#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
(কার্টেসি বা কপি করা নিষেধ শেয়ারিং ছাড়া)
……
আকাশে ঘন কালো মেঘ জমেছে।কে জানে কখন বৃষ্টি রূপে মাটিতে আছড়ে পড়ে।বর্ষাকালে তো এমনটা অহরহ হয়ে থাকে।দিন নেই রাত নেই বৃষ্টির হুট হাট আগমন।গ্রীষ্মের প্রচন্ড দহন শেষে বৃষ্টি যেনো আসে ভৈরব হরষে গুরুগম্ভীর হয়েই।এ যেনো রাজপুত্রের মতো ছুটে আসে।তার রথের মর্মর ধ্বনি শোনা যায়।তার বাঁকা তলোয়ার যেনো ঝলসে উঠে।বিবর্ণ প্রকৃতি যেনো হুট করেই কোমল আর সজীব হয়ে উঠে।এ যেনো এক আনন্দ বেদনার ঋতু।মেঘের গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। । বাহিরে বাতাসের বেগ ধীরে ধীরে বাড়ছে।কেমন যেন একটা বিষাদের দামামা বেজে চলেছে।এ যেন বৃষ্টির আগমনি বার্তা।আকশে যেমন মেঘ জমেছে মানুষের মনের আকাশেও তো মেঘ জমে কই কেউ তো দেখে না,বুঝে না।আচ্ছা কেন বুঝে না? একটু ভালো করে চোখের দিকে তাকালেই ত বুঝা যায়।চোখতো মনের কথা বলে।চোখে হৃদয়ের স্বরূপ ফুটে উঠে।
এক তরুণী জানালার পাশ ঘেষে দাঁড়িয়ে ভেবে চলছে।বাতাসের ঝাপটায় তার এলোকেশগুলো উড়ছে।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে।যেমন কতো দিনের জমানো কথা,দুঃখ,বেদনা সব আকাশকে পাঠাচ্ছে।ঠিক সেই সময় নীলা এসে দরজা ধাক্কাচ্ছে।
-এই ছায়া কোথায় তুই? শুনতে পাচ্ছিস? দরজাটা খোল।বাহিরে বৃষ্টি আসবে ছাদ থেকে কাপড় গুলা আনতে হবে তো।
নীলার ডাকে ছায়ার যেন মনঃক্ষুন্ন হলো।চোখ মুখ কুচকে ফেলে।
ইশশ মেয়েটার যন্ত্রণায় একটু আবহাওয়া উপভোগ করা যায় না।কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে স্থিরচিত্তে দরজা খুলতে খুলতে বললো,
-এত অস্থির কেন তুই?উফফফ।কাপড় ভিজলে আবার শুকানো যাবে।এই সময়টা চলে গেলে আর ফিরে আসবে না।কালের পরিক্রমায় অতিবাহিত সময় যে ফিরে আসে না।
নীলা নরম দৃষ্টিতে চাইলো এইবার ভালো করে ছায়ার দিকে।দেখতে বেশ লম্বা।আজকালকের যুগের মেয়েরা এতটা লম্বা হয় না সচরাচর।মুখটা এতটা গোল নয় আবার এতটা লম্বাও নয়।খাড়া নাক,চিকন গোলাপি আভার ঠোঁট,রেশমি বাদামি চুল,ছিম ছাম গৌড় বর্ণের অধিকারী সে।কিন্তু তার এই রূপই যেন কাল হলো তার জন্য।ইশ কি মায়া মুখটায় অথচ সেই মুখে হাসির লেশমাত্র নেই।এ যেনো কোন এক রূপকথার জীবন্ত কিন্তু মৃত প্রায় মানবী।
-বাইরে কাপড় ভিজে যাবে। পড়ে এই ভিজে কাপড় শুকাবি কোথায়?
ছায়া এইবার চঞ্চলা চপলা তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকায়।সময়ের ব্যবধানে মেয়েটা তার কতো কাছে চলে এলো।এই যে তার ঘরে দমবন্ধ লাগছিলো,কষ্টগুলো আকাশের কাছে বিলি করার পায়তারা করছিলো মেয়েটা ঠিক সেই সময়ে তাকে বাইরে পরোক্ষভাবে বৃষ্টি বিলাসের আহ্বান জানায়।মনে মনে হাসে ছায়া।ঝলমলে গলায় বললো,
-না যেয়ে উপায় দেখছি না।চলুন গিয়ে উদ্ধার করি আপনাকে।
নীলা ঠোঁট প্রসারিত করে এক হৃদয় বিগলিত হাসি দেয়।ফর্সা গোল মুখশ্রীতে হাসিটা বেশ মানাচ্ছে।
ছায়া গুটি গুটি পায়ে নীলার হাত ধরে গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠছে।
যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়…
যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়…
এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে জল ভরা দৃষ্টিতে
এসো কোমল শ্যামল ছায় ।
যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরি
কদম গুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি ।।
উতলা আকাশ মেঘে মেঘে হবে কালো
ছলকে ছলকে নাচিবে বিজলী আরো
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়…
ছাদের দরজা খুলে যেইনা ঢুকলো তখনি ঝর ঝর করে বৃষ্টি পড়া শুরু করলো। ছায়ার কোমল স্নিগ্ধ মুখশ্রীতে যেন আধার নেমে আসলো ।বৃষ্টিতে ভিজতে এখন আর তেমন ভালো লাগে না।একটা সময় খুব ভালো লাগতো বৃষ্টি বিলাস করতে। মানুষের ভালোলাগারও পরিবর্তন ঘটে সময়ের পরিক্রমার সাথে।ছায়া জলদি কাপড় গুলা নিয়ে নিচে নেমে এলো দ্রুত পায়ে। আর নীলাকে বললো সেও যেন তাড়াতাড়ি নেমে আসে।দ্রুত বেগে দৌঁড়ে আসায় ছায়া হাপাচ্ছে।ছায়ার ফর্সা মুখখানায় বৃষ্টির পানির বিন্দু বিন্দু ফোটা লেগে আছে।কাপড়টাও কিঞ্চিৎ ভিজে গিয়েছে।সে গায়ের উড়নাটা টেনে মুখের পানিটুকু মুছায় ব্যস্ত হয়ে উঠলো। নীলা উপড় থেকে নিচে নামছে আর ছায়ার এই অবস্থা দেখে জোড়ে জোড়ে হাসছে।এর থেকে মজার বিষয় যেনো আর হতেই পারে না।তার পরিকল্পনা যেনো কিঞ্চিৎ সফল হলো।
ছায়া এইবার নিজের ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করলো।কপালে দুই ভাজ ফেলে ফিচেল গলায় বললো,
-একি নীলা তুইতো একবারে কাকভেজা হয়ে ফিরে এলিরে।হাতের কাপড়গুলাও ভিজে গিয়েছে।কি লাভ হলো বলতো?
ঠোঁটে স্নিগ্ধ হাসির ফোয়ারা নিয়ে নীলা বলল
-ছায়া রে মাইন্ড ফ্রেশ হবারও একটু দরকার আছে।কি সারাদিন ঘরের এক কোণায় পড়ে থাকিস।কিভাবে পারিস তুই? আমি হলে জীবনেও পারতাম না।
ছায়া নীলার কথা শুনে মলিন হাসলো কিন্তু কিছু বলল না।
নীলা আবারও বলল,
– কাল মেডিকেলে জলদি যেতে বলা হয়েছে সবাইকে।তাই আজ জলদি ঘুমিয়ে যেতে হবে।সকালে উঠতে হবে। এই বলে ঘরের দিকে পা বাড়ালো।ছায়াও গেলো পিছু পিছু।
রুমে এসে কাপড় গুলো রেখে দুজনে ভিজে কাপড় চেঞ্জ করে ফেললো। ছায়া এক কাপ গরম গরম চা বানিয়ে নিয়ে পড়তে বসে গেলো। এইবার যে সে মেডিকেল তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী।কিছুদিন পরই পরীক্ষা।এই একটা জিনিস সে হেলা ফেলা করতে পারে না।এই পুরো জীবনটাই তো একটা পরীক্ষার রণক্ষেত্র। একটা ভুলে যে তার জীবনের বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে।
…..
The Royal London Hospital
ইমারজেন্সিতে একজন পেশেন্টকে ভর্তি করানো হয়েছে।শ্বাস-প্রশ্বাস খুবই ধীর গতিতে চলছে।বয়সটা আনুমানিক ৩০-৩১ হবে।গুলি লেগেছে বুকে একটি,হাতে একটি। বাচঁবে নাকি বলা যাচ্ছে না।রক্তক্ষরণ খুব বেশি হয়ে গিয়েছে।অপারেশন করাটা রিস্কি।ইমারজেন্সিতে ডক্টররা মিটিং এ বসেছে।তারা দ্রুত ৪ জনের একটি টিম তৈরি করে যাদের লিড করবে অরণ্য চৌধুরী।অরণ্য চৌধুরী খুবই ইয়াং এবং দক্ষ কার্ডিওলজিস্ট + সার্জন।বয়স ২৮ এর কাছাকাছি। অপারেশন শুরু হবার আগে সে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো।অরন্য সবুজ রঙের এপ্রোন,মাস্ক,ক্যাপ আর হাতে গ্লাভস পড়ে তৈরি হয়ে যায় ওটিতে যাওয়ার জন্য।ঠিক তখনই নীল রঙের স্কার্ট, আর শার্ট পরিহিত অল্প বয়সী শ্বেত বর্নের এক রমনী তার সামনে আহাজারি করছে,কাদঁছে।মেয়েটির চোখ কান্নামিশ্রিত।শোকের ছায়া মুখমন্ডল জুরে।মেয়েটির শার্টের একাংশ জুড়ে ছুপ ছুপ লালাভ রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে আছে।চুলগুলো এলোমেলো। মেয়েটি এইবার ফোলা ফোলা চোখ আর ফ্যাকাশে চেহারা নিয়ে ভাঙা গলায় বললো,
-প্লিজ সেইভ মাই হাসবেন্ড ডক্টর। সেইভ মাই লাভ।ইট টোটাল্লি ডিপেন্ডস অন ইউ।আই উইল ওয়েট ফর হিম পেশিয়েন্টলি।
অরণ্য কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে দেখলো এক মৃত্যুপথযাত্রীর প্রেয়সীকে।সে তাকে আশ্বস্ত করলো যে সে চেষ্টা করবে বাকিটা সৃষ্টিকর্তার হাতে।মানুষকে সৃষ্টিকর্তা নির্দিষ্ট আয়ু দিয়ে পাঠায় যা কেউ চাইলেও বদলাতে পারে না।কিন্তু এই শরীরের আগেই অনেকের আত্মার মৃত্যু ঘটে যায়।মানুষ তখন জীবিত থেকেও মৃত।চাইলেই সেই মৃত দেহে প্রাণ ফিরে আসতে পারে ভালোবাসার মাধ্যমে।অরন্য নিজের মনে কতকবার আওড়ালো “ভালোবাসা” “ভালোবাসা ”
অরন্যের বুক চিরে বেরিয়ে আসে এক দীর্ঘশ্বাস।
অপারেশন শুরু হলো।কিন্তু বাইরে পেশেন্ট এর বিবাহিতা স্ত্রী হাউমাউ করে কাদঁছে।বুকটা ফেটে যাচ্ছে।কি নিদারুণ কষ্ট!যে যাবার সেতো চলে যায় কিন্তু পিছনে যাদের রেখে যায় তাদের আজীবন সেই ব্যাথা যত্ন করে আগলে রাখতে হয়।
অপারেশন শেষ হলো দীর্ঘ ৪ ঘন্টা পর।দরজা খুলে করিডোরে আসতেই দেখলো মেয়েটি বেঞ্চে মাথা এলিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে চোখে এক সমুদ্র উৎকণ্ঠা নিয়ে।মেয়েটি যেন অস্থির চিত্তে দৌঁড়ে এলো। উৎসুক নয়নে তাকিয়ে থাকলো। অরণ্য চেয়ে রইলো শূণ্য দৃষ্টিতে আর ভাবলো সে এমন ভালোবাসা পেলো না জীবনে।তার জন্য কেউ এইভাবে অপেক্ষা করলো না।সেই নিষ্ঠুর মানবীর হৃদয়ে একটু জায়গা হলো না তার জন্য।অরন্য কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে তুললো তার অধরে।
– ইউর ওয়েট ইজ ওভার।হি ইস টোটাল্লি ফাইন।অপারেশন ইস সাকসেসফুল।ইউ ক্যান মিট হিম হুয়েন হি রিগেইনস হিজ সেন্স।নাউ হি ইজ ইন অভজারভেশন।
(আপনার অপেক্ষার অবসান ঘটেছে।সে এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।আপনি তার জ্ঞান ফিরলেই দেখা করতে পারবেন।এখন তিনি আমাদের অবজারভেশনে আছেন)
মেয়েটির খরস্রোতা বুকটা যেন প্রশান্তিতে ছেয়ে গেলো।অধর রংধনুর ন্যায় হাসিতে ভরে উঠলো। মন ভরে দোয়া করলো। আর স্নিগ্ধ কন্ঠে বললো,
-ইউ গেভ মাই লাই লাইফ ব্যাক টুডে।ইফ ইউ নিড সামথিং ফ্রম মি জাস্ট রিমেমবার মি ওয়ান্স।
(যদি কখনো আমার প্রয়োজন পড়ে যে কোন দরকারে আমাকে একবার স্মরণ করবেন।আপনি আজ আমার জীবন আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।)
এত ক্রিটিক্যাল কেইস সাকসেসফুল ভাবে সম্পন্ন করার জন্য হসপিটাল কমিটি অরণ্য চৌধুরীকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে।সবাই খুবই প্রশংসা করছে।সে হসপিটালে খুবই পপুলার আর প্রশংসিত একজন।দেখতেও বেশ সুদর্শন,লম্বা চওড়া।কিন্তু সৌন্দর্যই কি সব? নাহ। এর বাইরেও আরও অনেক কিছু আছে মানুষের জীবনে।মানুষের আসল সৌন্দর্য তো তার ব্যক্তিত্বে।
অরন্য নিজের এপ্রোন খুলে হাতে নিয়ে নিজের কেবিনের দিকে রওনা হয়।স্থির হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়।চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস নেয়।তখনই কানে বাজে কারো চুরির রিন রিন আওয়াজ।অরন্যের ঠোঁটে ফুটে উঠে তাচ্ছিল্যের হাসি।
-এই মন আজ মরিচীকার তরে সুবিশাল তপ্ত মরুভূমি পাড়ি দিলো।সে যেনো মরিচীকাই রয়ে গেলো।মিললো না তাহার দেখা।কবে পাবো,কবে পাবো তাহার দেখা?গ্রীষ্মের দাবদাহে আজ এই মন জমিন চৌচির।
#সূচনা_পর্ব
#চলবে
(এটা আমার লেখা প্রথম গল্প।মূলত শখের বশেই লেখা।তাই আপনারা উৎসাহ দিলে আমি বাকিটা লিখব।ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)