তুমি বললে আজ ২ পর্ব -১৩

#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ১৩.

.
বিছানার একপাশে দাদুর মাথার কাছে চুপচাপ বসে আছি। আমার পাশেই গা ঘেঁষে বসে আছেন তাসফি ভাই। অপর পাশে ফুপি, আম্মু ও বড়মা বসে আছেন দাদুর পাশে। রুমের মাঝে ফুপা, বড় বাবা, আব্বু ও দাদী বসে আছে সোফা ও চেয়ার দখল করে। বিছানার এক কোণায় বসে আছে রিফাপু। সবার মুখেই চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। কিছুক্ষণ আগেই ডাক্তার দেখে গেছে দাদুকে। কিছু মেডিসিন ও ইনজেকশন দিয়েছে। আর বলে গেছে, ‘চিন্তার কোন কারণ নেই, ঠিক ভাবে মেডিসিন গুলো নিলেই সেরে যাবে। বয়স হচ্ছে, তাই নানার রোগের বাসা বাঁধছে শরীরে।’ তবুও সবার মুখেই চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ভাবে ধরা দিয়েছে যেন।

ডাক্তার চলে যাবার পরেই অস্পষ্ট সুরে আমাকে ও তাসফি ভাইকে পাশে বসতে বলেছেন দাদু, তারপর আর কোন কথা বলেন নি কারোর সাথে। প্রায় পনের মিনিট যাবদ তাসফি ভাই ও আমার হাত একত্রে নিয়ে নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করে রেখেছেন দাদু। দাদুর এমন শান্ত হয়ে চুপ করে বিছানায় পরে থাকাটা যেন আমি ঠিক মেনে নিতে পারছি না আমি। মানুষটা আমাকে দেখলেই কেমন উৎসাহিত হয়ে পরে, ছোট বউ ছোট বলে সারাক্ষণ ডাকতে থাকে। আর আজকে নিশ্চুপ হয়ে পরে রয়েছে বিছানায়। তাসফি ভাইও চুপচাপ বসে আছেন পাশে, হয়তো উনিও মানতে পারছেন না, দাদুকে এমতবস্থায়।

রুমের মাঝের গুমোট পরিবেশে সকলের নীরবতাকে ভেঙে দিলো ফুপি। বলে উঠলো,
“আব্বার কাছে তো সবাই আছে, আমি বরং রাতের রান্নাটা চাপিয়ে দেই।”

ফুপির কথার সাথে তাল মিলিয়ে আম্মুও বলে উঠলো,
“হ্যাঁ, আমিও বরং তোর হাতে হাতে সাহায্য করি।”

আম্মু ও ফুপি উঠে চলে গেল রুম ছেড়ে। তাদের যাবার দিকে একবার তাকিয়ে তাসফি ভাইয়ের দিকে তাকালাম। আমি তাকিয়েছি বুঝতে পেরে উনিও তাকালেন, চোখের ইশারায় বলে উঠলেন, ‘কি হয়েছে?’ আমিও চোখের ইশারায় দাদুকে দেখালাম। তাসফি ভাই আবারও চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বললেন, দাদুর কিছু হবে না এটাও বোঝালেন।
মিনিট পাঁচেক পর হালকা নড়ে উঠে মিটমিট করে চোখ খুলতে লাগলেন দাদু। দাদুকে চোখ খুলতে দেখে খুশি হয়ে কিছু বলার আগেই বড়মা বলে উঠলেন,
“আব্বা… আব্বা এখন কেমন লাগছে আপনার? ঠিক আছেন তো।”

মাথা ঝাঁকালেন দাদু। বোঝালেন ঠিক আছেন। বিরস গলায় আব্বু ফুপা ও বড় বাবাকে ডেকে উঠলেন। ফুপা পাশে এসে বসতেই সরে নিলাম, কিন্তু হাতটা কিছুতেই ছাড়াতে পারলাম না দাদুর থেকে। বাধ্য হয়ে সেভাবেই বসে থাকতে হলো। আব্বু ও বড় বাবা অপর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাদের উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
“আমি কি আমার ছোট বউকে নিজের ঘরে তুলতে পারবো না বাবা? ছোট বউকে কি আমার তাসফির বউ রুপে দেখতে পারবো না, কখনো?”

সহসায় কেউ কোন কথা বলতে পারলো না। কিছু সময় নিয়ে আব্বু বলে উঠলো,
“পারবেন না কেন আব্বা? কিছু হবে না আপনার, আর তো কয়েকটা বছর।”

“আমার তো মনে হয় না বেশি দিন বাঁচবো। তাসফির বউ রুপে রূপাকে দেখে যেতে পারবো না।”

আবারও কেউ কথা বলতে পারলো না সহসায়। ফুপা বলে উঠলেন,
“তোমার কিছু হবে না বাবা, তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাও। রূপা তো এ বাড়িতেই আসবে তাসফির বউ হয়ে, তোমার সামনেই ওদের বিয়েটা হবে।”

বড় বাবা ও আব্বুও একই কথা বলে বোঝালেন দাদুকে। তবুও একই কথা বলতে লাগলেন দাদু। সবাই হাল ছেড়ে দিয়ে চুপ হয়ে গেলেন। একসময় শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলেন দাদু। ঘুমিয়ে যেতেই সবাই একে একে রুম ছেড়ে চলে গেল, বসে থাকলাম আমি ও তাসফি ভাইয়া। হঠাৎ এতক্ষণ পর যেন খেয়াল হলো তাসফি ভাই আমার অতি নিকটে বসে আছেন। বাকা হয়ে আমার পিছনে বসায় ওনার বলিষ্ঠ বাহুর সাথে আমার পিঠের অর্ধেক অংশ ঠেকে আছে। সেই সাথে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো ওনার সাথে আমার বিয়ের কথাটা। আমতা আমতা করে বলে উঠলাম,
“ওও… দিকে সরে যান না ভাইয়া, এত কাছে এসে বসেছেন কেন?”

কপাল কুঁচকে তাকালেন আমার দিকে, বিরক্ত গলায় বলে উঠলেন,
“ওদিকে সরে বসতে বলে আমার কোমর ভাঙার প্ল্যান করছিস নাকি? দেখছিস না এদিকে জায়গা নেই।”

“তাই বলে এতটা কাছে গা ঘেঁষে বসে থাকবেন? আমার কেমন কেমন জানি লাগছে, আপনি সরে যান।”

তাসফি সরে গেলেন না, আগের ন্যায় বসে রইলেন। গলায় আরও বিরক্তি মিশিয়ে সন্ধিহান স্বরে বলে উঠলেন,
“ঠিক কেমন কেমন লাগছে রে রুপু?”

“জানি না আমি, এদিকে সরে যান।”

একটু থেমে সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বলে উঠলাম,
“আচ্ছা তাসফি ভাইয়া, একটা কথা বলবো?”

“তুই আবার কবে থেকে আমার অনুমতি নেওয়া শুরু করলি? বল শুনি।”

তাসফি ভাই অনুমতি দিতেই আমি আর সময় নিলাম না। চট করে বলে উঠলাম,
“আচ্ছা ভাইয়া, আপনার সাথে কি আমার সত্যি সত্যিই বিয়ে হবে?”

“সেটা যখন হবে তখন এমনিতেই দেখতে পাবি।”

“তাহলে বিয়ের পর কি আপনার সাথে আমাকে থাকতে হবে, এ বাড়িতে? আপনার রুমে?”

“তোর মাথায় হঠাৎ এসব চিন্তা ভাবনা কিভাবে ঢুকলো, বল তো? পড়াশোনা বাদ দিয়ে এসব চিন্তা নিয়ে ঘুরিস, বেয়াদব!”

তাসফি ভাইয়ার ধমকে চুপ হয়ে গেলাম একেবারে। কি এমন বললাম যে এভাবে রেগে যেতে হবে? বজ্জাত লোক একটা, সারাক্ষণ শুধু ধমকায়। নিজেই বলছে বিয়ে হবে, আবার নিজেই ধমকাচ্ছেন। হু! করবো না ওনাকে বিয়ে, থাকবো না ওনার সাথে। আমার কি তাতে? রেগেমেগে আর কথা বললাম না ওনার সাথে, আলতো করে দাদুর হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে তাসফি ভাইয়ের থেকেও ছাড়িয়ে নিলাম। বিছানা থেকে নেমে বেরিয়ে এলাম রুম ছেড়ে।

.
রাতের খাবার পর্ব সেরে সবাই বাসায় যাবার জন্য রওনা হয়ে গেল। ফুপির বাসায় শুধু থেকে গেলাম আমি, দাদী ও রিফাপু। সবার সাথে কিছু সময় কাটিয়ে রুমে চলে গেলাম ঘুমাতে।

সেদিন দাদুর অসুস্থ শরীর নিয়ে আমাদের বিয়ের ব্যাপারে প্রচন্ড জেদ করলে সবাই চুপ হয়ে যায় একে বারে। বারবার জেদ ধরে বিয়ের কথাটা তুললেও কেউ কোন কথা বলে না। তার মূল কারণটা পরের দিন জানতে পারি, রিফাপুর কাছ থেকে। আমার বয়সটা নিতান্তই কম হওয়ায় কেউ বিয়ের কথাটা ভাবতেই চায় নি। কিন্তু দাদুর অসুস্থ শরীর নিয়ে জেদের তুলনায় আব্বু পুরোপুরিই হার মেনে নিয়েছিলো, শুধু বেঁকে বসেছিলো বড় বাবা ও ফুপা। আমিও এক প্রকার ভেবেই নিয়েছিলাম মাত্র কয়েকদিনের মাঝেই হয়তো তাসফি ভাইয়ের বউ হয়ে যাবো।
কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিন দিনের মাথায় পুরোপুরি আগের ন্যায় সুস্থ হয়ে উঠেন দাদু। আগের মতোই সুস্থ সবল চলাফেরা শুরু করেন। দাদুর সুস্থতায় ধামাচাপা পড়ে যায় তাসফি ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ের ব্যাপারটা। আগের ন্যায় আবারও চলতে থাকে সবকিছু, কাটতে থাকে সময়। এইটের বোর্ড পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়ে উঠে যাই নতুন ক্লাসে। নতুন ক্লাস, সাথে নতুন কিছু বন্ধুবান্ধব নিয়ে কাটতে থাকে আমার সময়গুলো। তাসফি ভাইয়ার রেজাল্টের দেরি হওয়ায় তখনও বাসাতেই উনি। মাঝে মাঝে আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যাওয়া, এটাই যেন ওনার একমাত্র কাজ ছিলো তখন। এর মাঝে হঠাৎ রিমি আপুর বিয়েও ঠিক হয়। হৈ-হুল্লোড় হাসি ঠাট্টার মাঝেই কাটতে লাগলো সেই সময়গুলো।

বর্তমান….
.
জানালা ভেদ করে আসা সূর্যের তীক্ষ্ণ আলো সরাসরি চোখে লাগতেই ঘুমের রেশটা কেটে গেলো। ধীরে ধীরে পুরো ঘুমটা ছুটে যেতেই চোখ বন্ধ করে বালিশের পাশে নিজের মোবাইলটা খুঁজে লাগলাম, কয়েক সেকেন্ড পর পেয়েও গেলাম। সময় দেখার জন্য মোবাইলটা অন করে তাকাতেই চোখ দুটো আরও বড় আকৃতির ধারণ করলো। আজকেও এতটা লেট করে ঘুম থেকে উঠলাম? ইস্! আজকেও কলেজে যাওয়া হলো না আমার। তবুও অলসতা কে ছুটি দিয়ে উঠে বসলাম বিছানায়। কয়েক সেকেন্ড বসে থেকে কিছু একটা ভাবতেই চমকে উঠলাম যেন। আশে পাশে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলাম নিজের রুমেই আছি। কিন্তু আমি তো তাসফি ভাইয়ের রুমে ছিলাম। তাসফি ভাইয়ের সাথে, ওনাকে জড়িয়ে…. ইস্! কেমন বেহা*য়ার মতো ওনাকে জড়িয়ে, বুকে মুখ গুঁজে ছিলাম, কথাটা ভাবতেই এখন কেমন জানি লজ্জা লাগছে। কখন যে ঘুমিয়ে গেছিলাম সেটাও ঠিক বুঝতে পারছি না।
.
আম্মুর হাজারো বকা গিলতে গিলতে প্লেটের খাবারও গিলছি। খারার সাথে সাথে আম্মুর বকাগুলোও হজম করে নিচ্ছি। একটা মানুষ যে খাবার এত এত শত বকাঝকা করতে পারে সেটা আম্মুকে না দেখলে হয়তো জানতামই না কখনো। অনেক কষ্টে প্লেটের খাবারগুলো শেষ করে বসার রুমে গিয়ে সকলের সাথে বসে গেলাম। ফুপিরা হয়তো আজকেই চলে যাবেন।
সকলের সাথে দেখা হলেও আমার অবুঝ মনের সাথে সাথে চোখ দুটোও যেন কাউকে খুঁজে চলেছে। কাল রাতে আমার করা কান্ডের পর ওনার সামনে যেতে লজ্জা লাগলেও, কেন জানি একটুখানি দেখার ইচ্ছে হচ্ছে। হয়তো এখনো রুমে আছেন, বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছেন। কথাটা ভেবেই বসার রুম ছেড়ে উঠে এলাম। ওনার রুমের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম আদোও ভিতরে আছেন কি না। হাজার দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে ভেতরে যাবার সাহস হলো না আমার। সেখানে আর না দাঁড়িয়ে চলে আসলাম নিজের রুমে।

সারাদিনে চেষ্টা করেও যখন তাসফি ভাইয়ের দেখা পেলাম না, তখন অজান্তেই মনটা উতলা হয়ে উঠলো। ওনাকে এক নজর দেখার জন্য ছটফট করতে লাগলো মন। দুপুরের পর যখন জানতে পারলাম তাসফি ভাই চলে গেছেন, তাও সকালের দিকে, তখন বিষন্নতায় ছেয়ে গেল। ওনাকে এক নজর দেখার অদম্য ইচ্ছে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো, রাতের মতো একটুখানি ছুঁয়ে দেবার জন্য মনটা আকুপাকু করতে লাগলো। অজান্তেই মনের কথাগুলো মুখ ফুটে বেরিয়ে আসলো।

“আপনাকে কেন এত মিস করছি তাসফি ভাই? কি আছে আপনার মাঝে, যা আমাকে চুম্বুকের ন্যায় আপনার দিকে টানতে থাকে। এই চার বছরেও তো আপনাকে এতটা মিস করি নি, যতটা সকাল থেকে এখন পর্যন্ত মিস করেছি। একটুখানি ছুঁয়ে দেবার জন্য ছটফট করছি।”

.
.
চলবে…..

আজকের পর্ব ছোট হয়েছে, আগামী পর্ব বড় করে দেবার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here