পর্বঃ২০
গল্পঃ #সেদিন_দেখা_হয়েছিলো
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
(গল্প কপি পোস্ট করা সম্পূর্ণ নিষেধ।)
…
‘কিরে রাই এতো চ্যাতলো কেনো?’,অর্ক ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বলে।
‘নিশ্চয়ই মেয়েটা পাকনামি করে তর্ক করছিলো তাই রাই হাই পাওয়ারের ঔষধ মেয়েটাকে দিচ্ছে।’,খেতে খেতে বাপ্পি জবাব দেয়।
‘জলদি গিয়ে ওরে থামা না হলে আজকে মেয়েটাকে এমন ঔষধ দিবে এই জীবনে আর ও ভার্সিটিতে আসবে না।’,ফাহিম ফোনের দিকে তাকিয়ে বলে।
‘একটা জিনিস খেয়াল করেছিস?রাই ফেরার পর থেকে অন্য রকম আচরণ করছে, ওর রাগটাও কন্ট্রোল করতে পারছে না।’,অর্ক বলে।
‘তুই কি বলতে চাচ্ছিস ঐ সায়নের সাথে দেখা হওয়ার পর রাইয়ের সব উলোট পালট হয়ে গেছে?’,বাপ্পি উল্টো অর্ককে প্রশ্ন করে।
‘কি হয়েছে পরে দেখা যাবে আগে রাইকে থামাই।’,অর্ক বসা থেকে উঠে বলে।
দুই বন্ধু এগিয়ে যায় ভীড়ের দিকে যেখানে একটা টেবিল ঘিরে সকলে দাঁড়িয়ে আছে।
রাইদা আর সায়ন্তিকার তামাশা দেখতে ক্লাস ছেড়ে অনেকে এসে ভীড় করেছে।রাইদা চা ছুঁড়ে মারার পর সায়ন্তিকা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় সাথে ওর বান্ধবীও ভয়ে সায়ন্তিকার পিছনে দাঁড়ায়। পায়েল রাইদার পাশে চেয়ার টেনে বসে ভিডিও করতে থাকে সব।
‘আপনি আবারো আমায় অপমান করলেন? চা টা যদি গরম হতো আমি পুড়ে যেতাম না?’,সায়ন্তিকা অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাইদাকে বলে।
‘তা পাপা কি পারী এখানে আবার কি এসেছো আমার কাছ থেকে আদব শিখতে?’,চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলে জিজ্ঞেস করে রাইদা।
‘আপনি জানেন আমি কে? আপনি এখানে কি করছেন? আপনি এখানে আছেন জানলে জীবনেও এখানে আসতাম না।’,সায়ন্তিকা আগের ন্যায় জোর গলায় বলে।
‘আমি আসলে কেয়ার করি না কে তুমি। তুমি যদি মন্ত্রীর মেয়েও হও তারপরও তোমাকে ভদ্রতা শেখানো উচিত।তোমাকে যখন বলেছে সিনিয়রদের জন্য চা নিয়ে যাচ্ছে তখন তুমি ত্যাড়ামি করতে গেলা ক্যান?বুঝা উচিত ছিলো সিনিয়রদের চা নিবা আর সিনিয়ররা চেয়ে চেয়ে তোমার সুন্দর চেহারা দেখবে কিছু বলবে না? চেহারাই খালি সুন্দর তোমার কিন্তু মাথা একদম খালি ভিতরে গোবর ও নেই।’,রাইদা পা দোলাতে দোলাতে বলে।
‘আমি এখানে আর এক সেকেন্ড ও থাকবো না।গত কালকে আমার আইসক্রিম ফেলেছেন আজকে আমার ড্রেস নষ্ট করেছেন।আমার কত পছন্দের ড্রেসটা গেলো।’,ফোন বের করে সায়ন্তিকা বলতে থাকে।
বাপ্পি আর অর্ক ততক্ষণে চলে আসে।
‘কিরে ফ্রেশারদের এতো প্রেসার দিলে তো ওরা আর ভার্সিটির চেহারাই দেখবে না।আরে তুমি সেই আইসক্রিমের জন্য কান্না করা মেয়েটা না?’,বাপ্পি হাসতে হাসতে বলে।
‘আজকের জন্য অনেক হয়েছে চল।’,অর্ক রাইদার হাত ধরে বসা থেকে দাঁড়া করায়।
সায়ন্তিকার ফোন বেজে উঠে। সায়ন কল দিয়েছে দেখে দ্রুত কল রিসিভ করে সায়ন্তিকা।
‘হ্যালো ভাইয়া আমি এখানে ভর্তি হবো না।অন্য কোথাও আমাকে ভর্তি করাও।’,সায়ন্তিকা এক টানা কথাগুলো বলে।
‘ভর্তির সব ফর্মালিটি শেষ, আমি ভার্সিটির অফিস রুম থেকে বের হলাম তুই কই?’,সায়ন জিজ্ঞেস করে।
‘কি? ভর্তি করে ফেলেছো?’,কথাটা বলে সায়ন্তিকা রাইদার দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকায়।
রাইদা সায়ন্তিকার কথা শুনে হাসি দেয়। অর্কের কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে সায়ন্তিকার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
‘ওয়েলকাল টু হেল জুনিয়র।’,সায়ন্তিকাকে কথাটা বলে গাল টেনে দেয় রাইদা।
সায়ন্তিকা মূর্তির মতো রাইদার দিকে তাকিয়ে থাকে।রাইদা হাসতে হাসতে বন্ধুদের নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।
সায়ন্তিকার কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে সায়ন ফোনের অপর পাশ থেকে হ্যালো হ্যালো করতে থাকে।
‘ভাইয়া আমি এখানে পড়বো না।’,সায়ন্তিকা গলার স্বর নরম করে বলে।
‘কি হয়েছে? তুই কই বল আসছি।’,সায়ন জিজ্ঞেস করে।
‘নিচ তলায় ক্যান্টিনে।’,সায়ন্তিকা জবাব দেয়।
‘আচ্ছা আসতেছি থাক।’,সায়ন কলটা কেটে তৃতীয় তলা থেকে নামতে থাকে।
‘আমি অডিটোরিয়ামে যাচ্ছি তোরা কি যাবি?’,রাইদা চেয়ার থেকে নিজের ব্যাগ তুলে জিজ্ঞেস করে।
‘চলেন সিনিয়র আমরা আপনার পিছন পিছন আসতেছি।’,অর্ক এক হাত বুকে দিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ল বলে। পায়েল নিজের ব্যাগ দিয়ে অর্কের পিঠে মেরে রাইদার পিছন পিছন যায়।একে একে বাপ্পি,অর্ক,ফাহিম ও বের হয়।
সায়ন প্রচন্ড বিরক্ত হয় নিজের বোনকে নিয়ে।এখানে এনে বোনকে ভর্তি করেছে যাতে রাইদার খোঁজ নিতে পারে এখন কিনা বোন ঝামেলা পাকিয়ে বলছে পড়বে না। সায়ন্তিকার কারণে কিছুতেই রাইদার খোঁজ পাওয়ার জায়গাটা সে হাত ছাড়া করতে চায় না।ক্যান্টিনে ঢুকে আশে পাশে তাকিয়ে সায়ন্তিকাকে খুঁজতে থাকে সায়ন। এক কোণায় সায়ন্তিকা আর ওর বান্ধবীকে দেখে সেখানে এসে দাঁড়ায় সায়ন।
‘ভাইয়া ঐ আপুটা দেখো কি করেছে।’,সায়ন্তিকা নিজের ড্রেসে চায়ের দাগ দেখিয়ে বলে।
‘এই অবস্থা কি করে হলো তোর?আর কোন আপুর কথা বলছিস?’,সায়ন জিজ্ঞেস করে।
‘গত কালকে মলে যেই আপুটা সায়ন্তিকাকে বকেছিলো।’,সায়ন্তিকার বান্ধবী জবাব দেয়।
‘এই যে আপু চায়ের বিলটা দেন।’,ছোটু এসে সায়ন্তিকার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দেয়।
সায়ন কাগজটা হাতে নিয়ে অবাক হয়।
‘এতোগুলো চা, সিগাঙ্গা তুই একা খেয়েছিস? আবার পানিও আছে দেখছি।’,সায়ন্তিকাকে জিজ্ঞেস করে।
‘ভার্সিটির বড় আপুর সাথে তর্ক করতে গেছিলো বিনিময়ে তাদের বিল এখন আপনাদের দিতে হইবে। ঐ আপুর সাথে তার সিনিয়ররাও তর্ক করতে যায় না।’,ছোটু হাসতে হাসতে বলে।
‘কি হয়েছিলো এখানে?’,সায়ন জিজ্ঞেস করে।
ছোটু ঘটনার বিস্তারিত সায়নকে বলে।সায়ন্তিকা মাথা নিচু করে থাকে।
‘বিল না হয় দিয়ে দিলাম কিন্তু তোমাদের সেই সিনিয়র আপুর সাথে তো দেখা করতে হয়।আমার বোনকে কাঁদায় তাকে তো দেখতেই হয়।তা তোমাদের সেই সিনিয়র আপু কোথায়?ডাকো দেখি।’,ছোটুর কাঁধে হাত দিয়ে বলে সায়ন।
‘ওনারা তো গেছে গা।অডিটোরিয়ামে পাইবেন তাগো।’,ছোটু জবাব দেয়।
সায়ন বিল মিটিয়ে সায়ন্তিকার হাত ধরে হাঁটা দেয়। বুঝাতে শুরু করে সায়ন্তিকাকে।
‘তুই গাড়িতে গিয়ে বস আমি আসতেছি।’,সায়ন্তিকাকে কথাটা বলে পকেট থেকে ফোন বের করে সাইডে চলে যায় সায়ন।
রাইদার নাম্বারে কল দেয়।রিং বাজতে থাকে কিন্তু কেউ রিসিভ করে না। রাইদা সেই সময় রিহার্সালে ব্যস্ত থাকায় ফোনের শব্দ শুনতে পায় না। সায়ন বিরক্ত হয়ে গাড়ির দিকে চলে যায়।
সয়ন্তিকাকে বাসায় নামিয়ে অফিসে চলে যায় সায়ন।
..
দুপুর বেলা রিহার্সাল শেষ করে সকলে ভার্সিটি থেকে বের হয়। ভার্সিটির পাশের একটা রেস্টুরেন্টে খেতে বসে।
‘রুহিকে কল দে জিজ্ঞেস কর কখন আসবে।’,অর্ককে বলে রাইদা।
‘আমি কেন কল দিবো?তোরা মিস করছিস তোরা কল দে।’,অর্ক জবাব দেয়।
বাপ্পি অর্কের হাত থেকে ফোন কেঁড়ে নিয়ে রুহিকে কল দেয়। অর্ক যতক্ষণে ফোন ফেরত নেয় ততক্ষণে কল রিসিভ করে ফেলে রুহি। বাধ্য হয়ে অর্ক ফোন কানে দেয়।
‘বলছিলাম কই তুই?’,গলা ঝেরে অর্ক জিজ্ঞেস করে।
‘আমি এই তো এক ঘন্টা পর বের হবো।সবাই কোথায়? রিহার্সাল হয়েছে?’,রুহি জিজ্ঞেস করে।
‘ওহ তাহলে আসতে পারবি একা?আমরা রেস্টুরেন্টে আছি খেয়ে বের হবো ।’,অর্ক জিজ্ঞেস করে।
‘আসতে পারবো সমস্যা নেই।’,রুহি জবাব দেয়।
পায়েল অর্কের হাত থেকে ফোন কেঁড়ে নিয়ে বলে,’অর্ক যাচ্ছে তোকে আনতে।তোকে কল দিলে তুই খালি বের হবি,রাখছি। ‘
কথাগুলো বলে পায়েল কল কেটে দেয়। অর্ক পায়েলের দিকে তাকিয়ে ধমক দেয়।
‘দেখ ও বলে ফেলেছে এখন যদি তুই না যাস মেয়েটা মন খারাপ করবে।যা ওরে নিয়ে আয়।তোর তো যেতেও টাইম লাগবে এখনই বের হ।’,রাইদা অর্ককে বুঝিয়ে বলে।
‘আমার বাইকটা নিয়ে যা সময় কম লাগবে।’,অর্কের হাতে বাইকের চাবি দিয়ে বলে বাপ্পি।
অর্ক আর কিছু বলার সুযোগ পায় না।বাপ্পি ওরে টেনে রেস্টুরেন্টের বাহিরে বের করে দেয়। বাধ্য হয়ে অর্ক বাইক স্টার্ট দেয়।
রাইদা আর পায়েল হাইফাইভ দেয় খুশিতে।
‘এই টুকুতে খুশি না হয়ে এদের মিলানোর ব্যবস্থা কর।’,ফাহিম বলে।
‘অর্ক এক পা এগুলেই সব সম্ভব। ওরেই বুঝাতে হবে।’,রাইদা বলে।
‘পছন্দের মানুষ সামনে অথচ অর্ক সুযোগ মিস করতেছে।’,বাপ্পি আফসোস করে বলে।
‘ওয়েটারকে বল আমাদের খাবার পার্সেল করতে আর অর্ক,রুহি আসলে ওদের জোর করে খাওয়াতে।দরকার হলে ওয়েটারকে বকশিস দিয়ে শিখিয়ে দে কীভাবে কি করবে। ‘,ফোন হাতে নিয়ে বাপ্পিকে বলে রাইদা।
বাপ্পি ওয়েটারকে ডাক দিয়ে সব বলতে শুরু করে।
রাইদা সায়নের মেসেজগুলো চেক করতে থাকে।গত রাত থেকে অনেকগুলো কল,মেসেজ পাঠিয়েছে কিন্তু রাইদা রিপ্লাই করেনি। সায়নের শেষ মেসেজটা দেখে ভাবছে রিপ্লাই করবে কিনা।
‘রি তোমার মনে হয় না আমাদের একবার বসে ঠান্ডা মাথায় এসব নিয়ে কথা বলা উচিত? এভাবে দূরত্ব বাড়তে থাকলে সম্পর্কটা কোনো দিকেই যাবে না।যেহেতু আমরা একটা সম্পর্কে আঁটকে গেছি সেটা তো তুমি অস্বীকার করলে মিথ্যা হয়ে যাবে না।আমি তোমায় কোনো বিষয়ে জোর করতে চাইছি না শুধু একবার ভেবে দেখো।’
সায়নের মেসেজের পড়ে গালে হাত দিয়ে ভাবনায় পরে যায় রাইদা।
‘ঠিক আছে সন্ধ্যায় দেখা করেন। আপনাকে বলে দিচ্ছি আমি কিন্তু শুধু সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে বলতে চাই আপনি অতিরিক্ত কিছু আশা করবেন না আমার থেকে।’
মেসেজটা পাঠিয়ে সায়নের রিপ্লাইয়ের অপেক্ষা করতে থাকে রাইদা।ততক্ষণে তাদের খাবার চলে আসলে সকলে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়।
সায়ন অফিসে এসে তার বাবার সাথে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলো। ফোনে মেসেজ আসার শব্দ হলে চোখ তুলে ফোনের দিকে তাকায়। স্কিনে রি লেখাটা দেখে সায়ন সব ভুলে ফোন হাতে তার বাবার কেবিন থেকে বের হয়ে যায়। সায়নের বাবা ছেলের এমন খামখেয়ালি আচরণে প্রচন্ড বিরক্ত হয়। একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ করে আজই ঢাকা ফিরেছে কিন্তু ফিরে দেখে সায়ন এখনো তার বুঝিয়ে দেওয়া কাজ শেষ করেনি।
নিজের কেবিনে বসে রাইদার মেসেজ পড়ে সায়ন অনেক খুশি হয়।
‘সন্ধ্যায় তোমায় আমি পিক করবো।’,রাইদার মেসেজের রিপ্লাই করে সায়ন।
‘কোনো দরকার নেই আমার পা আছে, আমি রাস্তা চিনি চলে আসবো।আপনি আমাকে জানান কোথায় আসবো।’,অপরপাশ থেকে রাইদা রিপ্লাই করে।
সায়ন ঠিকানা পাঠিয়ে নিজের খুশি লুকাতে মুখটা গম্ভীর করে বাবার কেবিনের দিলে যায়।
..
রেস্টুরেন্টে রুহিকে নিয়ে এসে অর্ক বোকাবনে যায়।যেই টেবিলে বন্ধুরা সবে ছিলো সেখানে গিয়ে বসে কিন্তু রেস্টুরেন্টের ভেতরে কাউকে দেখতে পায় না। একে একে বাপ্পি,রাইদা,পায়েল,ফাহিমকে কল দেয় কিন্তু কেউ রিসিভ করে না। রাইদার নাম্বার থেকে অর্কের ফোনে মেসেজ আসে।
‘খাবারের বিল আমি পে করেছি তাই পুরোটা শেষ করেই আসবি নষ্ট করবি না একদম। এনজয় ইউর ডেট উইথ রুহি।’
মেসেজটা পড়ে অর্কের কাশি উঠে যায়।রুহি পানির বোতল বাড়িয়ে দেয় অর্কের দিকে। পানি খেয়ে অর্ক কাশি থামায়।
ওয়েটার এসে দুজনকে এই টেবিল থেকে উঠিয়ে কোণায় একটা ছোট টেবিলে বসার ব্যবস্থা করে দেয়।টেবিলের দিকে তাকিয়ে অর্কের মাথা চক্কর দেয়।টেবিলে কিছু গোলাপ রাখা সাথে একটা কাগজ ও রাখা যাতে লেখা ‘দিস ইজ ফর লাভ বার্ডস’। কাগজটা তাড়াহুড়ো করে অর্ক নিজের পকেটে রাখে যাতে রুহি লেখা না দেখে। ওয়েটার গিয়ে সফট রোমান্টিক গান ছেড়ে দেয় এতে পুরো পরিবেশটা পাল্টে যায়। অর্ক আর রুহি চুপ করে বসে আছে কারো মুখে কোনো কথা নেই।
কিছুক্ষণ পর ওয়েটার এসে দু’জনের খাবার টেবিলে রেখে যায়।
‘বাকিরা কোথায়?’,নিরবতা ভেঙে রুহি জিজ্ঞেস করে।
‘জানি না।’,খেতে খেতে অর্ক জবাব দেয়।
রুহি আর কিছু জিজ্ঞেস না করে খেতে থাকে। অর্ক খেতে থাকে আর আঁড়চোখে রুহিকে দেখতে থাকে।শ্যাম বর্ণের এই মেয়েকে প্রথমদিন ক্লাসে দেখেই তার মনে ধরেছিলো। প্রথম প্রথম রুহির লজ্জা মাখা মুখ দেখে বিরক্ত লাগতো কিন্তু এরপর সেটা একসময় ভালোবাসায় পরিণত হয়ে গেলো। এই মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাবে ভাবলেও অর্কের কেমন জানি লাগে।
রুহি অস্বস্তিতে খেতে পারছে না।যতই অর্ক বন্ধু হোক একা কখনো অর্কের সাথে এভাবে বসে খায়নি তার উপর সে অর্কের উপর দূর্বল। অর্কের মতো একজন ছেলেকে সে সারাজীবনের জন্য চাইতো। এক সময় তার মনে হয় অর্ক তাকে ভালোবাসে আবার মনে হয় না এটা শুধুই বন্ধুত্ব।যেমন বন্ধুত্ব রাইদার সাথে অর্কের তেমন বন্ধুত্ব তার সাথে অর্কের। রুহির খুব ইচ্ছা করে অর্কের সাথে শহর ঘুরতে কিন্তু মুখ খুলে বলতে পারে না কখনো।
খাওয়া শেষ করে অর্ক রুহিকে নিয়ে বের হয়।রাইদাকে কল দিলে ওর নাম্বার থেকে মেসেজ আসে।
‘আমরা টিএসসি তে বসে আছি তুই রুহিকে নিয়ে আয়।’
রাইদার মেসেজ পড়ে অর্ক রুহিকে নিয়ে বাইক স্টার্ট দেয়।
ঐদিকে চার বন্ধু মিলে ফাহিমের বাসায় আড্ডা দিচ্ছে আর অর্ক, রুহিকে শহর ঘুরাচ্ছে।
‘তোর প্লান কি কাজে দিবে?অর্কের যেই ইগো সে তো মনে হয় না ইগো ভেঙে নিজ থেকে বলবে।’,বাপ্পি রাইদাকে জিজ্ঞেস করে।
‘ওদের একটু একান্ত সময় কাটাতে দেওয়া উচিত এতে নিজেদের অনুভূতি সম্পর্কে আরো ভালো করে বুঝতে পারবে।’,রাইদা জবাব দেয়।
‘আমি বলি কি দুইটারে ধরে বেঁধে কাজি অফিসে নিয়ে বিয়ে পড়িয়ে দেই ঝামেলা শেষ।’
বাপ্পির এমন কথায় রাইদা,পায়েল,ফাহিম মুখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে হাসি দেয়। বাপ্পি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।
‘কিরে এমনে তাকাইয়া আছোস কেন সব?’,ঢোক গিলে বাপ্পি জিজ্ঞেস করে।
‘এত দিনে একটা কাজের বুদ্ধি দিলি।যদি ওরা ইগো দেখাতে থাকে তাহলে এটাই করতে হবে।’,ফাহিম জবাব দেয়।
রাইাদা ভাবতে থাকে সন্ধ্যায় সায়নের সাথে দেখা হলে কি বলবে। এরমধ্যে অর্ক আবার কল দেয়।
‘চা অর্ডার দিয়ে খেতে থাক আমরা আসতেছি।’,অর্ককে মেসেজটা পাঠিয়ে রাইদা আবারো নিজের ভাবনায় ডুব দেয়।
রাইদার মেসেজ পেয়ে অর্ক বুঝে যায় এগুলো সব ওদের প্লান যাতে রুহিকে নিয়ে ও একটু একা সময় কাঁটায়। পাশে বসা রুহির দিকে অর্ক তাকায়।
‘তোর কোনো তাড়া আছে?’,অর্ক জিজ্ঞেস করে রুহিকে।
রুহি মাথা নাড়িয়ে না সূচক জবাব দেয়।অর্ক মনে মনে ভেবে নেয় রুহিকে নিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরবে।
..
পায়েল আর বাপ্পি বেরিয়েছে অনেকক্ষণ আগে।ফাহিম রুমে ঘুমাচ্ছে,মিসেস ফিরোজা রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত। রাইদা রেডি হয়ে বারবার নিজেকে আয়নায় দেখে নিচ্ছে, কেনো জানি সায়নের সামনে যেতে তার অস্বস্তি লাগছে।
‘আন্টি আমি বের হচ্ছি ফিরতে বেশি সময় লাগবে না।’,রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে রাইদা বলে।
‘সাবধানে যা আর কল দিস দেরি হলে আমি ফাহিমকে পাঠিয়ে দিবো।’,মিসেস ফিরেজা বলে।
রাইদা বাসা থেকে বের হয়ে একটা রিকশা ডেকে উঠে বসে। রিকশায় উঠে ধানমন্ডির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ধানমন্ডি এসে রিকশা থামলে রাইদা নেমে আশে পাশে তাকায়। সায়নকে কল দিবে কিনা ভাবতে থাকে।রিকশার ভাড়া মিটিয়ে হাঁটতে শুরু করে।
কিছু দূর হাঁটার পর দেখতে পায় সায়ন একটা গাড়িতে হেলান দিয়ে সিগারেট খাচ্ছে আর বারবার ফোনের দিকে তাকাচ্ছে,রাইদাকে সে দেখতে পায়নি এখনো। রাইদা ভ্রু কুঁচকে নিজের ফোন বের করে সায়নকে কল দেয়।ফোন কানে নিয়ে সায়নের দিকে তাকায়।সায়নের ফোন বেজে উঠলে তাড়াতাড়ি হাতের সিগারেট ফেলে সেটা নিভানোর চেষ্টা করে।কলটা রিসিভ করে কানে দিলে অপর পাশ থেকে রাইদার গম্ভীর কন্ঠ পায়।
‘সিগারেটটা ফেললেন কেনো?’,রাইদা বলে উঠে।
রাইদার এমন কথায় সায়ন ডানে বামে তাকায়।দূরেই দেখতে পায় রাইদা ফোন কানে দাঁড়িয়ে আছে।
‘সিগারেট না ফেললে বউকে চুমু খাবো কীভাবে? ‘,রাইদার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সায়ন ফোন কানে বলে।
‘ধ্যাত অসভ্য। ‘,কথাটা বলে রাইদা কল কেটে দেয়।
সায়ন হাসতে হাসতে রাইদার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
‘এতো হাসছেন কেনো?আজকাল দেখছি আপনার বড্ড হাসি পায়।’,রাইদা বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘বউয়ের দেখা পেয়ে শরীর, মন সব ফুরফুরে তাই এতো হাসিখুশি দেখতে পাচ্ছো।চলো বসি কোথাও।’,সায়ন রাইদার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে।
রাইদা ভেংচি দিয়ে হাঁটা শুরু করে। সায়ন রাইদার হাত ধরতে না পেরে ওড়না ধরে রাইদার পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করে।ওড়নায় টান পরলে রাইদা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে সায়ন তার ওড়না ধরে হাঁটছে।
‘এই ওড়না ছাড়ুন লোকে দেখলে উল্টা পাল্টা কথা বলবে।’,রাইদা সায়নের হাতের থেকে ওড়না ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে।
‘তুমি হাত ধরছো না তাই তো আমি তোমার ওড়না ধরলাম যাতে মানুষ বুঝে আমি সিঙ্গেল নই।জানোই তো এতো হ্যান্ডসাম একটা ছেলে দেখলে মেয়েরা লাইন মারতে চাইবে তাই তাদের বুঝাতে হবে আমার সুন্দরী বউ আছে আমি সারা জীবনের জন্য বুকড। আর বউয়ের ওড়না ধরলে কে কি ভাবলো তাতে আমার কিছু আসে যায় না।’,সায়ন জবাব দেয়।
‘এখন চিল্লানী দিয়ে মানুষকে জানাবেন নাকি আপনার বউ আছে?মনে হচ্ছে ওনার একারই বিয়ে হয়েছে আর কারো বিয়ে হয় না।’,বিরক্ত হয়ে রাইদা বলে।
‘আরে ভালো বুদ্ধি দিলে তো।এই যে শুনুন সবাই এটা আমার ব…’,চিল্লানী দিয়ে সায়ন কথাগুলো বলছিলো তখনই রাইদা সায়নের মুখ চেপে ধরে।
‘চুপ একদম আরেকটা কথা বললে আমি চলে যাবো।’,রাইদা সায়নের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বলে।
সায়ন ভদ্র ছেলের মতো চুপ হয়ে যায়।রাস্তার মানুষ জন সব ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে। সায়নের মুখ থেকে হাত সরিয়ে রাইদা হাঁটতে শুরু করে।সায়নও রাইদার ওড়না ধরে হাঁটতে থাকে। রাইদা বিরক্ত হলেও চুপ করে সহ্য করে।একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে দু’জনে মুখোমুখি বসে।
সায়ন গালে হাত দিয়ে রাইদার দিতে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাইদা বিরক্ত হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
‘কি সমস্যা এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো? ঠিক হয়ে বসুন।’
রাইদার কথায় সায়ন গাল থেকে হাত নামিয়ে সোজা হয়ে বসে। মেনু কার্ডটা রাইদার সামনে রাখে।
‘অর্ডার করো। ‘,সায়ন বলে।
‘আমি খেতে আসিনি কিংবা গল্প করতে আসিনি।আপনার খেতে ইচ্ছে হলে আপনি খান।’,পানির বোতল খুলে পানি খেতে খেতে রাইদা বলে।
‘না হওয়া প্রেমিকা এবং হওয়া বউয়ের সাথে এটা আমার প্রথম ডেট।ইশ্! আমার লজ্জা লাগছে।’,মেনু কার্ড দিয়ে মুখ ডেকে বলে সায়ন।
সায়নের এমন কথা শুনে পানি মুখে নিয়ে রাইদা কাশতে শুরু করে।অনেক কষ্টে পানিটা গিলে নিজেই নিজের মাথায় হাত দিয়ে কাশি থামানোর চেষ্টা করে। সায়ন সাহায্য করতে নিলে ইশারায় না করে দেয় রাইদা।
কিছুক্ষণ পর রাইদার কাশি থেমে গেলে সে স্বাভাবিক হয়।
‘হেই রাই বেইবি তুমি এখানে?’,রেস্টুরেন্টের দরজা দিয়ে কয়েকজন ছেলে ঢুক ছিলো সেখান থেকে এক ছেলে বলে উঠে।
সায়ন ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলেটার দিকে তাকায়।অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ছেলের ডাকে সে অনেক বিরক্ত হয়।সায়নের চোখ মুখে গম্ভীর ভাবে ফুটে উঠে।
‘আরে এই চিপকু আবার এখানে কেন? ‘,রাইদা দাঁতে দাঁত চেপে বলে।
‘ছেলেটা কে?’,গম্ভীর স্বরে সায়ন জিজ্ঞেস করে।
‘আরে ভার্সিটির সিনিয়র পুরো চিপকু। শতবার প্রপোজ করেছে আর শতবার রিজেক্ট করেছি তারপরও আমাকে তার প্রেমিকা বলে দাবি করে।ওনাকে অপমান করলেও গায়ে লাগে না ফালতু ছেলে।’,রাইদা আগের ন্যায় মুখ করে বলে।
‘ওনার উপর তুমি বিরক্ত? ‘,সায়ন জিজ্ঞেস করে।
‘প্রচুর মানে প্রচুর বিরক্ত।’,সায়নের দিকে তাকিয়ে বলে রাইদা।
সায়ন ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলেটার দিকে আবারো তাকায়। ততক্ষণে ছেলেটা ওদের টেবিলের সামনে চলে এসেছে।একটা চেয়ার টেনে বসে।
‘হেই রাই বেইবি কেমন আছো? এটা কে? তোমার ভাই নাকি নতুন প্রেমিক? হ্যালো আমি মাসুম হাসান।’,রাইদাকে একটার পর একটা প্রশ্ন করে শেষে সায়নের দিকে হাত বাড়িয়ে নিজের পরিচয় দেয় ছেলেটা।
সায়ন ছেলেটার বাড়ানো হাতের দিকে তাকায় কিন্তু হ্যান্ডসেক করে না।
‘আপনি এখন আসতে পারেন আমরা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছি।’,রাইদা মাসুমকে সরাসরি বলে।
‘কি যে বলো তুমি রাই।আমি তোমার একমাত্র বয়ফ্রেন্ড আমি যদি তোমার খেয়াল না রাখি কে রাখবে বলো? আমাকে ছেড়ে একা একা ঘুরে বেড়াও এটা তো ঠিক না। ভাই রাই কিন্তু আমার গার্লফ্রেন্ড। ভার্সিটির প্রথমদিন থেকে আমাদের প্রেম,আমাদের মধ্যে সব হয়ে গেছে খালি বিয়ে বাকি।’,মাসুম দাঁত কেলিয়ে সায়নকে শেষের কথা বলে।
‘মায়ের কাছে মাসির গল্প করতে আসছে।’,বিরবির করে রাইদা বলে।
‘একা একা কি বিরবির করছো বেইবি?’,কথাটা বলে রাইদার হাতের উপর হাত রাখে মাসুম।
এতক্ষণ সায়ন চুপ করে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছিলো কিন্তু রাইদার হাত মাসুম স্পর্শ করায় আর রাগকে দমিয়ে রাখতে পারে না সায়ন। মাসুমের গাল বরাবর দিয়ে দেয় এক ঘুষি। টাল সামলাতে না পেরে চেয়ার সহ মাসুম নিচে পড়ে যায়। বসা থেকে উঠে মাসুমের গলার ধরে পরপর কয়েকটা চড় মাসুমকে দেয় সায়ন।
রাইদা যতক্ষণে বুঝতে পারে সায়ন ক্ষেপেছে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। আশেপাশের টেবিলে মানুষ দৌড়ে আসে। মাসুমের বন্ধুরা সায়নকে থামানোর চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু পারে না।
‘সায়ন প্লিজ থামুন।সায়ন কথা শুনুন। ‘,চিৎকার করে রাইদা বলে কিন্তু সায়ন তা কানে নেয় না।
শেষে ওয়েটার ম্যানেজার সহ আরে কিছু লোক সায়নকে ধরে মাসুমের থেকে সরায়। মাসুমের বন্ধুরা এসে ওকে একটা চেয়ারে তুলে বসায়।
‘তোর এতো সাহস রি কে স্পর্শ করিস? ও যখন বলেছে ওর তোকে পছন্দ না তারপরও বিরক্ত কেন করিস?আজকের পর রি এর আশেপাশে তোরে দেখলে হাত পা ভেঙে পঙ্গু বানিয়ে দিবো।’,রেগে মাসুমকে কথাগুলো বলে সায়ন।
রাইদা নিজের ব্যাগ নিয়ে দ্রুত হেঁটে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে যায়। সায়নের যখন রাইদার কথা মাথায় আসে সে পিছনে ফিরে দেখে রাইদা নেই।দৌড়ে রেস্টুরেন্ট থেকে নামে।রাস্তায় এসে আশে পাশে তাকিয়ে রাইদাকে খুঁজতে থাকে।রাইদা রিকশায় উঠছিলো তখন পিছন থেকে এসে বাম হাত কেউ চেপে ধরে।ঘাড় ঘুরিয়ে রাইদা দেখে সায়ন হাত ধরেছে।
‘ছাড়ুন আমার হাত। আমার বুঝা উচিত ছিলো আপনি কখনো মানুষ হবেন না।আমার ভুল হয়েছে আমি ভেবেছিলাম ঠান্ডা মাথায় আলোচনা করবো কিন্তু এখন আমি এ বিষয়ে কোনো আলোচনা আপনার সাথে করবো না।যা কথা হবার কোর্টে কথা হবে।আপনার সাথে আর এক সেকেন্ড ও এই সম্পর্কে আমি থাকতে রাজি না।খুব জলদি আমি আপনাকে ডির্ভোস দিবো।’
কথাগুলো বলে সায়নের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে রাইদা রিকশায় উঠে বসে।রিকশা চলতে শুরু করলে সায়ন টলমল চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। হুট করেই সায়নের মনে হয় তার দম বন্ধ হয়ে যাবে।রাইদা বসা রিকশার পিছন পিছন দৌড় দেয় সে।
…
(চলবে..)