#সন্ধ্যালয়ের_প্রণয়
#আফসানা_মিমি
| আঠারো তম পর্ব | খণ্ডিত অংশ
❌[কোনোভাবেই কপি করা যাবে না]❌
পুরো অফিসে পীনপতন নীরবতা। সেই মেয়েটির মুখে বিশ্বজয়ী হাসি। হাঁটাহাটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছে নিলয়ের কেবিনের দিকে। চেয়ারের উপর বসে পা তুলে তুড়ি বাজায় সে। ভাবখানা এমন যেন সে বস আর কাউকে আসতে বলছে। বাহির থেকে অবশ্য কেউ আসেনি তবে সে এবার নিজেই একটি কাল্পনিক চিত্র ভেবে নিয়ে নিজেই অভিনয় শুরু করে।
চেয়ারে শরীরের পুরো ভার ছেড়ে দিয়ে ব্যাঙ্গস্বরে বলে,
” আমি নিলয় নীলাভ। যা বলি তাই করি। সন্ধ্যাবতী! তুমি আমার চেয়ে কখনো উপরে উঠতে পারবা না। আমি তোমার থেকে বয়সের বড়ো, আমি মহাজ্ঞানী। তুমি ছোট কিছুই পারবে না।”
কথাগুলো বলে মেয়েটি অট্টহাসি দিয়ে ফেটে উঠে। অফিসের চার দেয়াল, প্রতিটা বস্তু মেয়েটির আনন্দের স্বাক্ষী। হঠাৎই মেয়েটির মুখের হাসির রেখা বিলীন হয়ে কাঠিন্যতায় আভা ফুটে উঠে।
” আমি প্রতিশোধ নিয়েছি মিস্টার অসভ্য দুর্লয়। আমার কাছ থেকে আমার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিলেন তাই না! আজ আপনার থেকে আপনার সম্মান এই সন্ধ্যা কেড়ে নিয়েছে।”
সন্ধ্যার এমন বিকৃতিপূর্ণ কাজের প্রতিফল নিয়ে সে ভাবছে না। তার চিত্ত চেতনা ভয়ংকর। মুঠোফোন বের করে একজনকে কল করে সে। অপরপাশের মানুষটা কল ধরতেই সে উৎফল্লের সহিত বলে,
” আমি প্রতিশোধ নিয়েছি রাব্বি! তোমাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার ভয়াবহ শাস্তি দিয়েছি। এবার বাড়ির জনের মাথা এমনিতেই নিচু হবে।”
রাব্বির চোখ চিকচিক করছে। কত বছরের সাধনা আজ বিনা পরিশ্রম পূর্ণ হচ্ছে। সে তো পাখির ডানায় কিছু কৃত্রিম ডানা লাগিয়েছিল। সে চেয়েছিল মোক্ষম সময়ে নিজের মতো করে উড়াবে কিন্তু তার বাড়তি কষ্ট করতে হয়নি। পাখি নিজেই উড়া উচ্চাকাশে উড়াল দিয়েছে। রাব্বি বাঁকা হাসে। নিজের পরিকল্পনা মোতাবেক কাতর কন্ঠস্বরে বলে,
” তুমি আমার জন্য এতো ভাবো উষসী? আমি এবার আর অপেক্ষা করব না। আজই তোমাকে বিয়ে করব।”
সন্ধ্যা খানিকটা লজ্জা পায়। পরমুহূর্তে কিছু ভেবে প্রতুত্তুরে বলে, ” একটু তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে না ছদ্মবেশী রাফসান সাহেব! নিলয়কে তো জে’লে পাঠিয়েছি ঠিকই তবে আমি নিজের কাজকে ভালোবাসি। তোমার প্ল্যান অনুযায়ী এগিয়ে যেই রিক্স নিয়েছিলাম সেটার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে তো। এখন কোম্পানি আমি সামলাবো। নিলয়ের চেয়ে বড়ো বিজনেস ওমেন হয়ে আরিফ সরকারকে দেখিয়ে দিব।”
সন্ধ্যার কথায় রাব্বির চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে। চোখ বন্ধ করে রাগ কন্ট্রোল করে নেয় সে।
” আচ্ছা মহারাণী। আপনি অনেক বড়ো হোন। কবে দেখা করতে আসবেন বলুন। এখন তো যখন তখন তোমাদের অফিসে আসতে পারব না।”
সন্ধ্যা কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দেয়,
” আগামীকাল সন্ধ্যায় দেখা করব। আমার জন্য কি আনবে বলো!”
রাব্বি মুঠোফোনে কান থেকে সরিয়ে পাগলের মতো বলে,
” তোমার প্রিয় লাল তাজা র’ক্ত।”
” কি বললে?”
আনমনে কণ্ঠনালী থেকে বের হওয়া কথা সংশোধন করে পুনরায় রাব্বি বলে,
” আনবো কিছু একটা। যা দেখে তোমার খুব পছন্দ হবে।”
ফোন কেটে দেয় সন্ধ্যা। নিলয়ের কেবিন থেকে বের হতেই অফিসের সকল কর্মচারী সন্ধ্যার দিতে অদ্ভুত চোখে তাকায়। আকাশের আজ এই সন্ধ্যাকে অপরিচিত লাগছে। কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যার ব্যবহারে সকলে বিস্মিত। আকাশ রেগে তেড়ে আসে সন্ধ্যার দিকে।
” তোকে আমি জীবনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ভেবেছিলাম। কিন্তু তুই যে ঘরের শত্রু বিভীষণ বের হবি তা জানলে তোর সাথে বন্ধুত্ব করতাম না।”
সন্ধ্যা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে আকাশের কথা শুনে। মাথার এলোমেলো চুল গুছিয়ে নেয় যেন অফিসে যা ঘেটেছে তা নিয়ে সন্ধ্যার মাথা ব্যথা নেই। সন্ধ্যার ভাবভঙ্গি নিয়েও এক প্রকার গুঞ্জন শুরু হয়ে যায় অফিসে। আকাশ মুখ কালো করে কিছুক্ষণ আখের ঘটনা মনে করতে থাকে,
কিছুক্ষণ আগে পু’লি’শে’র সাথে সন্ধ্যাকে দেখতে পেয়ে সকলে যতটা না অবাক হয়েছিল, তার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছিল সন্ধ্যার কথা শুনে। সন্ধ্যা পু’লি’শ’কে তখন বলেছিল,
” আমাদের অফিসের প্রধান পরিচালক যার হাতে এই কোম্পানীর সকল লেনদেনের ভার রয়েছে। যিনি কিছুদিন আগেই কর্মচারীদের টাকা আত্মসাৎ করে এবং অফিসের নাম করে ব্যাংক থেকে প্রচুর পরিমাণে টাকা লোন নিয়ে পরিশোধ করেনি। ফলস্বরূপ কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যাংক আইনি ব্যবস্থা নিতে চাইছে। আমি সন্ধ্যা এই কোম্পানীর সহ পরিচালক হিসেবে সাক্ষী দিচ্ছি, এখানে আণি বা আঢরা কেউ যুক্ত নেই। যা দোষ করেছে মিস্টার নিলয় নীলাভ করেছে যা আপনাদের পূর্বেই জানিয়েছি। আপনাদের দোষী আপনারা নিয়ে যেতে পারেন।”
আকাশ চিৎকার করে তখন কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু নিলয় হাতের ইশারায় কথা বলতে না করে দেয়। পুলিশ এসে নিদয়ের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেয়। নিলয় টু শব্দ পর্যন্ত করে না। পুলিশের সাথে যাওয়ার আগে শুধু সন্ধ্যার কানে বলে যায়,
” ভালোবাসি মিস ঐরাবতী। খুব শীঘ্রই তোমাকে বউ করব। আমি ফিরে আসব সন্ধ্যাবতী, তোমার করা সব বোকামির শাস্তি তোমাকে দিব।”
সন্ধ্যা নিলয়েরকথায় তেমন পাত্তা দেয়নি। সকলকে পিছনে ফেলে নিজ কর্মে মগ্ন হয়ে যায় সে।
অফিস থেকে বেরিয়ে যেতেই আকাশ ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে আসে। সন্ধ্যার যাওয়ার পথে ঘৃণিত নজরে তাকিয়ে রয় সে।
—————
চলবে….
[আর পারিনি। এতটুকু পড়েই আজ মন ভরান। পরবর্তীতে পুষিয়ে দিব। রিভিশন দেইনি। ভুল ত্রুটি অবশ্যই ধরিয়ে দিবেন।]#সন্ধ্যালয়ের_প্রণয়
#আফসানা_মিমি
| আঠারো তম পর্ব | শেষাংশ
❌[কোনোভাবেই কপি করা যাবে না]❌
সন্ধ্যার মন মেজাজ আজ ফুরফুরে। নিলয়ের গাড়ি আজ নিজে ড্রাইভ করে সে বাসায় এসেছে। সে ভেবে নিয়েছে আজ থেকে এই গাড়ি সেই ব্যবহার করবে। এমন মনে করার কারণও আছে। গতকাল সকালে রাব্বি যখন সন্ধ্যাদের কোম্পানিতে আসে তখন কথায় কথায় সে সন্ধ্যাকে খোঁচা দিয়ে কিছু কথা বলে। তার মধ্যে অন্যতম একটি কথা ছিল এমন,
” আচ্ছা উষসী! তোমার গাড়ি নেই কেন?”
” তুমি তো জানোই আমার এমন বড়োলোকদের মতো চলা অপছন্দনীয়।”
” তা বুঝলাম। তুমি অনেক সরল। তোমার সরলতার সুযোগেই তো ঐ নিলয় নিজের জন্য সব করে রাখছে। এই যে সে এত দামি একটি গাড়িতে চড়ে বেড়ায়, আমরা না হয় নিলয়ের হাত থেকে কোম্পানি ছাড়িয়ে নিলাম, তোমাকে টপ বিজনেস ওমেন হতে সাহায্য করলাম কিন্তু আর কিছুদিন পর নিলয় যখন জেল থেকে ছাড়া পাবে তখন কোম্পানির দায়ভার না পেয়ে সরকার বাড়ি আয়ত্তে নিয়ে নিবে। এমনিতেও তো আরিফ সরকারের কাছে নিলয় প্রিয়। তুমিও তো সরকার বাড়ির মেয়ে। তোমার এখানে কোন অধিকার দেখছি না।”
সন্ধ্যা রাব্বির কথা অন্তরে গেঁথে ফেলে। তখনই নিয়ত করে সে নিলয়ের সবকিছু এক এক করে কেড়ে নিবে।
সরকার বাড়ি পৌঁছাতে সদর দরজার সামনে মায়ের সাথে দেখা মিলে সন্ধ্যার। সুমি বেগমের চোখ শান্ত কিন্তু অন্তরে অসীম পীড়া। সন্ধ্যা দরজার কাছে আসতে শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে থাপ্পড় মেরে দেয় সে। সন্ধ্যা মায়ের কাণ্ডে আক্কেলগুরুম গালে হাত দিয়ে অবাক নয়নে চেয়ে থাকে। সুমী তখনো শান্ত। মেয়েকে টেনে বাড়ির দিকে নিয়ে যায় সে। নিজেদের ঘরে না গিয়ে সন্ধ্যার ঘরে ঢুকে আবারো থাপ্পড় মেরে বলে,
” তোকে মেয়ে বলতে আমার ঘৃণা করছে সন্ধ্যা। কিছুদিন আগে আমার যেই মেয়ে তার বাবার কাজকে অপছন্দ করতো আর সেই মেয়ে তার বাবার চেয়েও জঘন্য কাজ করেছে। এতোটা নিচ কীভাবে নামতে পারলি সন্ধ্যা?”
মায়ের কথা শুনে সন্ধ্যা পাশ ফিরে তাকায়। তিক্ততার সহিত প্রত্যুত্তরে বলে,
” এখন তুমি আমাকে মারছো মা? সরকার বাড়ির মেয়ে হয়ে আমি যখন হেঁটে হেঁটে পথ চলতাম আর নিলয় গাড়ি চড়ে ঘুরতো তখন কিছু বলতে না কেন? প্রতিবাদ করেছো কখনো? করবে কেন? সে তো তোমার মেয়ের থেকেও অধিক প্রিয়।”
” পৃথিবীতে একজন মায়ের নিকট সন্তানের চেয়ে অধিক প্রিয় কে হতে পারে সন্ধ্যা?”
” মিস্টার নিলয় নীলাভ হতে পারে। সে সবার নিকট প্রিয়। আরিফ সরকার এজন্যই তো তার হাতে সরকার বাড়ির সকল দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছিল। দেখেছো, সে দায়িত্ব পালনে অপারগ। আমি এই সন্ধ্যা উপযোগী যা আবারও প্রমাণ হলো।”
সন্ধ্যার মা অসহায় চোখে মেয়ের দিকে তাকায়।
” আজ তোর আপনজনকে যেভাবে ধোঁকা দিলি।এমন দিন আসবে সন্ধ্যা। যেদিন একটু শান্তির জন্য তুই জায়গা খুঁজবি। সেদিন আপন কাউকে কাছে পাবি না।”
সুমি সন্ধ্যার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মায়ের কথার মর্মার্থ খুঁজতে থাকে সন্ধ্যা। বিছানার উপর বসে গভীরভাবে চিন্তা করার মাঝেই মুঠোফোন বেজে উঠে তার। রাব্বি ফোন করেছে। সন্ধ্যার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসির রেখা ফুটে উঠে সে খুঁজতে ভুলে যায় মায়ের কথার মর্মার্থ।
———————
বুকের অসহনীয় যন্ত্রণায় সন্ধ্যা বিছানায় শুয়ে কুঁকড়াচ্ছে। ভোর রাতে আবছায়া স্বপ্ন দেখার পর থেকেই এই যন্ত্রণা শুরু হয়। কোন এক রমণী সাদা কাপড় পরিধান করে সন্ধ্যার কাছে আসে। রমণীর চেহারা অস্পষ্ট কিন্তু সন্ধ্যার কাছে রমণীকে অতি পরিচিত মনে হচ্ছে। রমনীটি সন্ধ্যার কাছে আসে। তাঁকে না ছুঁয়ে আলতোস্বরে ডাকে,
” সন্ধ্যাবতী উঠে আসো। তোমার ডাক এসেছে। আপন ভূমিতে যেতে হবে।”
সন্ধ্যা তাই করে। রমণীর পিছু এগিয়ে যায়। এক জায়গায় এসে রমনীটি থেমে সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে বলে,
” তোমার ডানে যাওয়া উচিত। কিন্তু আমি জানি তুমি বামে যাবে এবং সারাজীবন পস্তাবে।”
রমণীর কথা সত্যি হয় সন্ধ্যা চাকচিক্যময় রাস্তায় প্রবেশ করে। কিছু পথ এগোতে কাঁচ ভাঙা রাস্তা দেখতে পায় সে। যেখানে পথ হেঁটে সন্ধ্যার হাত পা কেঁটে যায়। সন্ধ্যা খুব করে চাইছে সেখান থেকে উঠে আসতে কিন্তু হাছার চেষ্টা করেও পারছে না।
স্বপ্নটা দেখার পর থেকেই সন্ধ্যার বুকের যন্ত্রণা বেড়ে গেছে। বিছানা থেকে নেমে সন্ধ্যা পানি পান করে বারান্দায় চলে আসে। ভোরের সতেজ বাতাস গায়ে লাগতেই সন্ধ্যা চোখ বন্ধ করে নেয়। অভ্যাস মোতাবেক নিলয়ের বারান্দায় তাকায় সে। অন্য সময় নিরয়ের বারান্দার দরজা খোলা থাকে আজ সেটা বন্ধ। সন্ধ্যা ভুলেই যায় নিলয়ের সাথে করা কাজের কথা। সে মনে মনে নিলয়কে মিস করতে থাকে। বারান্দায় গ্রিলে হাত রেখে আড়চোখে নিলয়ের বারান্দায় বার কয়েকবার তাকায়। বিরক্ত হয়ে শেষে বিড়বিড় করে বলে,
” আজ কোথায় গেল এই অসভ্য দুর্লয়? আমাকে জ্বালাতন করতে তো এতক্ষণ চলে আসার কথা।”
সন্ধ্যা বারান্দার আরেকটু কাছে এসে নিলয়কে ডাক দিবে তখন মনে পড়ে গতকালের কথা। সাথে সাথে সন্ধ্যার মুখে কাঠিন্যতায় ছেয়ে যায়। নিলয়ের বারান্দা থেকে চোখ সরিয়ে সে বাহিরের দিকে দৃষ্টিপাত করে। ভোরের এই সময়ে কেউ একজন সরকার বাড়ির প্রধান ফটক দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে দারোয়ান সেই মানুষটাকে বিনা বাক্যে বের হতে দিচ্ছে। সন্ধ্যার কেমন যেন সন্দেহ হয়। পরিধানের কাপড় পাল্টে সেও সেই মানুষটির পিছু নেওয়ার জন্য তৈরি হয়।
সময় সকাল ছয়টা। দারোয়ানের কাছে জানতে পারে মানুষটি ছিল সন্ধ্যার মা সুমি। সন্ধ্যা আর সময় ব্যয় করে না। নিলয়ের গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায় সুমির পিছনে। সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা লগ্ন আগমন ঘটেছে সন্ধ্যা সারাদিনে সুমির কোন খোঁজ পায়নি। ক্লান্ত শরীরে সন্ধ্যা রাত আটটায় অফিসে ফিরে আসে। সেখানে আরো একটি ধাক্কা খায় সন্ধ্যা। পুরো অফিস ফাঁকা। সারাদিনের ব্যস্ততার জন্য অফিসের অভিমুখী আসেনি সে। সন্ধ্যার চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। একদিকে মায়ের চিন্তা অন্যদিকে অফিসের অবস্থা। সন্ধ্যা ধপ করে একটি চেয়ারে বসে পড়ে। চিন্তা চেতনার মাথার চুল ছিড়তে থাকে। আকস্মাত সন্ধ্যার মুঠোফোন বেজে উঠে। সে ভাবে হয়তো তার মা ফোন করেছে কিন্তু না, ফোনের স্ক্রিনে রাব্বির নাম জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। নিজেকে স্বাভাবিক করে ফোন রিসিভ করে সে, ” হ্যালো।”
” তোমাকে মিস করছি উষসী। এখন একটু বের হতে পারবে?”
” আমার মাকে খুঁজে পাচ্ছি না রাব্বি।”
” কি বলছো?
সন্ধ্যা কান্না করে দেয়। অপরপাশে রাব্বি নীরব যেন সন্ধ্যার মা হারানো তার কাছে কিছুই না। সন্ধ্যা আশাহত হয় সে ভেবেছিল রাব্বি আরো বেশি রিয়েক্ট করবে। আসছি বলে সন্ধ্যা ফোন কেটে দেয়। অফিসের ব্যাপারটা রাব্বিকে জানায়নি সে। অফিস থেকে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায় সন্ধ্যা। রাতের শহরে যানজটের সমস্যা এ আর তেমন কিছু না। একই সময়ে অফিস আদালতের ছুটি হওয়াতেই নিত্যদিনে একই সমস্যা হয়। সন্ধ্যার কাছে মনে হচ্ছে আজকের যানজটের কারণ ভিন্ন কিছু। সকল মানুষ কি যেন বশাবশি করে গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত পায়ে সম্মুখে এগিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা গাড়ির জানালার কাঁচ খুলে একজন পথিককে জিজ্ঞেস করাতে সে উত্তর দেয়, ” লোকমুখে শুনলাম, এক মহিলাকে কে যেন গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। প্রথমে সবাই ভেবেছিল মহিলাটি বেঁচে আছে কিন্তু না মহিলা তো সেই কবেই মরে গেছে। এখন পুলিশেরা এসেছে,মহিলার আত্মীয় স্বজনের খোঁজ করছে।”
পথচারীর কথা শুনে সন্ধ্যার আত্ম কেঁপে উঠে। সে ও তো সারাদিন মাকে খুঁজে যাচ্ছে। চিন্তায় ভালো মন্দ আনেক কিছু আসছে। যানজট কিছুটা কমে আসলে সন্ধ্যা সম্মুখে আগায়। ডেথ স্পটের কাছাকাছি এসে গাড়ি সাইড করিয়ে নেমে আসে সে। রাস্তার এক পাশে লাশ পড়ে আছে পুলিশ আশেপাশে মানুষদের জিজ্ঞেস করে তদারকি করছে। সারাদিনের অনাহারে থাকায় সন্ধ্যার শরীর ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। সন্ধ্যা চলে আসার জন্য উদ্যোগ নিতেই লাশের গায়ে জড়িয়ে থাকা কাপড় দেখে থমকে যায়। খয়েরি রঙের ওড়না দিয়ে লাশের শরীর ঢেকে রাখা হয়েছে। সকালে সুমির গায়েও একই রঙের ওড়না ছিল। সন্ধ্যার অন্তর কাঁপছে। খারাপ সংবাদ যেন না হয় মনে মনে দোয়া করছে। লাশের কাছাকাছি আসতেই একজন পুলিশ সন্ধ্যাকে আটকে দেয়, ” আপনি আর সামনে আগাতে পারবেন না, মিস।”
সন্ধ্যা পুলিশের দিকে তাকায়। গাম্ভীর্য মুখশ্রীতে সন্ধ্যাকে নিষেধ করছে বয়স আনুমানিক ত্রিশ কিংবা পঁয়ত্রিশ। সন্ধ্যা কাঁপা কন্ঠস্বরে বলল, ” ঐ লাশটা মনে হয় আমার পরিচিত। আমাকে একটু সেখানে যেতে দিবেন?”
পুলিশ অফিসার এবার নরম হয়। সন্ধ্যাকে সাথে নিয়ে লাশের দিকে এগিয়ে যায়। তাজা র’ক্ত ছড়িয়ে আছে আশে পাশে সন্ধ্যা বুকে হাত চেপে লাশের পাশে দাঁড়ায়। পুলিশ অফিসার নিজেই মুখমণ্ডলের উপর থেকে ওড়না সরিয়ে দেয়।
সন্ধ্যার শরীর অসাড় হয়ে আসছে, হাত পা কাঁপছে। ঠোঁট জোড়া থরথর করে কাঁপছে। ধপ করে বসে যায় সে।” মা” বলে আর্তনাদ করে সুমির চোখ মুখ ছুঁয়ে দিতে থাকে।
” মা! চোখ খুলো। কী হয়েছে তোমার? কথা বলো। বাবা বকেছে বলে কী অভিমান করেছো? বাবা তো এমনই তুমি রাগ করো না। ও মা উঠো না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে তো। মা গো! ও মা উঠো।”
রাস্তার মানুষ জড়ো হয়ে সন্ধ্যার আর্তনাদ শুনছে। মা হারানো মেয়ের আর্তনাদ শুনে কারো চোখে পানি চলে আসছে তো কেউ মেয়ের জন্য আফসোস করছে।
সন্ধ্যার কাছে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে সে জ্ঞান হারাবে। সুমিকে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরেছে সে। এদিকে অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ পেয়ে পুলিশ সন্ধ্যাকে ডাকে, ” ম্যাম বডিকে নিয়ে যেতে হবে। আমরা ধারণা করছি আপনার মাকে কেউ হত্যা করেছে।”
এতক্ষণে সন্ধ্যার স্তম্ভিত ফিরে আসে। তার মাকে সে কাটাকুটি করতে দিবে না। মুঠোফোন বের করে কাউকে আসতে বলবে। এসময়ে সন্ধ্যার নিলয়কে বেশ প্রয়োজন। ছোট মার এই অবস্থা শুনলে নিলয় কাউকে আস্তো রাখবে না। কাঁপা হাতে সন্ধ্যা নিলয়ের নাম্বারে ডায়াল করে কিন্তু হায় আফসোস! নিলয়ের ফোন বন্ধ। সন্ধ্যার মাথায় কাজকরা বন্ধ করে দিয়েছে। নিলয়ের ফোনে একের পর এক কল দিতে থাকে সে। আকস্মাত নিলয়ের অবস্থানের কথা স্বরণে আসতেই সন্ধ্যা ডুকরে কেঁদে উঠে। সরকার বাড়ির আর কারো নাম্বার নেই তার কাছে। আচমকা রাব্বির কথা মনে পড়তেই সন্ধ্যা আবারও ডায়াল করে। রাব্বির ফোন বন্ধ। সন্ধ্যা বার কয়েকবার ফোন করার পরও খোলা পায়নি সে। পুলিশের সহায়তায় সুমির লাশ অ্যাম্বুলেন্সে উঠায়।
রাত আটটা বাজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। সরকার বাড়ির সামনে অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র। দুজন লোক অ্যাম্বুলেন্স থেকে সুমির নিথর দেহ বের করে নিয়ে আসে। অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজপেয়ে আরিফ সরকার সহ সকলেই বের হয়ে আসে। নীরব দোতলায় বসে আসল কাহিনী দেখার চেষ্টা করছে। সন্ধ্যার শরীরে বল অবশিষ্ট নেই। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিলয়ের মা সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে আতকে উঠে। এগিয়ে গিয়ে সন্ধ্যার কাঁধে হাত রাখতেই সন্ধ্যা ছলছল চোখে বলে, ” আমার মাকে নিয়ে এসেছি। আতর,সুরমা,আগর বাতি সাথে এনেছি। সাদা কাপড় কিনতে পারিনি, হাত কাঁপছিল। আমার মা আর নেই বড়ো মা! আমার মা আর নেই।”
রেহেনার বুক কেঁপে ওঠে। সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরে ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়ে নেয়।
অ্যাম্বুলেন্স চলে গেছে। স্ট্রেচারের উপর সুমির নিথর দেহ পড়ে আছে। সুমির গায়ে জড়িয়ে রাখা সাদা কাপড়ে ছোপ ছোপ তাজা র’ক্তে’র দাগ দেখা যাচ্ছে। আরিফ সরকার সুমির মুখমণ্ডলের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে নিতেই আতকে উঠে। এদিকে নীরব দোতলার উপর থেকে সুমির চেহারা দেখতে পেয়ে থমকে যায়। গতকাল রাত থেকে সুমির দেখা পায়নি সে। দোতলার উপর থেকে চিৎকার করে সুমিকে ডাকতে থাকে,
“এই তোর কি হয়েছে? ঘুমিয়ে আছিস কেন? তোর শরীরে রক্ত আসলো কোথায় থেকে? উঠ বলছি। এই সন্ধ্যা আমাকে নিয়ে নিয়ে চল। আমার সুমির কি হয়েছে দেখবো।”
সন্ধ্যা বাবার আর্তনাদে আরো পাগল হয়ে যায়। মা মা বলে চিৎকার করে কান্না শুরু করে। পুরো সরকার বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। নীলিমা দোতলায় উঠে নীরব সরকারের হুইলচেয়ার করে নিয়ে আসে। নীরব তাড়াহুড়ো করে আসতে গিয়ে হুইলচেয়ার থেকে নিচে পড়ে যায় সে। নীলিমা ধরতে চাইলে হাতের ইশারায় না করে বলে, ” আমাকে ধরিস না নীলিমা। আমার সুমির কাছে আমি একাই যাব।”
জমিনে হিচড়ে হিচড়ে সুমির স্ট্রেচারের পাশে এসে দাঁড়ায় সে। সুমির গালে হাত রেখে বলে, ” কথা বলবে না? আমি আর বকব না। কঠিন কাজ করতে বলব না। ফিরে আসো সুমি। আমার যে তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়া বাকি আছে।”
সময় রাত বারোটা। প্রতিবেশী কিছু মহিলাদের সাহায্যে সুমির শেষ গোসলকার্য সম্পাদন করা হয়েছে। সন্ধ্যার অবস্থা খুব খারাপ। জ্ঞান হারিয়েছে কয়েকবার। শেষে আরিফ সরকারের আদেশে ডাক্তার ডেকে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দেয়া হয়। সন্ধ্যার এখন স্যালাইন চলছে। রাত সাড়ে বারোটায় দাফনকার্য সম্পাদন করা হয়।
—————
সুমি মারা গিয়েছে আজ পাঁচদিন। এই পাঁচদিনে সন্ধ্যা চুপচাপ ঘরে বসে থাকে। কারোর সাথে কথা বলে না, খায় না। পাশের ঘর থেকে বাবার চিৎকার ভেসে আসলে শুধু কানে হাত দিয়ে বসে থাকে।
সন্ধ্যার ফোন প্রায় বিশ মিনিট যাবত বেজে চলছে। সন্ধ্যার সেদিকে কোন ধ্যান নেই। সে ভাবছে সুমির সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা। আজ ফরেনসিক ল্যাব থেকঃ রিপোর্ট আসবে। কীভাবে কী হয়েছে বিস্তারিত জানা যাবে তখন। এতক্ষণ ফোন বেজে চলছে দেখে সন্ধ্যা খুবই বিরক্ত। দুর্বল চিত্তে ফোন হাতেনিতেই অপরিচিত নাম্বার দেখতে পায় সে। ফোন রিসিভ করে সন্ধ্যা। কানে ধরতেই রাব্বির স্বর শোনা যায়।
” উষসী আমার অবস্থা নাজেহাল। আজ পাঁচদিন যাবত এক অন্ধকার গোডাউনে বন্দি আছি। নিলয় আমাকে মেরে ফেলবে। কিছু করো।”
রাব্বির স্বর পেয়ে সন্ধ্যা বিচলিত হয়ে পড়ে।
” তুমি কোথায়? তোমার ফোন কোথায়?”
” আমি কিছুই জানি না। নিলয়ের কাছ থেকে এবার আর রক্ষা পাবো না উষসী।”
ফোন কেঁটে যায়। সন্ধ্যার চোখ মুখের রং ও সাথে সাথে পরিবর্তন হয়ে যায়। ফোন কলের সাহায্যে রাব্বির অবস্থান জানার জন্য কাউকে ম্যাসেজ দেয় সে। এরপর বিড়বিড় করে বলে,
” তোমার কিছু হবে না রাব্বি। মিস্টার নিলয় নীলাভের আজ শেষ দিন চলে এসেছে।”
চলবে………..