তীব্র প্রেমের নেশা পর্ব -০৫

#তীব্র_প্রেমের_নেশা (৫)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেও যখন আমার পাশের জায়গা খালি দেখলাম তখন বেশ অবাক হলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম কেবল সাড়ে ৬ টা বাজে। এতো সকালে তীব্র কই গেলো? কাল আমার সাথে রাগ দেখিয়ে কে’টে যাওয়া হাত নিয়েই বাসা থেকে বের হয়ে যায়। উনার এসব কান্ডে আমি শুধু হা করে তাকিয়ে ছিলাম। এরপর নিজে কোনোরকমে চেঞ্জ করে পুরো রুমটা গুছিয়েছি। সন্ধ্যা পেড়িয়ে যখন অনেক রাতেও তীব্র বাড়ি ফিরলো না তখন তিহা আমার রুমে এসেছিলো। গভীর রাত পর্যন্ত আমি জেগেই ছিলাম। নিজে না চাইলেও উনার জন্য চিন্তা হয়ে যাচ্ছিলো। জেগে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়েছি মনে নেই। এখন যখন ঘুম ভাঙলো তখনও তীব্রকে দেখলাম না। কিছুক্ষণ থম মে’রে বসে রইলাম। দরজা যেমন ছিলো তেমনই দেখে হতাশ শ্বাস নিলাম। সারা রাত মানুষটা বাড়ি আসেনি! কোথায় আছে, কি করছে কিছুই তো জানি না! হাতটাও তো প্রচুর র’ক্তাক্ত ছিলো এই অবস্থায় কোথায় চলে গেছে কিছুই বুঝতেছি না। মাথা হ্যাং মে’রে গেলো। ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আনমনে মুখ মুছে নিলাম। বেড সাইডের টেবিলে তীব্রর ফটো ফ্রেম দেখে কিছুক্ষণ ওভাবেই তাকিয়ে রইলাম। হুট করেই মনে পড়ে গেলো জুথি আপু আর জিনিয়ার কথা। সর্ব শরীর কেঁপে উঠে। নিজেই হতভম্ব হয়ে গেলাম নিজের কান্ডে। যে মানুষটাকে আমি সহ্য পর্যন্ত করতে পারি না তার জন্য চিন্তা করছি! যাকে মন থেকে মানতেই পারিনি তার জন্য ভাবছি আমি! সে ঠিক আছে কি না এটা ভেবে আমি রাতের ঘুম হারাম করে ফেলেছি! নিজের মাথার চুল নিজেরই একটা একটা করে ছি’ড়তে মন চাইলো। দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলাম। নিজেকে বুঝালাম, ‘উনার যা হয় হোক আমি ভাববো না উনাকে নিয়ে।’ নিজেকে হাজারটা বুঝ দিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ালাম। নিজেকে এতো ভাবে বুঝানোর পরও মনটা খুঁত খুত করছে। একসময় এই দুপাক্ষিক চিন্তায় নিজেই নিজেকে বকতে থাকলাম। নিচে এসে দেখলাম কিচেনে একজন মেইড টুকটাক সব কাজ সেড়ে নিচ্ছে। আমি কফি বানিয়ে খেতে শুরু করলাম। এখনো বাড়ির কেউ উঠেনি। ভাবলাম আজ আমিই নাস্তা বানাই৷ মেইড আন্টিকে আমতা আমতা করে বললাম,

‘আন্টি আজ আমি নাস্তা বানাই!’

আন্টি আমার দিকে তাকালেন৷ মাথা নিচু করে বললেন, ‘ম্যাম আপনি কাজ করেছেন শুনলে বড় ম্যাম রেগে যাবেন। আপনি বরং বলুন কি লাগবে আমি করে দিচ্ছি।’

কফির মগ রাখতে রাখতে ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘আন্টি আমি এখনো এতো বড়ও হয়ে যাইনি যে আপনি আমাকে ‘ম্যাম’ বলবেন আর আজকের নাস্তা আমিই রেডি করি! আপনার বড় ম্যামকে আমি বুঝাবো।’

উনি একটু আমতা আমতা করলেও আমি উনাকে সহজ করে নিলাম। উনার থেকে শুনেই আস্তে ধীরে নাস্তা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। নাস্তা বানানোর শেষের দিকে লিভিং রুমে শব্দ পেয়ে উঁকি দিলাম। তাকিয়ে দেখলাম তীব্র গটগট করে হেঁটে যাচ্ছে। চোখে মুখে গম্ভীরতা স্পষ্ট। উনাকে দেখেই আন্টিকে কাজ করতে বলে আমি দৌড় লাগালাম। পেছন পেছন দৌড়ে রুমে আসতেই দেখলাম তীব্র শার্ট খুলছে। আমি অন্যদিকে ঘুরে হালকা কাশি দিলাম। জানি না উনার আকর্ষণ আসলেই আমাার দিকে করতে পারলাম কি না! তবে উনার কোনো শব্দ পেলাম না। কয়েক মিনিট যাওয়ার পরও যখন উনার সাড়াশব্দ পেলাম না তখন আমি ঘাড় ঘুরিয়ে মাথাটা হালকা পিছে নিতেই ওয়াশরুমের দরজার শব্দ হলো। আমি বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম। উনি আমাকে ইগনোর করলো! চুপচাপ বিছানার ওপর পা তুলে দুগালে হাত দিয়ে বসলাম। উনি আমাকে ইগনোর করলো কেনো? সারারাত ছিলোই বা কোথায়? এখনই বা আসলো কোথা থেকে? আচ্ছা উনার কি কোথাও চক্কর টক্কর চলছে নাকি? ওএমজি! আমি এসব কি ভাবছি? উনি চক্কর চালাক মন চায় অন্য কাউকে বিয়ে করে নিক তাতে আমার কি! নিজেই নিজেরে বকতে বকতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হাজারটা চিন্তার ডিব্বা খুলে বসলাম। পাক্কা ২৫ মিনিট পর উনি বের হলেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বসে ছিলাম বলে হিসেবটা এতো সুন্দর করে বলতে পারলাম। উনি টাউজার আর টি-শার্ট পড়ে চুল মুছতে মুছতে বের হলেন। উনাকে দেখে আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। মুখের ওপর বিন্দু বিন্দু পানি, ভেজা চুলগুলো নিজেই এলোমেলো করছে। উনার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কাত হয়ে পড়ে যেতে নিলে নিজেকে সামলে নিলাম। উনি গম্ভীর মুখ করে নিজের কাজ করে গেলেন। আমার সাথে কোনো কথা বলা তো দুর তাকালেনও না। আমি নিজেই আমতা আমতা করে বললাম,

‘সারা রাত কোথায় ছিলেন? কোথা থেকে আসলেন সকাল সকাল? আর হাতে ব্যান্ডেজ করেননি?’

উনি গম্ভীর স্বরে জবাব দিলেন, ‘একটা প্রশ্নেরও জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না।’

জ্বলে উঠলাম আমি৷ রাগের মাথায় উনার সামনে গিয়ে পা উঁচু করে উনার টি-শার্ট আঁকড়ে ধরলাম। রাগে বললাম, ‘আমাকে জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছেন না মানে কি হ্যাঁ? আমি আপনার বউ আর তাই আপনি কোথায় ছিলেন, কোথা থেকে আসলেন সবটা জানার অধিকার আমার আছে।’

‘আমিও তো তোমার হাজবেন্ড তাহলে নিশ্চয় তুমি কোথাও যাচ্ছো তা জানারও অধিকার আছে আমার!’

উনার ঠান্ডা গলার কথায় আমি আস্তে করে টি-শার্ট ছেড়ে দিলাম। শুকনো ঢোক গিলে মাথা নিচু করে দাঁড়ালাম। উনি আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে বললেন,

‘তাছাড়া একটা রে’পি’ষ্টের ওপর নিশ্চয় বউয়ের অধিকার দেখাবে না!’

উনি আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চোখের আড়াল হয়ে গেলেন। এতক্ষণ কি হলো বিষয়গুলো পরপর ভাবতেই মাথা চক্কর দেওয়ার মতো অবস্থা। আসলেই তো! আমি কেনো ওই লোকটার ওপর বউয়ের অধিকার দেখাবো! উনি যা মনে চায় করুক। বড় করে শ্বাস নিয়ে আমি নিজেও নিচে নেমে আসলাম। তীব্র সোফায় বসে আঙ্কেলের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। তিহা আমার কাছে এসে বললো,

‘ভাবি তুমি নাকি নাস্তা বানিয়েছো!’

আমি হেঁসে মাথা নাড়ালাম। তিহা হাসি মুখে এটা ওটা বলতে থাকে। পাশ থেকে আন্টি খোঁচা মে’রে বললেন, ‘এসব ন্যাকামো করেই আমার বাড়ির মানুষগুলোকে আমার থেকে দুর করে দিচ্ছে।’

আমি বেশ অবাক হলাম। অবাকের রেশ ধরেই বললাম, ‘সরি আন্টি? আমি আপনার বাড়ির মানুষদের আপনার থেকে দূর করছি মানে?’

‘মানে বুঝো না! এমন ভাব নিবে না যে ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানো না। তোমার জন্য আমার ছেলেটা আমার সাথে কথা বলে না ঠিকমতো। তোমার জন্য আমার স্বামী পর্যন্ত আমাকে কথা শোনায়। আর এখন ন্যাকামো করছো!’

আন্টির কথায় অবাকতার শেষ থাকলো না আমার। আমার জন্য তীব্র উনার সাথে ঠিকমতো কথা বলেন না! আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম সোফায় বসা তীব্রর দিকে। তীব্র তখনো আঙ্কেলের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। আমি তিহার দিকে তাকাতেই তিহা অসহায় চোখে তাকিয়ে বলে,

‘আম্মুর কথায় কিছু মনে করো না ভাবি। আম্মু এমনিই বলেছে। তুমি চলো!’

পাশ থেকে আন্টি রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘হ্যাঁ এখন তো শুধু তুই-ই বাকি ছিলি! একেকটা শ’ত্রু জন্ম দিছি যেনো!’

আমি ফাঁকা ঢোক গিললাম। এতো এতো প্যাচের মধ্যে আমার মাথা ফাঁকা। আমি তিহার হাত ধরে দুরে টেনে আনলাম। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, ‘আন্টি আমাকে এমন বললেন কেনো? সত্যিটা বলো তিহা! তোমার ভাইয়া কি আসলেই আন্টির সাথে খুব একটা কথা বলে না আমার জন্য?’

তিহা করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ‘তুমি আম্মুর কথা মনে নিও না প্লিজ। আম্মু রেগে গেলে এসব বলেই থাকে। তাছাড়া তুমি তো জানো আম্মু তোমাকে তেমন একটা পছন্দ করেন না এইজন্যই এসব বলে।’

তিহা আমাকে হাজারটা বুঝ দিয়ে চুপ করিয়ে দিলো। বুঝলাম তিহা কিছু একটা লুকিয়ে গেলো তবুও কিছু বললাম না। চুপচাপ ওর সাথে এসে ডাইনিং এ বসে পড়লাম। খাওয়ার সময় আঙ্কেল, তিহা অনেক বার তীব্রকে জিজ্ঞেস করেছে তার হাত কীভাবে কে’টেছে কিন্তু সে কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ খেয়ে উঠে পড়ে। আন্টি তেমন ভাবে খেলেনই না। আমাকে অপছন্দ করার কোনো কারণ এতো দিন খুঁজে না পেলেও আজ মনে হলো হয়তো কারণ পেয়ে গেছি। শুধু একটু খুতিয়ে দেখতে হবে। আমি নিজেও দ্রুত খাওয়া শেষ করে তীব্রর পিছু ছুটলাম। রুমে এসে তীব্রকে বললাম,

‘হাতে ইনফেকশন হয়ে যাবে। ব্যান্ডেজ করে নিন।’

উনি কোনো উত্তর দিলেন না। আমার খুব রাগ হলো। তবুও মাথা ঠান্ডা করে উনার হাত টেনে ধরলাম। উনি ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘কি সমস্যা?’

আমি উনার হাত টেনে বসিয়ে দিয়ে দিলাম। ফাস্ট এইড বক্স এনে হাতে ওষুধ লাগাতে থাকলাম। জায়গাটা কি বি’শ্রী ভাবে কে’টেছে তবুও উনি কত সহজে সহ্য করছে! হাতে ব্যান্ডেজ করতে করতে আড়চোখে তাকিয়ে বললাম,

‘আপনি আন্টির সাথে ঠিকমতো কথা বলেন না কেনো?’

উনি চমকে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে তাকালেন। এরপর আমার থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কাবাডের দিকে যেতে যেতে বললো, ‘কে বলেছে ঠিকমতো কথা বলি না! অযথা কথা না বলে রেডি হও। ভার্সিটি আছে।’

আমি বাঁকা হেঁসে এগিয়ে আসলাম। বোরকা নিতে নিতে বললাম, ‘অযথা কথা নাকি সত্য কথা তা আমিও জানি আর আপনিও জানেন। অবশ্য আপনার থেকে এর বেশি আর কি আশা করা যায়! যে ছেলেটা একটা মেয়ের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে মে’রে ফেলতে পারে সে আবার নিজের মায়ের সাথে কি কথা বলবে! এসব মানুষের থেকে এমনিও দুরে থাকা উচিত। বাড়িতে তো তিহা আছে। কবে না কবে দেখা যাবে ওর সাথেও….’

কথা শেষ না করতেই তীব্র দ্রুত গতিতে ছুটে আসলো। রাগে আমার মুখ চেপে ধরে আরেকহাতে হাত মুচড়ে ধরে। উনার হঠাৎ আক্রমণে ভয় পেয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিলাম। তীব্র আগুন চোখে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,

‘আর একটা উল্টা পাল্টা কথা বললে তোমার জিভ টেনে ছি’ড়ে ফেলবো। আমার বোনকে নিয়ে তোমার এই মানসিকতা! আমাকে যা বলো চুপচাপ মেনে নিই বলে এই না আমার বোনকে নিয়ে বললেও চুপ করে শুনে যাবো।’

আমি উনার থেকে ছুটার চেষ্টা করতে করতেই অস্পষ্ট স্বরে বললাম, ‘নিজের বোনকে কিছু বললে আপনার এতো গায়ে লাগে! আর যখন অন্যের বোনের সাথে এতো ঘৃ’ণ্য একটা কাজ করেছেন। তখন?’

তীব্র ছুড়ে ফেললেন আমাকে। হঠাৎ ধাক্কায় তাল সামলাতে না পেরে দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেলাম৷ ব্যাথা পেয়ে ফ্লোরে বসে পড়তেই উনি তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে বললেন,

‘সত্যটা যেদিন জানতে পারবে সেদিন নিজেকে নিজেই ক্ষমা করতে পারবে না প্রাণ। আমার কাছে আসার জন্য, এক পলক দেখার জন্য মরিয়া হয়ে যাবে কিন্তু তখন অনেকটা দেড়ি হয়ে যাবে। তুমি প্রতিনিয়ত পু’ড়বে আর নিজেকে ঘৃ’ণা করবে সেদিনটা খুব কাছে। সবকিছুর জবাব তুমি সেদিন পাবে। সবকিছুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখো।’

চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here