প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব -২১

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-২১

“সৌহার্দ্যের গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে। ও আপাতত ওর হসপিটালেই ভর্তি। এসে দেখা করে যান, মিসেস অরিত্রী সেহরীশ!”

বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে তব্দা খেয়ে রইলো তরী। প্রহরের বলা কথাটার দুটো দিক তার মস্তিষ্কে ঘোরাঘুরি করলো অনেকক্ষণ। প্রথমত সৌহার্দ্যের এক্সিডেন্ট, দ্বিতীয়ত প্রহরের তার আসল নাম জেনে ফেলাটা। দ্বিতীয় বিষয়টার চেয়ে প্রথম বিষয়টা তরীর মধ্যে কয়েকগুণ বেশি প্রভাব ফেললো। কিন্তু প্রহরের কথা বিশ্বাস করার কোনো কারণ খুঁজে পেল না। রাগে ফোনটা কে*টে দিয়ে প্রহরকে একটা মেসেজ লিখে পাঠিয়ে দিলো তরী,

“আপনাকে বিশ্বাস করি না আমি। যদি এই ঘটনা সত্যি হয়ে থাকে, তবে বাবা নয়তো মাকে কল দিয়ে জানান।”

প্রহর হতাশ হলো না। সে জানে তরী বুদ্ধিমত্তা অসাধারণ তীক্ষ্ণ! তাই আর কালক্ষেপ না করে মিস্টার রায়হানকে কল দিয়ে জানালো। তরীর সারা শরীর কাঁপছে। মনের ভেতর ভয়েরা বাসা বেঁধেছে। সত্যি সত্যি যদি সৌহার্দ্যের কিছু হয়ে গিয়ে থাকে! প্রহর যদি সত্যি বলে থাকে, তখন কী হবে? তরী মনে মনে ভাবলো,

“যদি প্রহর মিথ্যে বলে, তাহলে আমি ওকে ছাড়বো না!”

তরীকে এভাবে কাঁপতে দেখে দাদী অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। এগিয়ে এসে বললেন, “কী রে, নাতবউ! তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?”

তরী কিছু বলার আগেই বাহির থেকে মিস্টার রায়হানের ক্রন্দনরত চিৎকার শোনা গেল, “সুজাতা, মা, বউমা! কোথায় তোমরা? আমার ছেলে হসপিটালে ভর্তি! তাড়াতাড়ি যেতে হবে। ড্রাইভার! গাড়ি বের করো।”

তরীর চোখের সামনে সারা পৃথিবী অন্ধকার হয়ে এলো। ঝাপসূ চোখে কিছুক্ষণ পলক ফেলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো সে। তারপর! কঠিন হৃদয়ের অধিকারী মেয়েটার অবশেষে দূর্বলতায় আঘাত লাগায় তার মস্তিষ্ক একটা বাক্যই আওড়ালো, “কেন বারবার আমাকেই প্রিয়জন হারানোর বেদনা সহ্য করতে হয়?”

৩৩.
সৌহার্দ্য বেডে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। সারা মাথা জুড়ে ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হয়েছে। প্রহর সৌহার্দ্যের বাবাকে কল দেওয়া শেষে আবার সৌহার্দ্যের কাছে ফিরে এলো। তাদেরকে এখনো জানায়নি যে, সৌহার্দ্য তেমন আ*হ*ত হয়নি আর এখন মোটামুটি সুস্থ। মূলত সৌহার্দ্যের মাথায় আঘাত লাগার পর প্রহর ওকে হসপিটালে এনে ওর সুস্থতা নিশ্চিত করার পরেই সৌহার্দ্যের পরিবারকে জানিয়েছে।

সৌহার্দ্য ভ্রুদ্বয় কুঁচকে হেলান দিয়ে বসে আছে। মাথাটায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে তার। আধো আধো কন্ঠে প্রহরকে বললো,

“আমাকে হসপিটালে নিয়ে এলো কে?”

প্রহর ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মুখ ভেঙিয়ে বললো, “তোর সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। তো আমি ছাড়া আর কে নিয়ে আসবে? আমিই নিয়ে এসেছি তোকে এখানে।”

“তুই ওখানে পৌছলি কী করে? মানে ওখানে তোর উপস্থিতি…. ব্যাপারটা বুঝলাম না ঠিক! ”

“আমি ঐ রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলাম। দূর থেকে দেখি তুই সেই বাড়িটা থেকে বের হচ্ছিস। তোকে ডাক দেওয়ার আগেই তুই গাড়ি টান দিয়ে চলে গেলি। আমিও তোর সাথে একই রাস্তা দিয়ে আসছিলাম। তোর ভাগ্য ভালো যে তোর পিছনে ছিলাম আমি। হঠাৎ দেখি তোর গাড়ির স্পিড হুট করে বেড়ে গেল। প্রথমে বুঝিনি। কিন্তু পরে ব্যাপারটা বুঝলাম! যাইহোক, ঐ বাড়িটা থেকে বের হওয়ার সময় তোর সাথে একটা ব্যাগ ছিল। সেটা কোথায়?”

সৌহার্দ্য অবাক চোখে তাকালো। চোখ ছোট ছোট অবাক কন্ঠে বললো, “ব্যাগটা তো আমার সাথেই ছিল! ঐটা গাড়িতে পাসনি তুই।”

প্রহর মাথা নাড়িয়ে বললো, “না, তো! তোর গাড়ি এতো দ্রুত এগিয়ে গিয়েছিল যে, এক্সিডেন্ট এর পর তোর কাছে আসতে একটু সময় লেগেছিল। কিন্তু তোর গাড়িটা পুরোটা চেক করে আমি কোনো ব্যাগ পেলাম না।”

সৌহার্দ্য নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বললে, “ওহ্! শিট!! তারমানে আমি যেন সত্যিটা না জানতে পারি, এজন্যই আমার গাড়িটা এক্সিডেন্ট করানো হলো যেন ঐ ব্যাগটা সরিয়ে ফেলা যায় সহজেই!”

“মানে? ঐ ব্যাগে ছিলটা কী?”

“অনেকগুলো পেপারস! আজাদ চাচা মৃ*ত্যুর আগে আমাকে বলে গিয়েছিলেন ঐ পেপারস গুলোতেই আমার অজানা সব প্রশ্নের উত্তর পাবো আমি!”

“আর এটা তুই আমাকে আগে জানাসনি? নিজে নিজে বেশি বুদ্ধি খাটাতে গেলে এরকমটা-ই হবে!”

প্রহর বিরক্ত নিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। রহস্যময় হাসি দিতে দিতে এগুতে লাগলো সে। মনে মনে বললো,

“তুই আমার থেকে যা লুকাতে চাইছিস, তা আমি খুব ভালো করেই জানি, সৌহার্দ্য! তোর তরী-ই আসল কালপ্রিট, এটা বুঝতে বাকি নেই আমার। আজ তোকে এক্সিডেন্ট করানোর পর থেকে ব্যাপারটায় আরো বেশি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছি আমি। তোকে খুব বেশি আঘাত দেওয়ার উদ্দেশ্যে এক্সিডেন্টটা করায়নি ও। যতই হোক! ভালোবাসার মানুষ!! কিন্তু যতই বুদ্ধি খাটাক না কেন? আমি তো তার একধাপ ওপরে। ঐ কাগজের ব্যাগটা তোকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার সময় সরিয়ে ফেলেছি আমি। ঐটা এখন আমার দখলে। এখন ঐটা থেকে সব রহস্য আমি উদঘাটন করবো।”

ভাবতে ভাবতে মনে মনে তৃপ্তির হাসি হাসলো প্রহর। সামনে তাকাতেই দেখতে পেল, সৌহার্দ্যের মা আর বাবা দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। কিন্তু তরীকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

মিস্টার রায়হান প্রহরের দুই বাহুতে হাত রেখে কান্নামাখা কন্ঠে বললেন,

“আমার ছেলে কেমন আছে? ও ঠিক আছে তো!”

সুজাতা ওড়না দিয়ে চোখ মুছে বললেন, “সৌহার্দ্যের কী হয়েছে? এখন কী অবস্থায় আছে আমার ছেলে? চুপ করে আছিস কেন? বল না?”

প্রহর শুকনো হাসি দিয়ে বললো, “সৌহার্দ্য ভালো আছে, আঙ্কেল! মাথায় সামান্য আঘাত লেগেছে। ওকে কেবিনেই রাখা হয়েছে।”

মিস্টার এবং মিসেস রায়হান দ্রুত গতিতে এগিয়ে গেলেন সৌহার্দ্যের কেবিনের দিকে। প্রহর তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো, তরী কেন এলো না? সৌহার্দ্যের অসুস্থতার কথা শুনে তরী বাড়িতেই রয়ে গেল? এটা কীভাবে সম্ভব? এতোটা কাঁচা কাজ তো তরীর করার কথা না।”

প্রহরের সামনে ওর সেক্রেটারি রিয়াদ এসে দাঁড়াতেই সে রিয়াদকে বললো, “পেপারস গুলো ঠিকঠাক মতো আছে তো?”

রিয়াদ বললো, “ইয়েস, স্যার! রেখে এসেছি সেইফ জায়গাতেই!”

“গুড!”

“একটা কথা বলবো, স্যার!”

“বলো!”

“স্যার, এমনও তো হতে পারে যে, আপনার ধারণাটা হয়তো ভুল! না, মানে তরী মেয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ডে ঝামেলা থাকলেও আমার কেন যেন ওকে এতোটাও ডে*ঞ্জা*রাস মনে হয় না! আর আমার মনে হয় না আজকে ডক্টর সৌহার্দ্যের এক্সিডেন্টের পেছনে তরীর কোনো হাত আছে।”

প্রহর শকৃত গলায় বললো, “আমার কোনো ধারণা আজ পর্যন্ত ভুল হয়নি, রিয়াদ। এবারেরটাও হবে না। আর তিক্ত বাস্তবতার সাথে পরিচয় হওয়ার পর মানুষের মন পাথরের মতো কঠিন হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়! তরীর ক্ষেত্রে ও এমনটাই…… ”

প্রহরের কথা শেষ হওয়ার আগেই ওর পাশ দিয়ে ঘেঁষে একটা মেয়ে ছুটে গেল। তার সুতি শাড়ির আঁচলের শেষপ্রান্ত মাটি স্পর্শ করে গড়িয়ে যেতে লাগলো মেয়েটার পিছু পিছু। মেয়েটার কোমড় অতিক্রান্ত চুলের ঢেউ দেখে প্রহরের চোখ চকচক করে উঠলো। তার বুঝতে বাকি নেই যে, এটাই তরী। সে ছুটে গেল তরীর পিছু পিছু।

সৌহার্দ্য তখন কেবিনে নিজের মাকে সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত। সুজাতার কান্নাকাটি থামছেই না। তিনি চোখ মুছছেন আর বলছেন, “আমার জীবনে তুই ছাড়া কে আছে আমাকে বল? অন্তত আমার জন্য হলেও তো একটু দেখে শুনে চলাফেরা করতে পারিস!”

সৌহার্দ্য কিছু বলবে তার আগেই তরী ছুটে তার কেবিনে প্রবেশ করলো। চোখমুখ লালচে বর্ণ ধারণ করেছে ওর। তরী ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সৌহার্দ্যের দিকে। সৌহার্দ্য অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তরীর পিছু পিছু প্রহরও প্রবেশ করলো। তরী সৌহার্দ্যের মাথার ব্যান্ডেজে হাত বুলিয়ে দিলো। ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে অবিরত।

সৌহার্দ্য মলিন হাসলো। ওর নিজের চোখেও পানি চিকচিক করছে। এটাই তার চাঁদ! আজও তার সামান্য আঘাতে যে চোখে বন্যা বয়ে যায়, সেই চাঁদ তার কাছে আবার ফিরে এসেছে। তরীর চোখের পানিগুলো মুছে দিয়ে ওর হাত দুটো নিজের দুহাতের মুঠোয় ভরে নিল সৌহার্দ্য। আশ্বস্ত কন্ঠে বললো,

“আমি ভালো আছি, সুস্থ আছি। কিচ্ছু হয়নি আমার! দেখো। আর কেঁদো না৷ তোমার কান্না দেখে আমার যন্ত্রণা যাও কমেছিল, তা আরো কয়েকগুন বেড়ে যাচ্ছে।”

তরী অশ্রুসিক্ত চোখে তাকালো। কান্নার কারণে বারবার কেঁপে উঠছে ও। সৌহার্দ্য তরীর গালে আবার হাত রাখতেই তরীর ঠোঁট কেঁপে উঠল। উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই ঠোঁট থেকে মিষ্টি কন্ঠে নিঃসৃত হলো,

“তোমার সামান্য কষ্ট আমার আজও সহ্য হয় না! আজ যদি তোমার কিছু হতো, আমি কী নিয়ে বেঁচে থাকতাম? আমার আজ পর্যন্ত বেঁচে থাকার কারণটাই যে তুমি!”

-চলবে….

(সবাই মন্তব্য করবেন আশা করি।)
(আজকের পর্ব পড়ে কেমন লাগলো, তার রিভিউ আমার এই ছোট্ট পরিবারটায় শেয়ার করতে পারেনঃ https://facebook.com/groups/532829361202192/)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here