রংধনুর মিল পর্ব -০৬

#রংধনুর_মিল
#পর্বঃ০৬
#মাহিয়া_মুন

রজনী জুড়ে লাল আভার আনাগোনা। ধরণী জুড়ে চলছে সন্ধার আগ মুহূর্ত। পাখিরা দল বেঁধে নিজ নিজ নীড়ে ফিরে যাওয়ার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
ছাদের এক প্রান্তে গায়ে শাল জড়িয়ে দোলনায় বসে নীরব আকাশের দিকে এক মনে তাকিয়ে আছে আবিদ। হাতে কফির মগ জুড়ে থাকা কফি ঠান্ডা হয়েছে প্রায় অনেক্ষন। তবে সেদিকে খেয়াল নেই আবিদের। আজ চার দিন সে বাসার বাহিরে বের হচ্ছে নাহ। শরীরের তাপমাত্রা ছিল প্রচুর। একবার অসুখ করলে সহজে সুস্থ্য হয় নাহ সে। গত পরশু নুজহাত এবং তাকিয়া এসে দেখে গিয়েছিল তাকে। আজ সকালেও কথা হয়েছিল নুজহাতের সাথে। মেয়েটাকে হারানোর ভয় ভীষন করে ঝেঁকে বসেছে আবিদের মনে। কলেজ যাওয়ার পর থেকে রাফির করা কর্মকাণ্ড সবটাই অবলোকন করেছে আবিদ।
রাফি তার থেকেও দেখতে সুন্দর এটা সবাই বলবে। আর মানুষ বলতেই সৌন্দর্যের পূজারী। সেখানে নুজহাতের কাছে রাফি কে অপছন্দ হওয়ার কোনো যুক্তি নেই। নুজহাত আবিদের সামনে যতই না বলুক, নুজহাত যে রাফির প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে তা খুব করে বুঝা যায়। আগের বার নাহয় ছোটো ছিলো বলে খুব একটা ভয় ছিলো নাহ। তবে এবার তো আলাদা। যৌবনে পা রাখা একটি মেয়ে। এতটাও অবুঝ নয়। আজ কলেজে কি হয়েছে এখন অবধি কিছুই জানে নাহ আবিদ। ভাবলো তাকিয়াকে কল করে আজকের খবরটা জেনে নেওয়া যাক।
আবিদের ভাবনা কে সত্যি করে দিয়ে ফোন বেজে উঠলো। আবিদ ভাবনা জগত থেকে বেরিয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই দেখলো তাকিয়ার নামটি জ্বলজ্বল করছে। আনমনেই হালকা হেসে উঠলো আবিদ। মেয়েটির নাম মস্তিষ্ক ভাবতেই মেয়েটি কল দিল। বেঁচে থাকবে অনেকদিন। একেই হয়তো বলে বন্ধুত্বের টান।
আবিদ কল রিসিভ করে কানের কাছে ধরতেই শুনতে পেলো তাকিয়ার রাগান্বিত কন্ঠস্বর।
“গা*ধা, শ*য়*তা*ন তুই বাসায় কম্বলের নিচেই শুয়ে থাক। আর ওদিকে তোর প্রেয়সীকে অন্য কেউ নিয়ে যাক। আসিস আমার কাছে চোখের পানি ফেলতে। তোর চোখ আমি কাটা চামচ দিয়ে উঠিয়ে ফেলবো। এতো করে বলেছি আমি, নিজের মনের কথা বলে দে, বলে দে। আমার কথার পাত্তাই ছিলো নাহ। আইছে আমার,,,বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাবে। এখন যা হয়েছে বেশ হয়েছে । এবার বলিস,,, বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাবে।”
আবিদ চমকে কান থেকে ফোন সরিয়ে ফেললো। আর একটু হলে মনে হয় কানের পর্দাই ফেটে যেত। এতো জোরে কথাগুলো বলছিলো। বুকে ফুঁ দিয়ে তাকিয়ার কথাগুলো মস্তিষ্কে সাজাতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল। দ্রুত কানের কাছে ফোন নিয়ে বলে উঠলো,
“মানে,,,,আমায় বকিস পরে আগে কি হয়েছে বল।”
“মানে মানে কর এখন। এটাই তোর সাথে যায়। আমি কিচ্ছু বলবো নাহ তোকে।”
“দেখ মোটি। মাথা গরম করবি নাহ। কি হয়েছে ভালোভাবে বল।”
ফোনের ওপর প্রান্ত থেকে তাকিয়ার জোরে নিঃশ্বাস ফেলার আওয়াজ ভেসে আসলো। এক পর্যায়ে শুনতে পাওয়া গেলো তাকিয়ার কণ্ঠ।
“আজ আমার মামীরা এসেছিল। যার কারণে আমি নুজু কে বলেছি আমি কলেজ যাবো নাহ। ভেবেছিলাম যেহেতু তুই আমি নেই, নুজহাত ও যাবে নাহ। কারণ সেতো আমাদের ছাড়া কখনোই যায় নাহ। তবে তার গায়ে তো এখন পুনরায় প্রেমের হাওয়া লেগেছে। সে ঠিকই চলে গেছে কলেজে। আর রাফিও এই সুযোগ টাই কাজে লাগিয়েছে। আমাদের কাউকে নুজুর সাথে দেখতে না পেয়ে নুজু কে লাইব্রেরী তে ডেকে নিয়ে প্রপোজ করে দিয়েছে।”
আবিদের কপালে পড়া ভাঁজ গুলো নিমিষেই মিলিয়ে গেল। চোখ, মুখ একদমই স্থির হয়ে গেল। বুকের উপর যেন ভারী পাথর পড়েছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়ে পরছে। এই কয়দিন ধরে এই ভয়টাই পাচ্ছিলো। তাহলে কি মনের গহীনে থাকা ভয়টাই সত্যিই হলো।
ঢোক গিলে বলে উঠলো,
“নুজু কি বলেছে। নিশ্চই না করে দিয়েছে।”
অপর প্রান্তে তাকিয়া কিছুক্ষন চুপ রইলো। হয়তো পরবর্তী কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে।
“নাহ্। নুজহাত না করে নি। একটু আগে নুজহাত আমায় কল দিয়েছে। তখনই জানতে পেরেছি আজ রাফি তাকে প্রপোজ করেছে। তার কানে কুড়ি নম্বর গোলাপ টি গুঁজে দিয়েছে। সেও আর না করে নি। কারণ সে নাকি রাফির চোখে তার জন্যে অঢেল ভালোবাসা দেখেছে। আর এখন তারও একজন মনের মানুষ চাই। রাফিকেই এই জায়গাটা দিয়েছে সে। এরকমটাই বলেছে আমায়।”
আর কিছু শুনতে পেলো নাহ আবিদ। কারণ তার হাতের ফোনটি এই মুহুর্তে অবস্থান করছে ছাদের অন্য প্রান্তে। যা সে কয়েক সেকেন্ড আগেই ছুঁড়ে মেরেছে। রাগে পুরো শরীর কাঁপছে। কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে। আশেপাশে যা পাচ্ছে তাই এদিক ওদিক ছুঁড়ে মারছে। একপর্যায়ে মাথা ভর্তি চুল খামচে ধরলো। নাহ্ এতো সহজে সে ছাড়বে নাহ নুজহাত কে। তার ভালোবাসা এতো টাও ঠুনকো নাহ।
*
আবিদের মা মিসেস নাহার কিচেনে সন্ধার নাস্তা তৈরী করেছিলেন। ছেলেটার জন্য তার চিন্তার শেষ নেই। চার দিনে একদম শুকিয়ে গেছে ছেলেটা। চেহারা একদম ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
হঠাৎ ছাদ থেকে কিছু ভাঙার আওয়াজ আসতেই কপাল কুঁচকে গেল। আওয়াজ যেন বেড়েই চলছে। দ্রুত পায়ে ছাদে উঠে আসলেন। ছেলেকে চুল খামচে ধরে রাখতে দেখে সচকিত হলেন। দ্রুত পায়ে ছেলের কাছে গিয়ে ছেলের পাশে বসে পড়লেন। চারদিকে নজর বুলিয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠলেন,
“কি হয়েছে বাবা। এসব ভেঙেছিস কেন? আর চোখে মুখের এই অবস্থা, কি হয়েছে আবিদ।”
আবিদ মাথা থেকে হাত সরিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকালো। নাহ্, মাকে এই মুহূর্তে কিছুই বলা যাবে নাহ। নাহলে নুজহাতকে ভুল বুঝবে। মায়ের মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে দ্রুত উঠে দাড়িয়ে বলে উঠলো,
“মা আমি একটু আসছি।”
এই বলে দ্রুত ছাদ থেকে নেমে পড়লো।
মিসেস নাহার অবাক চোখে ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। কি ঘটছে, কি হচ্ছে আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে নাহ্। ছেলে এমন করছিল কেন আর অসুস্থ্য শরীরে এই ভর সন্ধায় গেলো কোথায়।
*
*
হাতে রাফির দেওয়া গোলাপটি নিয়ে ব্যালকনিতে দাড়িয়ে আছে নুজহাত। সেই সাথে ফোনে একমনে চ্যাট করে যাচ্ছে রাফির সাথে। থেকে থেকে ঠোঁটের কোণে দেখা যাচ্ছে মুচকি হাসি। নতুন প্রেম গঠিত সম্পর্কে জড়ালে যা হয় আর কি। একটু আগেই ফোনে প্রায় অনেক্ষন কথা বলেছিল রাফির সাথে। মা যে কোনও সময় চলে আসতে পারে ভেবে কল কেটে দিয়ে চ্যাট করে যাচ্ছে।
নুজহাতের মা মিসেস রিধিমা একজন স্কুল শিক্ষিকা। আজ স্কুল থেকে বোনকে নিয়ে শপিং এ যাবে। যার কারণে আসতে হয়তো কিছুটা দেরী হবে।
কলিং বেলের শব্দে চমকে উঠলো নুজহাত। ভেবেই নিয়েছে যে তার মা চলে এসেছে। রাফিকে বায় জানিয়ে দ্রুত ফোন এবং ফুল রেখে দরজার সামনে এসে দাড়ালো। দরজা খুলে সামনে তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে গেল। এই অসময়ে অসুস্থ্য আবিদকে সামনে দেখে যার পর নাই অবাক হয়ে গেল। এই ছেলে হঠাৎ এখানে কেন। কিছু বলতে নিবে তার আগেই আবিদ দ্রুত পায়ে নুজহাত কে ঠেলে ভীতরে ঢুকে পড়লো। ভীতর থেকে দরজা আটকে দিয়ে আগুন চোখে নুজহাতের দিকে তাকালো।
হঠাৎ আবিদের আগমন, এমন দৃষ্টি দেখে নুজহাত কিছুটা ভরকে গেল। আমতা আমতা করে বলে উঠলো,
“তু,, তুই ঠিক আছিস। অসময়ে অসুস্থ্য শরীর নিয়ে হঠাৎ….”
আর কিছুই বলতে পারলো না নুজহাত। কারণ আবিদের হাত এই মুহুর্তে তার গলায় বিচরণ করছে।
আবিদ রেগে নুজহাতের গলা চেপে ধরলো। রাগ যেন কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। রেগে চিৎকার করে বলে উঠলো,
“শুনলাম তোর গায়ে নাকি পূনরায় প্রেমের হাওয়া লেগেছে। তোর নাকি একজন মনের মানুষ দরকার। আর সেটাও নাকি ওই রাফি। রাফির চোখে নাকি তোর জন্যে অঢেল ভালোবাসা দেখতে পেয়েছিস। তার চোখ দেখে বুঝতে পারছিস তাহলে আমার চোখ দেখে কেন বুঝতে পারিস নি। আমার চোখে কি তোর জন্যে ভালোবাসা দেখা যায় নাহ। কয়দিনের এই রাফির চোখে একটু ভালোবাসা দেখে তুই গলে গেলি। আর আমি, এই আমি পাগলের মত ভালোবেসে গেছি তোকে। জীবনে বুঝ হওয়ার পর থেকে মনে প্রাণে তোকে চেয়েছি। শুধু মাত্র বন্ধুত্ব নষ্ট হবে ভেবে বলতে পারি নি। ভেবেছি তোর বুঝ হওয়ার পর আমার ভালোবাসা তুই ঠিকই বুঝতে পারবি। কিন্তু তুই তো অন্য পর্যায়ে চলে গেলি। ওই দুই দিনের ছেলের চোখে ভালোবাসা দেখে তুই তার সাথে প্রেমগঠিত সম্পর্কে চলে গেলি, তাহলে আমার এতো দিনের ভালোবাসা তুই কেন দেখতে পেলি নাহ। বল, নাকি দেখতেও পেয়েও সেটা পায়ে ঠেলে দিয়েছিস। ওই রাফি আমার থেকে সুন্দর বলে তাইতো।”
নুজহাত গলা থেকে রাফির হাত সরানোর চেষ্টায় আছে। চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। অনেক কষ্টে বলে উঠলো,
“আবিদ ছাড়। ব্যাথা পাচ্ছি আমি।”
আবিদের হুস ফিরল। দ্রুত নুজহাতের গলা ছেড়ে দিল। নুজহাত ছাড় পেয়ে হাপাতে লাগলো।
আবিদ দ্রুত জগ থেকে পানি নিয়ে গ্লাস নুজহাতের সামনে ধরলো। নুজহাত সেদিকে তাকিয়ে ধাক্কা দিয়ে আবিদের হাত সরিয়ে ফেললো।
হাপাতে হাপাতে বলে উঠলো,
“ছি, ভাবতে পারি নি তুই এমন। শেষ পর্যন্ত তুই আমায় মারতে লেগে পড়েছিস।”
আবিদ দ্রুত নুজহাতের বাহু ধরে বলে উঠলো,
“দেখ আমি এমন করতে চাই নি। খুব রাগ উঠে গিয়েছিল যখন রাফির সাথে তোর সম্পর্কের কথা জানতে পেরেছি।”
নুজহাত ধাক্কা দিয়ে আবিদ কে নিজে থেকে ছাড়িয়ে চিল্লিয়ে বলে উঠলো,
“কি শুনেছিস তুই হ্যা। আমি বলছি তোকে। হ্যা আমি তাকে ভালোবাসি। আর সেও আমায় খুব ভালোবাসে। তোকে আমি বন্ধুর নজরেই দেখে এসেছি। তবে এই মুহুর্তে তুই সেটাও নিজ হাতে নষ্ট করলি। যেখানে এখনি তুই আমার গলা টিপে ধরতে যাচ্ছিস সেখানে ভবিষ্যতে না জানি কি করিস। বেড়িয়ে যা এখান থেকে। তোকে যাতে আমি আর কখনো আমার চোখের সামনে না দেখি। আমার আর রাফির মাঝে একদম তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে আসার চেষ্টা করবি নাহ।”
আবিদ স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল নুজহাতের দিকে। নিজের কান কেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। তাকে নুজহাত তৃতীয় ব্যাক্তি বলে সম্বোধন করলো।
*
*
*
#চলবে
(সবার রেসপন্স এতো কম কেন। তোমাদের কি এই গল্প টা ভালো লাগছে নাহ। সবাই এভাবে রেসপন্স কমিয়ে দিলে তো আমার গল্প লেখার ইচ্ছেটাই মরে যায়। তোমরা যত রেসপন্স করবা আমি গল্প লিখতে ততটাই স্বাচ্ছন্দ বোধ এবং অনুপ্রেরণা পাবো।😒😒❤️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here