সেদিন দেখা হয়েছিলো পর্ব -২১

পর্বঃ২১
গল্পঃ #সেদিন_দেখা_হয়েছিলো
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
(গল্প কপি পোস্ট করা সম্পূর্ণ নিষেধ।)

গাড়িতে উঠে রাইদার রিকশা যেই রোড দিয়ে গিয়েছে সেই রোড দিয়ে ঘুরতে থাকে সায়ন।রোডের শেষ মাথায় এসে আর রিকশাটা দেখতে পায় না।
মাঝ রাস্তায় ব্রেক কষে ফোন বের করে রাইদাকে কল দিতে থাকে কিন্তু রাইদা বারবার কল কেটে দেয়। পিছন থেকে অন্য গাড়ি হর্ণ দিলে গাড়িটা এক সাইডে পার্ক করে কিছু একটা ভাবে তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে অন্য রাস্তা ধরে।

রিকশায় বসে রাইদা সায়নের ফোন পেয়ে বিরক্ত হয়ে কল কেটে ফোন বন্ধ করতে যায় তখনই আরাফের কল আসে। কলটা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রাইদা রিসিভ করে না। কলটা বাজতে বাজতে এক সময় কেটে যায়,সাথে সাথে ফোন বন্ধ করে দেয় রাইদা।

বাসায় ফিরে দেখে ফাহিম আর মিসেস ফিরোজা সোফায় বসে গল্প করছে। রাইদা কারো সাথে কথা না বলে মিসেস ফিরোজার রুমে যায়। ফাহিম আর মিসেস ফিরোজা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে রাইদার এহেন কান্ডে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে রাইদার মন মেজাজ অনেক খারাপ।

‘চা খাবি?’,মিসেস ফিরোজা এসে জিজ্ঞেস করে।

‘না খাও তোমরা আমার ভালো লাগছে না।’,রাইদা জবাব দেয়।

নিজের লাগেজ বের করে গোছাতে থাকে রাইদা।

‘এত জলদি বাসায় ফিরবি? প্রোগ্রাম শেষ হলে ফিরিস।’,মিসেস ফিরোজা রাইদাকে বলে।

‘সকাল সন্ধ্যা খালি কল দিয়ে জিজ্ঞেস করতেছে কখন ফিরবো এত যন্ত্রণা আমার ভালো লাগে না।লাগেজ বাসায় থাকলে ভাবে মেয়ে পালাবে না বাসায় ফিরবে।’,তাচ্ছিল্য স্বরে রাইদ বলে।

‘কালকে দিনে ফিরবি নাকি রাতে?’,ফাহিম জিজ্ঞেস করে।

‘সব কাজ শেষ করে ফিরবো যে কয়টা বাজার বাজুক।’,রাইদ জবাব দেয়।

কথাটা বলে লাগেজ গোছানো রেখে বিছানায় বসে পরে রাইদা।

‘রাই বাবা মায়ের সাথে এত রাগ করতে হয় না শত হলেও তোর বাবা মা তারা।একটা ভুল না হয় করেছে তাই বলে এত বছর তাদের শাস্তি দেওয়া উচিত না।’,মিসেস ফিরোজা রাইদার সামনে এসে দাঁড়িয়ে রাইদার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে।

রাইদা মিসেস ফিরোজার কোমড়ে দুই হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে পেটে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে।

‘তাদের ভুলের মাশুল আমি দিচ্ছি আন্টি আর কত দিবো বলতো?ছোট বেলা থেকেই তারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত আমাকে ছেড়ে দিয়েছে আমার মতো।যখন মাকে কাছে চেয়েছি মা নিজের বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে চলে গেছে,যখন বাবাকে বলেছি আমার সাথে বসে গল্প করতে তখন সে নিজের কাজের ব্যস্ততা দেখিয়েছে আর এখন আমাকে তারা কাছে ডাকে। এখন বলে আয় গল্প করি আয় বেড়াতে যাই।আচ্ছা আন্টি এখন তারা সময় দিলে কি আমার শৈশব ফিরে আসবে? এখন তারা ঘুরতে নিলে আমি সেই আনন্দ পাবো?বলো আন্টি কীভাবে তাদের মাফ করি? তাদের কয়টা ভুল মাফ করবো?’,কথাগুলো বলে রাইদা কেঁদে দেয়।

মিসেস ফিরোজা কি বলবে ভাষা খুঁজে পায় না।ফাহিম এসে রাইদার পাশে বসে রাইদার হাত টেনে নিজের হাতে তালু বন্দি করে ফেলে।রাইদাকে কখনোই এতো ভেঙে পরতে সে দেখেনি।ফোনটা বের করে গ্রুপে একটা মেসেজ দেয় ফাহিম।

‘রাইদা কাঁদছে অনেক মনে হয় ওর কিছু হয়েছে।তোরা কেউ পারলে আয় আমি একা সামলাতে পারবো না।’

ফাহিমের পাঠানো মেসেজটা সর্বপ্রথম বাপ্পি পড়ে।সাথে সাথে বাকিদের কল দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায় সে।

মিসেস ফিরোজার কোলে শুয়ে রাইদা কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলেছে আর ফাহিম নিশ্চুপ হয়ে পাশেই রাইদার হাত ধরে বসে আছে। রাত তখন নয়টা বাজে বাসার কলিংবেল বেজে উঠে।ফাহিম উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।বাপ্পি আর পায়েল দৌড়ে মিসেস ফিরোজার রুমে আসে। পায়েল এসেই রাইদাকে জড়িয়ে ধরে। মিনিট পাঁচেক পর আবার কলিংবেল বেজে উঠলে মিসেস ফিরোজা গিয়ে খুলে দেয়। অর্ক বাসায় প্রবেশ করে পিছন পিছন রুহিও আসে।

‘তোর কি হইছে বলতো? গ্রাম থেকে ফেরার পর দেখছি অন্য রকম।বল কি হয়েছে।’,অর্ক রাইদাকে সোজা বসিয়ে ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করে।

রাইদা কোনো জবাব দেয় না চুপ করে থাকে।

‘অর্ক ছাড় রাইকে ওরে সময় দে।নিশ্চয়ই বড় কিছু হয়েছে ওর সময় লাগবে বলতে।’,রুহি অর্ককে সরিয়ে বলে।

‘আঙ্কেল আন্টির হয়তো কিছু বলেছে সেইজন্য কাঁদছিল।’,ফাহিম জবাব দেয়।

‘তুই আমাকে চেনাস রাই কেমন? ও কখন কাঁদে কেনো কাঁদে আমার থেকে ভালো তুই জানস?কলেজ থেকে ওরে দেখতেছি কখনোই আঙ্কেল আন্টির কথায় কষ্ট পেলে কান্না তো দূর উল্টো জিদ করে থাকতো।এই মেয়েকে তারা এতো কষ্ট দিয়েছে এখন তাদের কথায় কষ্ট পেয়ে কান্না আসবে এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলছিস?’,ফাহিমের দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বলে অর্ক।

অর্কের কথা বলার ধরণ আর কন্ঠ শুনে সকলে বুঝে যায় অর্ক মারাত্মক রেগে গেছে।সবাই চুপ করে থাকে কেউ কোনো জবাব দেয় না।ফাহিম মুখ তুলে রাইদার দিকে তাকায়।রাইদার এক পাশে পায়েল অপর পাশে রুহি বসা। রাইদা পায়েলের কাঁধে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।

‘রাই যখন কিছু লুকাতে চায় কারো সাথে শেয়ার করতে ভয় পায় তখন এভাবে কাঁদে। লাস্ট ওরে আমি কাঁদতে দেখছি যেদিন ও সায়নের কথা বলছিলো সেইদিন। এই তোরে কি সায়ন কিছু বলেছে? নিশ্চয়ই এই ছেলের সাথে তোর ঝামেলা হইছে আবার।বল কি হইছে আজকে যদি না বলিস তোর খবর আছে।’,অর্ক রাইদার সামনে চেয়ার টেনে বসে জিজ্ঞেস করে।

‘অর্ক প্লিজ ওরে এখন এসব জিজ্ঞেস করিস না। তোর কাছে আমার অনুরোধ।’,রুহি অর্কের হাত ধরে বলে।

‘তুই আগে নিজের দিক সামলা।’,অর্ক রুহির হাত সরিয়ে বলে।

মিসেস ফিরোজার রুম থেকে থেকে বের হয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে টিভি ছেড়ে বসে থাকে অর্ক। মিসেস ফিরোজা রান্নাঘরে বিরিয়ানি বসিয়েছে। যখনই সকলের মন খারাপ থাকে মিসেস ফিরোজা বিরিয়ানি রান্না করে খাওয়ায়।

‘মন ভালো করতে এসে নিজেই চেতে গেছে এই পোলাডায় এখনো মনে করে ওর বয়স চৌদ্দ কি পনেরো।’,বাপ্পি আফসোসের স্বরে বলে।

‘বাপি দা একটু পানি আন জলদি।ফ্রিজ থেকে আনবি তোর ভাঙ্গারিতে উঠে আমি টার্য়াড।’,স্কার্ফ দিয়ে কপাল মুছে বলে পায়েল।

‘আমার বাইকে তোরে যদি আর নিছি জরিনা।আর কানলেও জীবনে নিমু না। কত সাহস আমার জানরে ভাঙ্গারি কইছিস।’,পায়েলের চুল টেনে বলে বাপ্পি।

‘বাপি দা সর মাম্মি হেল্প মি।’,পায়েল বাপ্পির হাতে থাপ্পড় দিয়ে চিল্লাতে থাকে।

‘আন্টিরে কল দিয়ে ডাক নেইলে তোর চিকন বাঁশের গলা গুলশান পর্যন্ত যাইবো না।’,পায়লের চুল ছেড়ে পিঠে কিল দিয়ে বলে বাপ্পি।

‘তোরে তো আমি দাঁড়া।’,পায়েল আশে পাশে তাকিয়ে বিছানা থেকে একটা বালিশ নিয়ে বাপ্পিকে মারতে দৌড় দেয়।

পুরো ড্রইং রুমে চক্কর কেটে বাপ্পি এসে রাইদার পিছনে লুকায়। পায়েল দরজায় দাঁড়িয়ে বালিশটা ছুঁড়ে মারে ফলাফল বালিশটা এসে রাইদার গায়ে লাগে। পায়েল জিভে কামড় দিয়ে হাত দিয়ে নিজের দুই কান চেপে সরি বলতে থাকে।সুযোগে বাপ্পি পায়েলের এই অবস্থায় ছবি তুলে নেয়।

সবাই সিরিয়াস ভঙ্গিতে রাইদার দিকে তাকায় হুট করেই রাইদা হেঁসে দেয়। রাইদার হাসি দেখে সকলে হেঁসে দেয়। বিছানা থেকে উঠে রাইদা গিয়ে অর্কের পাশে বসে।অর্ক রাইদাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে রাইদাও অর্ককে চিমটি দিতে শুরু করে এক সময় অর্কও হেঁসে দেয়। অর্ক রাইদাকে নিয়ে সবসময় অনেক চিন্তায় থাকে, রাইদা কখনো ভেঙে পড়লে অর্কই বকাঝকা করে রাইদাকে সবসময় আগলে রাখে।

টেবিলে বিরিয়ানি দিতেই সবাই দৌড়ে এসে নিজেদের প্লেট নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে দেয়। খাবারের টেবিলে মাংস নিয়ে পায়েল আর বাপ্পির মধ্যে একদফা মারামরি হয় শেষে ফাহিম আর রাইদা ওদের দুজনের মাংস কেঁড়ে খেয়ে ফেলে।

খাওয়া শেষ করে রাত সাড়ে বারোটার দিকে বাপ্পি,অর্ক,পায়েল,রুহি বিদায় নেয়। বাসার নিচে এসে বাপ্পি দেখতে পায় অর্ক নিজের বাইক নিয়ে এসেছে।বাপ্পির পায়েলকে বাসায় পৌঁছে দেয় আর অর্ক রুহিকে মেসে পৌঁছে দেয়।

রাইদা মিসেস ফিরোজার কোলে ঘুমায়।

..

গাড়ি গ্যারাজে রেখে সায়ন ফোন বের করে রাইদাকে আবারো কল দেয় কিন্তু নাম্বার বন্ধ। রাতের বাজে প্রায় একটা। এতক্ষণ গাড়ি নিয়ে রাস্তায় ঘুরেছে যদি রাইদার একবার দেখা পায় সেই আশায়।গাড়ি থেকে সিগারেট আর লাইটার নিয়ে গাড়ির পিছনেই বসে পরে।একটা সিগারেট ধরিয়ে ভাবতে থাকে কি করে রাইদার রাগ ভাঙাবে।

কিছুক্ষণ পর আরেকটা গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখতে পায় সায়ন।গাড়িটা গ্যারাজে আসলে সায়ন বুঝতে পারে তার বাবা ফিরেছে।গাড়ি থেকে সায়নের বাবা নেমে ড্রাইভারকে বিদায় করে দেয় সেখান থেকে।গায়ের কোট খুলে আসন গেঁড়ে ছেলের সামনে এসে বসে। নিচে রাখা প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে লাইটার দিয়ে আগুন ধরায় সায়নের বাবা আরমান শেখ।

‘কি ব্যপার মনে হচ্ছে কেউ ছ্যাঁকা দিয়ে তোকে ব্যাকা করে দিয়েছে?কিন্তু আমি যতদূর জানি তোর প্রেমিকা নেই আর তুই তো কোনো এক মেয়েকে খুঁজতেছিস অনেক বছর ধরে।’,ভ্রু উঁচিয়ে সায়নকে জিজ্ঞেস করে আরমান শেখ।

‘যাকে খুঁজছিলাম তাকে পেয়ে গেছি কিন্তু সে আমার হয়েও নাই।’,সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে বলে সায়ন।

‘তাহলে সে ছ্যাকা দিয়েছে?আহারে যারে এতো বছর খুঁজলি সেই শেষে তোরে ছ্যাঁকা দিয়ে ব্যাকা করলো।’,হাসতে হাসতে বলে আরমান শেখ।

‘এখন আমি যেটা বলবো সেটা শুনলে তোমার হার্ট অ্যা*টা*ক হতে পারে তাই নিজের হার্ট শক্ত করো তারপর আমার কথা শুনো।’

সায়নের কথার আগামাথা কিছুই আরমান শেখ খুঁজে পায় না।প্রশ্ন বোধক চাহনিতে সায়নের দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘সে এখন আমার বউ।গত শুক্রবার আমাদের বিয়ে হয়েছে কিন্তু সে বিয়ে অস্বীকার করে।আজকে রাজি হয়েছিলো আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলোও দেখা করতে তারপর তো সব এলেমেলো হয়ে গেলো এখন ওর ফোন বন্ধ।’

সায়নের এমন কথা শুনে আরমান শেখ চোখ বড়বড় করে তাকায় সায়নের দিকে।

‘মানে?এই ছেলে তুই কি সিগারেটের পাশাপাশি অন্য কিছু খেয়েছিস?’

আরমান শেখের কথায় সায়ন বুঝতে পারে তার বাবা বিশ্বাস করছে না তাই সে নিজের বাবাকে বিস্তারিত সব বলে সাথে বিয়ের ভিডিও দেখায়।

‘শেষে ছেলের বিয়েতে থাকতে পারলাম না! কত শখ ছিলো ছেলের বিয়েতে নাচবো আমার সেই শখ স্বপ্নই রয়ে গেলো।তোর মা এই বিষয়ে জানে কিছু?’,আরামান শেখ নিজের মাথায় হাত দিয়ে বলে।

‘কেউ জানে না।ভেবেছি বউ বাসায় এনে একেবারে জানাবো।বউকে আনার ব্যবস্থা করি আগে তখন সব হয়ে নো চিন্তা। দরকার হলে আবার বিয়ে করবো তখন নাচানাচি কইরো।’

‘তোর মা জানলে ন্যাকা কান্না করে পুরো এলাকা ভাসিয়ে দিবে।কীভাবে যে সামলাবো এসব।যেই অবস্থা দেখতেছি তাতে বাবা তুই নাতি নাতনি এনে সামনে দিয়ে বলবি বাবা এই তোমার নাতি নাতনি দেখো।’

আরমান শেখের এমন কথায় সায়ন হেঁসে দেয়।

‘হাসি থামা বউ মাকে আনার ব্যবস্থা কর জলদি। আর এভাবে কেউ বউয়ের সামনে মারে কাউকে? ও এমনিতেই তোর এই সকল কাজ কারবার পছন্দ করে না তারপরও ওর সামনেই এসব করিস।কতবার বলেছি মারবি পিছনে নিয়ে মারবি।ছেলেটা রেস্টুরেন্ট থেকে নামলে রাম ধোলাই দিতি এতে তোর রাগ ও কমতো আর বউও রাগ করতো না।নিজের রাগ কমাতে গিয়ে বউ মাকে রাগিয়ে দিলি।’

‘তাহলে কি করবো এখন?’

‘এখন গিয়ে রেস্ট কর কালকে কল দিয়ে মাফ চাবি আর বলবি আরেকটা সুযোগ দিতে।বউয়ের পিছন আঠার মতো লেগে থাকবি একসময় ঠিকই তোকে মেনে নিবে।মেয়েদের মন অনেক নরম হয় শুধু সেখানে জায়গা করে নিতে আঠার মতো লেগে থাকতে হয়।’

সায়ন আর তার বাবা কথা বলতে বলতে বাসায় উঠে।

কলিং বেল দিলে নিপা এসে দরজা খুলে গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে থাকে।

‘কিরে তোর আবার কি হলো?’,বাসায় ঢুকে জিজ্ঞেস করে আরমান শেখ।

‘খালাম্মা কানতাছে।’,নিপা জবাব দেয়।

সায়ন আর আরমান শেখ বুঝতে পারে নতুন কোনো সমস্যার আমদানি। রুমে ঢুকে দেখে মিসেস রিনা শব্দ করে কাঁদছে পাশেই সায়ন্তিকা বসে মায়ের কান্না থামতে ব্যস্ত।

‘তোমার আমার কি হলো এতো রাতে?কান্না করছো কেনো?’,আরমান শেখ জিজ্ঞেস করেন।

‘আর কি হবে সবই আমার কপাল।ছেলে বিয়ে করে আর আমি মা হয়ে সেটা জানি না।অন্য মানুষের কাছ থেকে আমার শুনতে হয় নিজের ছেলের বিয়ের খবর।’,কথাগুলো বলে মিসেস রিনা কান্নাকাটি শুরু করে।

‘তুমি এই খবর কোথায় পেলে?’,সায়ন জিজ্ঞেস করে।

‘আর কোথায় মনিরা মামিকে কল দিয়েছিলো সে ই সব বলেছে।’,সায়ন্তিকা জবাব দেয়।

‘বলেছিলাম মা কে না বলতে তাও বলে দিলো আগ বাড়িয়ে।’,বিরক্ত হয়ে বলে সায়ন।

‘দেখো কেমন ছেলে মা কে নিজের বিয়ের খবর জানাতে চায় না।আমি সব শুনেছি বিয়ে নিয়ে কত কাহিনী হয়েছে।এত কিছু হলো অথচ মা হয়ে আমি কিছু শুনলাম না জানলাম না।এ ঘরে আমার কোনো দাম নেই কেউ আমাকে ভালোবাসে না।’,নাক টেনে কথাগুলো বলে মিসেস রিনা।

‘আসলে মা সব কিছু আমি বুঝে উঠার আগেই হয়েছে ভেবেছিলাম তোমার বউ মাকে নিয়ে একেবারে বাসায় ফিরবো কিন্তু সে আমায় না বলেই ঢাকা ফিরে আসে।ওরে খুঁজতে গিয়েই তোমাকে আর এসব বলা হয়নি।’,সায়ন তার মায়ের পাশে বসে বলে।

‘তাই বলে এত বড় কথাটা লুকাবি আমার থেকে?’,মিসেস রিনা ছেলের কান মলে বলে।

‘ঠিক আছে আর কিছু লুকাবো না এবার তুমি কান্না থামাও।হাসো একটু তুমি না হাসলে ঘর অন্ধকার লাগে।’,মিসেস রিনার চোখ মুছে দিয়ে বলে সায়ন।

ছেলের কথা শুনে মিসেস রিনা হেঁসে দেয়।

‘বউ মাকে বাসায় কবে আনবি? তোর দ*জ্জা*ল শ্বাশুড়ি বিয়ের খবর জানে?’,মিসেস রিনা জিজ্ঞেস করে।

‘আনবো আনবো খুব জলদি আনবো আর শ্বাশুড়ি এ বিষয়ে জানে কিনা সেটা তো বলতে পারলাম না।’,সায়ন জবাব দেয়।

‘তোমরা মা ছেলে অন্য রুমে গিয়ে গল্প করো আমি ফ্রেশ হয়ে ঘুমাবো।’,আরমান শেখ বলেন।

‘টেবিলে খাবার দিতে বলছি তোমরা ফ্রেশ হয়ে আসো।’,কথাটা বলে মিসেস রিনা রুম থেকে বের হয়ে যায়।

‘যাক এ যাত্রায় বেঁচে গেলি বাপ।’,আরমান শেখ ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলে।

‘তার মানে বাবা তুমি বিয়ের কথা জানতে?’,সায়ন্তিকা জিজ্ঞেস করে।

‘আরে না একটু আগেই জানলাম।’,আরমান শেখ জবাব দেয়।

সায়ন রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমের দিকে যায়। সায়ন্তিকা ও নিজের রুমে চলে যায়।
মিসেস রিনা খাবার বেড়ে সকলকে খেতে ডাকে।রাতে খাওয়া শেষ করে যার যার রুমে চলে যায় সবাই।

সকালে ভার্সিটিতে এসে ডান্স প্র্যাক্টিস শুরু করে দেয় পুরো গ্রুপ। গতকালকের মতো ব্রেক নিয়ে চলে আসে ক্যান্টিনে চা খেতে।
রাইদা কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনছে পাশে বসা ফাহিম ফোনে গেম খেলায় ব্যস্ত।পায়েল বাপ্পির সাথে সিঙ্গাড়া নিয়ে ঝগড়া করছে আর অর্ক ফোন টিপছে। রুহির ডিউটি থাকায় এখনো আসেনি।

রাইদা টেবিলের উপর দৃষ্টি রেখে মনোযোগ দিয়ে গান শুনছিলো আর গত সন্ধ্যার কথা ভাবছিলো।তার এখন মনে হচ্ছে সায়নের সাথে অমন ব্যবহার করা উচিত হয়নি। মাসুম যেই ব্যবহার করেছিলো তাতে ওরে আরো কয়েকটা ঘুষি দেওয়া উচিত ছিলো। রাইদার নিজেও ইচ্ছে ছিলো লোক ভাড়া করে মাসুমকে পি*টা*নো*র সেই কাজ সায়ন যেহেতু করেছে এতে রাগ করার মতো কিছু নেই সেটা এখন সে বুঝতে পারছে। আগ বাড়িয়ে সায়নকে মেসেজ দিবে কিনা সেটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায় রাইদা।

হুট করে টেবিলের উপর কেউ অনেকগুলো চায়ের কাপ রাখে।মনোযোগে ব্যঘাত ঘটায় বিরক্ত হয়ে রাইদা ব্যক্তিটাকে দেখার জন্য চোখ তুলে তাকায়। চোখ তুলে সায়ন্তিকার হাসিমুখ দেখে রাইদা ভ্রু কুঁচকে ফেলে।

‘কি সমস্যা? ‘,কান থেকে ইয়ারফোন সরিয়ে রাইদা সায়ন্তিকাকে জিজ্ঞেস করে।

‘কোনো সমস্যা না আপু আসলে গতকালকে আমি না বুঝে যেটা করেছি সেটার সরি হিসেবে এই চা এনেছি আপনাদের জন্য। ‘,সায়ন্তিকা হাসিমুখে জবাব দেয়।

‘কিন্তু আমি তো সরির বদলে অন্য রকম গন্ধ পাচ্ছি। চা তে কিছু মিশিয়ে আননি তো?এতো ভালো হঠাৎ সাজতে গেলে এখন তো অনেক সন্দেহ হচ্ছে আমার।’,পায়েল চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলে।

‘ছি ছি আপু কি বলেন এসব।আমি তো শুধু সরি বলতে এগুলো এনেছি।’,সায়ন্তিকা হেঁসে বলে।

‘নাও তাহলে তুমি আগে টেস্ট করো।’,একটা চায়ের কাপ তুলে বাপ্পি সায়ন্তিকার সামনে ধরে।

সায়ন্তিকা কাপটা নিয়ে চা খায়।

‘তোমার সরি নিলাম তবে চা গুলো খেতে পারছি না এগুলো তুমি খেয়ে নাও আমাদের হয়ে।’,রাইদা সায়ন্তিকাকে বলে।

সায়ন্তিকা কিছু বলার আগেই রাইদা ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে যায়।বাকিরাও হাসতে হাসতে ক্যাম্টিন থেকে বের হয়।বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে সায়ন্তিকা দাঁড়িয়ে থাকে।সায়ন তাকে বুদ্ধি দিয়ে বলেছিলো সিনিয়রদের সাথে ঝগড়া না করে মিল দিতে।চা এনে খাওয়ানোর বুদ্ধি টা ও সায়ন দিয়েছিলো।সায়ন্তিকাও ভেবেছিলো রাইদার সাথে ভাব করবে তারপর সুযোগ বুঝে রাইদাকে প্যাঁচে ফেলবে।

‘সমস্যা নেই সিনিয়র আপনাকে আমি একদিন অবশ্যই প্যাঁচে ফেলে সব অপমানের শোধ নিবো।’,বিরবির করে সায়ন্তিকা বলে।

সায়ন্তিকা আর তার বান্ধবী চা গুলো নিজের ক্লাসমেটদের নিয়ে খাওয়ায়।

অডিটোরিয়ামে এসে প্র্যাক্টিস শুরু হয়ে যায়।রাইদা ফোন রেখে যেতে নিলে দেখে যামিনী কল দিয়েছে।

‘এক মিনিট আমি কলে কথা বলে আসছি।’,ফাহিমকে বলে অডিটোরিয়াম থেকে ফোন হাতে বের হয় রাইদা।

‘হ্যালো আসসালামু আলাইকুম আপু। কেমন আছো?’,রাইদা জিজ্ঞেস করে।

‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমি ভালো আছি। তুমি কোথায় আছো রাই?’,যামিনী জিজ্ঞেস করে।

‘আমি ভার্সিটিতে কেনো আপু?’

‘ব্যস্ত তুমি? না হলে দেখা করতাম।আসলে বিয়ের কার্ড দিতে বের হয়েছি তোমার বাসা তো চিনি না তাই এসে দিতে পারছি না।তুমি যদি বলতে কোথায় আছো আমি এসে কার্ডটা দিতাম।’

‘সমস্যা নেই আপু কার্ড লাগবে না। ‘

‘আরে কি বলো তোমাকে কার্ড ছাড়া দাওয়াত দিবো না।এক কাজ করো আমি ঠিকানা দিচ্ছি তুমি চলে আসো।’

‘আচ্ছা ঠিকানা বলো আমি আসছি।’

যামিনী একটা রেস্টুরেন্টের ঠিকানা দেয়। কল কেটে রাইদা অডিটোরিয়ামে চলে আসে।অডিটোরিয়ামে এসে দেখে রুহিও এসেছে। ঘন্টা খানেক প্র্যাক্টিস করে রাইদা ব্যাগ গোছাতে থাকে।

‘কিরে বের হবি এখন?’,অর্ক জিজ্ঞেস করে।

‘হ্যা যামিনী আপুর সাথে দেখা করতে যাবো।’,রাইদা জবাব দেয়।

‘লাঞ্চ করে যা।’,ফাহিম বলে।

‘আপুর সাথেই খেয়ে নিবো।তোরা লাঞ্চ করে আমাকে জানাস কই আছিস আমি চলে আসবো।’,রাইদা বলে।

‘ঠিক আছে সাবধানে যা।’,অর্ক রাইদাকে বলে।

যামিনীকে মেসেজ পাঠিয়ে রাইদা ভার্সিটি থেকে বের হয়ে যায়। রিকশা ডেকে উঠে বসে।যামিনীর দেওয়া রেস্টুরেন্টের ঠিকানায় পৌঁছে যায় প্রায় তিরিশ মিনিট পর।

রেস্টুরেন্টে ঢুকেই রাইদা এদিক ওদিক তাকিয়ে যামিনীকে খুঁজতে থাকে।হাত নাড়িয়ে যামিনী রাইদাকে নিজের কাছে ডাকে। রাইদা হাসিমুখে গিয়ে যামিনীর বিপরীতে বসে।

‘তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু নিয়ে চিন্তিত।কিছু হয়েছে?’,যামিনী রাইদাকে জিজ্ঞেস করে।

‘আরে না আপু সরাসরি ডান্স প্র্যাক্টিস করা এখানে আসলাম তাই হয়তো মুখটা শুঁকনো লাগছে।’,হেঁসে জবাব দেয় রাইদা।

ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে যামিনী রাইদার হাতে দেয়।

‘বিয়ে সামনের মাসে তুমি কিন্তু অবশ্যই আসবা সাথে পরিবারকেও আনবা।’,হাসিমুখে যামিনী বলে।

‘আমি অবশ্যই আসবো আপু..।’

‘সাথে ওর বর,ননদ,শ্বশুর, শ্বাশুড়ি ও আসবে চিন্তা করিস না।’,হুট করে রাইদার কথার মাঝে বলে উঠে সায়ন।

রাইদা পাশে তাকিয়ে দেখে সায়ন এসে তার পাশে বসেছে।

‘আপনি এখানে?’,অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে রাইদা।

‘মিস করছিলে তাই না?’,চোখ মেরে জিজ্ঞেস করে সায়ন।

‘এহেম এহেম আমি উঠলাম এখনো অনেক কার্ড বিলানো বাকি আমার।রাই চলি দেখা হবে শীগ্রই।’,কাশি দিয়ে কথাগুলো বলে যামিনী বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।

যামিনী চলে গেলে রাইদাও উঠতে নেয় তখনই সায়ন নিজের ডান হাত দিয়ে রাইদার বাম হাত চেপে ধরে।

‘লক্ষি মেয়ের মতো বসো একদম পালানের চেষ্টা করবা না।’,সায়ন গম্ভীর গলায় রাইদাকে বলে।

রাইদা বুঝতে পারে দুই বন্ধু মিলে প্লান করে তাকে এখানে এনেছে।সেও চুপ করে বসে থাকে কিন্তু সায়ন তার হাত ধরেই রেখেছে।
ওয়েটারকে ডেকে সায়ন খাবার অর্ডার দেয়।

‘গতকালকের জন্য আম সরি রি।’,অনেকক্ষণ পর গলার স্বর নরম করে বলে সায়ন।

‘ইট’স ওকে আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড।’,সায়নের দিকে তাকিয়ে বলে রাইদা।

রাইদা এতো সহজে মাফ করেছে বিষয়টা বুঝতেই সায়নের মুখে হাসি ফুটে উঠে। রাইদার ধরে রাখা হাতটা টেনে নিঃশব্দে চুমু খায়। সায়নের এমন কাজে রাইদা আশে পাশে তাকিয়ে দেখতে থাকে কেউ এটা দেখেছে কিনা। রাইদার চেহারার অবস্থা দেখে সায়ন হাসতে থাকে।


(চলবে..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here