#তমসার_জল
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
।।পর্ব৫।।
(কার্টেসী ব্যতীত কপি নিষেধ)
জলের ওপর বর্ষণের বর্বরতা বেড়ে যায় বর্ষণ বদলি হয়ে ঢাকায় আসার পর।লোকমুখে শুনেছে জল যে ঢাকার মানুষের মধ্যে সামাজিকতা নেই খুব একটা।চারদেয়ালের ফ্ল্যাটে বসবাস করা মানুষ গুলো নাকি কখনো জানারই চেষ্টা করে না দেয়ালের ওই পাশে কিংবা তাদের পাশের ফ্ল্যাটে মানুষগুলো কেমন আছে।হাতে গোনা কয়েকজন ব্যতিক্রম হয়। লোক মুখে শোনা কথা গুলোই সত্য হয়ে যায়।টাংগাইলের জেলা শহরে কংক্রিটের ছোঁয়া থাকলেও সেখানে জলের প্রকৃতি ছিলো।মানুষ না শুনতে পেলেও জলের আর্তচিৎকার প্রকৃতি শুনতে পেতো কিন্তু ঢাকায় তো প্রকৃতি মৃত।এখানে কে শুনবে জলের চিৎকার?বর্ষণের বর্বরতার কথা মানুষ তো দূরে থাক ঢাকার কাক-পক্ষীতেও টের পায় না।প্রতিটা রাত জল অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে পার করতে লাগে।কারও কাছে যে সবটা খুলে বলবে তারও সুযোগ নেই জলের।সমাজ কি বলবে লোকে কি বলবে?যেখানে এগুলোর ভয়ে জল নিজের গর্ভধারিণী মাও সাড়া দেয় না আর অন্য মানুষ! সাইকোলজি নিয়ে পড়া মেয়েটা নিজেই মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বিকেল হলে আশেপাশের ফ্ল্যাটের মহিলারা এক হয়ে গল্প গুজব করে।জলেরও যেতে ইচ্ছে করে।কিন্তু বর্ষণের মানা আছে।তাই সে সাহস পায় না।
চার দেয়ালের ফ্ল্যাটে জেলখানার আসামীর মতো সময় কাটতে থাকে জলের।শ্বশুর বাড়িতে তাও বর্ষা থাকতো।ওর সাথে কথা বলে একটু হলেও জল হাল্কা হতো।
ফোনের রিংটোনের শব্দে জলের ধ্যান ভাঙে।স্ক্রিনে বর্ষার নামটা ভেসে উঠেছে।জল ফোন রিসিভ করে।ফোন রিসিভ করতেই ইয়ার্কির সুরে বর্ষা বলে,,,
” কি খবর ভাবিজি?”
” খারাপ থাকলেও আলহামদুলিল্লাহ ভালো থাকলেও আলহামদুলিল্লাহ। তুমি?”
শুকনো গলায় জবাব দেয় জল।বর্ষা বুঝতে পারে বর্ষণ শুধরায় নি।বর্ষাকে আদিবার কথা জানানোর সময় হয়েছে।
” বর্ষা?”
ফোনের বিপরীত পাশ থেকে জলের ডাকে বর্ষার ধ্যান ভাঙে।বর্ষা প্রফুল্ল কন্ঠে বলে,,,
” যেটার জন্য ফোন দিচ্ছিলাম।আমি কিন্তু ঢাকা আসছি।ট্রেনে আছি।টঙ্গী স্টেশনে আছি।”
” তুমি ঢাকা আসছো এটা আগে বলবে না?রান্না বান্না করে রাখতাম।”
” এখন তো বলেছি।শুধু ফ্রাইড রাইস করে রাখো।এটা তুমি অসম্ভব ভালো বানাও।অনেক দিন হলো তোমার হাতের ফ্রাইড রাইস খাই না।”
জল শুকনো গলায় বলে,,
” আচ্ছা।সাবধানে এসো।”
জল ফোন কেটে দেয়।ঘরে গাজর,ফুলকপি ছাড়া তেমন কোনো সবজি নেই যে ফ্রাইড রাইসে দেবে।মুরগী ছিলো তবে কাল রান্না করে ফেলেছে জল।বর্ষণকে কি জলের ফোন দেওয়া উচিত? লোকটার কথা ভাবলেও তো জলের ঘেন্না করে।বিয়ের দেড় বছরের মতো হয়েছে।এতগুলো দিনে বর্ষণের প্রতি জলের বিন্দুমাত্র ভালোলাগা তৈরি হয় নি।ভালোবাসা তো দূরে থাক।যতদিন যাচ্ছে ঘৃণা জন্মাচ্ছে আর তা গভীর হচ্ছে।কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা নিয়ে বর্ষণকে ফোন দেয়।
” হঠাৎ ফোন দিলে যে!”
” বলছি!একটা মুরগী,ক্যাপসিকাম, মটরশুঁটি, ব্রোকলি এনে দিতে পারবে?”
” হঠাৎ এগুলো আনতে বলছো কেন?আমি তো দুপুরে বাহিরেই খাই।বাসায় নিজের বয়ফ্রেন্ডকে দাওয়াত করে এনে ভালোমন্দ রান্না করে খাওয়াবে নাকি?”
লোকটার ব্যবহারের মতো মুখের কথা গুলোও ঘৃণ্য!বিয়ের আগেই কোনো পুরুষের সংস্পর্শে আসেনি জল!আর বিয়ের পরে পরকিয়া!এক পুরুষই জলের জীবন নরক বানিয়ে রেখেছে আর অন্য পুরুষ!জল শান্ত গলায় বলে,,,,
” বর্ষা আসছে।কিছুক্ষণ আগে ফোন দিয়েছিলো।টঙ্গী স্টেশনে আছে।”
” অহ,আমি দারোয়ানকে বলে দিচ্ছি। ”
জল ফোন কেটে দেয়।ঘরে চিনিগুড়া চাল ছিলো।সেগুলো ভালোভাবে ধুয়ে সেদ্ধ বসিয়ে দেয় জল।কিছুক্ষণ পরেই কলিংবেলের আওয়াজ জলের কানে আসে।দরজা খুলে দারোয়ানকে দেখতে পায় জল।দারোয়ান মুচকী হেসে বলে,,,
” ভাবী!ভাই এগুলা আইনা দিবার কইলো!”
” জ্বী।ধন্যবাদ ভাইয়া।”
জল বাজার গুলো হাতে নিয়ে মুচকী হেসে দরজা আটকিয়ে দেয়।মুরগী কা-টতে গিয়ে হঠাৎই জলের মনে একটা বাজে চিন্তা আসে।মুরগীকে যেভাবে কা*টছে সেভাবে যদি বর্ষণকে টুকরো টুকরো করে কা*টতে পারতো তাহলে হয়তো জলের মনে জমে থাকা রাগ দুঃখ গুলো একটু হলেও কমতো।কথায় বলে নারীর মস্তিষ্কে নীরবে তৈরি ঘৃণা পুরুষের ছলনার চেয়ে দ্বিগুন তিক্ত!আর এই নীরব ঘৃণাই একসময় জগত সংসার ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে।এজন্যই বলা হয় নারীতেই সৃষ্টির শুরু নারীতেই সৃষ্টির শেষ।
আদিবার ডায়েরীটা সবসময় বর্ষা নিজের কাছে রাখে।আদিবাও বেশ ভালো ও শান্ত স্বভাবের মেয়ে ছিলো।ভাবী ননদে নাকি কাঠ কুড়াল সম্পর্ক থাকে কিন্তু আদিবার সাথে বর্ষার সম্পর্ক ছিলো দুই বোনের মতো।বর্ষা নিজেকে আর বর্ষণকে খুব লাকি মনে করে।স্ত্রী হিসেবে বর্ষণ আদিবা জল দুইজনকেই ভালো পেয়েছে।কিন্তু কদর করতে পারেনি।আদিবাকে ভালো ভাবী হিসেবে পেলেও ধরে রাখতে পারে নি বর্ষা।আর জলের কথা এখনো বর্ষার অজানা।ওপরওয়ালাই জানেন কপালে কি আছে।
ব্যাগ থেকে ডায়েরীটা বের করে আলতো করে হাত বুলায় বর্ষা। রাস্তায় জ্যাম থাকার কারণে আদিবার পৌছাতে বেশ দেরি হয়।জল বর্ষার অপেক্ষায় অলস সময় পার করতে লাগে।কিন্তু বর্ষা আসে না।অবশেষে বাধ্য হয়ে জল গোসল করতে যায়।যে বাথরুমে ঢুকবে সেই সময়ই কলিংবেলের আওয়াজ।দরজা খুলে বর্ষাকে দেখতে পায় জল।অনেক দিন পর দেখা হওয়ায় খুশী হয়ে একেঅপরকে জড়িয়ে ধরে বর্ষা জল।
” এত দেরি হলো কেন?”
” আর বলো না!রাস্তায় যে জ্যাম!”
” জার্নি করে মুখখানা শুকিয়ে গেছে একদম।ফ্রেশ হয়ে নাও।”
বর্ষা ফ্রেশ হয়ে আসে ওয়াশরুম থেকে।জল বর্ষাকে বলে,,,
” নাস্তা দিয়ে আর খুদা নষ্ট করবো না।তুমি থাকো আমি গা ভিজিয়ে আসি।জার্নি করে এসেছো রেস্ট নাও।”
জল ওয়াশরুমে শাওয়ার নিতে চলে যায়।আদিবা আর ঘরে যায় না।সোফাতেই গা এলিয়ে দেয়।দুপুরে জল আর বর্ষা একসাথেই খায়।খাওয়া শেষে দুজন আড্ডায় মেতে ওঠে।আড্ডার ছলে জলকে বর্ষা জিজ্ঞেস করে,,,
” ভাইয়া কি আগের মতোই আছে?”
বর্ষার কথা শুনে জলের মুখ মলিন হয়ে যায়।হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায় জল।
” এক মিনিট।”
কথাটা বলে বর্ষা নিজের ঘরে চলে যায়।একটা ডায়েরী হাতে নিয়ে বের হয় বর্ষা।ডায়েরীটা জলের হাতে দিয়ে বলে,,,
” এটা আদিবার ডায়েরী।আশা করছি এই ডায়েরীতে তুমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর পাবে।”
” আদিবা?”
” হু,ভাইয়ার প্রথম স্ত্রী।”
বর্ষার মুখে কথাটা শোনার পর জলের পায়ের তলার মাটি সরে যায়।জল নিজেকে সামলে নিয়ে আদিবাকে বলে,,,
” তোমার ভাইয়া আগেও বিয়ে করেছে কেউ তো বলেনি!উনার প্রথম স্ত্রী কি উনার এই বিকৃত যৌ*নাচারের জন্যই ছেড়ে গেছে?”
” তোমার আন্দাজ করা কারণটা সঠিক কিন্তু যাওয়ার ধারণাটা ভুল।খুন হয়েছে আদিবা।আর খুনী সয়ং আমার মায়ের পেটের ভাই আর আমারই গর্ভধারিণী মা।ছোট থাকায় বুঝতে পারি নি কিন্তু বড় হওয়ার পর বুঝেছি আমার ভাই নেক্রোফিলিয়ায় আক্রান্ত।সাইকোলজির স্টুডেন্ট হওয়ায় আশা করছি তুমি বুঝতে পারবে।”
” নেক্রোফিলিয়া?অর্থাৎ লা*শের সাথে শারিরীক সম্পর্ক স্থাপন?”
” হু,আদিবা মারা যাওয়ার পর আদিবার লা*শের সাথেও ভাইয়া সঙ্গম করেছে।”
” থানা পুলিশ হয়নি?”
” মানুষ জানলে তো!আদিবার শরীর পচন না ধরা পর্যন্ত আমাদের স্টোরুমে ছিলো আদিবার লাশ।ভাইয়া যখন মন চাইতো আদিবার লাশের সাথে……..”
থেমে যায় বর্ষা।মা-ভাইয়ের প্রতি তীব্র ঘেন্না নিয়ে চোখ বন্ধ করে বর্ষা।
” একটা সময় তো লা*শের দুর্গন্ধ ছড়ায়।তখন এর সতকার করার প্রয়োজন পরে।কি হয়েছিলো আদিবার লাশের?”
” বাগানে মাটিচাপা দিয়েছিলো আম্মু ভাইয়া।শুধু আদিবা না!ভাইয়ার লালসার শিকার হয়েছে আমাদের বাসার ছোট্ট কাজের মেয়েটিও।টাকা দিয়ে আম্মু ভাইয়া বিষয়টাকে ধামাচাপা দেয়।”
একটা মানুষ কি রকম খারাপ হতে পারে তা হয়তো বর্ষণকে না দেখলে জলের জানাই হতো না।বাইরে থেকে আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষ কিন্তু ভেতরে ভেতরে বদ্ধ উন্মাদ।বিকৃত উন্মাদ।আর এই উন্মাদনার শিকার হয় নিরীহ মেয়েরা।এই উন্মাদনার শেষ কোথায়?নাকি এর কোনো শেষ নেই?
চলবে,,,ইনশাআল্লাহ