তুমি বললে আজ ২ পর্ব -১

#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ১৪.

.
অনেক সময় দীর্ঘ সময়ের দহন থেকে খুব অল্প সময়ের দহনেই মানুষের মন পুড়ে বেশি। আমার সাথেও ঠিক এমনটায় হচ্ছে। গত চার বছরেও সেই মানুষটাকে যতটা না মনে পড়েছে, এই চার দিনে তার চেয়েও শত শত বার মনে পরেছে। এক নজর দেখার জন্য আকুপাকু করেছে মন। কিন্তু পাই নি,সেদিন সকালে চলে যাবার পর আর এই বাসাতেও আসেন নি উনি, এই চার দিনেও একটাবার দেখার সুযোগ হয় নি ওনাকে। কয়েক দিন নিজের মাঝে মগ্ন থাকলেও তাসফি ভাইয়ের মাঝে গিয়েই তার সমাপ্তি ঘটেছে। বারংবার ভুলে যেতে যেন আরও বেশি করে মনোযোগ পরে গেছে তার প্রতি। কলেজে গিয়ে বন্ধু মহলে আড্ডায় মেতে উঠলেও এক মুহুর্তের জন্য ভুলতে পারি নি।

রাতের খাবার সময় সবাই চুপ হয়ে খেয়ে চলেছে। রিমি আপু ও ফুপিরা সেদিনই চলে গেছেন। হঠাৎ রিফাপুর কথা উঠে এলো। বড় বাবা জানিয়ে দিলো পরশু দিন সাদিক ভাইয়ার বাসা থেকে তার পরিবার আসবে। এই কয়েকদিনে সাদিক ভাইয়ার ব্যাপারে যতটুকু খোঁজ নেওয়া দরকার নিয়েছে। ছেলে ডাক্তার শুনেই বড়মা আর কোন কথা বলেন নি, মেয়ে তো আর খারাপ ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়ায় নি? বড়মার অনেক আগে থেকেই ইচ্ছে ছিলো পরিবারের একজন ডাক্তার হবে, কিন্তু সবাই বড়মার ইচ্ছেটাকে মাটিচাপা দিয়ে নিজেদের পছন্দটা বেছে নেয়। তাসফি ভাইকেও হাজার বলে কয়ে ডাক্তারি পড়তে পারে নি কেউ, ওনার নাকি হসপিটালে গেলে মাথা ভনভন করে, আর সেখানে ডাক্তার হবে, কিছুতেই নয়। পরিবারে একটা ডাক্তার জামাই আসবে এতে বড়মা যে মনে মনে ভীষণ খুশি, সেটা বড়মাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

সকলের কথা বার্তা শুনে যতদূর বুঝতে পারলাম, সাদিক ভাইয়ার পরিবারের সাথে কথা বলে আজকেই হয়তো বিয়ের কথাবার্তা বলবে। একরাশ মন খারাপের মাঝেও একটু ভালো লাগায় ছেয়ে গেল মন। অবশেষে রিফাপু তার ভালোবাসার মানুষকে পাচ্ছে, ভেবেই শান্তি লাগছে। ইস্! সবাই যদি সবার ভালোবাসার মানুষকে পেতো, কতই না ভালো হতো।
.
তাসফি ভাইয়ের দেখা পেলাম দু’দিন পর, যেদিন সাদিক ভাইয়ার পরিবার বাসায় আসলো সেদিন। তবুও যেন সেটা ছিলো আমাবস্যার রাতে চাঁদের দেখা পাওয়ার মতো। সাদিক ভাইয়ার পরিবার যতক্ষণ পর্যন্ত ছিলেন উনিও ঠিক ততক্ষণ পর্যন্তই ছিলেন। এর মাঝে একটিবারের জন্যও আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন নি, আর না আমার দিকে তাকিয়েছেন। এক প্রকার এভয়েড করে গেছেন আমাকে। কেন জানি ওনার এই ইগনোর করাটা মানতে পারছি না। আসার পর তো দুই দিন খুব করে আমার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করলেন, অভিমানকে দূরে ঠেলে দেবার চেষ্টা করে গেলেন। তাহলে আজ? আজকে তো ফিরেও তাকালেন না আমার দিকে। তাহলে কি সেগুলো নিতান্তই ওনার করা অভিনয় ছিলো? হ্যাঁ! তা নয়তো কি? ওনার জীবনে তো আমার কোন জায়গা নেই, ওনার সবটা জুড়েই তো কিয়ানা আপুর বসবাস। কথাটা ভাবতেই টিপটিপ শব্দের সৃষ্টি হলো বুকের বা পাশে।

রিফাপুর সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার এখনো ছয় মাসের মতো বাকি আছে। তার আগেই বিয়েটা দিতে চায় সবাই। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয় সবকিছু গুছিয়ে দুই মাস পরেই রিফাপু ও সাদিক ভাইয়ার বিয়ে হয়ে। সবার মুখেই যেন খুশির রেশ লেগে আছে। আমি খুশি থাকার চেষ্টা করলেও পারলাম না, তাসফি ভাইয়ের আজকের করা ইগনোরটা কেমন জানি চাপা কষ্টের সৃষ্টি হলো।

.
বুকের চাপা এক কষ্ট নিয়েই কেটে গেল আরও কয়েটা দিন। সময়ের সাথে সেই কষ্টটা একটুও কমলো না বরং বেড়েই গেল যেন। অনাকাঙ্ক্ষিত একটা চেহারা অপ্রত্যাশিত ভাবে একটুখানি দেখার আসায় ছটফট করতে লাগলো অবাধ্য মন। কিন্তু দেখা পেলাম না তাসফি ভাইয়ের। সময়ের সাথে আরও অভিমান এসে জমা হলো ওনার প্রতি, সাথে জমা হলো রাগের মাত্রা। কি দরকার সেই মানুষটার কথা ভেবে, যে মানুষটার ভাবনার এক বিন্দুতেও আমি নেই। না…. আর ওনার কথা ভাববো না আমি, আর না ওনার সামনে যাবো, কিছুতেই না। মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলাম। কিন্তু আমার করা প্রতিজ্ঞা কে ভঙ্গ করে দিয়ে আম্মু আগমন ঘটলো। রুমে এসেই বলে উঠলো,
“তোর ফুপি ভীষণ অসুস্থ রে রূপা, বাসায় তো কেউ নাই। তুই একটু যা তো মা, কয়েক দিন থেকে আয়। না জানি কি করছে ওরা।”

“কেন আম্মু, ফুপির হঠাৎ কি হয়েছে?”

“ওর নাকি ভীষণ জ্বর আসছে হঠাৎ করেই। বিছানা ছেড়ে উঠতেও পারছে না, তোর ফুপাও নাকি ফেনী তে গেছে কয়েক দিনের জন্য। তাসফি আর তোর ফুপি একা একা বাসায়, এখন তোর ফুপির পাশে একজন মেয়ে মানুষ থাকা খুব প্রয়োজন।”

“কিন্তু আম্মু আমি….”

“তোর বড়মা বাসায় থাকলে তো আমিই যেতাম, রিফাও নাই। এখন তুই ছাড়া কে যাবে বল মা? একটু তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে যা না, কয়েকদিন থেকে আয়। না জানি একা একা কি করছে ছেলেটা?”

বারণ করলেও কোন কথায় শুনলো না আম্মু। এক প্রকার জোর করেই রেডি হতে পাঠিয়ে দিলো, সেই সাথে কাপড় সহ বইও গুছিয়ে দিলো। যেন সেখান থেকেই কলেজে যেতে পারি। হতাশার নিশ্বাস ছেড়ে রেডি হয়ে নিলাম যাবার জন্য।

.
ফুপির বাসায় এসে কলিং বেল দিতেই তাসফি ভাইয়া এসে দরজা খুলে দিলেন। ওনাকে দেখে ভেতরে না ঢুকে সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম ওনার দিকে। এ কি অবস্থা ওনার?
আমাকে হঠাৎ এমন ব্যাগ সহ দেখে হয়তো উনি অবাক হলেন কিছুটা, কিন্তু সেটা প্রকাশ করলেন না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হলেন, ধমকে উঠে বললেন,
“হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বেয়াদব! তোর জন্য কি কাজ ফেলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবো আমি?”

প্রতিবারের মতো ওনার ধমকে আজকে আর কাজ হলো না। প্রতিত্তোরে কিছু না বলে দরজার সামনে দাঁড়িয়েই শব্দ করে হেঁসে উঠলাম। শুধু হাসিতেই থেমে থাকলাম না, হাতের ব্যাগটা মাটিতে ফেলে দরজা ধরে হাসতে লাগলাম। ওনার পুরো শরীরে আটা লেগে আছে, চুলের অর্ধেক অংশ জুড়েও ভর্তি হয়ে আছে আটা দিয়ে। মুখে এমন ভাবে লেগে আছে যে, যে কেউ দেখলেই পেট ফেটে হাসি আসবে। আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হলো, কিছুতেই যেন নিজের হাসিটা কন্ট্রোল করতে পারছি না। আমাকে এভাবে হাসতে দেখে আবারও ধমকে উঠলেন উনি,
“বত্রিশ পাটি দাঁত কেলিয়ে এভাবে হাসছিস কেন? বেয়াদব! আমাকে দেখে কি তোর জোকার মনে হচ্ছে?”

‘আপনাকে তার থেকেও বড় কিছু মনে হচ্ছে, তাসফি ভাইয়া।’ কাথাটা মনে মনে বললেও মুখে বলার সাহস পেলাম না, কিন্তু ওনার কথা শুনে আমি আবারও হেঁসে উঠলাম আমি। এবার বেশ বড়সড় করেই ধমকে উঠলেন উনি। সাথে সাথে চুপ হয়ে গেলাম, হাসি পেলেও কোন ভাবে চেপে রাখলাম নিজের মাঝে। ব্যাগটা উঠিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম। আমি ভেতরে ঢুকতেই তাসফি ভাই দরজাটা আঁটকে দিয়ে দ্রুত পায়ে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলেন। ওনার ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে সময় লাগলো না, রান্নার এক্সপেরিমেন্ট করে চলেছেন উনি। যদিও এর আগে কখনো ভুলেও রান্নাঘরের দিকে পা দেন নি। ওনার অবস্থা দেখে ধারণা করে নিলাম, রান্নাঘরের অবস্থা চোখে দেখার মতো নয়।

রান্নাঘরে না গিয়ে ব্যাগটা গেস্ট রুমে রেখে সোজা ফুপির রুমে গেলাম। বিছানায় শুয়ে আছে ফুপি, একটু কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম ঘুমিয়ে আছে। মাথার কাছে গিয়ে কপালে হাত রাখতেই চমকে উঠলাম যেন। এতটা জ্বর? হঠাৎ এতটা জ্বর আসলো কিভাবে? না জানি এতক্ষণে কিছু খেয়েছে কি না? ওষুধটাও হয়তো খায় নি। তাড়াতাড়ি কিছু একটা বানিয়ে খাওয়াতে হবে ফুপি কে, তারপর ওষুধ খাইয়ে দিতে হবে।
ভেবেই আর রুমে থাকলাম না। ফুপির রুম ছেড়ে বেড়িয়ে সোজা রান্নাঘরের দিকে চলে আসলাম। রান্নাঘরে ঢুকেই আরেক দফা চমকে উঠলাম আমি।

.
.
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here