ে ধীরে ধীরে নিচে পড়ে গেল। অতি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো তরীর মুখের দিকে। মুখ হা হয়ে গেছে ওর। ঘন ঘন পলক ফেলে বোঝার চেষ্টা করলো যে, সেঠিক শুনেছে কি না! নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে পাশে মুখ ফিরিয়ে সবার দিকে চোখ বুলালো। সবার অবাকতার মাত্রা যে তার থেকেও কয়েক গুন বেশি, সেটা তাদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তার মানে এটা সৌহার্দ্যের ভ্রম ছিল না! সে ঠিকই শুনেছে।

সবটা বুঝে উঠতেই সৌহার্দ্য নড়েচড়ে বসলো। আসলেই তার চাঁদ কথা বলেছে! সে দু-হাত তুলে তরীর মুখটা নিজের আঁজলায় ভরে নিল। থেমে থেমে যাওয়া কন্ঠে বললো, “তুমি কী বললে? তুমি সত্যি কথা বললে! তুমি সত্যি সত্যি কথা বলেছো? আরেকবার বলো না? আমার নিজের কানকেও বিশ্বাস হচ্ছে না।”

তরী সুনয়নে তাকালো। অতি আবেগে সে সৌহার্দ্যকে অতীতের মতো করে তুমি বলে সম্বোধন করে ফেলেছে। বর্তমানে তার মুখে হাসির লেশমাত্র নেই। অতি সন্তর্পণে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। তার গাল ছুঁয়ে থাকা সৌহার্দ্যের হাতের ওপর নিজের হাত রেখে বললো, “আপনি ঠিকই শুনেছেন, ড. সৌহার্দ্য।”

সৌহার্দ্য নিজের ভ্রুদ্বয় একত্রিত করে বললো, “এভাবে বলছো কেন? একটু আগেই ঠিক ছিল!”

” কী ঠিক ছিল?”

“তোমার মুখের তুমি সম্বোধন এবং ভালোবাসাময় সেই স্বীকারোক্তি!”

তরী বিব্রত হলো। অনাকাঙ্ক্ষিত এক পরিস্থিতিতে পড়ে নিজের খেই হারিয়ে ফেলেছিলো সে! কী অদ্ভুত কান্ড! মুখ খুলেছিল সে জেনে-বুঝেই! কিন্তু মুখ থেকে এমন ধরনের কথা বের হয়ে আসবে, সে ভাবতেও পারেনি।

প্রহর জানত, তরী আজকে কথা বলবে। কিন্তু সবকিছু জানা সত্ত্বেও আজ তরীর মুখ থেকে কথা শুনে সে অবাক হয়েছে। তরীর কথা শুনে মনে হচ্ছে না যে, ও কোনো অভিনয় করছে। সবটাই সত্য, বাস্তব বলে মনে হচ্ছে। এই রহস্যময় মেয়েটা তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটাকে প্রচন্ড ভালোবাসে- এতে এখন তার কোনো সংশয় নেই। প্রহরের সন্দেহ এখন ক্রমশ ধোয়াশায় ঘনীভূত হচ্ছে। ভাবুক ভঙ্গিতে সে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে।

“কী রে, নাতবউ? এতোদিন তুই আমাদের এই ভাবে ঠকাইলি? নাটক করলি? তুই তো অনেক খারাপ!”

বলেই দাদী তরীর কান ধরে টেনে বসা থেকে তুললো। তরী নিজের কানে হাত বুলিয়ে ঠোঁট উল্টে তাকালো। ইশারায় বোঝালো,

“আমার মুখ, আমার ইচ্ছে। আমার যখন কথা বলতে মন চাইবে, তখন কথা বলবো। নয়তো……”

তরীর কথা শেষ হওয়ার আগেই দাদী তেড়ে ওর কান চেপে ধরে বললো, “আবার? আবার ইশারায় কথা বলিস? মুখ দিয়ে কথা বলবি আমার সাথে এখন থেইকা!”

সৌহার্দ্য ব্যস্ত গলায় বললো, “আহ!, দাদী! ওর কানে ব্যথা পাচ্ছে তো! ওকে ওর ইচ্ছে মতো কথা বলতে দাও না!”

“তুই চুপ কর! দুই দিন আগেও বউকে দেখতে পারতি না। আর এখন দেখো! দরদ কতো!! বলি এতো ভালোবাসা আসলো কই থেইকা তোদের মইধ্যে?”

দাদীর কথা শুনে সৌহার্দ্য হাসলো। তরীর মুখেও হাসির রেশ ফুটে উঠলো। মিস্টার রায়হান ওদের খুনসুটি দেখে বললো,

“যাক! আমার সংসারটা এখন পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। আমি তোকে বলেছিলাম না, সৌহার্দ্য? আমি তোর জন্য সঠিক মানুষটা-ই সিলেক্ট করেছি। বাবা-মায়েরা সন্তানদের খারাপ চায় না কোনো দিন। কী বলো, সুজাতা?”

সুজাতা সন্তুষ্টির সাথে বললেন, “আমার এই সুন্দর সংসারে আর কোনো ঝড় না আসুক! কিন্তু তুই তো কথা বলতে পারিস না- এটা সবাই জানে। মানে আজকে তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে, সবাই ভুল জানতো। তুই এতোদিন এভাবে থাকলি কেন তাহলে?”

“আহ্! সুজাতা, ওকে এসবের কারণ জিজ্ঞেস করো না। এই ব্যাপারটা নিয়ে ঘাটাঘাটি না করাটাই ভালো হবে। চলো এখন আমরা বেরোই!”

মিস্টার রায়হানের কথা শুনে কেউ আর কথা বাড়ালো না। সবাই একে একে বের হয়ে গেল। তরী ওদের পিছনে যেতে নিলে সৌহার্দ্য ওর হাত টেনে ধরে বললো,

“আরে, তুমি কোথায় যাচ্ছো?”

“বাবা বললেন তো বের হতে এখান থেকে!”

“তোমাকে বলেনি যেতে। বাকিদের বের হতে বলেছেন যেন আমরা একটু প্রাইভেসি পাই।”

তরী অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো, “প্রাইভেসি? মাথায় আঘাত লেগে কি মাথাটা নষ্ট হয়ে গেছে নাকি?”

সৌহার্দ্য টেনে তরীকে নিজের পাশে বসিয়ে বললো, “সে তো অনেক আগেই হয়েছে! সেই এক যুগ আগে, যখন এক কিশোরের মধ্যকার প্রেমিক পুরুষ জেগে উঠেছিল এক পরীর কারণে।”

“মানে?”

সৌহার্দ্য আনমনে বললো,

“মানে খুবই সাধারণ। এক রাজকুমার আর এক পরীর গল্প এটা। রাজকুমার খুব ছোট ছিল। তার জীবনে একটা পরী আসে। পরীটাকে সে খুব যত্ন করতো, দেখেশুনে রাখতো, সব খেয়াল রাখতো। ধীরে ধীরে পরীটা তার জীবনের অংশ হয়ে যায়। প্রেম-ভালোবাসার মানে সে বুঝতো না। কিন্তু বয়স বাড়তে বাড়তে সে বুঝদার হয়। বুঝতে পারে যে, সে ঐ পরীটাকে ভালোবাসে।”

“তারপর?”

“তারপর আর কী? ভালোবাসলেই তাকে পাওয়া সম্ভব ছিল না। সে তো পরী! যেভাবে রাজকুমারের জীবনে এসেছিল, সেভাবেই তার জীবন থেকে হারিয়ে গেল। খুঁজে পাওয়াও সহজ ছিল না। বরং অসম্ভব ছিল। কারণ যে ইচ্ছে করে হারিয়ে যায়, সে স্বেচ্ছায় ফিরে না আসলে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তোমার এতো কিছু জানতে হবে না। তুমি বরং আমার সামনে বসো। আমি তোমাকে দেখি। তোমাকে দেখতে দেখতেই আমি সুস্থ হয়ে যাবো, দেখো!”

তরী হাসলো। সৌহার্দ্যের সামনে বসে রইলো ওর কথা মতো। আর সৌহার্দ্য? সে তো এতো বছর পর তার চাঁদকে নতুন ভাবে নিজের করে ফিরে পেয়েছে! এতো অপেক্ষার পর নিজের তৃষ্ণার্ত হৃদয়কে শান্ত করতে তাকিয়ে রইলো তার চাঁদের দিকে অপলক যেন এই চাঁদের পূর্ণিমায় তার জীবনের সকল অন্ধকার ফুরোবে আর সূচনা হবে এক সুন্দর প্রভাতের।

সৌহার্দ্যকে নিয়ে পরেরদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে গেল সবাই। তবে ওকে সপ্তাহ খানেক সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকতে বলা হয়েছে। সৌহার্দ্য নিজেও জানে, ওর মাথায় আঘাত লাগায় নিজেকে শান্ত ও বিশ্রামের মধ্যে রাখতে হবে। রাতের খাবারটা তরী আলাদা করে সৌহার্দ্যের জন্য নিয়ে এলো। সবার সাথে এক সাথে বসে খাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও কয়েকদিন ঘরের চার দেয়ালে নিজেকে বন্দী রাখাটাই ভালো মনে করলো সৌহার্দ্য। তাই এই ব্যাপারে তরীকে আর কিছু বললো না।

তরী সৌহার্দ্যের সামনে খাবার রাখলো। সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বললো, “একটা প্লেট কেন?”

তরী অবাক হয়ে বললো, “একটা প্লেট-ই তো থাকবে! আপনি একজন মানুষ। কেন? আপনি কি দুই প্লেট খাবার খাবেন?”

সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে বললো, “তোমার মনে হয়, আমি এখন দুই প্লেট খাবার খাবো? তুমি নিজে খেয়েছো?”

“না। আপনি খেয়ে নিন। তারপর না-হয় আমি খাবো।”

“আজ্ঞে না! আপনি আমার সাথেই খাবেন। আর শুধু আজকের জন্য না, প্রতিদিন খাবেন। বুঝলেন?”

“আপনি আমাকে এভাবে আপনি আপনি করে কথা বলছেন কেন?”

সৌহার্দ্য বললো, “কারণ তুমিও বলছো আপনি করে! তাই।”

তরী সুন্দর করে হাসলো। সৌহার্দ্যের পাশে বসে খাবার ঠিক করতে করতে বললো, “এসো, খাইয়ে দেই।”

সৌহার্দ্য অবাক চোখে তাকালো। সেই ছোটবেলায় সৌহার্দ্য রাগ বা অভিমান করলে তার চাঁদ এভাবেই তার কাছে খাবার নিয়ে এসে বলতো, “এসো, খাইয়ে দেই!” সৌহার্দ্যের অনুমতি চাইলেও অনুমতির অপেক্ষা সে কোনোদিনও করেনি। বরং নিজের ছোট ছোট হাত দিয়ে খাবার তুলে দিতো সৌহার্দ্যের মুখে। আজও কথাটা সৌহার্দ্যের কানে বাজে। কিন্তু কথাটা বলার মানুষটা হারিয়ে গিয়েছিল।

তরী সেই আগের মতোই সৌহার্দ্যের মুখে খাবার তুলে দিলো। সৌহার্দ্য খাবার খেতে খেতে তরীর দিকে তাকিয়ে রইলো। বললো, “শুধু আমাকে খাওয়ালেই হবে? বললাম না? তোমাকে আমার সাথে খেতে হবে!”

“কিন্তু খাবার তো এক প্লেট!”

“খেয়ে দেখো। এই খাবারে লেগে থাকা ভালোবাসা দিয়েই পেট ভরে যাবে।”

তরী খিলখিল করে হাসতে হাসতে বললো, “হ্যাঁ, তোমার কথা বার্তা আজ অদ্ভুত ঠেকছে!”

সৌহার্দ্য কিছু বললো না। খাওয়া শেষে তরী হাত ধুতে ধুতে বললো, “আমি যদি সত্যি সত্যি কথা বলতে না পারতাম, তাহলে কি আমায় কখনো মেনে নিতেন না?”

“মেনে তো তোমায় অনেক আগেই নিয়েছিলাম! বহু আগে। তুমি জানতেও না তখন!”

তরী ভ্রু কুঁচকে বললো, “মানে?”

সৌহার্দ্য হকচকিয়ে গেল। আমতা আমতা করে বললো, “না। মানে বলছিলাম যে, শুরু থেকেই মেনে নিয়েছিলাম। সেটাই বোঝালাম আর কি!কিন্তু তুমি এতো দিন কথা বলোনি কেন? ”

তরী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বললো, “ইচ্ছে ম*রে গিয়েছিল কথা বলার। আমার জীবনের শেষ কথা বলেছিলাম সেদিন, যেদিন আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে আমার নিজের চোখের সামনে ম*রে যেতে দেখেছিলাম। আমি চিৎকার করে কেঁদেছিলাম সেদিন। সেদিনের পর থেকে আমার জীবন থেকে কান্না ও কথা বলার ইচ্ছে, দুটোই হারিয়ে গেছে। কালকে যখন শুনলাম আপনি হসপিটালে এডমিটেড, আমার আবারও সেই পুরনো ভয় মনের মধ্যে জেগে উঠেছিল। দ্বিতীয় বার প্রিয় মানুষ হারানোর বেদনা সহ্য হতো না আমার। কান্না ও ভাষা- দু’টোই আমার মধ্যে ফিরে এসেছে আমার অজান্তেই!”

সৌহার্দ্য হাসলো। বললো, “তার মানে আমিও তোমার প্রিয় মানুষ। এতো ভালোবাসো?”

“বাসি তো! তোমার মতো না। আমাকে একটু ভালোবেসো, বুঝলে? একটু ভালোবাসাই চাইবো তোমার কাছে।”

বলেই তরী হাসতে হাসতে নিজের এলোমেলো চুলগুলো খোঁপা করার জন্য হাত তুললো। সৌহার্দ্য বাঁধা দিয়ে বললো, “তোমার ঢেউ খেলানো খোলা চুলগুলো আমার খুব প্রিয়। এই চুলগুলো আমার সামনে সবসময় খোলা রাখবে। তুমি খোলা চুলে আমার কাছে এসে কিছু চাইলে আমি তোমায় ফিরিয়ে দিতে পারবো না কখনো। আর একটু ভালোবাসার কথা বলছো? আমার ভালোবাসায় পা ফেললে তলিয়ে যাবে তুমি। বুঝলে?”

-চলবে….

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here