খেলাঘরে তুমি আমি পর্ব -১১ ও শেষ

#খেলাঘরে_তুমি_আমি
পর্ব—১১ এবং শেষ।
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।

—এরপর হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে দোয়া আদিত্যের হাতটা ছেড়ে দিয়ে আমার পাশ থেকে সরে যায়।তারপর পারমিতার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো!ওর এই অদ্ভুত আচরণ দেখে কিছুটা ভরকে গেলাম আমি।

—কি বললেন অর্ণব সাহেব,দোয়া আপনার সাথে শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসঘাতকতা করলো?

—সেটা একটু পরেই জানতে পারবেন ম্যাম।

—আচ্ছা আপনি কনটিনিউ করুন।

এতোক্ষণ ধরে আমি আমার জীবনের গল্প আমাদের দেশের একজন বিখ্যাত লেখিকা অনামিকা বৃষ্টির কাছে বর্ণনা করছিলাম।ওনার পরবর্তী পরিকল্পনা আমার আর মিথিলার গল্প নিয়ে একটা বই লেখা।ওনার অনেক গল্পের বই পড়েছি আমি,এককথায় ওনার ভক্ত আমি।অনামিকা বৃষ্টির কাছে আমি আমার গল্পের সমাপ্ত অংশ বর্ণনা করতে লাগলাম।উনি একমনে আমার কথা শ্রবণ করে চলছেন।

দোয়াকে উদ্দেশ্য করে আমি বললাম।

—একি দোয়া তুমি এটা কি করছো…তার মানে তুমি আগে থেকেই পারমিতাকে চিনতে?

—হ্যাঁ,একদম ঠিক ধরেছো তুমি!আমি ম্যাডামেরই লোক।উনিই আমায় তোমাকে খু ন করার জন্য ভাড়া করেছিলেন।

—এতো বড়ো চিটারি করলে আমার সাথে,কেনো করলে এটা বলো..?আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখলে না তুমি।

পারমিতা দোয়াকে থামিয়ে দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো।দোয়ার হাত থেকে পিস্তলটা নিয়ে আমার মাথা বরাবর ধরলো।তারপর বলতে লাগলো।

—বিশ্বাস করো,তোমায় মা রা র কোনো ইচ্ছেই ছিলো না আমার।কিন্তু কি করবো বলো,আমি যে একজনের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।কিকরে এখন নিজের কথার অমান্য করি!

—কি বলছোটা কি,কার কাছে কি প্রতিজ্ঞা করেছো তুমি?

—আমার মিথিলা আপুর কাছে।ওকে আমি কথা দিয়েছিলাম যে ওকে মা রা র পরে ওর স্বামীকেও ঠিক একইভাবে মা র বো।এই কারণে বিষ দিয়েছিলাম তোমায়,কিন্তু তুমি বেঁচে গেলে।এরপর সিড়ি থেকে ফেলেও মারার ট্রাই করলাম,তাও বেঁচে গেলে তুমি?কিন্তু এখন…এখন নিজেকে কিকরে বাঁচাবে?

–তার মানে আমাকে বিষ তুমি দিয়েছিলে,অথচ আমি কিনা নিজের মাকে সন্দেহ করেছি!

—হ্যাঁ,ওনার ওয়্যারড্রপে বিষের শিশিটা আমিই রেখে দিয়াছিলাম।যাতে তুমি নিজের মাকে ভুল বোঝো।

—আমাকে মারবে তাই তো?ঠিক আছে মারো…?এমনিতেও মিথিলার সাথে সাথে তুমি আমায় অনেক আগেই মেরে ফেলেছো!কিন্তু তার আগে আসল সত্যিটা তো তোমার জানা দরকার।

—কিসের সত্যি…দেখো আমার ভুল পথে পরিচালিত করার চেষ্টা একদম করো না।

আদিত্য বুঝতে পারলো ওর সত্যিটা আমি পারমিতার কাছে ফাঁস করতে চলেছি।তাই ও চেঁচিয়ে বলতে লাগলো।

—পারমিতা তুমি ওর কোনো কথা বিশ্বাস করবে না,ও তোমার মন ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।তুমি যাতে নিজের কাজ করতে না পারো।ওর মিথ্যে গল্প শোনার কোনো দরকার নেই,তার আগেই শেষ করে ফেলো ওকে।

—ঠিক বলেছো।ওর গল্প শুনে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।

—উনি যখন কিছু বলতে চাইছে।শুনেই নিন ম্যাম,নয়তো পরে আফসোস করতে হতে পারে।

পেছন থেকে দোয়া পারমিতাকে বললো।

—আচ্ছা ঠিক আছে।তুমি যখন বলছো,আমি শুনবো।বলো অর্ণব।কি এমন বলতে চাও তুমি।

—তুমি মিথিলাকে সাহিত্যের মৃত্যুর কারণ ভাবতে তাই তো?আর সেই কারণেই ওকে খু ন করিয়েছো!কিন্তু আসল সত্যিটা কোনোদিন জানতেই পারোনি,সাহিত্যের খুন মিথিলা নয় তোমার প্রেমিক আদিত্য করিয়েছে।ও নিজের মুখে স্বীকার করেছে সেটা…!

আমার কথা শুনে পারমিতা হাসতে লাগলো।ও কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলো আমার কথা।

—আমার হাত থেকে বাঁচার জন্যে এগুলো বলছো তাই না?আমি এতোটাও বোকা নই যে তোমার আষাঢ়ে গল্প বিশ্বাস করবো।

—আমার কথা বিশ্বাস নাই করতে পারো।কিন্তু এটাই সত্যি।

—আচ্ছা আমি দোয়ার কাছে জিজ্ঞেস করছি।ও নিশ্চয়ই মিথ্যে বলবে না আমায়।

—হ্যাঁ।দোয়াও নিজের কানে শুনেছে।কিন্তু আমার মনে হয় ও এখন স্বীকার করবে না।কারণ আমি বেঁচে যাই এটা যেমন তুমি চাও না,দোয়াও চায় না।

—উনি একদম ঠিক বলেছেন ম্যাডাম।আপনার একসময়ের প্রেমিক সাহিত্যের মৃত্যু মিথিলার কারণে হয়নি,এই আদিত্য সাহেবের জন্য হয়েছে।

দোয়া আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠলো।শুধু তাই নয় ও তারপর নিজের মোবাইলটা বের করে।

—আপনি বিশ্বাস করবেন না আমি জানি,তাই এই মোবাইলে ওনার সমস্ত কথা রেকর্ড করে রেখেছি।নিজের কানে শুনে নিন।

দোয়া রেকর্ডটা অন করতেই আদিত্যের বলা সকল শব্দ বেজে উঠলো।এদিকে আদিত্য ভয় আর আতঙ্কে ঘেমে একাকার।বারবার নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে।পারমিতা পুরো রেকর্ডটা শুনে স্থির হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো।এরপর পিস্তলটা আমার মাথার ওপর থেকে সরিয়ে আদিত্য বরাবর নিয়ে গেলো।আমি পারমিতাকে থামানোর চেষ্টা করছি।

—পারমিতা এটা কি করছো তুমি,দেখো এরকম কিছু করে না।পুলিশ ওকে ওর কৃতকর্মের শাস্তি দেবে।তোমরা দুজনেই আইনের কাছে নিজেদের সমর্পণ করো।

আমার কথার কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে পারমিতা আদিত্যের মাথা বরাবর পিস্তলটা চালিয়ে দিলো।মুহূর্তেই আদিত্য মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।ওর রক্তে সারা মেঝে ভেসে যাচ্ছে।পারমিতা এরকম পিস্তলটা নিজের মাথা বরাবর রেখে আমাকে বলতে লাগলো।

—আমায় ক্ষমা করো অর্ণব।তোমার সাথে আর আমি নিজের বোনের সাথে যে অন্যায় করেছি তার কোনো ক্ষমা হয় না!আমার এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।

আমি দ্রুত গিয়ে পারমিতার হাত থেকে পিস্তলটা কেড়ে নিলাম।ও আমাকে একটা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়,তারপর সিড়ি বেয়ে ছাদের দিকে ছুটে যায়।আমি আর দোয়া ওর পেছন পেছন গেলাম।দরজার সামনে আসতে না আসতেই পারমিতা ওপাশ থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।এর একটু পরে একটা চিৎকারের শব্দ হয়।আমরা ছুটে নিচে গেলাম।গিয়ে দেখি পারমিতার রক্তাক্ত শরীর মাটিতে পড়ে আছে।

—তার মানে স্পট ডেড…?
(অনামিকা বৃষ্টি)

—নাহ!সেদিন পারমিতা মারা যায়নি।সত্যি বলতে ওর পাপের শাস্তি পাওয়া অনেক বাকি ছিলো।তাই হয়তো সৃষ্টিকর্তা শাস্তিস্বরুপ বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন ওকে।

—এখন উনি কোথায় আছেন?

—লকাপে আছে।দু দুটো খুনের অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় শুনায় আদালত।লকাপের অন্ধকার ঘরে প্রায় পাঁচ বছর ধরে সে নিজের সাজা ভোগ করে চলছে।

—আর দোয়া রহমানের কি খবর…উনি তো সত্যিই শেষ পর্যন্ত আপনার সাথেই ছিলেন।

—হ্যাঁ,দোয়া আমার সাথে কোনো বিশ্বাসঘাতকতা করেনি।রিসালতের বয়স যখন একবছর তখন আমার সাথে দোয়ার বিয়ে হয়।রিসালাতের বয়স এখন সাড়ে পাঁচ বছর।আর আমার আর দোয়ারও একটা মেয়ে আছে,ও সবে হাঁটতে শিখেছে।

—বাহহহ!তার মানে হ্যাপি ফ্যামিলি।খুব ভালোই আছেন এখন আপনারা।

—জ্বী।

—আপনার ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে একদিন আসবেন।খুব খুশি হবো আমি।আর আমার লেখার কাজে সহযোগিতা করার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।

—আপনাকেও ধন্যবাদ ম্যাম।আমার আর মিথিলার গল্প আপনার মাধ্যমে সারা পৃথিবী জানতে পারবে এর থেকে আনন্দের আর কি আছে।বাস্তবে না হোক,অন্তত বইয়ের পাতায় আমার ভালোবাসা বেঁচে থাক।

—-একটা শেষ প্রশ্ন করি আপনায়,আপনি তো বললে মিথালার লাশ নিজেল চোখে দেখেননি আপনি…তাহলে কি এর মানে এটা দাঁড়ালো সে বেঁচে আছে?আর বেচেঁই থাকে সে কোথায়?

—সে প্রশ্নের জবাব আর কিকরে দেবো ম্যাম।তবে আমি কখনোই মানতে পারি না মিথিলা আর এই পৃথিবীতে নেই।ও যদি সত্যিই বেঁচে থেকে থাকে ঠিক কোনো না কোনোদিন দেখা হবে আমাদের!
এবার আমি আসি ম্যাম।ভালো থাকবেন।

অর্ণব এরপর উঠে চলে গেলো।অনামিকা বৃষ্টি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ওর চলে যাওয়ার দিকে।চশমাটা চোখ থেকে খুলে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় অনামিকা বৃষ্টি।তারপর গভীর ভাবে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।

না সার্জারির কোনো চিহ্নই নেই তার মুখমন্ডলে।সাড়ে পাঁচ বছর আগে এই আগুনে দগ্ধ মুখমন্ডল ঠিক করতে এতো বেশি পরিমান সার্জারি করতে হয়েছিলো যে তার চেহারটাই পাল্টে যায়।হাসপাতালের এক নার্স সেদিন দয়া না দেখালে হয়তো চেহারার সাথে সাথে জীবনটাই চলে যেতো।তবে সেদিন শুধু তার চেহারা পাল্টায়নি।তার সাথে নামটাও পাল্টে গিয়েছিলো।সুস্থ হয়ে এক বছর পরে দেশে ফিরে সে মিথিলা রহমান থেকে হয়ে উঠলো লেখিকা অনামিকা বৃষ্টি!ততোদিনে অর্ণব দোয়াকে নিয়ে নতুন সংসার পেতেছে।এই কয়েক বছরে বহু মানুষের সাথে মিশেছে অনামিকা,তাদের জীবনের গল্পকে বইয়ের পাতায় রূপদান দিয়েছে।আজ নিজের ভালোবাসার মানুষের থেকে নিজের অনুপস্থিত অধ্যায়ের গল্প শুনলো।অর্ণব সত্যিই মিথিলাকে খুব ভালবাসতো,আর এখনও বাসে।ও এখন নিজের নতুন জীবন নিয়ে সুখী।রিসালাতও দোয়ার সাথে খুব ভালো আছে।ও হয়তো জানেই না দোয়া ওর আপন মা নয়,দোয়ার ভালোবাসা ওকে কখনো সেটা বুঝতে দেয়নি।তাই ওদের সুখের সংসারে গিয়ে ভাগ বসাতে চায়না অনামিকা বৃষ্টি ওরফে মিথিলা।দূর থেকেই না হয় নিজের ভালোবাসার মানুষদের ভালোবেসে যাবে।এটাই হবে ওর এই অপূর্ণ জীবনের পরম পূর্ণতা।।💙🖤💗

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here