#বৃষ্টিস্নাত_সাঁঝ
|৪|
#সা_জি_দ
ভোরের মিষ্টি আলো চোখেমুখে এসে পড়তেই সাঁঝ এর ঘুম ভেঙে যায়। তবে চোখ খোলে না। চোখ বন্ধ রেখেই আড়মোড়া ভেঙে উঠতে গেলে নিজেকে আবদ্ধ অবস্থায় আবিষ্কার করে। তড়িৎগতিতে চোখ খুলতেই প্রহর এর সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। ঘুমঘুম চোখে প্রহর জিজ্ঞেস করে-
“কী সমস্যা?”
পরক্ষণেই আবার বলে-
“যেই সমস্যাই হোক না কেন, চুপ করে শুয়ে থাক।”
নিজের কথা শেষ করে সাঁঝকে নিজের সাথে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে আবার চোখ বন্ধ করে। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে রয় সাঁঝ। ক্ষনিক বাদেই কালকের ঘটনা মনে পড়তেই লজ্জায় রাঙা হয়ে যায় সাঁঝ। এজবার চোখ খুলে সাঁঝ এর লজ্জারাঙা মুখের দিকে একনজর তাকিয়ে আবারও চোখ বন্ধ করে নেয় প্রহর। এই চোখ এর দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার সাধ্য তার নেই।
_____________________
ফুরফুরে মেজাজে কিচেন এর দিকে যাচ্ছিলো সাঁঝ। তবে নীলিমা চৌধুরীর ঘরের সামনে এসে থমকে যায়। কারও ঘরের বাইরে আড়ি পাতার অভ্যাস না থাকলেও আবছাভাবে নিজের নামটি কানে আসায়ই সে নেমেছে।
“দেখছেন ভাবি, এতবেলা হইছে এখনও সাঁঝ এর কোনও খবর নাই। আপনিও তো বান্ধবীর মেয়েরে বউ করে এনে একদিনেই মাথায় তুলে ফেলছেন। পোলাটারেও তো প্রথম দিনেই বশ করে ফেলছে, কালকে কেমন চটাংচটাং কথা বললো!”
সাঁঝ কন্ঠ শুনে বুঝলো যে ইনি প্রহরের সেই ফুপু। একনজর ঘড়ির দিকে চোখ বুলালো সাঁঝ। সবেমাত্র সাতটা পয়ত্রিশ বাজে। এটা কি খুব বেশি সময়?
“আমার ছেলে বা ছেলের বউ কাউকে নিয়েই তোমার এত ভাবতে হবে না জুলেখা। অন্যকে নিয়ে বলার আগে নিজের দিকে তাকাও। বড়ছেলে খোজ নেয়না আজ কতদিন?”
নীলিমা চৌধুরীর কন্ঠ শুনে বোঝা গেল যে তিনি ননদের উপর অতিরিক্ত বিরক্ত। শাশুড়ির কথা শুনে সাঁঝ এর অদ্ভুত শান্তি লাগলো। আশ্চর্য! এখানে শান্তি লাগার মত কোনও ব্যাপার আছে? ওনারা হয়ত আরও কিছু বলেছেন তবে সেসব শোনার ইচ্ছে নেই দেখে আবারও কিচেনের দিকে পা বাড়ালো সাঁঝ। তার যা শোনার সে শুনেছে। কিচেন এর দিকে যেতে যেতেই সাঁঝ মনস্থির করলো, শাশুড়ির মনে সে কোনদিন কষ্ট দেবে না, কোনদিন না!
তবে সাঁঝ এর ধারণা খুব একটা সত্যি না, ননদের কথায় বিরক্ত হয়ে সাঁঝ চলে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নীলিমা চৌধুরী বেড়িয়ে এসেছিলেন। খানিকক্ষণ গজগজ করে জুলেখাও নিজের ঘরে চলে যায়।
_____________________
“আপনার নাম কী আপু?”
” আই এই বাইত কাম করি ভাবি, আরে আপনি কওন লাগতো না। তুই করি কইয়েন।”
“আচ্ছা আমি তুমি করেই বলি। তোমার নাম বললে না?”
“রত্না।”
“বাহ! সুন্দর নাম তো! কিন্তু তোমার কথাবার্তা তো চট্টগ্রামের মত লাগছে না।”
“আই তো চিটাং এর না ভাবি, আঙ্গ বাড়ি হেনী।”
মেয়েটার কথা শুনে সাঁঝ কিছুটা অবাক হলো। সাঁঝ কিছু বলার আগেই রত্না আবার বললো-
“বাপ-মা নাই তো, হেল্লাই চাচায় এতদূরে কাম কইরতাম দিছে। তয় কামডা ভালায়ে করছে। খালাম্মারা বহুত বালা মানুষ।”
বলেই আবারও কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো রত্না। সাঁঝও আর কিছু বললো না। সে কিচেন এ এসেছে বেশ অনেকক্ষন হয়েছে। তার শশুর বাজার নিয়ে ফিরলেই রান্নাবান্না শুরু হবে। এখন পেয়াজ-মরিচ এসব কেটে রাখা হচ্ছে। সাঁঝ বেশ কয়েকবার বলার পরও রত্না তাকে কোনও কাজে হাত দিতে দেয়নি। প্রতিবারই বলেছে-
“খালাম্মা মানা কইরছে ভাবী। আই খালাম্মার কতা ছাড়া কিছু করি না।”
তাই সাঁঝ এককোনায় দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে রত্নার কাজ দেখছে। ঘরকন্নার কাজে মেয়েটা যে বেশ পটু তা বোঝাই যায়। কিছুক্ষণ পর রত্না বললো-
“একখান কতা জিগাই ভাবি?”
“হ্যাঁ,বলো।”
“আন্নে আর কতা বেগ্গিন কেন্নে বুজেন? খালাম্মারা তো অদ্দেকগিনএ বুজে না।”
সাঁঝ হেসে উত্তর দিল-
“আমার নানুর বাড়িও ওইদিকেই।”
রত্না কিছু বলার আগেই নীলিমা চৌধুরী এসে কিচেন এ ঢোকেন। মাথার ঘোমটা ঠিক করে শাশুড়ীকে সালাম দেয় সাঁঝ। সালামের উত্তর দিয়ে নীলিমা চৌধুরী বলেন-
“আমার সামনে এত ঘোমটা টোমটা দিতে হবে না মা। আমি লিনা খান এর মত দ’জ্জা’ল শাশুড়ী না।”
শাশুড়ির কথায় হেসে দেয় সাঁঝ। মানুষটা যে কতটা অমায়িক তা সে এতক্ষণে বুঝে ফেলেছে।
________________________
সাড়ে সাতটার দিকে একগাদা সদাই নিয়ে ঘরে ঢোকেন আফতাব চৌধুরী। শুরু হয়ে যায় রান্নাবান্নার তোড়জোড়। অতিথিরাও সবাই উঠে গেছে। প্রচুর ব্যাস্ত থাকার পরও সাঁঝকে চুলার কাছে ঘেষতে দিচ্ছেন না নীলিমা চৌধুরী। সাঁঝ কয়েকবার চেষ্টা করায় ওকে ধমক দিয়ে এককোনায় দাড় করিয়ে রেখেছেন। জুলেখা বোধহয় এটা নিয়েও কিছু বলতো, তবে নীলিমা চৌধুরীর কড়া দৃষ্টি দেখে কিছু বলার সাহস পেল না। একফাকে এক কাপ চা হাতে সাঁঝকে পাঠায় প্রহর এর ঘরে। ফ্রেশ হয়ে এককাপ চা না খেলে নাকি তার দিন ভালো যায় না! ঘরে এসে প্রহরকে কোথাও না দেখে বেডসাইড টেবিলে চা’র কাপ রেখে চলে আসতে উদ্যত হয় সাঁঝ। দরজার দিকে কয়েক পা যেতেই পেছন থেকে সাঁঝকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কেও। পেছন ঘুরতেই প্রহর এর মুখশ্রী চোখে পড়ে। সে তো ভয়ই পেয়ে গেছিলাে। পরক্ষণেই নিজের উপরই বি’রক্ত হয়, প্রহর এর ঘরে প্রহর ছাড়া আর কে থাকবে!
“তোমাকে না বলেছিলাম, চুপচাপ শুয়ে থাকতে, উঠলে কেন?”
সাঁঝ অস্পষ্ট স্বরে বোধহয় কিছু বললো, তবে তা প্রহর এর কান পর্যন্ত পৌছালো না। তাই আবারও বললো-
“জোরে বলো।”
“আমি কী সারাদিন কুম্ভকর্ণের মত শুয়ে থাকবো নাকি!”
“তো, আমি যে এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম, আমি কুম্ভকর্ণ!”
“আমি কী জানি!”
“আমার মত সুদর্শন একটা ছেলেকে কুম্ভকর্ণ বলতে পারলে!”
“নিজের ঢাক নিজে পেটাচ্ছেন!”
কথাগুলো বলেই সাঁঝ অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো যে, একদিন আগেও যার সাথে কেবল ক্ষনিক সময়ের জন্য দেখা হয়েছিল তাকে এতটা আপন মনে হচ্ছে! এটা কী শুধুই বিয়ের জন্য নাকি অন্য কোনও কারণ আছে!
প্রহর বোধহয় কিছু বললো, তবে তা সাঁঝ শুনতে পেল না।
________________
সকালের নাস্তা করার পরপরই সাঁঝকে ঘরে পাঠিয়ে দেন নীলিমা চৌধুরী। সাঁঝ কিছুটা গাইগুই করলেও নীলিমা চৌধুরী পাত্তা দিলেন না। এই সময়ে স্বামী-স্ত্রীর একসাথে থাকা জরুরি।
প্রহর ল্যাপটপে কিছু একটা করছিল। সাঁঝ ঘরে ঢুকতেই চোখ তুলে জিজ্ঞেস করলো-
“তোমার কোনও ফার্নিচার লাগবে?”
সাঁঝ অবাক হয়ে বললো-
“এ’ঘরে তো সবই আছে। আমার আবার কী লাগবে?”
“না মানে, এখানে তো কোনও মেয়েলি ফার্নিচার নেই।”
“আমার কিছু লাগবে না।”
“আচ্ছা, কখনও লাগলে বলো।”
প্রহর এর সাথে কথাবার্তা শেষে সাঁঝ বারান্দার দিকে পা বাড়িয়েছিল, তবে নিচতলা থেকে আসা চিৎকার-চ্যাচামেচি কানে যেতেই থমকে গেল। প্রহর-সাঁঝ দুজনই একইসাথে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে, উদ্দেশ্য নিচে কী হয়েছে তা জানা।
চলবে……..