রংধনুর মিল পর্ব -০৮

#রংধনুর_মিল
#পর্বঃ০৮
#মাহিয়া_মুন

পরিবেশ থমথমে, গুমোট ভাবটা যেন পর্যায়ক্রমে বেড়েই চলছে। এই অবস্থা স্বাভাবিক ভাবেই ঝড় তুফান আসার পূর্ব সংকেত হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। এই মুহূর্তেও ঠিক তাই। ঝড় তুফান আসার পূর্ব সংকেত চলছে ঠিকই, তবে তা প্রকৃতিতে নয়।
নুজহাত দের ড্রয়িং রুমে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। বাড়ির সকলে গম্ভীর হয়ে নুজহাতের দিকে তাকিয়ে আছে। সোফার এক কোণায় গুটিসুটি মেরে অবিরত কান্না করে যাচ্ছে নুজহাত। গালে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ স্পষ্ট হয়ে আছে। তার কাধেই শান্তনা দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত রেখে বসে আছে তাকিয়া। সবার এমন থমথমে ভাব দেখে সেও কিছুটা ভয় পাচ্ছে। মেয়েটা কে বারবার বারণ করেছিলো এভাবে যখন তখন রাফির সাথে দেখা সাক্ষাত না করতে। এখন নিজে তো ফেঁসেছে সাথে তাকেও ফাসিঁয়েছে। আজ বাসায় গেলে যে তার মাও তার খবর করে ছাড়বে এতে কোনও সন্দেহ নেই।
নীরবতা ভেঙে মিসেস নাহার রেগে উচ্চস্বরে বলে উঠলেন,
“বিশ্বাস কাঁচের মতো। একবার ভেঙে গেলে তা আর জোড়া লাগে নাহ। এই মেয়ে একবার বিশ্বাস ভাঙার পরও তাকে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই মেয়ে তো উঠে পড়ে লেগেছে আমাদের মান সম্মান খাওয়ার তাড়নায়। একটা ছেলের সাথে নির্জন রাস্তায় ছি। আজ মনে হচ্ছে একে জন্ম দেওয়াই হয়তো জীবনের সবথেকে বড় ভুল হয়েছে।”
এই বলে মিসেস নাহার থামতেই তার হাতের মুঠোয় থাকা ফোন বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই মিসেস নাহারের রাগ যেন সপ্তম আকাশে উঠলো। চোখের পলকেই মেঝেতে আছড়ে ফেললো ফোনটি।
রাগে গজগজ করতে করতে নুজহাতের সামনে গিয়ে বলে উঠলো,
“দেখ, তোর কু কীর্তি আমার কানে পৌঁছানোর আগে স্কুলের ম্যাডাম দের কানে ঠিকই পৌঁছে গেছে। তারা কল দিয়ে এখন মজা নেওয়ার তাড়নায় আছে। তোকে আজ মেরে ফেললেও আমার শান্তি হবে নাহ।”
এই বলে পূনরায় থাপ্পড় মারলেন নুজহাতের গালে। তাকিয়া ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে। তবুও দ্রুত মিসেস নাহারকে থামাতে বলে উঠলো,
“মণি কি করছো।”
“তুই থাম। সেই ছোটো থেকে তুই আবিদ আর এই মেয়ে বন্ধু। আবিদ তো চলে গেছে। তুই তো এর সাথেই ছিলি। এর করা কু কীর্তি গুলো আমাদের একবার জানাতে পারলি নাহ। নাকি প্রশ্রয় দিয়েছিস ওকে। এর আগের বারের করা কথাগুলো ভুলে গেছিস। তখন তো ছোটো ছিলো কিন্তু এখন। এই মেয়ের জন্য প্রতিবার আমাদের সম্মান জলাঞ্জলি দিতে হচ্ছে। আমি আর এসব নিতে পারছি না।”
তাকিয়া কিছু না বলে মাথা নত করে ফেললো। সে আগে থেকেই ভেবেছিল যে ঘুরে ফিরে দোষ তাকে ঠিকই দেওয়া হবে। নুজহাত কি আর তাদের কথা শুনার মেয়ে। এখন নিজেরই রাগ উঠছে।
মিস্টার হাসান নিজের স্ত্রীর পানে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলে উঠলো,
“তুমি এভাবে রেগে যাচ্ছো কেন। শান্ত হয়ে বসো। এখন দেখ যা হওয়ার হয়ে তো গেছে। আমরা চাইলেই অতীত ঠিক করতে পারবো নাহ। এখন আমাদের বর্তমান কে গুছানোর চেষ্টা করতে হবে। যাতে করে ভবিষ্যত টা ভালো হয়। মেয়ের মতো নিজেও কি বিবেক বুদ্ধি হারিয়েছো।”
মিস্টার হাসানের শান্ত গলায় সকলেই অশান্ত হয়ে গেলো যেন। এই মুহূর্তেও এমন শান্ত থাকবে মিস্টার হাসান তা যেন সকলের ভাবনার বাহিরে ছিলো। নুজহাত অবাকের সাথে কিছুটা ভয়ও পেল। কারণ সে জানে যে তার বাবার শান্ত গলা মানেই ভয়ংকর কিছু। তার বাবা যে কি করতে চাইছে তা কিছুটা হলেও অনুমান করতে পারছে। অজান্তেই মানসপটে ভেসে উঠলো আজ সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া ঘটনাটি।
_________________________
আপন গতিতে বাইক চলছে অজানায়। রাফির কাঁধে হাত দিয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে নুজহাত। চারপাশে
লক্ষ্য করতেই নুজহাত বলে উঠলো,
“আরেহ এই রাস্তাটা তো নতুন হয়েছে। এখনো অনেক নির্জীব। এখানে আসলে কেন?”
রাফি মুচকি হেসে বলে উঠলো,
“কেনো নির্জন জায়গায় এখনও আমার সাথে আসতে ভয় পাচ্ছো তুমি।”
“আব…সেটা কখন বললাম। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে তুমি বাসার ওখানে দিয়ে আসো আমায়। পরে দেরী হলে বাবা মায়ের কাছে আবার নানারকম অজুহাত দিতে হবে।”
“একটু নাহয় দিলে, সমস্যা কি?”
“তুমি একটু বলছো। আজ চার বছর ধরে নানারকম অজুহাত, মিথ্যে তাদের বলেই আসছি।”
“নিজের মনের মানুষের জন্যইতো বলছো।”
এই বলে রাফি বাইক থামিয়ে রাস্তায় নেমে দাড়ালো। নুজহাত নিজেও নেমে চারদিক পরখ করতে লাগলো। রাস্তাটা নতুন তৈরি হয়েছে খাল ঘেঁষে। চারদিক সত্যিই খুব সুন্দর। তবে এই মুহূর্তে অনেকটাই নির্জীব।
রাফি নুজহাতের দিকে পলকহীন কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এই মেয়েটার সাথে যে তার সম্পর্ক এতো দীর্ঘ হবে তা কখনোই ভাবে নি। সত্যিই বিস্ময়কর। হয়তো তার কাছেই বিস্ময়কর মনে হচ্ছে।
নুজহাত রাফির সামনে চুটকি বাজিয়ে বলে উঠলো,
“কি হলো কি দেখছো?”
“এখানে তুমি ছাড়া তো আর কেউ নেই।”
“কেউ থাকলে বুঝি তাদের দিকে তাকাতে।”
“কেউ যাতে না থাকে সেই জন্যইতো এখানে আসলাম।”
“হায়রে।”
রাফি মুচকি হেসে নুজহাতের হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিল। চুড়িগুলো হাতের এদিক ওদিক করতে করতে বলে উঠলো,
“আমাদের সম্পর্ক কিন্তু অনেক সময় হয়েছে তাইনা।”
“কেনো তুমি কি আমাকে ছেড়ে দেওয়ার লক্ষ্যে সম্পর্কে জড়িয়েছিলে নাকি।”
“নাহ্ নাহ তানা। আন্টি আংকেল আমাদের সম্পর্কে রাজি হবে কি?”
“তাইতো বলছি দ্রুত চাকরী জোগাড় করো।”
“কেনো আমাকে কি বেকার অবস্থায় বিয়ে করবে নাহ।”
“তো বিয়ের পর আমাকে খাওয়াবে কি। একটা কথা জানো রাফি, অভাব আসলে ভালোবাসাও জানালা দিয়ে পালায়।”
রাফি মুচকি হেসে কিছু বলতে যাবে তার আগেই একজন গম্ভীর পুরুষ নালী কণ্ঠে দুজনেই পিছন ফিরে তাকালো। নুজহাত রাফির পিছনে তাকাতেই যাকে দেখলো তাতে ভয়ে শিরদাঁড়া শিরশির করে উঠলো। এই লোক এখানে।
পুলিশ মিস্টার মওদুদ আহমদ সরু চোখে নুজহাত এবং রাফির দিকে তাকিয়ে রইলো। নুজহাত কে সে চিনে। তার প্রিয় বন্ধু মিস্টার হাসান এর মেয়ে। এই নির্জীব রাস্তায় দুজন ছেলে মেয়েকে দেখে তিনি যা বুঝার বুঝে নিলেন। দুজনের উদ্দেশ্যে কিছু না বলে পকেট থেকে ফোন বের করে কারো কাছে কল দিল।
নুজহাত আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে রইলো। তার মন বলে দিচ্ছে যে আংকেল এখন কার কাছে কল দিচ্ছে। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে নাহ। এই একটাই সমস্যা তার। ভয় পেলে মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হতে চায় নাহ। এই মুহূর্তে তার বাবাও বাসায়। এখানে আসতে দশ মিনিট ও সময় লাগবে নাহ। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।
মিস্টার মওদুদ কথা বলা শেষে ফোন পকেটে রেখে নুজহাতের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
“কে এই ছেলে মামনি।”
নুজহাত আমতা আমতা করতে লাগলো। কি আশ্চর্য মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে নাহ কেনো। তবুও আমতা আমতা স্বরে বলে উঠলো,
“আন…আংকেল, ও আমার ফ্রেন্ড।”
“আমি কোন পেশায় আছি জানো তো মামনি।”
“জি আংকেল।”
“কেউ মিথ্যে বললে কিন্তু খুব সহজেই আমি বুঝতে পারি। ওকি তোমার বয়ফ্রেন্ড।”
নুজহাত আর কিছু না বলে মাথা নিচু করে ফেললো। রাফি বিরক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“হ্যা ও আমার গার্লফ্রেন্ড আংকেল। এতে আপনার সমস্যা টা কোথায়?”
“এতে সমস্যা নেই কিন্তু একটা মেয়েকে নিয়ে এমন নির্জন রাস্তায় নিশ্চয়ই তসবি গুনতে আসো নি।”
“এটা আমাদের ব্যাক্তিগত ব্যাপার। আপনি আমাদের ডাইরেক্টলি ব্লেইম করছেন।”
মিস্টার মওদুদ বাঁকা হেসে বলে উঠলেন,
“এখন তাহলে তোমার মত হাঁটুর বয়সী ছেলের থেকে এখন আমার ব্যাবহার শিখতে হবে।”
রাফি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। কারণ তাদের সামনেই নুজহাতের বাবা গাড়ি থেকে নেমে দাড়ালো। নুজহাত এবার ভয়ে কান্নাই করে দিলো। এভাবে সবটা সামনে চলে আসবে তা কল্পনাও করে নি। ভাবনার মাঝেই গালে সজোরে চড় পড়লো। তাল সামলাতে না পেরে রাস্তায় লুটিয়ে পড়লো।
মিস্টার হাসান রাফির দিকে অগ্নি চোখে তাকিয়ে রইলো। ইচ্ছে তো করছে এই ছেলেকে এই মুহুর্তে রাস্তায় পিষে ফেলতে। তবে আগে নিজের মেয়ের বিচার করে নিক। নুজহাতকে রাস্তা থেকে তুলে পুনরায় কষে থাপ্পড় মারলেন। মিস্টার মওদুদ দ্রুত বন্ধুকে থামিয়ে বলে উঠলেন,
“রাস্তায় এসব করো নাহ হাসান। বাসায় নিয়ে যাও ওকে।”
মিস্টার হাসান সম্মতি জানিয়ে নুজহাতের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো।
নুজহাত ব্যাকুল চোখে একবার পিছন ফিরে রাফির মুখটা দেখে নিল। বাড়িতে যে কি হতে যাচ্ছে তা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে।
_________________________________
রাতের শেষ প্রহর চলছে। লন্ডন এই সময়েও প্রায় আলোকিতই থাকে। অনেকে এই সময়েও নিজেদের সজাগ রাখে। নিজেদের মজুদ রাখে নানারকম ব্যাস্ততায়। কেউ আবার হয়তো নিজেদের ডুবিয়ে রাখে নানারকম ভাবনায়। অতীতের দুষ্টু মিষ্টি সময়ে।
ঠিক এইরকম ভাবেই কেউ একজন সুইমিং পুলের পানিতে পা ভিজিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে ডুবে আছে অতীতের দুষ্টু মিষ্টি, সুখ দুঃখ জড়িত ভাবনায়। থেকে থেকে দেখা যাচ্ছে ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা। আবার কিছুক্ষণ যেতেই তা এক নিমিষেই মিলিয়ে যায়। মুখ জুড়ে নেমে আসে মলিনতা। যেন মেঘে ঢাকা অন্ধকারে বিলিয়ে যাচ্ছে সে। প্রায় রাত গুলো এভাবেই কেটে যায় তার। এতো সুখ দুঃখ, অপেক্ষায় বিজড়িত স্মৃতি গুলো তাকে কিছুতেই ঘুমাতে দেয় নাহ।
কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই ভাবনা জগত থেকে কিয়ৎক্ষণ এর জন্য বিরতি নিল। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো তার প্রিয় বন্ধু শাওন ঘুম ঘুম চোখে বিরক্তি জড়িয়ে ফোন হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। ভ্রূ কুঁচকে ইশারায় বুঝালো,
“কি হয়েছে।”
শাওন রেগে বলে উঠলো,
“নিজের ভাবনায় ডুবার আগে আশেপাশে ফোনটা রাখিস অন্তত। নিজে ঘুমাবি না বলে কি আমার ঘুমকেও বিনাশ করার লক্ষ্যে আছিস নাকি।”
ছেলেটি তার ঠান্ডা শীতল কণ্ঠে উদাস মুখে বলে উঠলো,
” কেন আমার ফোন তোর ঘুমের কি করেছে।”
“তোর ভাবী আমার ফোন রেখে তোর ফোনে কল দিয়েছে। এতো রাতে ভাবীর সাথে কি কথা বলিস রে। লজ্জা লাগে নাহ তোর। ভাইকে শুইয়ে রেখে কিনা ভাবির সাথে কথা বলিস।”
ছেলেটি সরু চোখে শাওনের দিকে তাকিয়ে রইলো। ভাবী বলতে কাকে যে বুঝিয়েছে তা ঠিকই বুঝতে পারছে। শাওনের থেকে হেচকা টানে নিজের ফোনটি হাতে নিয়ে দেখতে পেলো তাকিয়ার কল। এতে কপালের ভাঁজ আরো দীর্ঘ হলো। এই সময়ে তাকিয়া কি বুঝে কল দিল। কারও কোনো বিপদ হলো নাতো।
*
*
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here