রংধনুর মিল পর্ব -০৭

#রংধনুর_মিল
#পর্বঃ০৭
#মাহিয়া_মুন

সূর্যের প্রখর রোদে ধরণী উত্তপ্ত। ধরণীর প্রতিটি প্রাণী হয়ে উঠেছে অতিষ্ঠ। জনজীবন থেকে থেকে পানির উপর হামলে পড়ছে। এই বছর গরম যেন পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ উত্তেজিত হয়ে ধরণীর বুকে নেমেছে। প্রতিজ্ঞা করে নেমেছে হয়তো, জনজীবন কে নাচিয়ে ছাড়বে।
ঢাকার জনবহুল রাস্তায় ধীর গতিতে সামনের দিকে আগাচ্ছে রিক্সাটি। এই গরমে যে রিক্সাওয়ালার খুব কষ্ট হচ্ছে তা পিছনে বসে থাকা মেয়েটি খুব করে উপলব্ধি করছে। তার কপাল বেয়েও অঝোর ধারায় গড়িয়ে পড়ছে ঘাম। মেয়েটি সামনে তাকিয়ে দেখলো সে প্রায় চলেই এসেছে। চারদিক একবার পরখ করে হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিল। রিক্সাওয়ালার দিকে বিনয়ী চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“চাচা এখানে রাখেন।”
রিক্সাওয়ালা রিক্সা থামিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“কেনো আফা মনি। আপনে না কইলেন সামনের পার্ক টার সামনে নামাইতাম।”
মেয়েটি রিক্সা থেকে নেমে হাসিমুখে বলে উঠলো,
“এখানে একটু কাজ পড়ে গেছে মামা।”
এই বলে মেয়েটি নিজের ব্যাগ থেকে পানির বোতল টি বের করে রিক্সাওয়ালা চাচার দিকে এগিয়ে দিয়ে পুনরায় বলে উঠলো,
“চাচা বোতল টা আপনার সাথে রাখেন। এখন যেই পরিমান গরম। পানিটা খেয়ে নিন।”
এই বলে মেয়েটি ভাড়া মিটিয়ে সেখান থেকে সামনের দিকে আগাতে লাগলো।
রিক্সাওয়ালা চাচা কৃতজ্ঞ চোখে মেয়েটির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো কিয়ৎক্ষণ। বোতলের ঢাকনা খুলে পানি খেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“আল্লাহ্ মেয়েটার ভালো কইরো।”
*
মেয়েটি হাঁটতে হাঁটতে পার্ক এর সামনে এসে দাঁড়ালো। চারদিকে পরখ করতেই কাঙ্খিত ব্যাক্তিকে পেয়ে গেল। পাশের ফুলের দোকান থেকে একগুচ্ছ গোলাপ কিনে সামনের দিকে আগাতে লাগলো।
ফোনে কারো সাথে বেশ হাসিমুখে কথা বলে চলেছে একটি ছেলে। কথা বলার ভাবভঙ্গি দেখলে নিঃসন্দেহে যে কেউ বলে দিবে যে ছেলেটি তার কোনো পছন্দের মানুষের সাথেই এভাবে হেসেখেলে কথা বলছে। ছেলেটি কথা বলে কল কেটে বামে ডানে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তখনি পিছন থেকে এক জোড়া হাত এসে তার চক্ষুদ্বয় নিজেদের মধ্যে আটক করে ফেললো। তবে এতে ছেলেটা না চমকে বেশ হাসি মুখে বলে উঠলো,
“নুজহাত….”
হ্যা নুজহাত। নুজহাত হাত সরিয়ে ছেলেটির সামনে এসে মুখ ফুলিয়ে বলে উঠলো,
“তুমি ভয় কেনো পাও নাহ। আর আমাকে চিনে ফেলো কিভাবে।”
ছেলেটি হেসে ফিসফিস কণ্ঠে বলে উঠলো,
“তোমার এই হাত জোড়া, তোমার শরীরের স্মেল যে আমার খুব করে চেনা।”
নুজহাত কিছুটা বিব্রত বোধ করলো, সেই সাথে লজ্জায় নুয়ে গেল। কথা ঘুরাতে বলে উঠলো,
“আসার সময় দেখলাম ফোনে কারো সাথে খুব হাসিমুখে কথা বলছিলে। কে ছিলো সে?”
ছেলেটি কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে উঠলো,
“আমাদের সম্পর্ক গড়িয়ে প্রায় চার বছরে পড়েছে। আর তুমি এখনও আমায় সন্দেহ করে যাচ্ছো।”
“নুজহাত দ্রুত না বোধক মাথা নাড়িয়ে বলে উঠলো,
“আরেহ আরেহ রেগে যাচ্ছো কেনো রাফি। আমিতো শুধু জানতে চাইলাম এতো হাসিমুখে কার সাথে কথা বলছিলে। আচ্ছা এসব কথা বাদ দেও। আজ নাহ তোমার ইন্টারভিউ দেওয়ার কথা ছিল, গিয়েছিলে কি?”
রাফি আমতা আমতা কণ্ঠে বলে উঠলো,
“গিয়েছিলাম তো। এবার দেখো এই চাকরীটা হয়েই যাবে।”
নুজহাত ক্লান্ত চোখে রাফির দিকে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থেকে রাফির কাধে নিজের মাথা রেখে বিরস কণ্ঠে বলে উঠলো,
“বলতে বলতে এবার আমার অনার্স শেষ হয়ে যাচ্ছে। তারপর হয়তো পরিবার থেকে বিয়ের চাপ দিবেই। চাকরীটা না হলে কীভাবে আমি তোমাকে তাদের সামনে নিয়ে যাবো।”
রাফি বিরক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“যেভাবে আমার সাথে প্রেম করছো ওভাবেই। আমিতো আর চাকরীটা ইচ্ছে করে হারাচ্ছি নাহ। ইন্টারভিউ দেই এখন না টিকলে আমি কি করবো। তাছাড়া ওরা যে পরিমাণ ঘুষ চায় তা দেওয়ার মত সামর্থ আমার কাছে নেই। যেহেতু আমার চাকরী নিয়ে তোমার এতো মাথা ব্যাথা, তাহলে তুমিই বরং টাকা টা দেও।”
নুজহাত কিছুক্ষন পলকহীন তাকিয়ে রইলো রাফির মুখপানে। ছেলেটার ব্যবহার দিন দিন যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। তাহলে কি তার প্রতি রাফির ভালোবাসা ফিকে হয়ে যাচ্ছে। তবে ভালোবাসা নাকি কখনো ফিকে হয় নাহ্। তাহলে এসব কি?
নুজহাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,
“আচ্ছা চলো কোথাও ঘুরে আসি।”
রাফিও আর অমত পোষণ করলো নাহ। *
*
সুর্যের আলো প্রায় হেলে পড়েছে চারদিকে। ঘুম ঘুম চোখে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তাকিয়া। কারেন্ট এর জ্বালায় ঠিক মত একটু ঘুমানোও দায় হয়ে পড়েছে। ওয়াশ রুম থেকে চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়ে পূনরায় এসে খাটের এক কোনায় বসলো। বিছানা হাতিয়ে বালিশ এর নিচ থেকে ফোনটি বের করে হাতে নিতেই দেখতে পেলো প্রায় অনেকগুলো কল উঠে আছে। কপাল কুঁচকে কল লিস্ট এ যেতেই দেখতে পেল একটি নাম জ্বলজ্বল করছে।
“দেওয়ান আবিদ।”
নামটি চোখে পড়তেই মনের অন্দরমহল থেকে নীরবে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। ভাবনা জুড়ে বিরাজ করতে লাগলো চার বছর আগের সেই কালো অতীত গুলো।
সেদিন নুজহাতের বাসা থেকে বের হয়ে আবিদ কোথায় যেন চলে গিয়েছিল। হঠাৎ করেই হাওয়া হয়ে যাওয়া। সবাই তো ভীষন কান্না কাটি জুড়ে দিয়েছিলো। আবিদের মাকে তো সামলানোই যাচ্ছিল নাহ। পুলিশ অনেক খোঁজ করেও কোনো সন্ধান পায় নি। এভাবে প্রায় কেটে গিয়েছিল দশ দশদিন। একদিন রাতে আবিদের বাবার ফোনে বিদেশি নম্বর থেকে কল আসে। কল টা ছিল আবিদের। আবিদ জানিয়েছিল যে সে এই মুহুর্তে লন্ডন আছে। আবিদ তার বাবা মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে আরও বলেছিল সে যদি বলে আসতো তাহলে তারা কিছুতেই তাকে সেখানে যেতে দিত নাহ। তার স্বপ্ন সে এখানে থেকেই পড়ালেখা শেষ করবে।
সেদিনের পর কিছুদিন খুব কেঁদেছিলো আবিদের বাবা মা। আবিদ কল এ শান্তনা দিয়েছিলো।
এভাবেই হঠাৎ করে আলাদা হয়ে গিয়েছিল আবিদ তাদের থেকে। সেই দিনগুলো তাকিয়ার কাছে কালো অতীত ই মনে হয়। আবিদ ভুলে গিয়েছিল তাদের বন্ধুত্বের শর্ত। কথা ছিলো কেউ কাউকে ছেড়ে যাবে নাহ। কিন্তু আবিদ সেটা করেছিল। অবশ্য তার সাথে যা হয়েছিল তাতে এরকম হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।
সেদিনের পর তাকিয়া চেয়েছিলো নুজহাত এর সাথেও বন্ধুত্ব টা ভেঙে দিবে। তবে আবিদ সেটা করতেও বারণ করেছিল। তাকে ফোন দিয়ে নুজহাতের সাথে আগের মতোই থাকতে বলেছিল। যাতে করে নুজহাত কোনো রকম কষ্ট না পায়। নুজহাত যদি তার বাম পাঁজরের হাড় দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে তাহলে সে অবশ্যই নুজহাতকে নিজের জীবন সঙ্গী হিসেবে পাবে। ধৈর্য্যের ফল মিষ্টিই হয়।
রিংটোনের আওয়াজে ভাবনা জগত থেকে বেড়িয়ে আসলো তাকিয়া। ভাবলো হয়তো আবিদই ফোন দিয়েছে। ফোনের দিকে তাকাতেই কিছুটা অবাক হলো।
এই সময়ে নুজহাত কেনো ফোন দিল। এখন তো রাফির সাথে থাকার কথা। ভাবনার গভীরে না গিয়ে দ্রুত কল রিসিভ করে কানের কাছে ধরতেই ফোনের অপর প্রান্ত থেকে নুজহাতের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো। তাকিয়া দ্রুত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“আরেহ আরেহ নুজু কি হইছে, কাদঁছিস কেনো। আরেহ বলবি তো।”
নুজহাত কান্নারত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“তুই এখন আমার বাসায় আয়।”
“এখন কিভাবে আসবো। আচ্ছা তুই শান্ত হ, আমি দেখি আসতে পারি কিনা। তোকে জানাচ্ছি পরে।”
*
*
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here