#তীব্র_প্রেমের_নেশা (৬)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_________________
বাড়িতে বেশ জমজমাট অবস্থা। তীব্রর নানুবাড়ির লোকজন আসবে আজ। আন্টি তো খুবই খুশি। ওইদিনের পর থেকে সবই স্বাভাবিক শুধু আমার আর তীব্রর সম্পর্কের জটিলতা দিন দিন বেড়ে গেছে। উনার কথাগুলো আজও ভীষণ ভাবে আমার মনে ঘুরপাক খায়। আমি বুঝতেই পারি না কেনো! বার বার মনে হয় আচ্ছা আমি কি কোনোভাবে ভুল! কিন্তু সেদিন তো জিনিয়াকে নিজ চোখেই দেখেছি। মৃ’ত্যুর আগে কি মানুষ মিথ্যা বলতে পারে! দুপাক্ষিক চিন্তায় আমার অবস্থা করুণ। মাথা চেপে বসে রইলাম রুমে। খট করে দরজা খোলার শব্দে সেদিকে তাকাতেই তীব্রকে নজরে পড়লো। তীব্র গম্ভীর মুখে নিজের মতো কিছু একটা খুজতে শুরু করে। আমি আগ বাড়িয়ে কিছু বললাম না। যেভাবে ছিলাম ঠিক সেভাবেই রইলাম। তীব্র একটা ফাইল নিয়ে যাওয়ার সময় গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
‘নিচে যাও। আম্মু যখন তখন চেচামেচি শুরু করবে! বাড়িতে নানুবাড়ির সবাই আসবে এসব অশান্তি যেনো না হয়।’
উনি চলে গেলেন। আমি কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়ে শাড়ি ঠিক করে নিলাম। কাল রাত থেকেই শরীরটা ভালো লাগছে না৷ শরীর খুবই দুর্বল লাগছে। তারপরও নিজেকে সামলে নিচে নামলাম। তীব্র ততক্ষণে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে। আন্টি খুশি মনে কাজ করছেন। একবার এখানে ছুটছে তো আরেকবার ওখানে। তিহা সোফায় বসে শুধু একবার এদিক আরেকবার ওদিক তাকাচ্ছে। আমি ওর পাশে বসতেই আমার দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে বললো,
‘ভাবি আম্মু ঘুরছে নাকি পৃথিবী ঘুরছে গো? নাকি আমার মাথা ঘুরছে?’
ওর কথার ধরণ শুনে ফিক করে হেসে দিলাম। চিপস খাচ্ছিলো সেখান থেকে একটা চিপস মুখে পুড়তেই আন্টি কড়া গলায় তিহার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তিহা তোর ভাবিকে বল সে যেনো মেহমানের সামনে একটু ভালো মতো থাকে। আর পারলে যেনো এসে কাজে হাত লাগায়। কারণ তোর নানু কিন্তু এসেই বলবে, ‘নতুন বউয়ের হাতের রান্না খাবো।’
তিহা আমার দিকে তাকালো। আমি হাসার চেষ্টা করে উঠে গেলাম। কিচেনের দিকে যেতে যেতে বললাম, ‘আন্টি আজকে না হয় আমার সাথেও একটু কথা বলে নিয়েন। তিহার নানু তো এটাও দেখবে তার মেয়ের সাথে নাতবউয়ের সম্পর্ক কেমন! কি বলো তিহা?’
তিহা সাথে ‘হ্যাঁ হ্যাঁ’ বলে উঠলো। আন্টি কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমার কাছে এসে কি কি করতে হবে, কতটা কি দিতে হবে সবটা বুঝিয়ে দিলেন। আমি তার কথামতো রান্না শুরু করলাম।
রান্না শেষ হতে হতে দুপুর ২ টা বাজে। একেই শরীর খারাপ তারওপর রান্নার প্যারায় মাথা ঘুরিয়ে আসলো। পেট গুলিয়ে আসে। নিজেকে সামলে কোনোমতে রুমে আসলাম। কাবাড থেকে শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে শাওয়ারের জন্য ঢুকলাম। চোখে মুখে পানি দিয়ে আগে নিজেকে হালকা করে একেবারে শাওয়ার নিয়ে বের হতেই রুমে কারো উপস্থিতি টের পেলাম। বিছানার ওপর একটা মেয়েকে বসে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলাম। কে উনি? আমি টাওয়েল দিয়ে চুলগুলো আটকে নিলাম। মেয়েটা আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে বললেন,
‘তীব্র ভাইয়া কোথায়?’
‘উনি তো এখনো আসেননি। আপনাকে তো চিনলাম না!’
উনি আমাার প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করলেন না। কেমন দৃষ্টিতে যেনো তাকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। উনার এমন ব্যবহারের মানে বুঝে উঠলাম না। চুপচাপ চুল মুছে নিয়ে মাথায় কাপড় দিয়ে নিচে নামলাম। নিচে শোরগোল বেঁধে গেছে। নিচে এতো মানুষ দেখে বেশ অবাক হলাম। তীব্রর নানুবাড়িতে এতো লোক নাকি! গুণে গুণে দেখলাম প্রায় ১০ জন। সিড়ির ওপর আমাকে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে তিহা দৌড়ে আসে। এসে হাত টেনে ধরে বলে,
‘ভাবি জলদি আসো। এখানে দাঁড়িয়ে কি করো?’
আমি কিছু বলার আগেই তিহা থেমে যায়। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই তিহা কাছে এগিয়ে এসে কপালে গালে হাত ছুঁয়ে বলে, ‘তোমার শরীর এমন গরম কেনো ভাবি? জ্বর আসছে?’
আমি থতমত খেয়ে বললাম, ‘জানি না। শরীর ভালো লাগছে না এমনিতেই।’
তিহা কিছু বলতে যাবে তার আগেই একজন গম্ভীর মহিলা স্বরে ভেসে আসে। সেদিকে তাকাতেই তিহা বিড়বিড় করে বলে, ‘ওটা নানু।’
আমি শাড়ির আঁচল ভালো ভাবে টেনে নিলাম। নানু বললেন, ‘নাত বউ ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? নিচো আসো।’
আমি আর তিহা নিচে আসলাম। নানু আমার মুখ দেখে বললেন, ‘মাশাল্লাহ বউ তো খুবই সুন্দর।’
এরপর একজনকে ঈশারায় কিছু বলতেই তিনি ছুট লাগালেন। নানুই আমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তীব্রর এক মামা, মামি। ৫ জন কাজিন! ৩ জন মেয়ে। এর মধ্যে বড় নীলুফা আপু। তানহা আমার বয়সী আর মিলি তিহার বয়সী। ২ জন ছেলে। একজন মুন্না আরেকজন বিপ্লব। দুজনই আমার ছোট। ওহ হ্যাঁ মজার বিষয় হলো ওরা দুজনই টুইন। ওরা ছোট মামার ছেলে। ছোট মামা আর ছোট মামি আসে নাই। নীলুফা আপুর হাজবেন্ড আসে নাই তবে তার একটা পিচ্চি মেয়ে আছে। বয়স প্রায় ৩ বছর৷ সবাই টুকটাক কথা বললেও তানহা আর মামা মামি আমার সাথে তেমন কথা বললেন না৷ তানহা মেয়েটাই তখন আমার রুমে গেছিলো। নীলুফা আপু হাতে গয়নার বাক্স নিয়ে এসে নানুকে দিলেন। নানু হেঁসে তা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
‘নাতির বিয়েতে আসতে পারিনি কেউ। তাই তোমার নানু আর নানাভাইয়ের তরফ থেকে আমাদের উপহার। আর ওরা তোমাকে পরে দিয়ে দিবে।’
আমি গয়নার বাক্সর দিকে একবার তাকিয়ে আরেকবার তাকালাম আন্টির দিকে। আন্টি ঈশারায় নিতে বললেন। আমি নিয়ে নিলাম। এরপর টুকটাক কথা বলতেই তীব্র, আঙ্কেল আর তাদের সাথে বয়স্ক একজন লোক বাড়িতে ঢুকলেন। বুঝলাম এটা তীব্রর নানাভাই। আন্টি কাছে এসে বললেন সালাম করতে। আমি শাড়ির আঁচল টেনে সালাম দিলাম। সবাই তাকায় আমার দিকে। মামি চোখ মুখ কুঁচকে বললেন,
‘পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে হয় জানো না!’
উনার কথা শুনে যেনো হ্যাং মে’রে গেলাম। তবুও কিছু না বলে মাথা নিচু করতেই গম্ভীর গলায় সালাাম নিলেন নানাভাই। এরপর মামির উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আল্লাহ ছাড়া কারোর কাছে মাথা নত বা পায়ে হাত দিয়া সালাম করা যায় না। তাই নাতবউ যা করছে ঠিক করছে।’
মামি মাথা নত করে নিলেন। আড়চোখে তীব্রর দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি সবসময় উনাকে এভাবে দেখেই অভ্যস্ত। এরপর টুকটাক কথা বলে সবাই নিজেদের রুমে গেলো রেস্ট নিতে। তারপর খাওয়া দাওয়ার বিষয়টা হবে। আমিও নিজের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। পেছনে একবার তাকিয়ে দেখলাম তানহা আর তীব্র দাঁড়িয়ে আছে লিভিং রুমে। তিহা সিড়ির কাছ পর্যন্ত এসে আবার ঘুরে গেলো তীব্রর কাছে। আমি চুপচাপ রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম৷ তার বেশ কিছুক্ষণ পর আসলো তীব্র। এসেই নিজের গায়ের ব্লেজারটা রেগে ছুঁড়ে মারলেন। উনার হঠাৎ রাগের কারণ বুঝলাম না। এতক্ষণ তো তাকে স্বাভাবিকই মনে হয়েছে। আমি কিছু না বলে যেভাবে ছিলাম সেভাবেই রইলাম। কিছুই ভালো লাগছে না। তীব্র আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন,
‘চোখ মুখ এমন কেন? শরীর খারাপ?’
আমি পিটপিট করে তার দিকে তাকালাম। আসলেও শরীরটা খুবই খারাপ লাগছে কিন্তু আমি তো উনাকে বলিনি। তাহলে বুঝলো কিভাবে? ওভাবেই বসে থেকে বললাম,
‘কই না তো!’
তীব্র আর কিছু না বলে ওয়াশরুমে চলে গেলেন। খানিক বাদেই তিহা হাজির। নিচে ডাকছে আন্টি। তিহার সাথে নিচে এসে সবাইকে খাবার দিলাম।
__________
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই আড্ডা দিতে বসেছি। আমরা ছোটরা সবাই একসাথে। তিহা, মিলি, বিপ্লব, মুন্না সবাই আমাকে গল্প শুনাচ্ছে। এক পর্যায়ে কথা ওঠে তানহা আর তীব্রকে নিয়ে। আমি ওদের মুখে তানহার কথা শুনে বললাম,
‘আচ্ছা তানহা এতো চুপচাপ কেন? ‘ও’ কি সবসময় এমনই থাকে? আমার সাথে কথাও বললো না!’
মিলি আগ্রহ নিয়ে বললো, ‘আরেহ ভাবী ‘ও’ এমনিতে চুপচাপ স্বভাবের তবে আপনাকে সহ্য করতে পারে না তাই কথা বলে না। আব্বু আম্মুও আপনাকে পছন্দ করে না।’
‘কেনো?’
‘আরেহ জানেন না তানহা আপুর সাাথে তো..’
এটুকু বলতেই তিহা থামিয়ে দেয় মুন্নাকে। চোখ গরম করে বলে, ‘এগুলো আগের কথা এখন বলছিস কেনো? অনেক রাত হয়েছে যে যার রুমে যা। তাছাড়াা তোরা তো অনেকদুর জার্নি করে এসেছিস।’
তিহার কথায় সবাই চুপ মে’রে গেলো। আমি তিহার দিকে তাকালাম। কিছু লুকালো নাকি তিহা! এক এক করে তিহা, মিলি বিপ্লব চলে গেলেও সব শেষে মুন্না বের হতে গিয়েও আমার কানের কাছে এসে বলে,
‘তানহা আপু আর তীব্র ভাইয়ার বিয়ের কথা হয়েছিলো। আপনার জন্য তা ভেঙে গেছে এজন্যই আপনাকে ওরা সহ্য করতে পারে না। কিন্তু আমার আপনাকে খুব ভালো লেগেছে তাই জন্য বলে দিলাম।’
বলেই এক দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো। আমি ওর যাওয়ার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম। তানহার সাথে বিয়ের কথা হলে কেনো সে বিয়ে ভেঙে গেলো! কেনোই বা আমাকে বিয়ে করলো তীব্র! মাথার মধ্যে সব জট পেকে গেলো। ওভাবেই বসে রইলাম। মাথা ঝিম ঝিম করছে। ঠান্ডা বাড়তে লাগলো আমার। বুঝলাম জ্বর বাড়ছে। কোনো রকমে শুয়ে পড়লাম। খানিক বাদেই একবার তিহা এসে কপালে হাত দিয়ে দেখে কি কি যেনো বলে গেলো। জ্বরের ঘোরে ঠিকমতো তার কিছুই শুনতে পেলাম না। তিহা চলে যায়। আমি ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম।
ঘুম হালকা হলো কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শে। একেই তো ঠান্ডা তার মধ্যে জ্বর। তাই ঠান্ডা হাতটা একটু বেশিই ঠান্ডা মনে হলো। পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলাম তীব্র চিন্তিত মুখে পাশে বসে আছে। আমাকে চোখ মেলতে দেখে দুহাতে আগলে নিয়ে বললেন,
‘জ্বরে গা পু’ড়ে যাচ্ছে। আমাকে জানাওনি কেনো তোমার শরীর খারাপ? কিছু খেয়েছো? মেডিসিন নিছো?’
আমি উনার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হাত টেনে ধরলাম। ঠোঁট উল্টে বললাম, ‘আপনি ওই তানহাকে বিয়ে করবেন বলে আমাকে ছেড়ে দিবেন তাই না! পঁচা আপনি। কথা নাই আপনার সাথে।’
চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কাল দিতে পারিনি তাই আজ আরো এক পর্ব দিবো ইন শাহ আল্লাহ)