মন গহীনে পর্ব -১৫+১৬

#মন_গহীনে

#পর্বঃ১৫

#দোলন_আফরোজ

সন্ধ্যায় বিয়ের অনুষ্ঠান হবে কমিউনিটি সেন্টার এ। বাড়ি ভর্তি মেহমান, ঘুম টাও হয়নি কারো ঠিক মতো। সবচেয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে তানিয়া বেগম আর তারেক রহমান। এদিকে মেহমান দের এটেন্ট করা তার উপর কমিউনিটি সেন্টার এ বার বার খোঁজ লাগানো। তারেক রহমান কে সাহায্য করছেন উনার ভাই এর ছেলেরা। কাব্য সকাল থেকে আবিরের ওখানে। আবির আগেই বলে দিয়েছে তার সাথে বরযাত্রী যেতে হবে। কাল সারাটা দিন ও বাড়িতেই কাটিয়েছে, কিন্তু আজ আর তা চলবে না। কলিজার বন্ধুর বিয়ে বলে কথা,কাব্য বরযাত্রী হয়ে না গেলে কি হয়?

শাহানারা বেগম, অর্না,কায়েস আর হিয়া ও যাবে। উনারা ঠিক করেছেন সরাসরি কমিউনিটি সেন্টার এই যাবেন। এতো আগে আগে গিয়ে শুধু শুধুই বিয়ে বাড়িতে ভির বাড়াতে চান না।
সেলিম সাহেব এর ও যাওয়ার কথা ছিলো,কিন্তু একটা কাজ পরে গেছে তাই যেতে পারেননি।

দুপুর এর পর পর ই পার্লার এর মেয়েরা এসে সাজানোর জন্য। তিনটা মেয়ে এসেছে পার্লার থেকে। বউ এর সাথে আরো মেয়েরাও সাজবে, সন্ধ্যের আগে সাজানো কমপ্লিট করতে হবে।

বিকেল প্রায় শেষের দিকে,তমাকে সাজানো কমপ্লিট। বাকি মেয়েরা হুলুস্থুল শুরু করেছে কে আগে সাজবে। তিথী সাজতে গেলে ওর কাজিন অন্য রা বলে পিচ্চি মানুষের এতো সাজগোজ এর দরকার নাই, আমাদের আগে সাজতে দে, দেড়ি হয়ে যাবে নইলে।

খুব রাগ হয় তিথীর, ওর নিজের বোনের বিয়ে আর ওকেই কেউ পাত্তা দিচ্ছে না।
আমি মোটেও পিচ্চি না, কলেজে পড়ি। যথেষ্ট বড় হয়েছি।
আমি সাজবো না, যাও তোমরা ই সাজো, বলেই কান্না করে চলে যেতে নেয়, তখন মিলা আটকায় তাকে।

কিরে, ময়না পাখিটা রাগ করেছে কেনো শুনি?

রাগ করিনি। আমি কি রাগ করতে পারি? পিচ্চি মানুষের কি অতো রাগ আছে? বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

মিলা মুখ গম্ভীর করে, কে বলেছে আমার ময়না পাখিটা পিচ্চি? হুম? এক্ষুনি ওকে শাস্তি দিতে হবে যে।

কাউকে কোনো শাস্তি দেয়ার দরকার নাই। আমি বিয়েতেই যাবো না, বলে আবার চলে যেতে নিলে মিলা তাকে একটা চেয়ার এ বসিয়ে বলে, কি হয়েছে আমার সোনাটার? বলনা? তোকে আপু কতো ভালোবাসে না? আপুকেও বলবি না?

কেঁদে কেটে নাক মুখ লাল করে ফেলেছে। নাক টেনে বলে, সবাই সাজছে পার্লার এর মেয়েদের কাছে, আমি সাজতে গেছি বলে আমি পিচ্চি, পিচ্চি মানুষের অতো সাজতে নেই!

যাহ পার্লার এর মেয়েরা কি আমার থেকেও সুন্দর সাজাতে পারে? হুম? আমি আমার ময়না পাখিকে সাজিয়ে দিবো, আয়।
যা ফ্রেশ হয়ে আয়। চোখ মুখ এমন লাল হয়ে থাকলে কিন্তু সাজিয়ে দিবো না আমি।

তিথী দৌঁড় লাগায় ওয়াশরুমে। ১০ মিনিট পর একদম ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে।

মিলা ওকে সাজাতে শুরু করে। প্রায় আধা ঘণ্টা পর সাজানো কমপ্লিট হলে কাব্যর দেয়া পার্পল কালার লেহেঙ্গা টা পড়ে আসে।

ওয়াও সো প্রিটি লেহেঙ্গা। বিয়ের জন্যই কিনলি?

আবির জিজু গিফট করেছে।

হুম জিজুর পছন্দ তো সেই রে।

হুম এই জন্যই তো আপুটি কে পছন্দ করেছে। বলেই দুজন হাসতে থাকে।

পুরোপুরি সাজ কমপ্লিট হওয়ার পর মিলা বলে, তোকে আজ পুরাই পুতুল লাগছে রে। আজ যে কতো ছেলে হার্ট অ্যাটাক করে কে জানে। বলে একটা নজর টিকা লাগিয়ে দেয়।
এক কাজ করি চল, আজ তোকেও বিয়ে দিয়ে দেই? বউ বউ ই লাগছে তোকে। ছোট্ট একটা পুতুল বউ। বলে জড়িয়ে ধরে মিলা।

আমার কিন্তু এখন লজ্জা লাগছে মিলাপু। তুমি বেশি বেশি বলছো।

উহুম, মোটেও না। পুরাই বার্বি লাগছে তোকে।

আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে। তুমি ফাইনাল টাচ আপ করে নাও। সবাই বেরুবে কিছুক্ষণের মাঝে।

মিলা আর তিথী যায় বাকিদের সাজার খবর নিতে। সবার সাজ ই মোটামুটি কমপ্লিট। তমাকে সাজিয়ে একটা চেয়ার এ বসিয়ে রেখেছিলো। মেরুন কালার বেনারসিতে তমাকে যা সুন্দর লাগছে। লম্বা চুল গুলো খোপা করে কানের এক পাশে তিনটা গোলাপ গুজে দিয়ে মাথায় বিয়ের ওড়না দিয়ে দিয়েছে। দুই পাশের ছোট চুল গুলো সামান্য কার্ল করে সামনে ঝুলিয়ে দিয়েছে। গোলগাল মুখ টাতে ভাড়ি বিয়ের মেকাপে পুরাই অন্যরকম সুন্দর লাগছে।

তিথী গিয়ে তমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, তোমায় অনেএএএক সুন্দর লাগছে আপুটি। আবির জিজু তোমায় দেখলে আজ মাথা ঘুরে পরেই যাবে। তবে বিয়ে করবে কি করে বলোতো? বলে চিন্তা করার ভংগী করে।

তমা ও জড়িয়ে রেখেই আরেক হাতে তিথীর মাথায় ছোট্ট করে গাট্টা মেরে বলে তাই না?
বলে সামনে নিয়ে এসে দাঁড় করায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিছুক্ষণ দেখে বলে, এতো না সাজলেও পারতি। কেউ একজন তোকে না দেখেই পাগল হয়ে বসে ছিলো এতো বছর যাবৎ। আজ তার কি হয় কে জানে।

তিথী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কি বলছো? কে আমায় না দেখে পাগল হয়ে বসে আছে?

আরেহ নাহ, এমনি বললাম। অনেক সুন্দর লাগছে তোকে। একদম পাগল করা সুন্দর। বলে জড়িয়ে ধরে বলে, মিস করবো তোকে, তোর বাচ্চামো গুলো আরো মিস করবো। পড়া ফাকি দেয়ার হাজার টা বাহানা খুঁজাটাও মিস করবো। আমার নাস্তা খেয়ে ফেলাটা মিস করবো। আম্মুর বকা খেয়ে আমার কাছে এসে লুকানো টাও মিস করবো রে। হুটহাট ফুচকা, আইসক্রিম খাওয়ার আবদার করাটাও মিস করবো। মিস করবো তোর করা ছোট ছোট পাগলামো গুলো।

তিথীও শক্ত করে ধরে বলে, তোমাকেও অনেক মিস করবো আপুটি। কাকে এতো এতো জ্বালাবো এখন? কার সাথে মাঝরাতে তারা গুনতে যাবো। যেদিন হরর মুভি দেখে ভয় পাবো সেদিন কার সাথে ঘুমাতে যাবো আমি। আমার প্র‍্যাক্টিক্যাল খাতা গুলো কাকে দিয়ে করাবো এখন? একটা জিনিস নষ্ট করে কার ঘাড়ে দোষ চাপাবো এখন?
দুই বোন ই কাঁদছে।

মিলা আর অন্য কাজিন রা এসে শান্তনা দিচ্ছে। কাঁদলে সাজ খারাপ হয়ে ভুতের মতো লাগবে। পরে আবির জিজু বিয়ে না করেই পেতনী দেখে পালাবে। বলেই সবাই হুহু করে হেসে উঠে। সাথে তমা তিথী ও।

*************

সন্ধ্যা ৭ টার দিকে তমা তিথী ওদের নানু বাকি কাজিন রা আর অন্যান্য আত্নিয় স্বজন রা কমিউনিটি সেন্টার এ আসে। তমাকে স্টেজে নিয়ে বসিয়ে দেয়া হয়। সবাই ফটোশুটে ব্যস্ত।
এর মাঝে বার দুয়েক তিথীর মামাতো ভাই রনি ওকে ডেকেছিলো। যায়নি তিথী। রনির আচরণ ইদানীং তিথীর মোটেও সুবিধার লাগছে না, তাই যতোটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে চলার চেষ্টা করে।

কিছুক্ষণের মাঝেই শাহানারা বেগম রা এসে উপস্থিত হন। স্টেজে তমার কাছে গিয়ে ওর হাতে একটা ডায়মন্ড এর নেকলেস দিয়ে দোয়া করে দেয় তাকে।
তিথীকে দেখে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তিনি। মনে মনে বলেন তুই সত্যিই আমার ছেলের পুতুল বউ। পুতুল এর মতোই দেখতে তুই, সেই ছোট বেলা থেকেই।

তিথীকে হাতের ইশারায় ডাকেন উনি।
তিথী সালাম দিয়ে উনার পাশে বসে জিজ্ঞেস করে কখন এসেছেন?

উহুম, আপনি না, তুমি বলবি তুই আমায়।

তিথী ও হাসি মুখে বলে আচ্ছা। কখন এসেছো তোমরা।

এইতো কিছুক্ষণ আগে। সুন্দর লাগছে তোকে খুব।

তিথী একটা লাজুক হাসি দেয়। তারপর হিয়াকে বলে, চলো হিয়া আপু, আপুটির সাথে দেখা করবে।

হিয়াঃ দেখা করেছি।

তবুও চলো। ওখানে সবাই আছে, সবার সাথে মজা করবে চলো। বলেই হিয়াকে টেনে নিয়ে যায়।

কিছুক্ষণ এর মাঝেই বর এসে যায়। সবাই গিয়ে বর কে আটকানোর জন্য গেট ধরে। বরযাত্রীতে গেট এর সামনে কাব্য, মোহনা, পিয়াস আরো বন্ধুরা আর মাহি আরো কাজিন রা।

হৃদি, মিলা, মৌ আরো সব কাজিন রা গেট আটকে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে তিথীকে ছোট পেয়ে যতো কাজ আছে সব তিথীকে দিয়েই করাচ্ছে। তাই তিথীর আসতে দেড়ি হয়। মিষ্টি নিয়ে এসে তিথী গেট এর সামনের টেবিলে রেখে মুখ ফুলিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে।

তিথীকে দেখেই সবাই এক সাথে অই হই করে চেচিয়ে উঠে। এই যে আমাদের বিয়াইন সাহেবা এসেছেন। উনি তো কিছুটা হলেও দয়া মায়া করবেন, তাই না।

এদিকে তিথীকে দেখে কাব্য ওখানেই ফ্রিজ হয়ে গেছে। মনে মনে বলে, কে বলেছিলো তোমায় এতো সাজতে? আমায় না মারা পর্যন্ত শান্তি পাবে না তুমি।

তিথী মুখ খুলে বলে আপুরা দয়া করেছে বলেই ৫০ হাজার এ ঢুকতে দিবে বলেছে। আমি থাকলে ১ লাখ ই চাইতাম।

এই এই বিয়াইন বলে কি এইসব? এবার তুই ই কিছু বল কাব্য।

কাব্য বলাতে তিথী ওদিকে একবার তাকায়, পার্পল কালার পাঞ্জাবীতে কি অমায়িক লাগছে কাব্যকে।
মনে মনে বলে আজ তো দেখছি কাবির সিং কেউ সুন্দর লাগছে।

আমি কি বলবো, তারাতাড়ি এসব ঝামেলা শেষ কর।

অনেকক্ষণ ঝামেলার পর ৩৫০০০ টাকা নিয়ে কনে পক্ষ গেট ছাড়ে।

আবিরকে নিয়ে স্টেজে তমার পাশে বসিয়ে দেয়া হয়। আবির তো তমাকে দেখে পুরাই স্পিচলেস, বউ সাজে তমাকে অন্যরকম লাগছে।

শুরু হয় আবির তমার ফটোশুট। আবির তমার কানে কানে বলে, আমার বউ টাকে কি এতো সুন্দর ও হতে হতো? মুচকি হাসে তমা আর সেই মুহূর্তটাই ক্যাপচার করে নেয় ক্যামেরাম্যান।

এদিকে কাব্য শুধু সুযোগ খুঁজছে কখন তিথীকে সে একা পায়।

খাওয়া দাওয়া প্রায় শেষের দিকে। কিছুক্ষণ পরেই বিয়ে পরানো হবে। রনি এসে তিথীকে বলে, তিথী তোকে মিলা ডাকছে, ওই পাশের কর্নারে রুমটাতে, ওর শাড়ীটা নাকি ঠিক করতে হবে।
মিলার কথা শুনে তিথীর হিয়াকে বলে উত্তর পাশের কর্নারের রুমটাতে যায়। রুমে ঢুকে মিলাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে কয়েকবার ডাকে মিলাকে। কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। ওয়াশরুমেও উঁকি দিয়ে দেখে, সেখানেও নেই।
তাই নিজে নিজেই বিরবির কিরে বলে, শাড়ী ঠিক করে চলে গেছে হয়তো। বলে রুম থেকে বেরুতে গেলে হাতে টান পড়াতেই আচমকায় আবার নিজেকে রুমে আবিষ্কার করে সে।

ত ত তু তুমি? তুমি এখানে?

বলতে বলতেই রনি ঘরের দরজা লাগিয়ে দেয়।
এই পাশটা মোটামুটি নিরব, এই পাশটাতে কেউ তেমন একটা আসে না।

কি ব্যাপার রনি ভাই, তুমি দরজা লাগাচ্ছো কেনো? বলে দরজা খুলতে গেলে রনি তিথীর হাত ধরে বলে,এতো ইশারা করছি পাত্তাই দিচ্ছিস না কেনো? সেই কবে থেকে তোকে একটু কাছে পেতে চাইছি, বুঝেও কেনো না বুঝে আছিস।

কি বলছো কি তুমি এসব? মাথা ঠিক আছে তোমার?

নাহ একদম ঠিক নেই। তোর এই হট ফিগার দেখলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। প্লিজ একটু আদর করতে দে আমায়। বলেই কাছে আসতে নেয়।

একদম কাছে আসবে না। চেচাবো কিন্তু আমি।

চেঁচা, যতো খুশী চেঁচা। কেউ শুনবে না কিছু। একটু আদর করতে দে, বলেই এগিয়ে যেতে নেয়।

ছিহঃ এতো নোংরা তুমি? তুমি আমার ভাই হও ভাবতেও ঘেন্না লাগছে।

যাহ যাহ এতো স্বতি গিরি দেখাচ্ছিস কাকে হেহ? তোকে যে কি*ড*ন্যা*প করেছিলো, ৫ দিন আটকে রেখেছিলো কিছু না করেই ছেড়ে দিয়েছে? আমি করলেই দোষ না? মেজাজ খারাপ করাবি না। আপোষে আয়, তবে কষ্ট হবে না, আর আমায় রাগালে খুব খারাপ হবে বলে দিচ্ছি।
তিথী উপায় না পেয়ে চেঁচানো শুরু করেছে।

তিথীর চেঁচানো শুনে রনি গিয়ে তিথীর মুখ চেপে ধরে।

এদিকে তিথীকে না দেখে কাব্য অস্থির হয়ে গেছে। হিয়াকে এসে জিজ্ঞেস করে তিথী তো তোর সাথে ছিলো, কোথায় গেছে এখন?

হিয়া বলে ওর একটা কাজিন বলে মিলা ওকে ডাকছে, তাই উত্তর পাশের কর্নারের রুম টাতে গেছে।

কোন কাজিন?

ওর মামাতো ভাই মনে হয়।

এক সেকেন্ড ও আর দেড়ি করে না কাব্য। দৌঁড়ে যায় উত্তর পাশটাতে। রুম টা ভিতর থেকে লক করা। কাব্যর বুকের ভিতর টা মুচড় দিয়ে উঠে। ওদিটায় বিয়ে পড়ানো শুরু হয়ে গেছে। তিথী কি ভিততেই আছে? মিলাকেও তো সে দেখেনি। তাহলে কি সত্যিই মিলা আর তিথী ভিতরে আছে?

সে ফিরে যেতে নেয়। কিন্তু বুকের ভিতর কেমন যেনো অশান্তি লাগছে। তবুও মিলা আছে এখানে, তাই সে আর এখানে থাকতে চাইছে না। আবার যখন পা বাড়ায় ফিরে যাওয়ার জন্য তখন তিথীর চেঁচানোর আওয়াজ শুনতে পায়।

রনির চেঁচানোর আওয়াজ ও শুনতে পায়। তুই আমার হাতে কামড় দিলি? এবার দেখ কি করি তোর। বলেছিলাম আপোষে আয়, এবার এমন অবস্থা করবো তোর নিজেই কল্পনা করতে পারবি না। লজ্জায় কাউকে বলতেও পারবি না।

দ্রুত পায়ে দরজার কাছে যায় কাব্য। দরজার হ্যান্ডেল ঘুড়িয়ে দরজা খুলার চেষ্টা করে আবার। না পেরে তিথীকে ডাকে। তিথী যেই উত্তর দিতে যাবে তখন ই রনি ওর মুখ চেপে ধরে।

কারো কোনো আওয়াজ না পেয়ে কাব্য দরজায় বার বার কড়া নাড়তে থাকে। কোনো আওয়াজ নেই ভিতর থেকে। কিন্তু সে স্পষ্ট তিথীর গলা শুনেছে,সাথে রনির ও।

দরজা ভাংগার জন্য জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে আর লাথি দিচ্ছে।ভিতর থেকে ধস্তাধস্তির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কাব্যর ভিতর টায় তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। সে তার সর্বশক্তি দিয়ে দরজাতে লাথি দিচ্ছে আর তিথীকে ডাকছে। কাব্যর কাছে হিয়া ও এসে দাঁড়ায়। প্রায় অনেকক্ষণ পর হুট করেই ভিতর থেকে দরজা খুলে যায়, আর সাথে সাথে তিথী কাব্যর বুকে ঝাপিয়ে পড়ে।

এদিকে রনি প্রচন্ড রকম ঘামছে। সব জানাজানি হয়ে গেলে কি হবে সেই চিন্তায় তার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

তিথী কোনো কথা বলতে পারছে না, খুব কাঁপছে আর কান্না করছে। কার বুকে আছে তার ও হুস নেই তার।

কাব্যর চোখ দুটো দিয়ে যেনো আগুন বেরুচ্ছে। তার মাথায় খুন চেপে গেছে। সামনে থাকা মানুষ টাকে এই মুহূর্তে খুন না করলে সে কিছুতেই শান্তি পাবে না।
হিয়াকে ইশারাতে তিথীকে ধরতে বলে তিথীকে তার বুক থেকে সরিয়ে দিয়ে আক্রমণ করে রনির উপর।
এলোপাতাড়ি ভাবে মারতে থাকে রনিকে। রনির ঠোঁট কেটে অনেক আগেই রক্ত পড়া শুরু হয়। এখন তো সারা মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে।
রনির হাত টা উল্টো দিকে এমন ভাবে ধরে যেনো এক্ষুনি ভেঙে যাবে।
রনি কিছু বলতে চাইছে কিন্তু সেই সুযোগ আর দিচ্ছে না কাব্য। পুরো পাগল হয়ে গেছে সে।

কু* ত্তা*র বাচ্চা। খুন করে ফেলবো তোকে। যাকে প্রজাতির মতো আগলে রেখেছি আমি, কোন সাহসে ওর দিকে হাত বাড়াস তুই। বলেই হাত টা আরো চেপে ধরে। কিছু বলবে রনি, ব্যথার চোটে আর বলতে পারে না।
এই নোংরা চোখ দিয়ে তাকিয়েছিস তুই তিথীর দিকে? এই চোখ ই আমি তোলে ফেলবো।

অবস্থা বেগতিক দেখে হিয়া তিথীকে দাঁড় করিয়ে রেখে শাহানারা বেগম আর তানিয়া বেগম কে ডাকতে যায়। ওদের এদিকে এভাবে দৌঁড়ে আসতে দেখে কয়েকজন পিছু পিছু আসে তাদের।

শাহানারা বেগম কাব্য কে এভাবে দেখে সরাতে নেয় ওকে।
ছাড় কাব্য, মরে যাবে ও।

মেরেই ফেলবো ওকে।

এদিকে তানিয়া বেগম কে দেখে তিথী মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। তানিয়া বেগম মেয়েকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে।

কায়েস, অর্না এসে দুজন দুদিক থেকে ধরে কাব্য কে। কায়েস বলে পাগল হয়ে গেছিস তুই? ছাড় ওকে। মরে যাবে।

ছেড়ে দিয়ে বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ পাগল হয়ে গেছি আমি। ওর সাহস কি করে হয় তিথীর দিকে নোংরা চোখে তাকানোর।

এদিকে বিয়ে বাড়ির প্রায় সব মানুষ ই জড়ো হয় এখানে। তমা এসে জড়িয়ে ধরে তিথীকে। আবির এসে কাব্য কে ঠান্ডা করার চেষ্টা করে।

রনির মা বাবা ও এসে হাজির হয়। ছেলে কে এই অবস্থায় দেখে রনির মা কাব্য কে কড়া কথা শুনাতে থাকে।
কাব্য উলটে ক্ষেপে গিয়ে বলে তার ছেলে কি কুকির্তি করতে চেয়েছিলো।

রনির মা রেহানা বেগম বলে, আমার ছেলে ভুল কি করেছে? কি*ড*ন্যা*পা*র রা ৫ দিন আটকে রেখেছিলো কি এমনি এমনি? আর আমার ছেলে কিছু কিরলেই দোষ? এ মেয়ের কেচ্ছা সবাই জানে, সবাই বলাবলি করে এসব। এ মেয়ের জন্য আমরা মানুষের কাছে মুখ দেখাতে পারি না।

রেহানা বেগম এর কথা শুনে সবাই চরম লেভেলের অবাক হয়। রনির বাবা বলে, কি বলছো তুমি এসব? মাথা ঠিক আছে তোমার? তুমি আমাদের মেয়ে সম্পর্কে এরকম বাজে কথা কি করে বলছো?

তিথীর নানু রেহানা বেগম কে কড়া কথা শুনায়। এতে উনি দমে যায়নি।

ভুল কি বলেছি? এই মেয়েকে তো জীবনে বিয়ে দিতে পারবে না।লোকে সারাক্ষণ ই আড়ালে বলে, ওকে তো আর এমনি এমনি ছেড়ে দেয়নি।

রনির বাবা বলে, যেমন মা তেমন ই তার ছেলে।

কাব্য চেঁচিয়ে বলে, আমি তিথীকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলাম। আর কেউ যদি একটা নোংরা কথা বলে তিথীর নামে আমি এখানে রক্তের বন্যা বইয়ে দিবো।

দুই একজন ছাড়া কাব্যর কথায় সবাই অবাক হয়। সবাই কানাঘুষা করতে থাকে। কাব্য রেহানা বেগম কে বলে আপনার আর আপনার ছেলের কপাল ভালো ও এখনো বেঁচে আছে।

তারেক রহমান আর তানিয়া বেগম কে উদ্দেশ্য করে বলে, এই মুহূর্তে তিথীকে বিয়ে করবো আমি।

অবাক হয় তানিয়া বেগম। কি বলছিস এসব? এখন কি করে সম্ভব? তাছাড়া তিথীর বয়স ও হয়নি বিয়ের।

এতো কিছু শুনতে চাই না আমি। আমার তিথীকে চাই, আর এখন, এই মুহুর্তে। আমি ওকে নিয়ে আর কোনো রিস্ক নিতে চাই না। যা কিছুদিন পর হতো তা এখন হবে।
শাহানারা বেগম কায়েস কাব্য কে বুঝাতে চাইছে, কিন্তু সে বুঝতে নারাজ।
আর কিছু শুনতে চাই না, তোমার বিয়ের আয়োজন করো, আমি বাইরে আছি। বলেই সে বাইরে বেরিয়ে যায়।

তিথী কে কি*ড*ন্যা*প করার কাহিনি কারণ সহ সবটা সবাইকে বলে আবির।

কিন্তু আবির নিজেও অবাক কাব্য তিথীকে বিয়ের কথা বলাতে।

কাব্য বাইরে বসে আছে,তাকে ঘিরে আছে তার সব বন্ধুরা। একপাশে দাঁড়িয়ে আছে মোহনা। সবটা সবার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আবির আসে সেখানে। আবিরের মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে, যা কদিন পর হবে তা আজ হচ্ছে, সমস্যা কি তাতে। তার মানে…..

কাব্যর পাশে বসে কাব্যর পিঠে হাত রেখে বলে, তিথী ই কি তোর পুতুল বউ?
কাব্য শুধু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।

মোহনার আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা নেই। তার পক্ষে সম্ভব না এখানে দাঁড়িয়ে কাব্যর বিয়ে দেখার।

বিয়ের আয়োজন বলতে তেমন কিছু ই না। তমা আবিরের বিয়ে হয়ে গেছে। তিথী কিছুতেই রাজি হচ্ছে না বিয়ে করতে। যেই কাব্য তাকে তুলে নিয়ে গেছিলো সেই কাব্য কে কিভাবে সে ক্ষমা করবে? যার জন্য পদে পদে তার হেনস্তা হতে হচ্ছে সে কিছুতেই তাকে বিয়ে করবে না।

।#মন_গহীনে

#পর্বঃ১৬

#দোলন_আফরোজ

খাটের উপর বসে আছে তিথী। কোনো নড়চড় নাই, মনে হচ্ছে মানুষ না, কোনো পাথর বসে আছে। তার পাশেই বসে আছে হিয়া। হাজার টা কথা বলছে হিয়া, তার কোনো উত্তর ই দিচ্ছে না সে, চোখ দিয়ে পানিও পড়ছে না। শুধু ভাবছে ওর বাবা মা কিভাবে ওর সাথে এটা করতে পারলো। কোনো দিন ও আর ওদের মুখ দেখবে না সে, আর না কাব্য কে কখনো মেনে নিবে। যার জন্য তার সুন্দর হাসিখুশি জীবন টা পদে পদে নরক যন্ত্রণা ভোগ করেছে, লোকের বাঁকা চোখে তাকানো দেখেছে, তাকে দেখলেই লোকেরা নিজেদের মধ্যে কানাঘুষা শুরু করেছে কোনো দিন ও সে তাকে ক্ষমা করবে না।
কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা টা তার পুরো জীবন পালটে দিয়েছে নিমিষেই। চোখ দুটো বন্ধ করে ভাবতে থাকে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা গুলো।

তখন কাব্য ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর সে বার বার করে বলেছে আমি কিছুতেই ওই ভিলেন টা কে বিয়ে করবো না, আর না ক্ষমা করতে পারবো ওকে কোনো দিন। আমি শুধু এতোদিন চুপ করে ছিলাম আপুটির কথা ভেবে, এখন তো আর সেই চিন্তা নেই। আপুটির তো বিয়ে হয়ে গেছে, ওই ভিলেন টা চাইলেও আর কিছু করতে পারবে না।
আমি কোনো দিন করবো না ওকে বিয়ে।
তানিয়া বেগম শাহানারা বেগম অনেক বুঝিয়েছে, কোনো কাজ হয়নি। তখন শাহানারা বেগম ছুটে যান ছেলের কাছে।

একটু বুঝার চেষ্টা কর বাবা, একটু সময় দে তিথীকে। সে কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না।

সময় দেয়ার সময় টাই যে আমার নাই মা। আমি আর কোনো রিস্ক নিতে চাই না ওকে নিয়ে। ওর ভালো মন্দ যা হবে সবটা আমার সাথে থেকেই হবে। ওর রাজি হওয়ার দরকার নাই, জোর করেই বিয়ে করবো আমি।

এতে কিন্তু ভালোর চেয়ে খারাপ টাই বেশি হবে।

হলে হবে, আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে সবটা ঠিক করে দিবো, তবু আর একা ছাড়ছি না। বলেই উঠে তিথীর কাছে যায়।

তিথী এখনো মাকে জড়িয়ে ধরে আছে আর বার বার বলছে,আম্মু আমি ওই কাবির সিং কে বিয়ে করবো না। প্লিজ আম্মু মেরে ফেলো আমায়, তবু বিয়ে দিও না।

তানিয়া বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। সোনা মেয়ে আমার, তুই কাব্য কে ভুল বুঝছিস। কাব্য মানুষ টা খুব ভালো, হুম তোর সাথে খুব অন্যায় করেছে।আমি তার শাস্তি ও দিয়েছি ওকে। তোকে অনেক ভালো রাখবে, অনেক ভালোবাসবে মা।

চাই না আমার ওই খারাপ লোক টার ভালোবাসা। আমি বিয়ে করবো না আম্মু।

না মা, কাব্য খারাপ না। তোর ও কিছু ভুল ছিলো আর তার ই বিপরীতে সে অনেক বড় অন্যায় করেছে, তার শাস্তি পেয়েছে।আর এভাবে তোকে বার বার হেনস্তা হতে হবে, যা আমি কিছুতেই হতে দিবো না।

আচ্ছা ঠিক আছে, আমাকে নিয়ে তোমাদের চিন্তা করতে হবে না। মুখ তুলে দুইহাতে চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়িয়ে, মরে যাবো আমি তবু বিয়ে করবো না ওকে। বলেই দৌঁড় লাগায় বাইরের দিকে।

তখনই কাব্য ধরে ফেলে ওকে।কোথায় যাচ্ছো হ্যাঁ?

হাত মোচড়াতে মোচড়াতে, হাত ছাড়ুন আমার। খু*ন করে ফেলবো কিন্তু!

খু* ন হতেই চাইছি আমি। যা খুশী করো, তবে সবটা আমার সাথে থেকেই।

কোনোদিন ও বিয়ে করবো না আপনাকে। মরে যাবো তবুও না।

এক টানে তিথীকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে, চোখে চোখ রেখে, বলেছি না যা খুশী করো, তবে সবটা আমার সাথে থেকে। মরবে বলছো? বেশ, দুজন এক সাথেই মরবো। বলেই কোলে তুলে নেয় তিথীকে।
তানিয়া বেগম কে বলে, আর রেডি হওয়ার দরকার নাই, এভাবেই বিয়ে করবো। চাচাকে বলো সব রেডি করতে। বলে তিথীকে নিয়ে বাইরে আসে।

এদিকে তিথী ছুটার জন্য ছটফট করছে, কাব্যর ঘাড়ে গলায় ওর নখ বসিয়ে দিয়েছে। এতে কাব্যর কোনো হেলদোল নেই।

কাজি এসেছে বিয়ে পড়াতে, তারেক রহমান বলেন আর কিছুটা সময় দিই আমরা তিথীকে।

কাব্য বলে এখন আর সময় দেয়ার সময় নেই। পরিস্থিতি এমনিতেই বিগড়ে গেছে,এর চেয়ে খারাপ হোক তা আমি চাই না।তারপর আর কেউ কোনো কথা বলেনি। তিথীর না টা শুনেনি ওর আব্বু আম্মু। তখন থেকেই তিথী পাথর হয়ে গেছে। আর কোনো ছটফট নাই, কান্না ও করেনি আর। এমনকি চোখ দিয়ে দু ফোটা পানি ও পরেনি।

এভাবেই বিয়েটা হয়ে যায়। মেয়ে বিদায়ের সময় তানিয়া বেগম কয়েকবার সেন্সলেস হয়ে যান, আজ যে উনার ঘর খালি। দুই মেয়ের বিদায় ই এক সাথে হচ্ছে।
তমা মা বাবা কে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদছে। তারেক রহমান এর বুক টা ফেটে যাচ্ছে। মেয়ে দুটো যে উনার কলিজার টুকরা। তমা টা সব সময় লক্ষি মন্ত মেয়ে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দোয়া করে দেন আর সবাইকে আগলে রাখার পরামর্শ দেন।
আবিরের হাত ধরে তার হাতে তমাকে দিয়ে বলে, বাবা তমা আমার বরাবর ই লাজুক মেয়ে, কোনো দিন মুখ ফুটে কিচ্ছুটি চায়নি আমার কাছে, তবু তাদের কোনো অভাব রাখিনি আমি। আমি জানি সে তার সবটা দিয়ে তোমাদের ভালো রাখার চেষ্টা করবে, ওকে বুঝার চেষ্টা করো বাবা। ওর কোনো ব্যবহার এ খারাপ লাগলে বুঝিয়ে বলো, সে শুধরে নেয়ার চেষ্টা করবে।

আপনি কোনো চিন্তা করবেন না বাবা, হয়তো আপনার মতো ভালো রাখতে পারবো না, তবে আমি তাকে আমার ছোট্ট সাম্রাজ্যের রাণী করে রাখবো।

এদিকে তিথী এখনো পাথর হয়েই বসে আছে। তমা ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, তবু হু হা শব্দ পর্যন্ত করেনি। নড়েনি পর্যন্ত।

তানিয়া বেগম মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন। তিথী ধরেনি পর্যন্ত। তানিয়া বেগম এর কলিজাটা যেনো কেউ ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ পেরে কান্না করছে। তোর ভালোর জন্য করেছিরে মা, আজ না বুঝলেও একদিন ঠিক বুঝবি।তবুও তিথী কোনো শব্দ করেনি।

কাব্য দের ও যাওয়ার সময় হয়ে গেছে, শাহানারা বেগম আর হিয়া তিথীকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তিথী যেনো নিজের মাঝেই নেই।তারেক রহমান মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন আর বলছেন, আজ যে তোর ও বিদায় হয়ে যাবে তাও এভাবে, ভাবতেও পারিনি।

তিথীর হাত টা কাব্যর হাতে দিয়ে, বাবা আমার এর মেয়েটা খুবই জেদি, কিন্তু মনটা ভিষণ নরম, ও সংসার করা বুঝে না বাবা, হয়তো খুব জ্বালাবে তোমায়, কিন্তু দেখো যদি ভালোবাসতে পারে তোমায় তবে তার সবটা দিয়ে ভালোবাসবে। মেয়েটা আমার ভিষণ আদরের, হুটহাট এটা সেটা আবদার করে বসে, বিরক্ত হয়ো না বাবা। আগলে রেখো ওকে।

আমার আমিটাকে নিয়ে যাচ্ছি চাচা, জীবন দিয়ে আগলে রাখবো। কথা দিচ্ছি ওর সব পাগলামি হবে আমাকে ঘিরে, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।
বলে গাড়িতে উঠে যায় ।

তারেক রহমান শাহানারা বেগম এর হাত ধরে বলে, তিথীকে নিয়ে আমার অনেক চিন্তা ভাবি, ওর ভুল গুলো ক্ষমার চোখে দেখবেন।

আপনি কোনো চিন্তা করবেন না ভাই। কাব্য যেমন আপনাদের ছেলে, তিথী ও তো তেমনি আমার মেয়ে। আমার মেয়েকে আমি আগলে রাখবো।

****************

কাব্য ঘরে আসতেই হিয়া উঠে চলে যায়। তিথী এখনো ওভাবেই আছে, চোখ বুজে। কাব্য এসে ওর পাশে বসে। তখন শাহানারা বেগম খাবার হাতে ভিতরে আসেন।

মেয়েটা বিয়ে বাড়িতেও খায়নি, আসার পর থেকেই বলছি,খাবার নিয়েও এসেছিলাম,খায়নি।দেখ তুই কিছু খাওয়াতে পারিস কিনা। বলে খাবার দিয়ে উনি চলে যান।

কেনো কথা শুনছো না? বলে হাত দুটো ধরতে গেলে ছিটকে দূরে সরে যায় তিথী। প্রায় কয়েক ঘন্টা পর সে নড়লো।

একদম কাছে আসবেন না আমার। কাছে ঘেষার চেষ্টা ভুলেও করবেন না। কোনো দিন ও মেনে নিতে পারবো না আপনাকে আমি। জুতো মেরে গরু দান করতে এসেছেন। নিজেই আমায় অপবাদ দিয়ে আবার ওই অপবাদ ঘুচানোর জন্য আমার এতো টেককেয়ার করলেন এই কতোদিন আর এখন বিয়েও করেনিলেন?

কাব্য তিথীর সামনে হাটু গেড়ে বসে ওর হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বলে, আমার চোখের দিকে তাকাও।
শুধু কি আমার অপরাধ আর অপরাধ বোধ টাই দেখতে পাচ্ছো? এ চোখে কি সত্যিই কোনোদিন ভালোবাসা দেখতে পাওনি?

কিছুক্ষণ হাত ছাড়ানোর জন্য ছটফট করে,হঠাৎ ই থেমে যায় তিথী। কি জানি আছে এই দুটো চোখে। আগে কখনো সে অমন ভাবে তাকায়নি এই চোখ দুটোতে। খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে কাব্য কে। কিন্তু নাহ, তা করলে তো হবে।
কিচ্ছু দেখতে পাইনা আমি, আর দেখতে চাই ও না।
ছাড়ুন আমায়। বলেই এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নেয়।

আচ্ছা কিচ্ছু দেখতে হবে না। খাওনি কেনো?

খাবো না আমি।

এখন কিন্তু আমি রাগ করবো। বকবো খুব। আর মারতেও পারি,হুম।

আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না তিথী। অনেকক্ষণের আটকে রাখা কান্নাটা ছেড়ে দেয় সে। হুম, তাই তো করবেন। এসব শাস্তি দেয়ার জন্য ই তো বিয়ে করেছেন আমাকে। জানি না আমি এসব। আপনি খুব খারাপ, খুব বাজে লোক।আমি থাকবো না এখানে, চলে যাবো। আব্বু আম্মুর কাছেও যাবো না। অনেক দূরে কোথাও চলে যাবো।

তৎক্ষনাৎ তিথীকে বুকে জড়িয়ে নেয় কাব্য। কোথাও যেতে দেয়ার জন্য ই কি এতো বছর এই বুকে আগলে রেখেছি তোমায়।

অবাক হয়ে তাকায় তিথী। এতো বছর মানে?

সব জানবে, আগে লক্ষি মেয়ের মতো খেয়ে নাও,বলে খাবার এর প্লেট থেকে খাবার নিয়ে তিথীর সামনে ধরে।
প্রথম কয়েকবার না করে বাধ্য হয়েই খাবার মুখে নেয় তিথী। কিন্তু দুই লোকমা খেয়ে আর খেতে পারে না,গলা দিয়ে খাবার নামে না।একদম ই পছন্দ করে না সে কাব্য কে। কিন্তু কাছে এলে কি যেনো হয়ে যায়, দূরে সরাতে পারে না, না চাইতেও কেনো যেনো কাব্যর সব কথা শুনে সে।

তিথীর এঁটো খাবার টা কাব্য খেয়ে নেয় অনায়াসেই। তিথী আরেক দফা অবাক হয় তাতে।
কাব্য সেদিকে পাত্তা না দিয়ে এক মনে খেয়েই যাচ্ছে।খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে এসে তিথীর সামনে কয়েক টা প্যাকেট ধরে বলে, এগুলোতে তোমার জন্য কিছু জামা কাপড় আছে,ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে এসে ঘুমিয়ে যাও।

তিথীর মনে হয় সে কেনো কাব্যর সব কথা শুনছে? মোটেও শুনবে না সে এই বদ লোকটার কথা। তাই সে বলে, ড্রেস চেঞ্জ করবো না আমি। ঘুমাবো এখন। আপনি যান এখান থেকে।

কাব্য অবাক হয়ে তাকায়। কোথায় যাবো আমি?

কেনো? আপনাদের বাসায় কি আর রুম নেই?

থাকবে না কেনো? আছে তো।

তবে ওখানেই যান।

এটা আমার ঘর, আর আমি আমার ঘর ছাড়া অন্য কোথাও ঘুমাতে পারি না।

তবে আমাকেই আরেক টা ঘর দেখিয়ে দিন।

বললেই হলো? আমার বউ,আমার ঘরেই থাকবে আর আমার সাথেই থাকবে। চুপচাপ শুয়ে পরো।

বউ কথাটা শুনে তিথীর সারা শরীর কেমন যেনো করে উঠলো। ভালো লাগা নাকি খারাপ লাগা বুঝতে পারছে না সে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ শুয়ে পরে ।

কিন্তু সমস্যা বাধে যখন কাব্য শুতে আসে। আ আপ আপনি এখানে কেনো?

তো কোথায় থাকবো আমি?

অন্য কোথাও।

হ্যালো ম্যাম, হিন্দি সিরিয়াল এর মতো আমার রুমে কোনো সোফা কিংবা ডিভান নেই, তাই আমার এখানেই ঘুমাতে হবে।বলেই সে শুয়ে পরে।

তিথী খাটের এক কোণে চুপটি মেরে বসে আছে। তা বুঝতে পেরে কাব্য বলে আমাদের বাসায় কিন্তু মাঝরাতে ভুতের আনাগোনা হয়। আর কিছুক্ষণ বসে থাকো, দেখা পেয়ে যাবে তাদের।বলেই কাথা দিয়ে মুখ ঢেকে ঘুমের ভাব ধরে।

তিথী কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে থেকে কাব্য অনেকটাই কাছ ঘেঁষে শুয়ে পরে। কাল রাতেও ঘুম হয়নি,তাই কিছুক্ষণের মাঝেই ঘুমের রাজ্যে পারি দেয় সে।

এদিকে কাব্যর চোখে ঘুম নেই, তার প্রেয়সী, তার পুতুল বউ, যাকে এতো গুলো বছর মন গহীনে লুকিয়ে রেখেছিলো, নিজের মতো করে কল্পনার রঙে রাংগিয়েছিলো সে আজ সত্যিই তার বউ, তার ছোট্ট পুতুল বউ।
ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় কি অমায়িক লাগছে তিথীকে।কাব্য তার গালে বুড়ো আংগুল বুলাতে থাকে। তুমি আমার কল্পনার থেকেও সুন্দর পুতুল বউ।

তিথীকে দেখতে দেখতেই সেই ১৬/১৭ বছর আগে ফিরে যায় সে।তানিয়া বেগম হস্পিটালে ভর্তি, কাব্য শাহানারা বেগম এর সাথে গেছে উনাকে দেখতে। তখন কাব্য কোলে তুলে দেয় ছোট্ট তিথীকে, যার বয়স মাত্র দুদিন।
কাব্য সানন্দে ছোট্ট তিথীকে কোলে তুলে নেয়। ওর ৮ বছরের ছোট হাত দিয়ে তিথীর ২ দিনের ছোট্ট হাত গুলো দেখতে থাকে। পা টাও যে বেশ ছোট, একদম পুতুল এর মতো।তখনই সে বলে মা মা এটা কি আমার পুতুল?

তখন শাহানারা বেগম হাসতে হাসতে বলে, হ্যাঁ বাবা এটা তোর পুতুল। চাচী তোর জন্য একটা পুতুল এনেছে।
সেদিন থেকেই এই ছোট্ট পুতুল কে নিয়েই কাব্যর খেলা করা। স্কুল ছুটির পর সারাক্ষণ এই তিথী কে নিয়েই পরে থাকতো। সেও কোলে নিতে পারতো না ঠিক মতো, বেশি সময় শুয়িয়েই খেলা করতো।

তিথীর তখন ৭ মাস বয়স, একটু একটু বসতে পারে, তখন একদিন তিথী শাহানারা বেগম এর কাছে। শাহানারা বেগম ছোট্ট তিথীকে ওড়না পেচিয়ে শাড়ী পড়িয়ে দেয়। তখন কাব্য বলে, মা ওকে কি বউ সাজিয়েছো?

শাহানারা বেগম জবাব দেন, হুম ছোট্ট একটা পুতুল বউ সাজিয়েছি। সেই থেকেই কাব্য বলে, এটা আমার পুতুল বউ। আর তখন থেকেই শুরু হয় তার পুতুল বউ নিয়ে পাগলামি।

সময়ের বিবর্তনে সবাই হয়তো ভেবেছে কাব্য সব ভুলে যাবে, কিন্তু তার ছোট্ট মস্তিষ্ক তো এটা মেনে নিয়েছে তার একটা পুতুল বউ আছে, আর তাই সে বুকের মাঝে ধারণ করে নিয়ে বসে আছে। যখন বড় হয়েছে, বুঝতে শিখেছে তখন পুতুল বউ এর প্রতি সেই টান তার ভালোবাসায় রুপ নেয়। আর নিজের কল্পনায় পুতুল বউ কে সাজিয়ে সে স্বপ্ন বুনতে শুরু করে।এসব ভাবতে ভাবতেই তার অধর কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠে।

কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয় তিথীর সাথে তার প্রথম দেখা হওয়া। কি একটা বাজে পরিস্থিতি তৈরী করে সে। এটার জন্য কি তার পুতুল বউ কখনো তাকে ক্ষমা করতে পারবে? একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে।বুকের ভিতর টা চিনচিন করে উঠে। তিথীর গালে দুহাত রেখে, কবে ভালোবাসবে তুমি আমায়? কবে আমার এই তৃষ্ণার্ত হৃদয় শান্ত করবে তুমি? আর কতো পুড়াবে আমায়। বলে তিথীর কপালে চুমু খেয়ে বেলকনিতে চলে যায়।
একটা সিগারেট ধরায় সে। সিগারেট এর ধোঁয়া গুলো আকাশে ছেড়ে ভাবতে থাকে, তোমায় এতোটা কাছে পেয়েও কাছে যেতে পারছি না আমি, সব ভুলে প্লিজ আমায় আপন করে নাও না।

ঘন্টা খানিক বেলকনিতে থেকে আবার এসে শুয়ে পরে তিথীকে জড়িয়ে ধরে। তিথী গভীর ঘুমে আছে, তাই কিচ্ছুটি টের পায়নি।
কখন যেনো কাব্য ও চোখ লেগে যায়। তিথীকে বুকে নিয়ে পরম শান্তি পাচ্ছে সে, তাই ঘুম আসতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।

কাব্য হঠাৎ ঘুম ভাংগে তিথীর নড়াচড়াতে, কেমন যেনো হাসফাস করছে তিথী। আর বড় বড় করে নিশ্বাস ও নিচ্ছে। কাব্য দ্রুত রুমের লাইট অন করে দেয়। তিথীর কাছে গিয়ে তিথীকে উঠিয়ে বসিয়ে দেয়। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তিথীর। কাব্য এসি অফ করে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে রুমের সব দরজা জানালা খুলে দেয়।
দৌঁড়ে এক গ্লাস পানি এনে দেয় তিথীকে। পানি খেয়ে তিথী বড়ো বড়ো করে দম নিতে থাকে। এভাবে প্রায় ১০ মিনিট পর তিথী কিছুটা স্বাভাবিক হয়। তখন কাব্য জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে তোমার? এমন শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল কেনো?

তিথী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, আপনি সিগারেট খেয়েছিলেন?

কাব্য উপর নিচ মাথা নাড়ে।

সিগারেট এর গন্ধে আমার এলার্জি আছে। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায় আমার।

কাব্য নিজের খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। আর এই সিগারেট খেয়ে এসেই সে তিথীকে এভাবে জড়িয়ে ধরেছিলো।
শুয়ে পরো তুমি, বলে ওয়াশরুমে ঢুকে যায় সে। এই মধ্য রাতে আবার শাওয়ার নিয়ে এসে দেখে তিথী এখনো বিছানায় বসে আছে।



চলবে…
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here