পর্বঃ০৬
গল্পঃ #সেদিন_দেখা_হয়েছিলো
লেখনীতেঃ ঈশিতা ইশা
(কার্টেসি ছাড়া গল্প কপি নিষেধ।)
…
সারা বিকাল ভিডিও শুট করে বেশ ক্লান্ত হয়ে যায় রাই তখন রাকিব, মনি সহ বাকি বাচ্চাদের বাড়ি ফিরে যেতে বলে। সন্ধ্যার পর অন্ধকার নেমে এলে নিজেই গিয়ে এগিয়ে দেয় সকলকে। যেদিন এই গ্রামে এসেছে সেদিন থেকেই রাকিব আর মনি এর সাথে ভাব জমে যায়। মনিদের আর্থিক অবস্থা ভালো না সেইজন্য প্রাইভেট পড়তে পারে না স্যারদের কাছে এ কথা রাই জানতে পেরে মনি,রাকিব সহ কয়েকজন বাচ্চাদের নিজে থেকে সন্ধ্যার পর ডেকে পড়ায়। এরাই রাইকে সব সময় সাহায্য করছে যতদিন ধরে রাই এখানে আছে।
আরাফের অসহায়ের মতো করা মুখটা যতবার চোখের সামনে ভাসছে ততবার রাইদা হেঁসে উঠছে। হাসতে হাসতে কখন যে বাড়ির উঠোন পেরিয়ে ঘরের দরজার সামনে চলে এসেছে সেদিকে খেয়াল করেনি সে। মাথা থেকে ওড়না নামিয়ে ঝুটি খুলে চুলগুলো এলেমেলো করে ফেলে রাই।হাসিমুখে দরজায় হাত দিতেই দেখে দরজা খোলা।
‘মারু..’, বসার ঘরে প্রবেশ করে মারিয়াকে ডাক দিতে নিলে বাম পাশে চেয়ারে বসা মানুষটাকে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠে সে।
চেয়ারে বসা মানুষটা রাইদাকে দেখে গম্ভীর মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে।
‘আরে রাই চইল্লা আইছে।সায়ন এইডাই রাই বুঝছো? ওর কথাই তোমারে কইতাছিলাম।’,সাবিনা রাইদার দিকে ইশারা করে বলে।
রাইদা এতক্ষণে খেয়াল করে সাবিনা খালা সায়নের সাথে গল্প করছে বসে। পাশেই সাবিনার ছেলে খেলছে।
‘এটা সেই পিচ্চি মেয়েটা? কত বড় হয়ে গেছে চেনাই যায় না।ছোট বেলায় যা দুষ্টু ছিলো।’,হাসি থামিয়ে বলে সায়ন।
‘আরে রাইয়ের মতো দুষ্টু মাইয়া এখন যে কত ভদ্র আর লক্ষী হইছে সেইডা দেইক্ষা আমরা মেলা অবাক।’
‘তা তো দেখেই বুঝা যাচ্ছে।’
সায়নের কথা শুনে কেনো জানি রাইদার শরীরে জ্বালানি ধরে যায়।এক মূহুর্ত সেখানে আর না দাঁড়িয়ে হনহনিয়ে রুমে চলে যায়।রুমে এসে গায়ের ওড়ানাটা বিছানায় ঢিল দেয়।
ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে বসার ঘরে যেতে থাকে মারিয়া। রুমে দাঁড়িয়ে পর্দার ফাঁকা দিয়ে সেগুলো দেখছে রাইদা। ওর ইচ্ছে করছে গিয়ে জুসের গ্লাসের সব জুস সায়নের গায়ে ঢেলে দিতে।মোটেও সায়নকে সহ্য করতে পারছে না সে।
টেবিলের উপর ট্রে টা রেখে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে মারিয়া।
‘এই আমার মেজ বইনের মাইয়া বুঝলা? ‘
সাবিনার কথায় মুখ তুলে মারিয়ার দিকে তাকায় সায়ন তবে তার চোখ দুটো এখনো খুঁজছে অন্য কাউকে।
‘নাম কি তোমার? কীসে পড়ো?’, মারিয়াকে প্রশ্ন করে সায়ন।
‘জে ক্লাস টেনে মানে এসএসসি দিমু সামনে। আর নাম হইলো মারিয়া।’
সায়নকে সামনে দেখে কথাগুলো এলেমেলো হয়ে যায় মারিয়ার।সেদিন বাজারে সায়নকে দেখেই তার প্রচন্ড ভালো লেগে গেছে। আজকে সায়নকে নিজেদের বাসায় দেখে প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনি সে। সদ্য কিশোরীতে পা দেওয়া মারিয়ার ছোট্ট মনে অজান্তেই জায়গা করে নিচ্ছে সায়ন।
‘তুমি আমার অনেক ছোট। আমি তোমার বড় ভাইয়ার মতো বুঝছো?ভালো করে পড়াশোনা করবা।’
সায়নের মুখে ভাইয়া ডাকটা শুনে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে সে।
‘বাবা তুমি বহো আমি একটু দেইখা আহি আম্মার রান্নার কি অবস্থা।আইজকা তোমারে না খাওয়াইয়া পাডামু না।’
‘আরে খালামনি এসব লাগবে না আমি বাসায় গিয়ে খেয়ে নিবো সমস্যা নেই।’
‘না না তুমি বহো আমি যামু আর আমু।’
কথাগুলো বলে রান্নাঘরের দিকে যায় সাবিনা। মারিয়া হ্যাংলার মতো সায়নের সামনে বসে ওর দিকে তাকিয়ে তাকে। সায়ন আঁড়চোখে দরজার দিকে তাকচ্ছে আর বিরক্ত হচ্ছে। ফোনটা বের করে বারবার গ্যালারিতে যাচ্ছে, মেসেজে দেখছে আবার ফেসবুকের ঢুকছে বের হচ্ছে তাও তার অস্বস্তি কমছে না।
অনেকক্ষণ সাবিনা আর সায়নের গলা না পেয়ে রাইদা ভাবে সায়ন হয়তো চলে গেছে। একটা চাদর গায়ে দিয়ে রুম থেকে বের হয় সে। বসার ঘরে এসে দেখে মারিয়া সায়নের দিকে তাকিয়ে আছে। রাইদা রেগে বকা দেয় মারিয়াকে।
‘মারু! যা ঘরে গিয়ে পড়তে বস।কালকে সকালে প্রাইভেট আছে সেই খেয়াল আছে তোর? যা এক্ষুনি বই নিয়ে বস।’
রাইয়ের ঝাঁঝালো কন্ঠ শুনে ফোন থেকে মুখ তুলে তাকায় সায়ন।মারিয়া মন খারাপ করে নিজের রুমের দিকে যেতে থাকে।
গোলাপি রঙের গেঞ্জি আর কালো রঙের ট্রাউজার পড়ে আছে রাইদা তার উপর চাদর জড়িয়ে আছে সে। রাইকে এই অবস্থায় দেখে চোখ ফিরিয়ে নেয় সায়ন।
মারিয়া চলে গেলে যেখানে সে বসে ছিলো সেখানে গিয়ে দাঁড়ায় সে।
‘আপনি কেনো এখানে এসেছেন?আপনাকে আমার মোটেও পছন্দ না।’,সায়নের মুখের উপর অকপটে কথাগুলো বলে রাইদা।
বসা থেকে উঠে রাইদার সামনে এসে দাঁড়ায় সায়ন।রাইয়ের থেকে সে অনেকটা লম্বা।রাই খেয়াল করলো সে সায়নের কাঁধ পর্যন্ত হবে। হুট করে তার মনে হলো আরাফের উচ্চতাও এমন।
‘ তোমার মাথায় সমস্যা আছে বুঝছো? আমি এখানে নানুর সাথে দেখা করতে এসেছি। তুমি কি আমাকে নিয়ে আকাশ কুসুম কিছু ভাবছো?’
সায়নের এমন প্রশ্নে শুনে চমকে উঠে সে।
‘আচ্ছা রাই কোনো কারণে তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছো? আমাদের মধ্যে কোনো কানেকশন আছে নাকি যেই কারণে তুমি এমন ব্যবহার করছো?’
সায়নের ঠান্ডা গলায় বলা কথাগুলো শুনে রাইয়ের গলা শুঁকিয়ে আসে সকালের মতো।টেবিলে রাখা জুসের গ্লাসটা নিয়ে অর্ধেক খেয়ে গ্লাসটা আবার টেবিলে রেখে দেয় সে।
‘আপনাকে ভয় পাওয়ার কি আছে আপনি কি বাঘ নাকি ভাল্লুক?’
‘সেটাই তো আমি বাঘও না ভাল্লুকও না আমি হলাম ইমতিয়াজ সায়ন।আমাকে ভয় কেনো পাবা? আমি কি ভয় পাওয়ার মতো কিছু করেছি নাকি?’
সায়নের মুখে এমন কথা শুনে বোকা বনে যায় রাইদা।
কিছু বলতে নিলেই সাবিনার গলার স্বর পায় সে। বিরক্ত হয়ে রাইদা নিজের রুমের দিকে যায়।
রুমে এসে দেখে মারিয়া বই খুলে উদাসীন হয়ে বসে আছে।মারিয়াকে ঝারি মেরে পড়তে বলে রুমে পায়চারী করতে থাকে সে। সায়নের হাবভাব কিছুই বুঝতে পারছে না তার উপর সায়নের থেকে কথা বের করতে গিয়ে উল্টো কথার জালে ফেঁসে যাচ্ছে সে।
মিনিট দশেক পর সাবিনা এসে রাইদাকে খাবার ঘরে ডাকে কিন্তু রাইদা যেতে চায় না।এক প্রকার অনুরোধ করেই রাইদাকে খাবার ঘরে নিয়ে যায় সাবিনা।
খাবার ঘরে এসে রাইদা দেখে টেবিলে চালের রুটি আর বাটি ভর্তি মুরগীর মাংসের তরকারি রাখা। সে বুঝতে পারে আলেয়া বেগম তার জন্য চালের রুটি বানিয়েছে তবে এতে এসে ভাগ বসিয়েছে সায়ন।
সায়ন মাংস রুটি খাচ্ছে আর আলেয়া বেগমের প্রশংসা করছে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সায়নের দিকে তাকিয়ে খেতে থাকে রাইদা। সায়ন খুব মজা করে খাচ্ছে আর আলেয়া বেগম এবং সাবিনার সাথে গল্প করছে। রাইদা চুপচাপ কোনো মতে একটা রুটি খায় তার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সে মেহমান আর সায়ন এই ঘরের ছেলে।
খাওয়া শেষ হলে সায়ন ঘড়ি বের করে সময় দেখে নেয়।
‘নানু আমাকে এবার ফিরতে হবে রাত হয়ে গেছে।আমার ফোনে আবার চার্য নেই তাই কেউ কল দিলে পাবে না পরে সবাই চিন্তা করবে।’
‘এই অন্ধকারে যাইতে পারবা? টর্চ তো নাই তোমার লগে এক কাম করো আমগো টর্চটা নাও।’, আলেয়া বেগম টর্চ আনে সায়নকে দিতে নেয়।
‘আরে না নানু টর্চ লাগবে না যেতে পারবো আমি তবে মেইন রাস্তা পর্যন্ত আলো পেলে যেতে আমার সুবিধা হতো। ‘
‘সাবিনা তো ওর পোলারে খাওয়াইতাছে।খাঁড়াও আমি আইতাছি।’
‘আরে না নানু আপনাকে কষ্ট করতে হবে না আমি যেতে পারবো।’
‘না না তা কেমনে হয় আন্ধারে যদি পইড়া যাও তহন কি হইবো?এই রাই তুই কি একটু ওরে মেইন রাস্তা পর্যন্ত দিয়াইতে পারবি?’
রাইদা বিরক্ত হয়ে কোনো উত্তর দেয় না। আলেয়া বেগম টর্চটা রাইদার হাতে দেয়।
‘ঐদিন আছাড় খাইয়া পরছিলাম পরে মাজাডায় মেলা বেতা পাইছি। অহন একটু জিরামু।’,কোমড়ে এক হাত রেখে বলে আলেয়া বেগম।
‘আচ্ছা নানু থাকেন আমি আসি।’,বিদায় নিয়ে ঘর থেকে বের হয় সায়ন।
রাইদাও পিছুপিছু টর্চ জ্বালিয়ে বের হয়। উঠান পেরিয়ে কাঁচা রাস্তা দিয়ে দুজনে যেতে থাকে। খপ করে রাইদার হাত থেকে টর্চটা কেঁড়ে নেয় সায়ন।
‘কি সমস্যা আপনার? টর্চ কেড়ে নিয়ে বন্ধ করলেন কেনো?’, বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে রাইদা।
‘তোমার কাছ থেকে কিছু উত্তর চাই তাই।’,সায়ন সোজাসাপ্টা বলে।
‘আমি আপনাকে কেনো উত্তর দিবো? আমি কাউকে কোনো উত্তর দিতে বাধ্য নই।স্পেশালি আপনাকে।’
রাইদার বাম হাত টেনে ধরে আঙ্গুল টর্চ মেরে দেখতে থাকে সায়ন।
‘আরে হাত টানছেন কেনো?অসভ্য লোক ভদ্রতা শিখেননি?আমি কিন্তু চিৎকার করে লোক জড়ো করবো।’,সায়নের হাত থেকে নিজের বাম হাত ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে থাকে রাইদা।
‘তুমি কি জানো তোমার হাতের নখের নেইলপলিশের কাছে তুমি হেরে গেছো?সেদিন ও তুমি এই কালো রঙের নেইলপলিশ নখে দিয়েছিলে।সেই রাতেই তোমার নখ দেখে বুঝে গিয়েছিলাম বিকালে যার সাথে দেখা হয়েছিলো সেই মেয়েটা তুমিই।’
সায়নের কথা শুনে রাইদার হাত মোচড়ামুচড়ি বন্ধ হয়ে যায়। সায়ন হাতের বাঁধন আলগা করে দিতেই রাইদা হাত টেনে ছাড়িয়ে নেয়।
‘দেখো তুমি খামচি দিয়ে সেদিন বিকালে আমার হাতে দাগ বসিয়ে দিয়েছো। এত বড় নখ কেউ রাখে বলো? ‘,নিজের ডান হাতে টর্চ মেরে বলে সায়ন।
‘আসলে আমি ইচ্ছে করে খামচি দেইনি ভুলবশত হয়ে গেছে আর সেদিন যা ঘটেছে সবই আমার অনিচ্ছায় ঘটা।’,গলার স্বর নরম করে বলে রাইদা।
‘ঐ সাজ তারপর সেই বরিশাইল্লা ভাষা বলার কারণ?’, টর্চ বন্ধ করে বলে সায়ন।
‘আপনাকে এতো কিছু বলবো কেনো? অজান্তে আপানকে ব্যথা দিয়েছি সেজন্য আমি দুঃখিত কিন্তু তার মানে এই না যে আপনার সকল প্রশ্নের উত্তর দিবো। ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট মিস্টার সায়ন।দিন আমার টর্চ বাসায় যাবো আমি।’
‘যদি লিমিট ক্রস করি তাহলে কি হবে? বলো রাই।’,রাইয়ের কাছাকাছি এসে ফিসফিস করে বলে সায়ন।
সায়নের ফিসফিস করে বলা কথাগুলো কাঁটার মতো রাইদার শরীরে বিঁধতে থাকে। ধাক্কা মেরে সায়নকে সরিয়ে দিতে নিলেই অন্ধকারের মধ্যেই সায়ন তার হাত আবার ধরে।
‘তোমার প্রধান সমস্যা তুমি কখনোই কোনো প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিতে চাও না।অভ্যাসটা পাল্টাও রাই আমার কিন্তু এসব মোটেও পছন্দ না।’
‘আপনার পছন্দে গু*ল্লি মারি হাত ছাড়ুন অসভ্য লোক। আপনার মতো বেহায়া আর আমি দু’টো দেখিনি।সুযোগ বুঝে খালি স্পর্শ করার ধান্দা করছেন।’,রেগে গিয়ে বলে রাই।
‘ইমতিয়াজ সায়ন একপিসই আছে এই পৃথিবীর বুকে তুমি সারাজীবন খুঁজলেও আরেক পিস পাবে না।আর অসভ্যতা কিংবা বেহায়াপনা আমি এখনো করিনি শুধু শুধু তুমি আমায় অপবাদ দিচ্ছো।ধাক্কা মেরেছিলে যেভাবে আমি তো ডোবায় পরে যেতাম তাই তোমার হাত ধরলাম।’,কথাটা বলে রাইদার হাত ছেড়ে দেয় সায়ন।
রাইদার হাত ছেড়ে দিয়ে টর্চটা জ্বালিয়ে হাতে ধরিয়ে দেয় সায়ন। টর্চ দিয়ে সায়নের হাতে বারি দেয় সে।
‘রাই আমি দাঁড়াচ্ছি তুমি জলদি ঘরে যাও।’,সায়ন গম্ভীর গলায় বলে।
‘আপনি এই কাজটা একদম ঠিক করেননি।আপনার সাহস কি করে হয় আমার হাত ধরার?’
‘আমার সাহস এখনো দেখাইনি।দেখতে চাও?’
কথায় না পেরে রাইদা উঠানের দিকে যেতে থাকে।একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে সায়ন ফোন টিপছে।চোখ বড়বড় করে সেদিকে তাকায় সে। তার মানে সায়ন মিথ্যে বলে তাকে ঘর থেকে বের করেছে!
রাগে জিদে সোজা ঘরে গিয়ে দরজা আঁটকে দেয় রাইদা।বসার ঘরের টেবিলের দিকে চোখ গেলে দেখে আর আধখাওয়া জুসের গ্লাসটা খালি। এ বিষয়ে আর মাথা না ঘামিয়ে নিজের রুমে চলে যায় সে।
রাইদা চলে গেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারম্যান বাড়ির দিকে পা বাড়ায় সায়ন।
…
একা একা হাঁটছে রাইদা।সকালের ঠান্ডা বাতাসে তার বেশ ভালো লাগে। গ্রামে এসেছে পর থেকে প্রতিদিন সকালে হাঁটতে বের হয় সে।চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নেয়।
ফেরার পথে দূর থেকে আরাফকে দেখতে পায় সে। হাত নাড়িয়ে আরাফ তাকে থামতে ইশারা করে। শ্যামবর্ণের পুরুষকে ছাই রঙের গেঞ্জিতে বেশ লাগছে তার কাছে।গত রাতে আরাফকে কেনো এই সকাল বেলা দেখা করতে ডেকেছে সে নিজেও জানে না।বাড়ি গিয়ে যখন সায়নকে দেখেছিলো তখন তার হুঁশ হয় আরাফ তো সায়নেরই বন্ধু। রাতে চিন্তা করেছিলো আজকে হাঁটতেই বের হবে না যাতে আরাফের মুখোমুখি না হয় কিন্তু সকাল হতেই সব কিছু মাথা থেকে ঝেরে বের হয়েছে।ভেবেছিলো কিছুক্ষণ হাঁটা হাঁটি করে বাড়ি ফিরবে কিন্তু সেই সুযোগ না দিয়ে আরাফ চলে এলো।
রাইদার ধ্যান ভাঙে আরাফের কন্ঠে।
‘শুভ সকাল মিস রাই।’
আরাফের কথা শুনে হেঁসে দেয় রাইদা।
‘কোথা থেকে আসলেন এই সকাল বেলা?’
‘মসজিদে গিয়েছিলাম।ইমাম সাহেব কিছু কথা বলছিলো তাই আমার আসতে দেরি হলো।’
‘দেরি করার জন্য আপনার তো শাস্তি হওয়া উচিত।’
‘জি ম্যাডাম আপনি শাস্তি দিলে আমি মাথা পেতে নিবো।তার আগে এই ব্যাগটা নিন।’,রাইদার সামনে একটা কাপড়ের ব্যাগ ধরে বলে আরাফ।
‘কি এটা?’,রাইদা ব্যাগ হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘যেটা চেয়েছিলেন সেদিন।’
ব্যাগ খুলে রাইদা দেখে পলির মধ্যে কিছু কাঁচা আম রাখা।
‘আপনি না গাছে উঠতে পারেন না তাহলে এগুলো?’,আশ্চর্য হয়ে রাইদা প্রশ্ন করে।
‘গত রাতে জাহিদকে দিয়ে আমগুলো গাছ থেকে পেড়েছি।’, হেঁসে জবাব দেয় আরাফ।
আরাফের কথা শুনে আবারো রাইদা হেঁসে দেয়। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো এখন হাঁটতে শুরু করে পাশাপাশি আরাফও হাঁটতে থাকে।
‘কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করি?’,আরাফ বলে।
‘করেন তবে একটা প্রশ্নই করতে পারবেন যেহেতু অনুমতি নিয়েছেন একটা প্রশ্নের।’
রাইদার কথা শুনে আরাফ লজ্জা পায়।
‘প্রথমদিন আপনাকে দেখেছিলাম এক রকম এখন দেখি আরেক রকম আসলে আমি দু’জনকে মিলাতে পারছি না।মানুষ তো আপনি একজনই তবে সাজ এবং কথা বলার ধরণ এতো আলাদা তাই কৌতুহল জাগলো।’
‘আসলে ঐদিন আমার মাথায় ভূত চাপে গ্রামের মেয়ে সাজার।তাই ঠিক সেই ভাবেই শাড়ি পড়ি এবং সাজসজ্জা করি।বাচ্চাদের কাছ থেকে কিছু বরিশালের শব্দ শিখে নিয়েছিলাম। ঘুরাঘুরি করে অনেকের সামনে পরেছিলাম কিন্তু কেউ চিনতে পারেনি।এরপর কানামাছি খেলার সময় আপনারা সামনে চলে আসেন তখন ভাবলাম একটু দুষ্টুমি করি। আমার কথা শুনে আপনারাও বুঝতে পারেননি এতে আমি নিজেও অবশ্য অবাক হয়েছি।’
‘সত্যি বলতে একদম বুঝতে পারিনি আপনি গ্রামের মেয়ে নন যে!দ্বিতীয় দিন যখন আমাদের দেখা হয় তখন তো বলতে পারতেন,বলেন নি কেনো? আবার আমাকে চিনতেও পারেননি।’
‘তেমন কিছু না আপনার সাথে একটু দুষ্টুমি করেছি।তা আপনি মাইন্ড করেছেন নাকি?’
‘আরে না কিছু মনে করিনি আমি।’
‘আপনি বোধহয় বন্ধুদের সাথে এখানে ঘুরতে এসেছেন?’,আরাফকে প্রশ্ন করে রাইদা।
‘হ্যা তবে সব প্লান সায়নেরই।ও বললো মামা বাড়ি যাবো চল সবাই । যেহেতু ফ্রি ছিলাম তাই আর না করিনি।’
সায়নের নাম শুনেই হাসিমুখ মিলিয়ে যায় রাইদার।
‘আপনি কি এখানেই থাকেন নাকি বেড়াতে এসেছেন?’,রাইদাকে প্রশ্ন করে আরাফ।
‘আমিও আপনাদের মতো গ্রাম ঘুরতে এসেছি। এটা আমার নানা বাড়ি।’
‘আপনাকে কিন্তু গ্রামের মেয়ের সাজে বেশ লাগে।’
‘বেশ বলতে কি বুঝাতে চাাচ্ছেন? তরুণী থেকে কিশোরী লাগে?’,হাসি দিয়ে বলে রাইদা।
আরাফের মুখের কথা রাইদা কেঁড়ে নেওয়ায় অনেকটা অবাক হয় সে।
কথা বলে হাঁটতে হাঁটতে মাস্টার বাড়ির সামনে চলে আসে দু’জনে।
‘আপনি কিন্তু কথা দিয়েছিলেন নাম বললে আমি যা বলবো তাই করবেন।’, বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলে রাইদা।
‘হ্যা কথা যখন দিয়েছি অবশ্যই চেষ্টা করবো তবে আমার সাধ্যের বাহিরে কিছু বললে সেটা করা অসম্ভব হয়ে যাবে।’
‘আপনার সাধ্যের মধ্যেই হবেই বুঝলেন মশাই?’
‘জি বুঝেছি এবার বলুন।’
‘আপনি আর আমার সামনে আসবেন না।আমাদের মধ্যে যতটুকু আলাপ চারিতা হয়েছে সে টুকু তেই সীমাবদ্ধ থাকুক।এটা আপনার কাছে আমার অনুরোধ রইলো। ‘
রাইদা এমন কিছু বলবে সেটার শুনতে আরাফ মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।
‘মিস রাই আমি কথা দিচ্ছি ইচ্ছাকৃত ভাবে আপনার সামনে আসবো না আর কিন্তু আপনি যদি কখনো আমার সামনে পরেন তাহলে সেই দায়ভার একান্ত আপনার।তখন কিন্তু কোনো রকম দোষ আমায় দিতে পারবেন না।’,গাছে হেলান দিয়ে হাসিমুখে বলে আরাফ।
আরাফের কাছ থেকে এমন উত্তর প্রত্যাশা করেনি সে।
‘আপনাকে বোকা ভেবেছিলাম কিন্তু আপনি দেখি শেয়ালের মতো সেয়ানা। আচ্ছা চললাম আর আমের ধন্যবাদ বোকা মশাই।’
কথাগুলো বলে রাইদা উঠানের দিকে যেতে থাকে।রাইদার যাওয়ার পানে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয় আরাফ মুখে তার এখনো হাসি লেগে আছে।
..
‘এই যে আপা শুনেন আপনের লগে আমগো বড় ভাই কথা কইবার চায়।একটু এদিকে আহেন।’
সকালে ফিরে মারিয়াকে প্রাইভেটে এগিয়ে দিতে বেড়িয়েছিলো রাইদা।এখন বাড়ি ফিরছিলো তখনই কিশোর একটা ছেলে এসে কথাগুলো বলে।
‘রাস্তার মধ্যে যার তার সাথে আমি কথা বলি না।’
কথাটা বলে রাইদা হাঁটতে শুরু করে। ছেলেটা আবারো এসে পথ আঁটকায় তার। বিরক্ত হয়ে পাশে তাকায় সে।দুটো মোটরসাইকেলের উপর কিছু ছেলে বসে তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।ওদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে জীবনে কখনো মেয়ে দেখেনি।
‘আপা দুই মিনিট শুধু কথা শুনে যান।’,ছেলেটা আবারো বলে।
‘আরে ওনার কষ্ট করা লাগবো না আমিই আইতাছি।’
ছেলেগুলো বসা থেকে উঠে রাইদার দিকে এগিয়ে আসে। রাইদা খেয়াল করে দেখে এদের মধ্যে একটা ছেলে আছে নাম মেহেদী,যে মারিয়াকে বিরক্ত করে সবসময়। সেদিন সকাল বেলাও স্কুলে যাওয়ার সময় বিরক্ত করছিলো তখন রাইদা এসে ছেলেটাকে বকাঝকা করে হুমকি দেয় এরপর ছেলেটা আর মারিয়ার সামনে আসেনি।
‘ভাই এই সেই আপা মানে মারিয়ার বইন যে আমারে বকছে আবার হুমকিও দিচ্ছে।’,মেহেদী আরেকটা ছেলের কানে ফিসফিস করে বলে।
‘তোমারে চেনাচেনা লাগতেছে কই দেখছি বলোতো? ও হ ছোড কালে তোমারে দেখছিলাম এলাকায়।সেই সময় যদি তোমার নানা নানী বিয়ার প্রস্তাবে রাজি হইয়া যাইতো তেইলে আইজকা তুমি আমার পোলার মা হইতা।’, দাঁত কেলিয়ে কথাগুলো বলে ছেলেটা।
‘আরে আপনাকেও তো আমি খুব ভালো করে চিনি মনে হচ্ছে। বাইক নিয়ে সারাদিন মেয়েদের পিছন পিছন ঘুরতেন আমি তো ইট মেরে আপনার বাইকের লাইটও ভেঙে দিয়েছিলাম। যতদূর মনে পরে আমাদের বাড়ির সামনে আপনি বখাটের মতো বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন।এতো অপমানের পরেও আবার নির্লজ্জের মতো নিজের বাবাকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।’
‘এই মেয়ে তুমি জানো কার লগে কথা কইতাছো? আমি অমিত তালুকদার। গ্রামের মধ্যে আমার গুষ্ঠিরে সক্কলে এক নামে চিনে।চেয়ারম্যান ও আমগো ইশারায় উডে বহে।তোমার মতো মাইয়ারে আমার বিছানায় নিতে এক মিনিট লাগবো।’,রাইদার দিকে আঙ্গুল তাক করে বলে অমিত।
‘শুনলাম ধ*র্ষ*নের মামলায় জে*লে গিয়েছিলেন তারপর মুক্তি পেতে মেয়েটাকে বিয়ে করেছেন এরপরও দেখছি আপনার ভাব কমেনি।শুনুন আপনার এইসব তালুকদারের পাওয়ার এই গ্রামের গন্ডি পর্যন্তই।ভদ্র ভাবে শেষ বারের মতো বলছে আমার সাথে ঝামেলায় জড়ানোর চেষ্টা করলে কুয়ায় ডুবে মরবেন।’
‘এই আপা আরমান ভাইয়ের লগে এমনে কথা কন ক্যান? আপনেরে..’
মেহেদী আর কিছু বলার আগেই রাইদা চড় বসিয়ে দেয় ওর গালে।
‘বড়রা কথা বললে কথার মধ্যে আগ বাড়িয়ে কথা বলিস কেনো? ভদ্রতা শিখিসনি? বয়স তো মনে হয় আঠারো হবে আর আমার বয়স জানিস?আমি তোর বড় আপুর বয়সী তাই কথা বার্তা সাবধানে বলবি।আর হ্যা পরেরবার যদি তোকে মারিয়ার আশেপাশে দেখেছি তাহলে ঠ্যাং ভেঙে তালুকদার বাড়িতে পার্সেল করে দিবো।শুনুন অমিত তালুকদার আপনার ছোট ভাইকে সামলে রাখবেন। ‘
রেগে কথাগুলো বলে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয় রাইদা।অমিত সহ বাকি ছেলেরাও হা করে তাকিয়ে আছে।তারা বিশ্বাসই করতে পারছে না একটা মেয়ে এসে এভাবে তাদের অপদস্ত করে গেলো।মেহেদী গালে হাত দিয়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। রাইদা যখন চড় দিয়েছিলো তখন কিছু মেয়ে এবং মুরব্বিরা দেখে নেয়।অমিত রাগে বাইকের কাছে গিয়ে লাথি মারে।
…
বিকাল বেলা রুমে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো রাইদা।পড়ার টেবিলের দিকে চোখ গেলে দেখে মারিয়া সাজুগুজু করছে। অসময়ে মারিয়াকে সাজতে দেখে বেশ অবাক হয় সে।
টেবিল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মাথায় ঘোমটা দেয় মরিয়া।দুই বিনুনি করা লম্বা চুলগুলো দুই পাশে ঝুলছে। রাইদা খেয়াল করে দেখে তারই গোলাপি রঙের লিপস্টিক ঠোঁটে দিয়েছে মারিয়া।
‘এই এদিকে আয় তো।’,মারিয়াকে হাতের ইশারায় ডেকে বলে রাইদা।
সামনে এসে মারিয়া দাঁড়ালে রাই মারিয়াকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে থাকে।
‘তুই জামা পাল্টে নতুন জামা পড়েছিস কেনো? আবার সেজেছিস কাহিনী কি?কোথাও যাচ্ছিস নাকি?’,মারিয়াকে প্রশ্ন করে রাইদা।
কোনো জবাব না দিয়ে আঙ্গুল দিয়ে ওড়না প্যাঁচাতে থাকে মারিয়া।
‘চেয়ারম্যান বাইত যামু।তুমিও রেডি হও জলদি।’,সাবিনা রুমে এসে বলে।
‘হুট করে চেয়ারম্যান বাড়ি কেনো যেতে চাচ্ছো? আর এ বিষয়ে আমাকে আগে কেনো কিছু জানাওনি?’,রাইদা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘সক্কাল বেলা মনিরা ভাবি ওনার পোলারে পাডাইয়া দাওয়াত দিয়া গেছে কও না করা যায় নাকি? আমি তোমার ভাইরে তৈরি করাইতাছি তুমিও জলদি জামা পাল্টাইয়া নাও।’,কথাগুলো বলে সাবিনা পাশের রুমে চলে যায়। মারিয়াও তার পিছনে পিছন যায়।
বিছানায় বসে ভাবনায় পড়ে যায় রাইদা।
…
(চলবে..)
(কমেন্টে অবশ্যই জানাবেন কেমন লাগলো আর এখন পর্যন্ত আপনাদের পছন্দ চরিত্র কোনটা সেটাও জানান।)