বসন্ত বিলাস পর্ব -০৪

#বসন্ত_বিলাস
#আমিনা_আফরোজ
#পর্ব:-৪

পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলছে মেহুল। অবসন্ন বিকেল। রাস্তায় উপচে পড়া ভিড়। তাদের মধ্যে স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যায় বেশি। মেহুল গুটি গুটি পায়ে এসে দাঁড়ালো মনা কাকার দোকানের সামনে। মনা কাকার দোকানটাতেও আজ দারুন ভিড়। দোকানে ফুচকা থেকে শুরু করে আচার সবই শোভা পাচ্ছে দোকানের কাঁচের বাক্সের ভেতরে। কিন্তু আজ সেসবে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই মেহুলের। মেহুলের দৃষ্টি দোকানের ভিতরে। কিন্তু কাঙ্খিত ব্যক্তিটিকে খুঁজে পেলো না সেখানে। মেহুল এবার মনা কাকার দিকে এগিয়ে গেলো যদি কোন খবর পায় তার। মনা কাকা তখন ভিষন ব্যস্ত। খদ্দের সামলাতে সামলাতেই তার সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। মেহুল মনা কাকার থেকে হাত খানেক দূরে এসে দাঁড়ালো। মনা কাকা মুখ তুলে তাকাল মেহুলের দিকে। স্মিত হেসে বলল,

–” ঝাল ঝাল কামারাঙ্গা আছে , দিবো নাকি?”

মনা কাকার কথায় মেহুল ওর মাথাটা দুদিকে নাড়িয়ে না সূচক সম্মতি জানালো। মনা কাকা খানিকটা বিশ্মিত হলেন। তবে নিজের বিষ্ময় ভাবটা নিজের মধ্যে রেখেই আবারো প্রশ্ন করলেন,

–” আজ জোড়া শালিকের একটার দেখা পেলাম যে আরেকটা শালিক কোথায়?”

মনা কাকার কথা শুনে মেহুলের দুচোখ নোনা পানিতে ভরে গেল। মেহুল আর কোন কথা না বলে বেরিয়ে এলো দোকান থেকে। মনা কাকা খানিকটা অবাক হলেও সেদিকে মন দেবার সময় পেলেন না তিনি। খদ্দেরদের ডাকে আবারো ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি।

বাড়ির কাছের সরু গলির মুখে এসে থামলো মেহুল। পুরো রাস্তায় কান্না করতে করতে এসেছে ও। কান্নার কারনে চোখ লাল টকটকে হয়ে গেছে। গলির মুখটাই দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলিয়ে নিল মেহুল। তারপর দ্রুত পায়ে গলির রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো মেহুল।

অন্যদিকে এতক্ষন ধরে মেহুলের সকল কর্মকান্ড খেয়াল করছিল অভি। মেহুলের অগোচরে বেশ খানিকটা দুরুত্ব রেখেই আসছিল অভি। মনা কাকার দোকান, গলির মুখের দাঁড়ানো, ফোলা ফোলা চোখ সবটাই দেখেছে অভি। মেহুল ওদের বাড়ি গেলে অভি সরু গলি ছেড়ে চলে যায় দূরের মাঠটায়। আপাদত সেখানেই কিছু সময় কাটাতে চায় অভি।

এক সময় সময়ের চাকা ঘুরে ধরনীতে নেমে আসে অন্ধকার। দিনের সমস্ত আলোকে শুষে নেয় সে অন্ধকার। পৃথিবীতে রাজত্ব শুরু হয় অন্ধকারের। আজ প্রথম সন্ধ্যা পেরোলেও অভি ফিরে না আসায় এইবার দুশ্চিন্তায় পড়ে যান মৃন্ময়ী ঘোষ। ছেলের কথা জানতেই মেহুলদের বাড়িতে যান তিনি। সেখানে গিয়ে দেখেন মেহুল সারাদিন না খেয়ে ঘর বন্দি হয়ে পড়ে রয়েছে। তিনি নিজে অনেক বার মেহুলের নাম ধরে ডাকলেন কিন্তু অপাশ থেকে কোন সাড়াশব্দ পেলেন না। এদিকে অভির কোন খবর এখনো পান নি তিনি। কে জানে কোথায় আছে তার ছেলেটা? তবে দুটোতে যে ঝগড়া বাঁধিয়েছে এইটা বেশ বুঝতে পারছেন তিনি। ছেলেমেয়ে দুটোর এমন অবস্থা দেখে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন মৃন্ময়ী ঘোষ। এদিকে রাতের আটটায় চুপি চুপি বাড়ি ফিরে অভি। পা টিপে টিপে নিজের ঘরে ঢুকে। ছেলের বাড়িতে ঢুকবার উপস্থিতি বুঝতে পেরেছেন মৃন্ময়ী দেবী। কিন্তু আগ বাড়িয়ে ছেলের সাথে কথা বলতে গেলেন না তিনি। বাকি রাতটুকু ওদের মন মতোই চলতে দিলেন এমনকি মৃণাল বাবুকেও কিছুই জানালেন না। এ বয়সে এমন ঝগড়া লেগেই থাকে। এমনিতেই দুটোতে আবার ভাব জমবে এই আশায় রইলেন ।

পরেরদিন সকালে মেহুল ও অভি গত দিনের মতোই আলাদা আলাদা স্কুলে গিয়ে পৌঁছল। কিন্তু আজ আর ক্লাসে যাওয়া হলো না মেহুলের। স্কুলের মাঠে যেতেই পিয়ন এসে মেহুলকে নিয়ে ছুটল অফিস রুমের দিকে। অভিও মেহুলের পিছু পিছু গেলো। মেহুলকে নিয়ে অফিস রুমে যাবার মিনিট কুড়ি পরেও যখন মেহুল ফিরল না তখন অভির মনে ভয় ঠুকে গেলো। অভি পিয়নের দিকে গিয়ে বলল,

–” আদাব চাচা।”

পিয়ন মোতালেব মিয়া একবার অভির দিকে তাকালেন। তারপর পান খাওয়া লালচে দাঁত বের করে হেসে বললেন,

–” আদাব।”

–” চাচা অফিসে কিছু হয়েছে কি? না মানে একটা মেয়েকে……

অভিকে কথা শেষ করতে না দিয়েই মোতালেব মিয়া বললেন,

–” ঐ বজ্জাত মাইয়াডার কথা কইতাছো?”

অভি উপর নিচ মাথা নাড়ল।

–” মাইয়াডা তো এক্কেবারে বদমাইশের হাড্ডি। মাইয়ার কলিজায় কত বড়ো সাহস আমাগোর প্রিন্সিপল স্যারের মোটরসাইকেলের টায়ার পিন দিয়ে ফুটো করে।”

মোতালেব মিয়ার কথা শুনে অভি চমকে উঠে বলে,

–” কি বলছেন ওসব? মেহুল প্রিন্সিপল স্যারের মোটরসাইকেলের চাকার হাওয়া বের করতে যাবে কেন? ওর যদি কারো মোটরসাইকেলের হাওয়া বের করার ইচ্ছে হতো তবে অবিনাশ স্যারের মোটরসাইকেলের হাওয়া ছেড়ে দিবে………

–” কি ? কি কইলা তুমি? তারমানে ঐ মাইয়া একা দোষী না ওর লগে তুমিও সমান দোষী। চলো চলো স্যারের কাছে। দুইটারে একলগে শাস্তি দিবো স্যারে।”

কথাটা বলেই মোতালেব মিয়া অভির হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে অফিস রুমের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো।

–” আরে চাচা, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? হাত ছাড়ুন। আপনি ভুল বুঝছেন আমাকে।”

কিন্তু মোতালেব মিয়া অভির কোন কথায় শুনলো না। একেবারে অভিকে নিয়ে হাজির হলো প্রিন্সিপল স্যারের সামনে।

–” স্যার আসসালামু আলাইকুম। এই যে আরেকটারে লইয়া আইছি। ”

প্রিন্সিপল হারুনুর রশিদ তখন মেহুলের সাথে কথা বলছেন। ওনার ফর্সা মুখ তখন রাগে লাল হয়ে রয়েছে। অফিস কক্ষে তখন মেহুল ছাড়াও আরো একজন উপস্থিত ছিল। সে আর কেউ নয় রিয়াদ। গতকাল বিকালেই রিয়াদ ওর স্যারকে সবকিছু জানিয়েছে।

–” ওয়ালাইকুমুস সালাম। এ কি মোতালেব এ কাকে ধরে নিয়ে এসেছো তুমি?”

স্যারের কথা শুনে মোতালেব মিয়া আবারো তার পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বলল,

–” স্যার, এইডা আরেক অপরাধী। গতকাল মাইয়াডার সাথে এই পোলাডাও আছিলো।”

–” তুমি জানলে কিভাবে?”

–” নিজের কানে হুনছি স্যার। হের লাইগাই তো লইয়া আইলাম।”

–” খুব ভালো করেছো এবার তুমি যাও?”

মোতালেব মিয়া চলে গেলে প্রিন্সিপল হারুনুর রশিদ সাহেব বললেন,

–” মেহুল আর অভি তোমাদের দুজনের কাছে এরকম ব্যবহার আশা করি নি আমি। যেহেতু তোমরা অপরাধ করেছো তাই তোমাদের শাস্তি তো পেতেই হবে।”

–” স্যার শাস্তি দেওয়ার আগে আমার একটা কথা ছিল।”

মৃদু স্বরে বলল অভি।

–” বলো কি কথা।”

–” আমরা দুজনেই যে আপনার মোটরসাইকেলের টায়ার ফুটো করেছি এর কোন প্রমাণ আছে আপনার কাছে নাকি কারো মুখের কথাতেই…….

–” প্রমাণ লাগবে কেন? আমি নিজের চোখে দেখেছি মেহুলকে একাজ করতে।”

–” তাই নাকি। তা তুই বাবদ আর কোন সাক্ষি আছে? না মানে কাজটা যে তুই করে মেহুলের কাঁধে দোষ চাপাচ্ছিস না এমনটা নয় তো।”

–” মোটেই না। আমি মেহুলকে গতকাল বিকেলে এ কাজ করতে দেখেছি।”

–” দেখ তুই যে আমাকে আর মেহুলকে সহ্য করতে পারিস না এ কথা ক্লাসের সবাই জানে। স্যার চাইলে এ কথা আমি প্রমাণ করেও দেখ তে পারি।”

অভির কথা শুনে হারুনুর সাহেব বললেন,

–” ঠিক আছে, প্রমাণ করে দেখাও তাহলে। দেখি তোমার কথার সত্যতা কতটুকু?”

–” স্যার আপনি এর কথায় বিশ্বাস করছেন?”

–” আমি যদি তোমার মতো একটা বখে যাওয়া ছেলের কথা বিশ্বাস করতে পারি তাহলে অভি মতো মেধাবী ছেলের কথা কেন বিশ্বাস করতে পারবো না?”

প্রিন্সিপল এর কথায় চুপ করে গেল রিয়াদ। তবে অশ্নিশর্মা হয়ে তাকিয়ে রইল মেহুল আর অভির দিকে।
কিছুক্ষন পর সাহিল এলো সেখানে। সাহিল অভিদের ক্লাসের ক্লাস ক্যাপ্টেন।

–” স্যার আমাকে ডেকেছেন?”

–” স্যার না, আমি স্যারকে বলে পাঠিয়েছি তোমাকে ডেকে আনার জন্য।”

–” কেনো?”

–” স্যার জানতে চায় রিয়াদ এর আগেও আমাদের দিকে মিথ্যে বদনাম ছুঁড়েছে কি না?”

–” হ্যাঁ রিয়াদ তো ক্লাসের সবার সাথেই ঝগড়া করে , এ আর নতুন কি। ”

–” মিথ্যে কথা স্যার। এরা সবাই একজোট হয়ে আমার নামে মিথ্যা কথা বলছে।”

–” আমি সব বুঝতে পেরেছি। যাও তোমরা সবাই ক্লাসে যাও।”

হারুনুর রশিদ সাহেবের কথায় অভিস কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো ওরা চারজনে। মেহুল অভির দিকে না তাকিয়েই চলে গেলো ক্লাস রুমের দিকে। অভির মেহুলের পিছু পিছু পা বাড়াতেই পিছন থেকে শুনতে পেলো রিয়াদের কন্ঠস্বর,

–” কাজটা কিন্তু ভালো করলি না অভি। তোর সাথে তো আমার কোন শত্রুতা ছিল না , আমার ঝামেলা ছিল মেহুলের সাথে । মাঝখান দিয়ে তুই ফেঁসে গেলি। ”

অভি পিছন ফিরল। দুকদম এগিয়ে এলো রিয়াদের দিকে। চোখে চোখ রেখে বলল,

–” আমাকে নিয়ে তোকে এত ভাবতে হবে না। আমাকে নিয়ে ভাববার অনেক মানুষ আছে। তুই বরং তোর কথা ভাব । আর হ্যাঁ দ্বিতীয় বার যদি তোকে মেহুলের আশেপাশেও যদি দেখি তবে………

–” তবে? কি করবি? ”

–” হাত পা আর আস্ত থাকবে না তোর বুঝলি। আমি ভালোর ভালো, খারাপের খারাপ।”

–” তাই নাকি মামা? তা মেহুল তোর কি হয়? লাইলি?”

–” মেহুল আমার জোড়া শালিক।”

–” কি শালিক?”

–” ও তোর মতো গাধা বুঝবে না। তুই বরং নিজের চরকায় তেল দে। আর মেহুলের আশেপাশেও ঘেঁষবার চেষ্টা করিস না। ”

কথাগুলো বলে অভিও ক্লাস রুমের দিকে চলে গেল। মনে মনে ঠিক করে নিলো আজকে সন্ধ্যার আগেই মেহুলের রাগ ভাঙ্গাবে ও। শালিক কি তার জোড়া শালিকের ওপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারে? পাগলিটা যা রেগে আছে ওর উপর? এইবার পাগলিটার রাগ ভাঙ্গাতে বেশ কাঠ খড় পুড়াতে হবে ওকে?

চলবে

(আজকের পর্বটি কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আর আগামী পর্বে কিন্তু আরেকটা টুইস্ট আছে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here