#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব- ৯
সন্ধ্যাতারাটা আকাশের বুকে আজ জ্বলজ্বল করছে খুব। দক্ষিণ থেকে আসা হিমেল হাওয়া শরীরের প্রতিটি লোমকূপে কা-টা দিচ্ছে মৈত্রীর। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সে পলকহীন তাকিয়ে আছে আকাশের বুকে ওই এক টু-ক-রো তারার পানে। বুক ফে-টে কান্নার জোয়ার উঠে আসছে কণ্ঠদেশে অথচ সে কাঁদে না আজ অনেক গুলো বছর হলো। তার খালা বলে এটা তার একটা মানসিক স-ম-স্যা। বি-প-দ আপদে একজন সুস্থ মানুষ অবশ্যই আবেগী হবে তার চোখে জল আসবে প্রচণ্ড য-ন্ত্র-ণায় কিন্তু তার তেমনটা হয় না। সে কবে শেষ হেসেছিল মুখ খুলে, কবে কেঁ-দেছিল ঠোঁট ফুলিয়ে সেটা তার মনে নেই। মাকে তো হারিয়েছে ছোট বেলাতেই এতদিনে তো কিছুটা পরিবর্তন আসা উচিত তার। কিন্তু না তারমধ্যে কোন পরিবর্তন নেই। এই যে এখন মন কেমনের কা-ন্না আছে ভেতরে ভেতরে সেটা বাহিরে কেন স্পষ্ট হয় না! কেন তার ক-ষ্টগুলো গাল গড়িয়ে বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যায় না শূন্যে! শিপলুর আম্মু যখন পাত্র আর তাকে তার রুমে দিয়ে গেল কথা বলার জন্য তখন তার হুট করে মনে পড়ল বিড়ালচোখা লোকটার কথা। পাত্রের করা প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটা প্রশ্ন ছিলো, “তোমার কি নিজস্ব কোন পছন্দ আছে? পরিবারের পছন্দে বিয়ে করতে আ-পত্তি নেই তো কোন প্রকার?”
মৈত্রীর তখন ইচ্ছে করছিলো মুখের ওপর বলে দেয়, “আমার পছন্দ আছে কিন্তু কারো সাথে প্রেম নেই। আমার একজনের প্রতি দীর্ঘ পাঁচ মাসের ভালোলাগা আছে কিন্তু তার কোন সু দৃষ্টি কিংবা ভালো লাগা নেই আমার প্রতি। আমি পরিবারের পছন্দে বিয়েতে আপত্তি জানাতে পারব না কিন্তু সেই মানুষটাকে ছাড়া অন্য কাউকে নিজের বলেও ভাবতে পারব না।”
তার এই কথাগুলো মন কুঠিতেই ব-ন্দী হয়ে ছটফট করেছে কিন্তু ঠোঁট ভেদ করে উচ্চারিত হতে পারেনি। মেহমান চলে যেতেই সে বেলকোনিতে দাঁড়িয়েছিল। আকাশসম দুঃ-খ নিয়ে তাকিয়েছিল নিচতলার বেলকোনিটাতে। তার মন খা-রাপের পরিমাণ দ্বিগুণ করে দিয়েছে যখন দেখলো বিড়ালচোখা লোকটা ফোনালাপে লেগেছিল আধঘন্টা সময় নিয়ে। সেই থেকেই তার ভেতরে ঝ-ড় বইছে আর বাহিরটা হয়ে আছে শ-ক্ত পাথরের ন্যায়। আকাশে মেঘ নেই, শীতল হাওয়া নেই তার পাশে এক ছাঁদ শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই নেই।
“আকাশে আজ নক্ষত্রের দেখা নেই কি দেখতে ছাঁদে পাঠানো হলো!” সিঁড়ি বেয়ে ছাঁদে পা রেখেই ইরশাদ কাউকে বলে উঠলো কথাটা৷ ঘোর অমানিশায় চোখে পড়েনি ছাঁদের রেলিং ঘেঁষে কেউ দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চুপ। সে তো শুধু মেহেরের জে-দ ভরা আবদারে বাধ্য হয়ে এখন ছাঁদে উঠে এসেছে কিন্তু তার ফোনালাপের স্বর শুনে ভীষণরকম চমকে গেছে মৈত্রী। রেলিংয়ে দু হাতে ভর রেখে সে তারার দিকেই তো তাকিয়ে ছিল। পেছন থেকে পুরুষ কণ্ঠ শুনে এক মুহূর্ত মনে হয়েছিল কথাটা বুঝি তাকেই বলছে মানুষটা। কিন্তু ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই দেখল মানুষটার কানে ফোন, মুখে হাসি৷ কি এত কথা বলছে ফোনে আর কার সাথে! সন্ধ্যার আগেও কতক্ষণ সময় বলল কথা তারপর শুধু নামাজটা পড়তে গেল ওই তো ফিরে আবারও ফোন হাতে৷ উদাস মন জমিনে এবার বিনা মেঘেই ব-র্ষণের প্রস্তুতি চলতে লাগল। ইরশাদ তখনও বোধহয় খেয়াল করেনি ছাঁদে থাকা মানবীকে। সে এগিয়ে গিয়ে রেলিং ঘেঁষতেই চোখে পড়ল মৈত্রীকে৷ সে ফোন হাতেই কিছু বলতে চাইছিল মেয়েটিকে কিন্তু তাকে সেই সুযোগ না দিয়েই চঞ্চল পায়ে নেমে গেল মৈত্রী।
“এ্যাই তুই ফোন রাখ বাঁচাল। এত কথা কোথায় শিখলি রে!”
“কোথায় শিখলাম তা বাদ দাও আগে শোনো ভাই আজ কি কি করেছে আমার বান্ধবীদের সাথে। আমার বান্দবী রিয়া ভাইয়াকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলো বলে শপিংমলে সবার সামনে বলে কিনা, ‘এই পুঁচকি দুধের দাঁত তো এখনো পড়েনি এই বয়সেই ছেলেদের দিকে নজর দিচ্ছো! ঠা-টিয়ে লাগাব এক কানের পিছে।’ জানো শাদ ব্রো আমার বান্ধবী খুব ক-ষ্ট পেয়েছে সে আমার সাথে বন্ধুত্ব শে-ষ করে দিয়েছে।”
ভাইয়ের প্রতি ক্ষো-ভ আর ইরশাদের কাছে যেন অ-ভিযোগ প্রকাশ করছে মেহের। এমনটাই মনে হলো ইরশাদের কিন্তু তার তো মনে খচ-খ-চানিও হচ্ছে মৈত্রীর অমন তাকে দেখে নেমে যাওয়াটা। এই মেয়েটা এমন কেন! সবসময়ই উ-দা-স, অ-স্থির, অস্বা-ভাবিক আচরণ! এমন কি শুধু তার সামনেই নাকি সবসময়ই?”
মুজিব সাহেব নিজ ঘরে বসে ব্যক্তিগত ডায়েরিটা বের করলেন। রোকসানাকে ডেকে একে একে মৈত্রীর নানী, বড় মামা আর বড় খালার নাম্বার বের করতে বললেন৷ মেয়ে তার নিজের হলেও মেয়ের জন্য নেওয়া কোন সিদ্ধান্ত তাঁর একার হতে পারে না৷ সুমনা মানে মৈত্রীর মায়ের ভাই বোনের মতের বাইরে কোন সিদ্ধান্ত নিলে তারা যে মুজিবের গ-র্দা-ন নিতে পিছুপা হবেন না সে কথা তিনি খুব জানেন। তাই পাত্রের ছবিসহ লম্বা বায়োডাটা কপি সেন্ড করেছেন তিনজনের হোয়াটসঅ্যাপে। তাদের জবাব শুনে তবেই না পাত্রপক্ষকে জানানো হবে তারা কবে যাবে। রোকসানা অবশ্য এ নিয়ে কিছুই ভাবছেন না৷ তিনি যাই ভাববেন তাতেই দোষ বের করবে মৈত্রীর খালা রোমানা। মৈত্রীর মায়ের ঘরে সে আসার চেষ্টা করেছিল খুব মৈত্রীর মা হয়ে এ কথা অজানা নেই রোকসানার। মুজিব রোমানাকে নাকি বোন হিসেবেই দেখে এসেছে সবসময় তাই শালিকে বিয়ের প্রস্তাব প্র-ত্যাখান করে রোকসানাকে বিয়ে করেছিলেন। সেই থেকেই মৈত্রীর নানা বাড়ির সবাই মুখ কালো করে আছে আজ অনেকগুলো বছর ধরে। তবে সুমনার মেয়ের ব্যাপারে তারা দূর থেকেই বড় ক-ঠি-ন নজর রেখেছে মুজিব আর রোকসানার দিকে। অর্থের জো-র এ বিষয়ে তাদের খুব সহায়ক। পরপর তিনজনকে বায়োডাটা কপি সেন্ড করে মুজিব প্রথমেই কল দিলেন শ্বাশুড়িকে। বৃদ্ধা দেশে নেই আজ প্রায় আট মাস ধরে। মেয়ে রোমানা প্রবাসে স্যাটেলড সেখানেই আছেন৷ পরপর কয়েকবার কল করেও পাওয়া গেল না ভদ্রমহিলাকে বাধ্য হয়ে কল দিলেন শালির নাম্বারে। রোকসানা এ সময়ে খুব ত-ট-স্থ তার মনে মনে রা-গ হয় রোমানার সাথে যোগাযোগের সময়টুকু। অনেকটা দাঁতে দাঁত চে-পে স*হ্য করেন স্বামীর সাথে ওই নারীর আলাপের মুহূর্ত৷ আজও ব্যতিক্রম নয়৷ রোমানাকে ফোন দিতেই সে প্রথমেই খুঁচিয়ে বলল, “বড় জলদিই মনে পড়ল আমাকে? বউয়ের আঁচল ছেড়ে আমাকে কল দেওয়ার সুযোগ পেলেন আপনি?”
কল রিসিভ করেই বিনা সম্মোধনে এমন বাক্য একদমই কা-ম্য ছিলো না মুজিব সাহেবের। কিন্তু পরিস্থিতি নিজ থেকেই বা-জে হয়ে উঠল। তিনি রোমানার কথাটাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য সরাসরি মৈত্রীর কথা তুললেন। রোকসানা স্বামীর পাশাপাশি বসা আর ফোন স্পিকারও লাউডে থাকায় প্রথম কথাটা শুনেই রে-গে গেলেন। কোন আওয়াজ না করলেও দৃষ্টির ধা-রালো ভাব দিয়েই স্বামীকে রা-গ প্রকাশ করলেন। মুজিব দু দিক থেকেই আ-পসেট হলেন এই নারীদের আচরণে কিন্তু এই মুহুর্তে তার জন্য জরুরি মেয়ের কথা বলা। রেমানাকে পাত্তা না দিয়ে সরাসরি বললেন, “হোয়াটসঅ্যাপে তোমাকে, আম্মাকে আর বড় ভাইকে একটা ছেলের বায়ো পাঠিয়েছি। মৈত্রীর জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে খুব ভালো এক ফ্যামিলি থেকে। তোমরা বায়ো দেখো ভালো মন্দ যাই লাগে আশা করি শিগ্রই জানাবে যেন আমি পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পারি। পাত্রপক্ষ মৈত্রীর ছবি দেখে খুবই পছন্দ করেছে তাই চাইছি সামনাসামনি দেখা সাক্ষাতের আয়োজন করতে।”
অতি সন্তর্পণে লু-কিয়ে গেলেন আজকের সাক্ষাতের ব্যাপারটা। তিনি ভালো করেই জানেন এই নারী যদি জানতে পারে আজই দেখাদেখি হয়ে গেছে তাহলে নিজের মা-ভাইকে উল্টাপাল্টা বোঝাবে। বলে বসবে তাদের ছাড়াই মেয়ে বিয়ে দিয়ে ফেলছে তাই এই লুকানো। রোমানা সব শুনলো আরও কিছুক্ষণ মুজিবকে কথার বা-ণে আ-ঘা-ত করে তবেই ফোন ছাড়লেন৷ এরপরই মৈত্রীর বড় মামার সাথে যোগাযোগ করলেন এবং তিনি বলে বসলেন, নিজে একবার খোঁজ নেবে পাত্রের এরপরই এ বিষয়ে কথা বলবেন। এখানেই শ্বাস টা-ন পড়লো মুজিবের। এই লোক এবার পাত্রের জ্ঞাতিগুষ্টি সব দেখে তবেই কথা আগাবে। কে জানে কতোটা সময় নষ্ট করবে! মুজিব নিজে খোঁজ নিয়েছে এবং ইরশাদের বাবা ফখরুলের চেনাজানা লোক শুনে উনার মাধ্যমেও খোঁজ নিয়েছেন। পাত্র জাপানে যাবে পি এইচডি করতে, ঢাকায় নিজস্ব বাড়ি, গাড়ি সব আছে তারওপর পাত্রও দেখতে মাশাআল্লাহ। মনে মনে এবার ভয় লাগছে মৈত্রীর মামা কোন দোষ না বের করে বলেন এই পাত্র পছন্দ নয়। এসব কথা ভেবেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস।
“ইরশাদের মা ছেলেটাকে দেখেছো?”
ফখরুল সাহেব রাতের খাবার খেতে বসে প্রশ্নটা করলেন স্ত্রীর উদ্দেশ্যে৷ ইরিন বেগম ইরশাদ আর তার বাবাকে খাবার বেড়ে দিচ্ছিলেন। স্বামী করা প্রশ্ন শুনে একটা প্রলম্বিত শ্বাস ফেললেন৷ তাঁর এই শ্বাসের অর্থ ইরশাদের বুঝতে একটুও ভু-ল হয়নি তাই যথা সম্ভব দ্রুত খাবার গি-লতে চেষ্টা করছে। ফখরুল সাহেব বললেন, কি হলো কিছু বলছো না যে!
“পাত্রের বয়স আমার ময়ূখের সমান হবে। এই ছেলেকেই বাবা -মা বিয়ের করার জন্য সুন্দরী মেয়ে দেখে ফেলছেন আর আমার ঘরে তার চেয়েও বড় একটা ছেলে আছে৷ আমি বিয়ে দেব তো দূর এখনও পাত্রী খেঁজারই সুযোগ পাচ্ছি না। ঘরে পুত্রবধূর জায়গায় পাখি আর গাছপালা পালছি।”
ভাতের লোকমায় দৃষ্টি রেখে ইরশাদ বিড়বিড় করলো, “দুনিয়ায় বিয়েটা এত জরুরি কেন?”
“তুমিও খোঁজো আমি বলি কি মুজিব ভাইয়ের মেয়ের যদি এ জায়গায় বিয়ে না হয় তবে আমাদের ছেলের জন্যই প্রস্তাব দিয়ে ফেলো।”
“কিহ!” একসাথে দু দুটো কণ্ঠ একই শব্দ উচ্চারণ করে উঠলো। আর সেই শব্দে খাবার মুখে বিষম খেলেন ফখরুল সাহেব। গলায় ভাত আট-কে গেছে ভদ্রলোকের। কাশতে কাশতে চোখে মুখে পানি চলে এসেছে উনার। ইরশাদ দ্রুত নিজের চেয়ার ছেড়ে গ্লাসে পানি ঢেলে বাবার মুখের কাছে ধরল। ইরিনও স্বামীর পিঠে, বুকে মালিশ করে দিতে লাগলেন৷ কয়েক মুহূর্ত কা-টতেই ফখরুল সাহেব একটু স্থির হয়ে তাকালেন স্ত্রী -পুত্রেদ দিকে। ইরশাদ বাবার দৃষ্টিতে অপ্রস্তুত হয়ে কাঁচুমাচু করে বলল, ওই মেয়েটা ভালো একদম ময়ূখের বিপরীত খুব মানাবে তাদের দুজনকে৷ দেখো ব্যবস্থা করা যায় কিনা এমনিতেও ময়ূখ তো যেখানে যায় সেখানেই সুন্দরী মেয়েদের পেছনে ঘুরঘুর করে ওকে বাঁ*ধার ব্যবস্থা করে ফেলো আম্মু নাক কা-টার আগে।”
চলবে
(রি-চেক খরা হয়নি৷ ভু-লত্রু-টি ক্ষমা করবেন)