#বসন্ত_কন্যা
#পর্ব_৩
#লেখিকা : সাদিয়া
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
ঐ দিনই এ বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল নিশা। ব্যাগটা আগেই গুছানো ছিল। এ বাড়িতে দুই সপ্তাহ হয় আসলেও ব্যাগ থেকে জামা কাপড় বের করে আর আলমারিতে রাখেনি নিশা। বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার সময় সোহেল ইমদাদও এবার আর আটকায়নি নিশাকে । আসলে সেও নিজের বোনের সম্পর্কে বাজে কথাগুলো শুনে মেনে নিতে পারেনি। শুধু নিশা চলে যাওয়ার সময় নিশার হাত দুটো ধরে বলেছিল : আমাকে মাফ করে দিস মা। আমার জন্য তোকে আজ এতটা অপমান সহ্য করতে হলো। ছেলেটা উচ্চ শিক্ষিত হলেও ব্যবহার শিখতে পারেনি।
নিশা চলে যাওয়ার পর বেশ অস্থির লাগছিল ফয়সালের , মনের মধ্যে কেমন একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল। কিন্তু নিশাকে স্যরি আর বলা হয়ে উঠেছি। ঐ যে প্রচন্ড ইগো, নিশার মতো মিডেল ক্লাস একটা মেয়েকে স্যরি বললে তার ইগোতে লাগবে। বেশ কয়েকদিন ধরে নিশার ওর দিকে আড় চোখে তাকানো, উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখা দৃষ্টিগোচর হয়েছিল ফয়সালের। তাই তো ঘুম থেকে উঠে সকাল সকাল টেবিলের উপর চিঠিটা দেখেই প্রথম সন্দেহটা নিশার প্রতিই হয়েছিল।
_________________
দেখতে দেখতে কেটে গেল সপ্তাহ খানেক। এই এক সপ্তাহ ধরে কলেজে ভালো করে ক্লাস করেনি নিশা, এক প্রকার নিজেকে সামলেছে, নিজের সাথে লড়ছে, কিশোরী বয়সে জন্ম নেওয়া অনুভূতিকে কবর দেওয়ার চেষ্টা করেছে, রুম আটকে চোখের জল বিসর্জন দিয়েছে। হয়তো অনুভূতিগুলো এখনও সবটা শেষ হয়ে যায়নি তবে নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। এক সপ্তাহ পর আজ কলেজে এসেছে নিশা। এসেই দেখে আয়না বাংলার পাঁচের মতো মুখটা করে বসে আছে আর অন্যরা তার মজা উড়াতে ব্যস্ত। নিশা অবশ্য সবটাই জানে যে কেন আয়না এই বাংলার পাঁচের মতো মুখটা করে আছে। তার আর্মির ক্যাপ্টেন ভাই দ্যা গ্রেট আবসার তাহমিদ ভাই বাড়ি ফিরেছে তাও দুই মাসের ছুটিতে। বাড়ি ফিরেই মেয়েটার জীবন নাজেহাল করে ছেড়েছে। অবশ্য মেয়েটার একার নয় বাড়ির সবার জীবন নাজেহাল করে ছেড়েছে। আয়নার মতে বাড়ির সবাই নাকি ওর ভাইকে ভীষণ ভয় পায়, মানুষটা বাড়িতেও নাকি ক্যাপ্টেনগিরি করে। ভীষন স্ট্রিকড , ফজরের সময় ঘুম থেকে তুলে সবাইকে নামাজ পড়ায়, তারপর সবার ব্যয়াম করতে হবে, ৭ টার মধ্যে বাড়ির সকলের সকালের খাবার খেতে হবে, তারপর পড়াশোনা নিয়ে তো ঝামেলার শেষ নেই আরও ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ম। তার বানানো সব নিয়মগুলো বলতে গেলে কলমের কালি শেষ হয়ে যাবে কিন্তু নিয়ম শেষ হবে না। আর নিয়মের বিন্দু পরিমাণ এদিক ওদিক হলে আকাশ কাঁপানো ধমক। যদিও এই সবকিছুই আয়নার কাছ থেকেই শোনা, মানুষটার সাথে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি এখনও আর দেখা করার ইচ্ছেও নেই নিশার। সে এই প্রায় বছর দুই থেকে আর্মি , পুলিশ এই পেশাগুলোর মানুষদের ভীষণ ভয় পায়। যদিও তার ভয়টা শুরু হয়েছিল শুধুমাত্র একটা মানুষের জন্য কিন্তু ঐ একজনের জন্য এখন এইসব পেশায় নিযুক্ত সকলের জন্যই ভয় কাজ করে নিশার।
বিরস মুখ নিয়ে সামনে চোখ যেতেই আনন্দে গদগদ হয়ে উঠলো আয়না।
– তুই এসেছিস নিশা। এতদিন আসিসনি কেন? জানিস কত মিস করেছি তোকে?
আয়নার কথা শুনে সামনে তাকালো নিশার বন্ধু মহল। এর মধ্যে হঠাৎই নিলয় বলে উঠলো –
– তা মহারানী অবশেষে আপনার পদধুলি পড়েলো আমাদের কলেজে?
নিলয়ের কথার সাথে সুর মিলিয়ে কাজল বলল : হ্যা হ্যা অবশেষে মহারানী ভিক্টোরিয়ার পদধুলি পড়েছে আমাদের কলেজে। কি সৌভাগ্য আমাদের। এই তোরা বরন ডালা আন মহারানীকে বরন করতে হবে।
– তোরা কি আমাকে নিয়ে মজা করছিস?
নিশার কথা শুনেই রাকিব বলে উঠলো : আমাদের ঘাড়ে কয়টা মাথা যে মহারানী ভিক্টোরিয়াকে নিয়ে মজা করবো আমরা।
আয়না বিরক্তির স্বরে বলল : তোরা চুপ থাকবি? আমি একটা জরুরী কথা বলব।
– তোর আবার জরুরী কথা। বলে ফেল কি বলবি – বলল নিশা
– শোন আমার ভাইয়ের বিয়ে তোরা সবাই যাবি আমার ভাইয়ের বিয়েতে। বিয়ের এক সপ্তাহ আগে থেকে তোদের আমাদের বাড়িতে দেখতে চাই।
নিশা বেশ অবাক হয়েই বলল : তাহলে শেষ পর্যন্ত তোর ক্যাপ্টেন ভাই বিয়ের পিঁড়িতে বসবে বলছিস। কে জানে কোন মেয়ের কপালটা পুড়লো।
আয়না ফোশ করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল : তাহলে তো হতোই, মেঝ ভাইয়ার বিয়ে আমার।
নিলয় অবাকের সুরে বলল : বড় ভাইকে ছেড়ে মেঝ ভাইয়ের বিয়ে কেন?
আয়না আফসোস করে বলল : কি করবো বল বড় ভাইয়া তো বিয়েই করতে চাইছে না। তার এক কথা সময় হলে করবে। এদিকে মেঝ ভাইয়েরও বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। এখন বড় ভাইয়ের অপেক্ষায় তো আর মেজ ভাইয়ের জীবনটা শেষ করে দেওয়া যায় না তাই মেজ ভাইয়ের বিয়েটা আগেই দিয়ে দিচ্ছে। বড় ভাইয়াও এই কথাই বলেছে।
নিশা বিরস কন্ঠে বলল : তা ঠিক করেছিস ঐ হিটলার ক্যাপ্টেনের অপেক্ষায় থাকলে আয়ান ( আয়নার মেজ ভাই ) ভাইয়ার আর এ জন্মে বউয়ের মুখ দেখা লাগতো না , বাচ্চা তো দূরে থাক।
রাকিব গালে হাত দিয়ে চিন্তিত স্বরে বলে উঠলো : নির্ঘাত ব্যাটার কোনো ঘাপলা আছে। হারবালের ডাক্তার দেখা, ডাক্তারের কাছে যাইতে শরম পাইলে আমার লগে দেখা করতে বলিস আমি গোপনে ঔষধ এনে দেব।
রাকিবের কথায় তেতে উঠল আয়না।
– একদম আমার ভাইকে নিয়ে বাজে কথা বলবি না।
– বাজে কথা কই বললাম। এর জন্যই বলে মানুষের ভালো করতে নেই। ভালোর জামাটাই নাই।
– হয়েছে তোর আর আমার ভাইয়ের ভালো করতে হবে না। আমার ভাই যদি এই কথা একবার জানতে পারে কচুকাটা করবে তোকে।
– বা*ল করবে তোর ভাই। যা হুস তোর ভাইকে আমি ভয় পাই নাকি?
– ছিঃ অশ্লীল
নিশার কথায় ভেংচি কাটলো রাকিব। সকলকে থামিয়ে আয়না বলে উঠলো
– আমি কিছু জানি না সবাইকে আমার ভাইয়ের বিয়ের এক সপ্তাহ আগে থেকে আমাদের বাড়িতে থাকতে হবে ব্যস এই টুকুই।
কাজল গদগদ হয়ে বলল : থাকবে তো অবশ্যই। এই তো সুযোগ ছেলে পটানোর।
রাকিব কাজলের মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলল : থাকিস তো শুধু ছেলে পটানোর ধান্দায় লুচি মেয়ে মানুষ কোথাকার।
নিলয় হাই তুলতে তুলতে বলল : আমি তো যাবো খেতে। একদম কব্জি ডুবিয়ে খাব।
নিশা ঠাট্টার স্বরে বলল : তোর তো শুধু খাই খাই, খেয়ে খেয়ে কুমড়ো পটাসের মতো একখান দেহ বানিয়েছিস।
– এটাকে কুমড়ো পটাস নয় স্বাস্থ্যবান বলে বৎস।
এর মধ্যে ক্লাসের ঘন্টা পড়ায় অগত্যা আড্ডা ছেড়ে সকলকে ক্লাসে চলে যেতে হয়। তবে সবাই বেশ এক্সাইটেড আয়নায় ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে। নিশা নিজেও বিয়েতে যাওয়ার জন্য প্রচন্ড ইচ্ছুক। হয়তো ব্যস্ত থাকলে, বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে থাকলে নিজের অনুভূতিগুলো একটু ভুলে থাকতে পারবে। নিজেকে আর একটু সামলে নিতে পারবে। আর আয়নার সাথে থাকলে তো কথাই নেই। মেয়েটা একটা সেকেন্ডের জন্যও নিশাকে মন খারাপ করে থাকতে দেয় না। এটা ওটা বলে ঠিক নিশাকে হাসিয়ে ছাড়ে।
__________________
আয়নার জেদের কাছে হার মেনে বিয়ের এক সপ্তাহ আগেই সবাইকে আসতে হয়েছে ওদের বাড়িতে। সবার বাড়ি আয়নাদের বাড়ির কাছাকাছিই তাই ওরা বলেছে এসে যেয়ে দেখবে কিন্তু নিশা , তার বাসা দূরে হওয়ায় এক প্রকার টেনে হিচড়ে ওদের বাড়িতে নিয়ে এসেছে আয়না। এত আগে তাও বান্ধবীর ভাইয়ের বিয়ে বলে তাদের বাড়িতে উঠে থাকাটা মোটেই ভালো লাগছে না নিশার। কিন্তু কি আর করার এই আয়না মেয়েটা যা, মাঝ খানে একদিন বাবা মায়ের দোষ দিয়েছিল নিশা, যে ওর বাবা মা এত তাড়াতাড়ি যাওয়াটা মানবে না বিয়ের একদিন আগেই যাবে। এই কথা শুনে আয়না সরাসরি নিশাদের বাড়ি গিয়ে হাজির। প্রথমে নিশার বাবা মা মেয়ের বান্ধীর ভাইয়ের বিয়েতে এতদিন আগে তাদের বাড়িতে যাওয়ার ব্যাপারটা না মানলেও আয়নার জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে। অগত্যা নিশাকেও এক সপ্তাহ আগেই এসে আয়নাদের বাড়িতে এসে হাজির হতে হলো।
বাড়ির গেট থেকে ঢুকেই আকাশ কাঁপানো এক ধমকে থমকে দাঁড়ালো নিশা। সামনে তাকাতেই ভয়ে কেঁপে উঠলো পুরো কায়া। সামনে এ কাকে দেখছে। আজ টানা দুই বছর পর ওর সামনে সেই লোক দাঁড়ানো তাকে ও জমের মতো ভয় পায়। এই লোক এখানে কেন? হাঁটু কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেছে নিশার। হঠাৎ প্রচন্ড ঘামতে শুরু করেছে। কপাল থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম চুঁইয়ে পড়ছে। লোকটা ফোনে কাউকে ধমকে যাচ্ছে আর এদিকে ভয়ে হৃদপিন্ড লাফাচ্ছে নিশার।
( গল্পের নামটা মন বিবাগী থেকে চেঞ্জ করে #বসন্ত_কন্যা দিয়েছি। আসলে গল্পটা যেভাবে শিখেছি বা যেভাবে ভেবে রেখেছি তাতে ঐ নামটা ঠিক যাচ্ছিলো না তাই )
#বসন্ত_কন্যা
#পর্ব_৪
#লেখিকা : সাদিয়া
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
ফোনে কাউকে ধমকে যাচ্ছে আর এদিকে ভয়ে হৃদপিন্ড লাফাচ্ছে নিশার। ফোনটা কেটেই সামনে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে উঠলো – এখানে কি আয়না? কলেজ থেকে এসে ফ্রেশ না হয়ে এখানে সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
আয়না কাঁপা কাঁপা কন্ঠে উত্তর দিল – এই তো যাচ্ছি আবসার ভাইয়া।
নিশা গোল গোল চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে আয়নার দিকে তাকালো। এর মানে এই লোকটা ওর ভাই? এতদিন এই লোকটার গল্পই করেছে আয়না? না না ও বাড়িতে কিছুতেই থাকবে না নিশা। জেনে শুনে নিজেকে বাঘের খাঁচায় বন্দী করার কোনো মানেই হয় না। ব্যাগটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে এক পা দুই পা পিছিয়ে গিয়ে যেই না দৌড় দিতে যাবে অমনি এক কঠিন পুরুষালী কন্ঠে আটকে গেল নিশার দুই পা।
– এই মেয়ে কে তুমি? আর এভাবে পালাচ্ছো কেন?
আয়না আমতা আমতা করে বলল – ও আমার বান্ধবী, আয়ন ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে এসেছে।
– এসেছে যখন পালাচ্ছে কেন?
তৎক্ষণাৎ পিছন ফিরে তাকালো নিশা , চোখাচোখি হয়ে গেল
আবসারের সাথে। চমকে উঠলো আবসার, ও স্বপ্ন দেখছে না তো। দিন দুপুরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন। এই মেয়েকে স্বপ্ন তো ও গত দুই বছর ধরে দেখে আসছে তবে ঘুমের মধ্যে, এখন কি তাহলে এই মেয়েকে চোখ খুলে দিন দুপুরে জেগে জেগেও স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে নাকি?
নিশা আমতা আমতা করে : কককককোথায় আমি পালাচ্ছিলাম না তো।
নিশার উচ্চারিত শব্দযুগল আবসারের কর্নকুহরে পৌঁছাতেই ঘোর থেকে বেড়িয়ে এলো আবসার। না ও স্বপ্ন দেখছে না। সত্যিই ওর বসন্ত কন্যা ওর সামনে দাঁড়ানো। অবশেষে ও ওর বসন্ত কন্যাকে খুঁজে পেয়েছে। যাকে দেখে আজ দেখে দুই বছর আগে পহেলা বসন্তে নিজের হৃদয় হারিয়েছিল । সেই বসন্তে শ্যামবর্না হলদে শাড়িতে এক অষ্টাদশী রমনীকে দেখে নিজের চোখ আটকে গিয়েছিল আবসারের, যার হাঁটু অব্দি ছড়ানো ছিলো উন্মুক্ত ঘন কালো কেশ। নিশার চোখের দিকে তাকিয়েই অতীতে ডুব দিল আবসার।
___________________
( ২ বছর আগে )
ছুটিতে বাড়িতে এসেছিল আবসার। কিন্তু কাজ যেন তার পিছু ছাড়ে না। সেদিন ছিল পহেলা বসন্ত , পুরো ঢাকা মেতে উঠেছিল বসন্ত উৎসবে। বসন্তের রঙে নিজেদের রাঙিয়ে তুলেছিল তরুন তরুণীরা। হলদে একটা শাড়ি পড়ে বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করেছিলো নিশা ওর বান্ধবীরা সবাই ঢাকার ভিতরকার হওয়ার সেখানে গিয়ে একসাথ হওয়ার সিন্ধান্তই নেয় সবাই। একটা সরু গলি ধরে হেঁটে চলছিল সে। হঠাৎ কারো আর্তনাদের শব্দ কর্নকুহরে পৌঁছাতে থমকে দাঁড়ায় নিশা। শব্দের উৎপত্তি স্থান খুঁজতে থাকে চারদিকে হঠাৎই সামনে এক বিভৎস দৃশ্য দেখে আঁতকে ওঠে সে। ওর সামনেই একজন লোককে মেরে রক্তাক্ত করে দিচ্ছিলো একটা ছেলে। লোকটার মুখ থেকে গলাগলিয়ে রক্ত পড়ছে। পুরো শরীর রক্তে মাখামাখি, লোকটার মুখটা অব্দি বোঝা যাচ্ছিলো না। এমন দৃশ্য এই প্রথম দেখছে নিশা, এমন কোনো দৃশ্যের দেখা মিলবে কখনও সেটাই নিশা কখনও ভাবেনি। ভয়ে মুখ থেকে যেন কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। ও চিৎকার করতে চাইছে কিন্তু গলা থেকে বের হচ্ছে না। লোকটিকে মারতে মারতে হঠাৎই অবসারের চোখ দুটো আটকে যায় এক হলদে পরীর দিকে, শ্যামবর্না গায়ের রং, গোল গোল চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, মুখশ্রীতে ভয়ের আভাস, হাঁটু অব্দি মুক্ত ঘন কালো কেশ। আবসারের চোখে মুখে এতক্ষন এত রাগ, ক্ষোভের জায়গায় যেন জায়গা করে নিয়েছে একরাশ মুগ্ধতা। কিন্তু হঠাৎ করেই এই মুগ্ধতাকে উৎকণ্ঠায় পরিনত করে জ্ঞান হারিয়ে বসে তার বসন্ত কন্যা। লোকটাকে ছেড়ে দ্রুত আবসার তার বসন্ত কন্যাকে ধরে নেয় মাটিতে পড়ার আগেই।
নিশার গালে হাত রাখতে কেমন ইতস্ততবোধ করছিল আবসার। একটা মেয়ের গালে এভাবে হাত রাখাটা বিবেকে বাধা দিচ্ছিলো বারবার। কিন্তু মেয়েটিকে জাগাতে হলে তো অবশ্যই নিশার গালে হাত দিতে হবে। জান বাঁচানো ফরজ। আগে মেয়েটিকে বাঁচাতে হবে। অতিরিক্ত ভয়ে যে মেয়েটা ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে তা বুঝতে আর বাকি নেই আবসারের। ইতস্ততবোধকে পাশে রেখে নিশার গালে হাত রেখে ডাকতে শুরু করলো – শুনছেন, শুনছেন?
এমনিতে আবসারের বুদ্ধিবৃত্তি প্রখর, আর্মির ক্যাপ্টেন বলে কথা। এমনি এমনি চেহারা দেখে তো আর সে আর্মির ক্যাপ্টেন হননি। কিন্তু এই মুহূর্তে যেন সে তার বুদ্ধিবৃত্তি হারিয়ে বসে আছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। না হয় অজ্ঞান হওয়া একটা মেয়েকে হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে বা মুখে পানির ঝাপটা না দিয়ে নির্বোধের মতো ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে তোলার চেষ্টা করে কেউ?
প্রায় ৩০ মিনিট পর এমনি এমনি জ্ঞান ফিরে আসে নিশার। চোখ খুলেই দেখে তার মাথার কাছে সেই ভয়ংকর ছেলেটা যে এতক্ষন লোকটাকে মারছিল সে বসে আছে। এই ৩০ মিনিট অপলক দৃষ্টিতে আবসার তাকিয়ে ছিল তার বসন্ত কন্যার দিকে। তার রূপ দেখে নিজের বক্ষস্থলকে শান্ত করছিল সে। নিশা আবসারকে দেখে হুড়মুড়িয়ে উঠে এক চিৎকার দিয়ে পালিয়ে যায়। হঠাৎ এমন কিছু ঘটবে ভাবতেই পারেনি আবসার। আকর্ষিক ঘটনায় হতবম্ব হয়ে বসে থাকে সে। যখন হুশ ফেরে সেও তার বসন্ত কন্যার পিছু পিছু দৌড় দেয়। কিন্তু ততক্ষণে তার বসন্তকন্যা হারিয়ে গেছে।
সেদিন বাড়ি গিয়ে ভয়ে জ্বর উঠে যায় নিশার। মনের অজান্তেই আবসারের প্রতি তৈরি হয় এক অজানা ভয় । অজানা কারনে সে প্রচন্ড ভয় পেতে থাকে আবসারকে। এরপরও অনেকটা কাকতালীয়ভাবেই দুই দিন দেখা হয় আবসারের সাথে। যদিও আবসার ওকে দেখেনি কারন আবসারকে দেখলেই ও ভয়ে উল্টো পথে দৌড় দিয়েছে। শেষ যেদিন দেখেছিলো সেদিন আবসারের সাথে কতগুলো পুলিশও ছিল। পুলিশগুলোর আবসারকে স্যার স্যার বলে সম্বোধন শুনে নিশা ভেবেছিল এই লোক হয়তো পুলিশ। তখন থেকেই আর্মি পুলিশ পেশাটার প্রতি একটা ভয় জন্মে গিয়েছিল নিশার।
এদিকে আবসার তার বসন্ত কন্যাকে খুঁজে খুঁজতে হয়রান। ঐ ক্ষনিকের দেখাতেই যেন মেয়েটা তার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়ে গেছে, সব কিছু এলোমেলো করে দিয়েছিল। খুব করে খুঁজেছিল কিন্তু খুঁজে পায়নি তার বসন্ত কন্যাকে।
_______________
( বর্তমানে )
আয়না নিশার হাত ধরে টেনে বাড়ির ভিতরে নিয়ে এলো। বাড়ির মানুষগুলো প্রচন্ড ভালো। সব থেকে ভালো আবিদা বেগম ( আবসার, আয়ান, আয়নার মা ) । মানুষটা একদম নিজের মায়ের মতো, মনে একদম কোনো অহংকার নেই। সে তো বলেই দিয়েছে নিশাও যেন তাকে মা ডাকে। আয়নার মতো নিশাও তার একটি মেয়ে। আয়নার দাদী ভারী মজার মানুষ, অল্প সময়েই এমনভাবে মিশে গেছে যে নিশার মনে হয়েছে উনি ওদের বড় কেউ নয় উনি ওদের বয়সীই।
এ বাড়িতে আসার পর এক সেকেন্ডের জন্যও রুম থেকে বের হয়নি নিশা। আবসারের ভয়ে এক প্রকার লুকিয়েই ছিল। কিন্তু রাতে আর লুকিয়ে থাকাটা যেন সম্ভব হলো না। রাতের খাবার খাওয়ার জন্য বাইরে আসতেই হলো। যদিও নিশা আসতে চাইছিল না কিন্তু আয়নার জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত আসতেই হলো। ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়েই হাঁটু কাঁপা কাঁপি শুরু হয়ে গেছে নিশার। ওর সামনে বসেই চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে আবসার। নিশা ভয়ে মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়া শুরু করে দিয়েছে
– লা ইলাহা ইল্লা আংতা , সুবহানাকা ইন্নি কুংতু মিনাজ জ্বালিমিন।
আবিদা বেগম নিশাকে বসতে না দেখে বলে উঠল – কি নিশা মা বসছো না কেন? খেতে বসো।
নিশা একটা মেকি হাসি দিয়ে – এই তো আন্টি বসছি বলে একটা চেয়ার টেনে বসলো। খেতে যতই বসুক ওর মনে তো আবসার নামক ভয়ের তোলপাড় চলছে। এই লোকের সামনে বসে খাওয়া , খাবার যেন নিশার গলা দিয়েই নামছে না। মনে হচ্ছে কেউ ওর গলাটা আটকে চিপে ধরেছে। কোনো রকমের দুই লোকমা খেয়ে ” পেট ভরে গেছে ” বলে উঠে যেতে নিলেই শুনতে হলো আবসারের সেই আকাশ কাঁপানো ধমক।
– এই মেয়ে খাওয়া ছেড়ে উঠছো কেন? শরীরে তো হাড্ডি ছাড়া কিছু নেই, হাড্ডি মন্ত্রী পদবী নেওয়ার শখ জেগেছে নাকি? বসো, খাওয়া শেষ না করে যেন এক পাও এগোতে না দেখি।
আবসারের ধমকে কেঁপে উঠলো নিশা। আগে তো শুধু হাঁটু কাপছিল এবার পুরো শরীর কাঁপছে। দাঁড়ানোর শক্তি টুকু নেই। ধপ করে বসে পড়লো চেয়ারে আর মনে মনে আওরাতে লাগল –
– লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ ( স )
চলবে….