#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব_৩৩
সৌহার্দ্য সারা ঘরময় সাজানো মোমবাতি গুলো প্রজ্বলিত করছে আর সম্মোহনী দৃষ্টিতে তরীর দিকে তাকাচ্ছে। তরী শাড়ির আঁচল হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সবটা অস্বাভাবিক ঠেকছে। সৌহার্দ্যের মতিগতি কিছুটা আঁচ করতে পারছে সে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে ওর।
নিজেকে স্বাভাবিক করার ব্যর্থ চেষ্টা করে তরী তাকালো মোমবাতির আড়ালে থাকা সৌহার্দ্যের মুখের দিকে। সৌহার্দ্যের চশমাবিহীন চোখ দুটো তরীর দিকে তাক হয়ে আছে যেন। একবারও পলক পড়ছে না। তরীর শুভ্র-সুন্দর গায়ে বাদামী বর্ণের সুতি শাড়িটা একেবারে মিশে গিয়েছে যেন! খোলা জানালা গলিয়ে এক টুকরো চাঁদের আলো তরীর মুখের ওপর পড়ছে। শীতল হাওয়ায় লম্বা চুলগুলো মুখের ওপর অবিন্যস্তভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। সৌহার্দ্যের কেমন যেন অদ্ভুত ঘোর লেগে আসছে! এরকম তো আগে কখনো হয়নি!
অন্য দিকে, মধু কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। দু’চোখে ঘুম নেই। বারবার এদিক-সেদিক ছটফট করছে সে। ড্রিম লাইটের লালচে আলোয় ঘরটা অদ্ভুত লাগছে। কিন্তু মধু এই আলোয় ঘুমিয়েই অভ্যস্ত। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে মধু সটান হয়ে শুয়ে ঘুমানোর মনস্থির করলো। ঘুমটা আসবে আসবে মনে হচ্ছে। কিছু মুহুর্ত পরে হঠাৎ পাশে কারো উপস্থিতি অনুভব করলো মধু। কেউ ওর পাশে এসে বসলো যেন! মধু তড়িৎ গতিতে চোখ মেলতেই আবছা আলোয় নিজে পাশে বসা এক ছায়ামূর্তিকে দেখলো। আকস্মিক ঘটনায় মধু ভড়কে গিয়ে গলা ছেড়ে এক চিৎকার দিতে গেলে তার আগেই ওর মুখ চেপে ধরলো কেউ!
“ষাড়ের মতো চেঁচালে ঠাটিয়ে দুটো চড় মারবো। আমি এসেছি, কোনো বাঘ-ভাল্লুক বা ভূত-পেত্নী না! স্টুপিড!!”
ফিসফিসানির আওয়াজে কথাগুলো কানে পৌঁছাতেই মধু চোখ গোল গোল করে তাকালো। মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে অবাক কন্ঠে বললো,
“প্রহর! তুমি এখানে? এতো রাতে? কেন? কীভাবে?”
“এমন ভাবে বলছো যেন আজ নতুন এলাম! তোমার জন্য এ জীবনে কম তো আর পাইপ বেয়ে এই ঘরে আসিনি! আজও এলাম। তুমি আসতে বাধ্য করেছো।”
মধু চাপা স্বরে রাগ দেখিয়ে বললো,
“মাথা ঠিক আছে তোমার? আগেকার পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতির মাঝে অনেক তফাৎ! কেউ তোমায় এতো রাতে আমার ঘরে দেখলে কী ভাববে বলো তো? সবকিছুতে এতো হঠকারিতা ঠিক নয়, প্রহর!”
প্রহর মুখ অন্ধকার করে ফেললো মধুর কথা শুনে। মিনমিনে স্বরে বললো,
“আমি তো তোমারই রাগ ভাঙাতে এসেছিলাম, ল্যাভেন্ডার! তোমার মনে আর বিন্দু মাত্র রাগ, ক্ষোভ বা কষ্ট জমতে দিতে চাই না আমি। যাইহোক! এতো রাতে ডিস্টার্ব করার জন্য সরি। আমি চলে যাচ্ছি। আর কখনো এভাবে আসবো না।”
প্রহর পা ঘুরিয়ে চলে যেতে লাগলো বারান্দার দিকে। মধু কপাল চাপড়ালো! আসলেই মানুষ বদলায় না। রাগ ভাঙাতে এসে প্রহর নিজেই রেগে গেল, কষ্ট পেল! এটা কোনো কথা!!
এই দিকে,
সৌহার্দ্য একহাতে একটা মোম নিয়ে তরীর দিকে এগিয়ে আসছে। পুরো ঘর হলুদ আলোয় ঝলমল করছে। সৌহার্দ্য তরীর কাছাকাছি এসে মোমের আলো তরীর মুখের ওপর ধরলো। তরীর সৌহার্দ্যের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে। হাতে হাত ঘষে আমতাআমতা করে বললো,
“আব্… ঘুমাবে না? এতো রাতে এসব কী করছো? এতো মোম কেন জ্বালিয়েছো?”
সৌহার্দ্য অদ্ভুত কন্ঠে বললো,
“কেন? তোমার পছন্দ হয়নি?”
তরী হকচকিয়ে গেল। বললো,
“হ..হয়েছে! অনেক সুন্দর লাগছে। সব তো দেখা শেষ! এবার আলোগুলো নেভাও। আলো জ্বালিয়ে দেই আর আমরা ঘুমোই। এমনিতেই অনেক রাত হয়েছে। কালকে আবার ক্লসে যেতে হবে আমার!”
বলেই তরী উল্টো দিকে গিয়ে আলো জ্বালাতে উদ্যত হতেই সৌহার্দ্য ওর শাড়ির আঁচল টেনে ধরলো। তরীর হৃৎস্পন্দন থেমে যাওয়ার যোগাড়!
“কালকে ফ্রাইডে। তোমার ক্লাস নেই। আর আমার বিকেলে ডিউটি।”
তরী সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,
“ওহহ! ভুলেই গিয়েছি, দেখেছো?”
সৌহার্দ্য হাত থেকে মোমটা রেখে দু’পা এগিয়ে গেল। তরীর হাত ধরে টেনে নিজের কাছাকাছি এনে বললো,
“চাঁদ!! ”
তরী ঈষৎ কেঁপে উঠে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। কিছু বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না এখন। কী অদ্ভুত কান্ড! সৌহার্দ্য হয়তো সেটা বুঝতে পারলো। নিঃশব্দে হেসে বললো,
“তোমাকে হারিয়ে আমি শূন্য হয়ে গিয়েছিলাম, চাঁদ। বিশ্বাস করো! আমার শুধু শ্বাস চলতো, কিন্তু প্রাণটা তোমার সাথেই হারিয়ে গিয়েছিল। প্রাণহীন সৌহার্দ্য রায়হানকে সবাই দেখেছে, জানো?”
তরীর চোখে পানি জমে এসেছে। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে তরী নিজের চোখে জল আসতে দেয়নি। নিতান্তই পরিস্থিতির দায়ে লোক দেখানো কান্না কাঁদতে হয়েছে। তরীর খুব করে বলতে ইচ্ছে হলো,
“ম*রে তো আমিও গিয়েছিলাম! কিন্তু কেউ সেটা জানতে পারেনি, বুঝতে পারেনি।”
বলতে চেয়েও কিচ্ছু বলে উঠতে পারলো না তরী। গলার ভেতর সব কথা জমাট বেঁধে আছে যেন। কিন্তু গাল বারবার ভিজে যাচ্ছে তরীর। সৌহার্দ্য তরীর মুখটা দু’হাতে আগলে নিলো। যত্ন সহকারে চোখের পানিগুলো মুছে দিতে দিতে ফিচেল হেসে বললো,
“তুমি বলতে না পারলেও তোমার না বলা কথাগুলো বুঝি আমি। আমার থেকে বেশি কষ্টে তুমি ছিলে। জানো? আমি কখনো ভাবিনি তোমায় আবার ফিরে পাবো। মৃ*ত মানুষ তো কখনো ফিরে আসে না! তোমার ফেরার দুরাশা করতাম কী করে বলো? আর তোমায় বিয়ে আমি নিজের ইচ্ছাতেই করেছিলাম। আমি আগেই চেয়েছিলাম এমন কাউকে বিয়ে করতে, যে কখনো আমার কাছে ভালোবাসা, অধিকার দাবী করতে পারবে না। মায়ের কাছে শুনেছিলাম তুমি কথা বলতে পারো না। মা-বাবা দুজনই চিন্তিত ছিলেন তোমার বিয়ে নিয়ে। কারণ বরপক্ষ নাকি জানতো না যে, তুমি কথা বলতে পারো না। সবটা জেনে আমি নিজে পরিকল্পনা সাজিয়েছিলাম তোমাকে বিয়ে করার। বিয়ের আগমুহূর্তে বরপক্ষের কানে তোমার কথা বলতে না পারার সত্যটা আমিই তুলেছিলাম। ফলশ্রুতিতে তোমার বিয়েটা ভেঙে যায়। কেউ তোমায় বিয়ে করবে না, এটা জানা-ই ছিল আমার! আমি নিজেই তোমায় বিয়ের প্রস্তাব দেবো ভেবেছিলাম। কিন্তু আমার কাজকে আরো সহজ করে দেয় আমার বাবা।”
তরী রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“এরকম কাজ করতে পারলেন আপনি? এতো প্ল্যান করে আমাকে বিয়ে করেছেন! সিরিয়াসলি!!”
সৌহার্দ্য হেসে বললো,
“নিজের স্বার্থের জন্য একটু বোকা তো বানাতেই হয়েছে সবাইকে। তবুও তোমাকে প্রথম বার দেখে অবাক হয়েছিলাম। এতো সুন্দর একটা মেয়ে কথা বলতে পারে না! আফসোস হচ্ছিল তোমার ভাগ্য দেখে। আমার সাথে বিয়ে হওয়ায় তোমার জীবনটা-ই নষ্ট হয়ে গেছে মনে হচ্ছিল বারবার। কারণ আমার পুরো অস্তিত্ব জুড়ে শুধুই আমার চাঁদের বসবাস ছিল। সে জায়গায় কাউকে কোনোদিন বসাতে পারতাম না আমি। তবুও সময়ের পরিবর্তনে হয়তো তোমার প্রতি অনুভূতি সৃষ্টি হতো। তোমার নীরবতাকে নিবিড়ভাবে ভালোবেসে ফেলতাম, দ্বিতীয় প্রেমের জোয়ার আসতো। কিন্তু চাঁদকে যে কোনো দিন ভুলতে পারতাম না। চাঁদের প্রতি আমার ভালোবাসা কখনো বিন্দু পরিমাণ কমেনি, বরং বেড়েই চলছিল ক্রমাগত। ওর অনুপস্থিতিতেও! এখানে আমার কী দোষ বলো? মনের ওপর তো আর জোর খাটানো যায় না!”
সৌহার্দ্য থামলো। তরী ঠোঁট প্রসারিত করে হাসছে। ছেলেটা পাগল! সৌহার্দ্যের চুলগুলো হাত দিয়ে নাড়িয়ে দিতে দিতে তরী বললো,
“পাগল ডাক্তার আমার! এতো বেশি ভালোবাসতে নেই। জীবন সবসময়ই আমার সাথে নিষ্ঠুরতা করেছে, জানো? আমাকে এতো বেশি ভালোবেসো না! পরে আমার দেওয়া কোনো আঘাতের কষ্ট সহ্য হবে না তোমার। আবার এমনও তো হতে পারে! তুমি-ই আমাকে আঘাত করলে। সেই যন্ত্রণার বি*ষ অনেক ভয়ংকর! ”
সৌহার্দ্য তরীকে তড়িৎ গতিতে বুকে আগলে নিলো। বললো,
“আকাশের বুকে যেমন একটা মাত্র চাঁদ, তেমনি আমার জীবনেও একটা মাত্র চাঁদ তুমি। তোমায় নিজের বুকে আগলে রাখবো সবসময়। পারলে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে রাখবো। সৌহার্দ্য অরিত্রীর জন্য সব করতে পারে।”
তরী হাসলো। কিছু বললো না। সৌহার্দ্যকে কিছু বলে লাভ নেই। বেশ কিছু মুহুর্ত নীরব কাটলো। হঠাৎ সৌহার্দ্য নীরবতা ভেঙে বললো,
“চাঁদ!! ”
“হুম…”
“দাদীর সাথে আজকে আমার একটা ডিল হয়েছে।”
তরী ভ্রু কুঁচকে সৌহার্দ্যের বুক থেকে মাথা তুললো। উৎসুক দৃষ্টিতে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কী ডিল?”
সৌহার্দ্য তরীর কানে ফিসফিস করে বললো,
“দাদী তার নাতির ঘরে বংশধর চেয়েছে। দাদীর ইচ্ছে কীভাবে অপূর্ণ রাখি বলো?”
তরী হতভম্ব হয়ে বললো,
“তার মানে এসব আপনাদের প্ল্যান ছিল? দাদী এজন্য আমাকে এতোক্ষণ আটকে রেখেছিল? আপনি দাদীর সাথে এতো কিছু বলেছেন? লাজলজ্জা কী সব পানি দিয়ে গুলিয়ে খেয়ে ফেলেছেন? মানে আপনি…..
সৌহার্দ্য তরীর মুখ চেপে ধরে কথা বলা বন্ধ করে দিলো। তরী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্যের দিকে। সৌহার্দ্য বললো,
” আপনি আপনি করে কথা বলতে নিষেধ করেছি না? আর যা করেছি, বেশ করেছি। বয়স থার্টি-প্লাস হয়ে গেছে আমার। আর কতো অপেক্ষা? এবার বলে দাও না যে, আমাকে ভালোবাসো!”
তরী কিছু বললো না। সৌহার্দ্যের হাতের বাঁধন আলগা করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। সৌহার্দ্যের মুখে আধার নেমে এলো। মুখ ঘুরিয়ে নিতেই হুট করে তরী এসে সৌহার্দ্যের গালে অধর ছুঁইয়ে দিলো। সৌহার্দ্য চোখ বড়বড় করে তরীর দিকে তাকাতেই তরী সৌহার্দ্যকে ঝাপটে ধরে বললো,
“ভালোবাসি তো!”
খুশিতে সৌহার্দ্যের চোখে পানি চলে এলো। পরম আবেশে নিজের বুকে আগলে নিলো নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে। তারপর? প্রজ্বলিত মোমগুলো কেঁপে কেঁপে উঠে নিজ দায়িত্বে নিভে গেল। চাঁদ হঠাৎ-ই মেঘের আড়ালে মুখ লুকালো। কিন্তু পূর্ণিমার আলোয় ভাসিয়ে দিলো পৃথিবীকে। প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমার পরিণয় থেকে পরিণতি পেল অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই!
-চলবে…..
👉👉