সেদিন দেখা হয়েছিলো পর্ব -২২

পর্বঃ২২
গল্পঃ #সেদিন_দেখা_হয়েছিলো
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
(গল্প কপি পোস্ট করা সম্পূর্ণ নিষেধ।)

প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে সায়ন গাড়ি ড্রাইভ করছে পাশের সিটেই রাইদা বসে আছে।পাশে বসা রাইদার মাথায় কি চলছে সায়ন এখনো বুঝে উঠতে পারছে না।রেস্টুরেন্টে পুরোটা সময় চুপচাপ খাওয়া শেষ করেছে রাইদা মাঝে মাঝে সায়নের কিছু কথার জবাব দিয়েছে।
গাড়ির গ্লাস দিয়ে রাইদা রাস্তার মানুষজন দেখছে আর ভাবছে। রেস্টুরেন্টে সায়নকে কথাগুলো বলতে পারেনি ভয়ে যদি সায়ন চিল্লাপাল্লা করে ভেবেছিলো গাড়িতে বলবে কিন্তু এখন আরো বেশি ভয় হচ্ছে বলতে।

‘মাকে মনিরা মামি বিয়ের কথা বলে দিয়েছে তো মা চাচ্ছে তোমাকে বাসায় নিয়ে যাই।’,নিরবতা ভেঙে সায়ন বলে।

সায়নের কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে রাইদা সায়নের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকায়।

‘আরে একেবারে এখন নিতে বলে নায় তো।তোমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে এরপর বিয়ে পড়িয়ে বউ করে নিবে।’,সায়ন আবারো বলে উঠে।

‘বিয়ে?’,রাইদা বলে উঠে।

‘মানে আমাদের বিয়েতে তো রেজিস্ট্রেশন হয়নি সেটার কথাই বলছিলাম।’

সায়নের উল্টাপাল্টা কথা কিছুই রাইদার মাথায় ঢুকছে না সে শুধু ভাবছে নিজের কথাগুলো কীভাবে সায়নকে বলবে। একটু পরপর সায়নের হাসিমাখা মুখের দিকে তাকাচ্ছে আর চোখ সরিয়ে নিচ্ছে।

‘এখনো হ্যা না কিছু বললাম না লোকটা খুশি কত।’,বিরবির করে রাইদা বলে।

‘বিরবির করে কি বলছো?’,সায়ন জিজ্ঞেস করে।

‘কিছু না এমনি বিরবির করছিলাম।’,বিরক্ত হয়ে রাইদা জবাব দেয়।

হুট করে সায়ন গাড়িটা থামায়।

‘তুমি একটু বসো আমি পাঁচ মিনিটে আসতেছে যাবা না কিন্তু।’,কথাগুলো বলে গাড়ির ডোর লক করে সায়ন বের হয়।

রাইদা আশেপাশে তাকিয়ে দেখে গাড়িটা মেইন রাস্তার একপাশে সায়ন পার্ক করেছে। রাস্তা পাড় হয়ে সায়ন রাস্তার অপর পাশে যায় যেখানে অনেকগুলো ফুলের দোকান রয়েছে।বাকিটা রাইদার দেখতে হয় না বুঝে যায় সায়ন ফুল কিনতে গিয়েছে। ফুলের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সায়ন বারবার নিজের গাড়ির দিকে তাকাচ্ছে যদিও বাহির থেকে রাইদাকে দেখতে পারছে না তাও তার শান্তি লাগছে।

রাইদার ফোন বেজে উঠলে রাইদা কল রিসিভ করার জন্য ফোন বের করে ব্যাগ থেকে।ফোনের স্কিনে আরাফের নাম দেখে কল রিসিভ করবে না ভেবে নেয়।কলটা বাজতে বাজতে কেটে যায় এরপর আরাফ আবারো কল দেয়। নিজের সাথে যুদ্ধ করে রাইদা কলটা রিসিভ করে কানে দেয়।

‘হ্যালো রাই? কি হয়েছে তুমি ঠিক আছো?কতদিন হয়ে গেলো আমার মেসেজের রিপ্লাই করো না কল রিসিভ করো না। রাই তুমি কি শুনতে পাচ্ছো? হ্যালো রাই।’,আরাফ একটার পর একটা কথা বলতে থাকে।

রাইদার কাছে মনে হয় তার গলা কেউ চেপে ধরে আছে যার কারণে সে কথা বলতে পারছে না।

‘রাই! কি হলো তোমার?’,আরাফ আবারো বলে।

‘আমি ঠিক আছি আরাফ চিন্তা করবেন না।’,জড়তা কাটিয়ে রাইদা বলে।

‘তুমি কি ঢাকা ফিরেছো? আমার আসলে তোমার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিলো।আমি চাই দেখা করেই কথাগুলো বলতে।’,আরাফ কথাগুলো বলে রাইদার উত্তরের অপেক্ষা করে।

‘দেখুন আমি অনেক ব্যস্ত সময় বের করতে পারবো না।আর আমার মনে হয় না আপনার সাথে আমার কোনো কথা আছে।’, রুড গলায় বলে রাইদা।

‘এভাবে কেনো বলছো রাই?তোমার কি মন মেজাজ খারাপ? তাহলে আমি পরে কল দিবো সমস্যা নেই।আমাদের কথা বলা উচিত।’,আরাফ শান্ত গলায় বলে।

‘বলেছি না আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই আর কখনো আমায় কল দিবেন না।’,চিল্লানি দিয়ে কথাগুলো বলে কল কেটে দেয় রাইদা।

আরাফ প্রচন্ড অবাক হয়ে যায় রাইদার এমন ব্যবহারে।কান থেকে ফোন নামিয়ে রাইদার নাম্বারের দিকে তাকিয়ে আবারো কল দেয়।
রাগে জিদে রাইদার ইচ্ছে করছে নিজের মাথা নিজের ফাটাতে।না সে এদিক যেতে পারছে না ওদিক যেতে পারছে। নিজের চুল গুলো নিজেই টানতে থাকে। আবারো ফোন বেজে উঠলে কল কেটে দেয় রাইদা।

গাড়ির ডোর খোলার শব্দ হতেই মাথা তুলে সায়নের দিকে তাকায় রাইদা।

‘কি হয়েছে রি শরীর খারাপ লাগছে?’,রাইদার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে জিজ্ঞেস করে সায়ন।

‘না না ঠিক আছি আমি আসলে বন্ধ গাড়িতে আমার সমস্যা হয়।’,রাইদা জবাব দেয়।

এরমধ্যে রাইদার ফোন বেজে উঠে।

‘কেউ কল দিয়েছে দেখো গুরুত্বপূর্ণ কল হতে পারে।’,সায়ন রাইদাকে তার ফোনের দিকে ইশারা করে বলে।

‘না গুরুত্বপূর্ণ কিছু না কাস্টমার কেয়ার থেকে কল দিচ্ছে।আপনি কোথায় গিয়েছিলেন বললেন না যে।’,রাইদা জোর পূর্বক হেঁসে বলে।

‘তোমার জন্য এটা আনতে গিয়েছিলাম।মনে আছে তুমি একবার বলেছিলে যেই ছেলে তোমায় সব রঙের গোলাপ দিবে তাকে চুমু খাবা।’,রাইদার দিকে একগুচ্ছ রঙবেরঙের গোলাপ বাড়িয়ে দিয়ে বলে সায়ন।

সায়নের কথা শুনে রাইদা ভ্যাবাচ্যাকা খায়।

‘অসম্ভব আমি এমন কিছু বলতেই পারি না। আপনি বললেই হলো নাকি।’,রাইদ চোখ বড়বড় করে বলে।

সায়ন ঠোঁট কামড়ে হাসে।

‘চুমুর কথাটা তো আমি যুক্ত করেছি তুমি বলেছিলে তোমার এমন প্রেমিক চাই যে রোজ তোমায় রঙবেরঙের গোলাপ এনে দিবে। আমি তোমায় শুধু লাল গোলাপ দিতে চেয়েছিলাম তখন এ কথা বলেছিলে এরপর সারা গ্রাম গোলাপ চুরি করার মিশনে নেমেছিলাম।’,রাইদার দিকে ঘুরে বলে সায়ন।

‘এরপর আমাদের পিছনের বাড়িতে গোলাপ না পেয়ে বেচারাদের সব গাঁদাফুলের গাছগুলো নষ্ট করেছিলেন জিদে।’,হাসতে হাসতে রাইদা বলে।

‘তুমি কি করে জানলে?’,সায়ন অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।

‘কারণ আপনাকে আমার ফুল গাছের আশেপাশেও দেখেছিলাম সেখানে গাছে একটা ছোট গোলাপ ছিলো সেটা আপনি চুরি করেছিলেন আবার আমার গাঁদাফুল গুলো ছিঁড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে গিয়েছিলেন কিন্তু গাছ গুলো নষ্ট করেননি।’,রাইদা কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে।

সায়ন গালে হাত দিয়ে রাইদার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে আর মুগ্ধ হয়ে রাইদার হাসি দেখে।

‘গাঁদাফুল আমার বিরক্ত লাগে তাই আমিও চাচ্ছিলাম গ্রামের সব গাঁদাফুল নষ্ট করবো। তোমার গাছ নষ্ট করতে গিয়ে মনে হয়েছিলো যদি কান্না করো তাই শুধু ফুল নষ্ট করি।এখন এগুলো নাও।’,ফুলগুলো আবারো রাইদার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে সায়ন।

‘আমার কিন্তু গোলাপ মোটেও পছন্দ না।গাঁদাফুল অনেক পছন্দ সেই জন্যই তখন বাগানে অনেক রঙের গাঁদা ফুলের গাছ ছিলো আর সব লাগিয়েছিলাম আমি।’,ফুলগুলো হাতে নিয়ে বলে রাইদা।

‘তারমানে আমাকে মিথ্যা বলেছিলে?’,সায়ন আবারো প্রশ্ন করে।

‘তখন আপনার চেহারা ছিলো পুরো বোকা বোকা আপনাকে দেখেই মনে হয়েছিলো যা বলবো বিশ্বাস করবেন আর করতে দৌড় দিবেন, আপনিও তাই করলেন।’,কথাগুলো বলে জোরে জোরে হাসতে থাকে রাইদা।

রাইদার হাসি দেখে সায়নও হেঁসে দেয়। সায়ন নিজের অতীত ঘেঁটে বুঝতে পারে আসলেই সে তখন রাইদাকে পটাতে বোকা বোকা কাজ করতো। ছোট বেলা থেকে গম্ভীর থাকা ছেলেটা রাইদার মতো চঞ্চল মেয়েটার ভালোবাসা পেতে কত কিছু করেছে। সায়ন রাইদর হাসিমুখ দেখে খুশি হয়।

‘তুমি অনেক দুষ্টু রি।তখনো দুষ্টু ছিলে তখনো দুষ্টু আছো।উপর থেকে না বোঝার ভান করে থকতে কিন্তু ভেতরে ভেতরে সবই বুঝতে।’,সায়ন গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলে।

‘আপনি যে সন্ধ্যার পরে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন সেটাও দেখেছি আবার বিনা পয়সায় পোলাপান দিয়ে আমাদের বাড়ির কাজ করিয়ে দিতেন সে গুলোও জানি।’,হাসি থামিয়ে বলে রাইদা।

‘তোমাদের বাড়ির সামনে সেই সময় এতো ছেলেরা ঘুরতো সবগুলোকে তাড়াতে কি যে যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে।কিছু অবশ্য বশে চলে এসেছিলো আমাকে ভাই আর তোমাকে ভাবী ডাকতে শুরু করেছিলো ।কয়েকটাকে মেরে ভাগিয়েছি আর কয়েকটাকে ভয় দেখিয়ে ভাগিয়েছি।’গাড়ি চালানো অবস্থায় রাইদার দিকে তাকিয়ে জবাব দেয় সায়ন।

সায়নের কথাগুলো শুনে রাইদার হাসিমুখ মিলিয়ে যায়।ফোনে মেসেজ আসার শব্দ হলে রাইদা মেসেজ ওপেন করে।

‘বুঝতে পেরেছি রাই তুমি কোনো কারনে রেগে আছো।জানি না আমার উপর রাগ নাকি অন্য কারোর উপর তারপরও তুমি যেহেতু চাইছো না তোমায় বিরক্ত করি তাই আমি আর তোমায় কল দিবো না।তোমার যদি নিজ থেকে মনে হয় কল দিও। আম অলওয়েজ দেয়ার ফর ইউ রাই।’

আরাফের মেসেজটা পড়ে রাইদার মন খারাপ হয়ে যায়।সায়ন লক্ষ করে রাইদা ফোনের দিকে তাকিয়ে মুখ ভাড় করে রেখেছে।

‘তোমায় কোথায় ড্রপ করবো নাকি একেবারে শ্বাশুড়ির সাথে দেখা করে ফিরবা?’,সায়ন জিজ্ঞেস করে।

‘সায়ন আমি আপনাকে কিছু বলতে চাচ্ছিলাম।’

‘আমি তো আছিই তোমার কথা শোনার জন্য।’

‘আপনি আর আমি দুই মেরুর মানুষ। আমাদের মধ্যে কোনো মিল নেই তা ছাড়া আমি আপনার পাশে বেশিক্ষণ নরমাল ভাবে বসে থাকতে পারি না খালি মনে হয় হুট করে আপনি রেগে যাবেন তারপর কিছু একটা করে ফেলবেন।গত কালকের রেস্টুরেন্টের ঘটনার পর ভয় বেড়ে গেছে আমার মধ্যে।’

‘জানো রি তুমি যখন কোনো ভণিতা না করে সরাসরি মুখের উপর সব বলে দাও বিষয়টা আমার ভালো লাগে।তার মানে আমাদের মধ্যে একটাই সমস্যা আমার কন্ট্রোল না করতে পারা রাগ। এই রাগ কন্ট্রোল করলে তো আর কোনো সমস্যা নেই?’

নিজের কথার জালে ফেঁসে গেছে বিষয়টা বুঝে রাইদা নিজেকে বকতে শুরু করে।

‘কি হলো জবাব দিচ্ছো না কেনো?’,সায়ন আবারো জিজ্ঞেস করে।

‘আমি আপনাকে ভালোবাসি না একদম আর ভালোবাসা ছাড়া দু’জন মানুষ কখনো একত্রে থাকতে পারে না।’

‘কে বলেছে এ কথা? আমি তো তোমায় এতো ভালোবাসি যেই ভালোবাসা কখনো শেষ হবে না।আমার একার ভালোবাসায় সংসার চলে যাবে সমস্যা নেই।’

‘গাড়ি থামান নামবো এখানে।’

সায়ন গাড়ি থামায় রাইদা ডোর খুলে বের হয় এরপর ঘুরে সায়নের উইন্ডো তে নক করে।গ্লাস নামিয়ে সায়ন তাকায়।

‘আমি কথা দিচ্ছি যদি কোনোদিন এক মূহুর্তের জন্য আমার মনে হয় ইমতিয়াজ সায়নকে ছাড়া আমার জীবন চলবে না সেদিন আপনার কাছে আমি নিজে এসে ধরা দিবো। ততদিন আপনি আমাকে জোর করতে পারবেন না।’

‘লাগেজ ঘুছিয়ে রাখো দিনটা খুব জলদি আসবে।’

সায়নের কথা শুনে মুখ ভেংচি দেয় রাইদা। একটা রিকশা ডেকে রাইদা উঠে বসে।রিকশা চলতে শুরু করলে সায়নও গাড়িতে করে রাইদার রিকশা ফলো করতে থাকে। বিষয়টা রাইদা দেখে বিরক্ত হয়। ফোন বের করে সায়নকে কল দেয়।

‘কি ব্যপার বউয়ের এতো জলদি আমায় মনে পড়লো? এখন কি শ্বশুর বাড়ি ফিরতে চাচ্ছো?’,কল রিসিভ করে ঠাট্টার ছলে কথাগুলো বলে সায়ন।

‘রিকশা ফলো করা বন্ধ করেন আর নিজের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালান।’

‘কেনো এই রাস্তা তোমার নাকি তোমার বরের যেই কারণে এই রাস্তায় আমি গাড়ি চালাতে পারবো না?’

‘আমি রিকশা থেকে নামলে আপনার গাড়ি আস্ত থাকবে না।’

কল কেটে সায়ন রাইদার রিকশার পাশাপাশি গাড়ি চালাতে শুরু করে।উইন্ডোর গ্লাস নামিয়ে রাইদার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে শুরু করে।

‘আমাকেই আট বছর আগে ভেঙে দিয়েছো গাড়ি আর এমন কি জিনিস।বউ যেহেতু অর্ডার করেছি আমি তাহলে অন্য রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছি।সাবধানে বাসায় যেও বউ।এই মামা আমার বউকে সাবধানে নিয়ে যাবা,দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বউ আমার। বউ বাসায় গিয়ে কল দিও কিন্তু। আমি চললাম আর বউ ভালোবাসি অনেক তোমায়।’,চিল্লানি দিয়ে কথাগুলো বলে সায়ন।

রিকশাওয়ালা সহ রাস্তার মানুষজন হা করে কথাগুলো গিলে।রাইদা লজ্জায় হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে।সায়ন রাইদার দিকে ফ্লায়িং কিস ছুঁড়ে দিয়ে গাড়ি দ্রুত টেনে চলে যায়। সায়ন চলে গেলে রাইদা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

..

রাইদা যখন ফাহিমের বাসায় ফিরে তখন শেষ বিকেল । কলিং বেল দিলে অর্ক এসে দরজা খুলে দেয়। রাইদার হাতে রঙ বেরঙের গোলাপ দেখে অর্ক ভ্রু কুঁচকে তাকায়।

ফাহিমের রুমে গিয়ে রাইদা দেখে সবাই কিছু নিয়ে কথা বলায় ব্যস্ত।

‘কি নিয়ে আলাপ করতেছিলি আমাকেও বল একটু।’,বিছানায় বসে রাইদা বলে।

‘তোর বিয়ে নিয়ে আলাপ করতাছিলাম।’,বাপ্পি বলে উঠে।

বাপ্পির মুখে এমন কথা শুনে রাইদা চমকে উঠে।

‘কি বললি?কিসের বিয়ে? ‘,অবাক হয়ে রাইদা জিজ্ঞেস করে।

‘পায়েল বললো দারুণ একটা পাত্র খুঁজে পাইছে যদি তুই রাজি থাকিস তাহলে তোর জন্য দেখবে।’,বাপ্পি জবাব দেয়।

‘রাই তো পাত্র পছন্দ করে রেখেছে তাই না?’,পায়েল ফোঁড়ন কেটে বলে।

বাপ্পি আর পায়েলের এমন কথা শুনে রাইদা বুঝে নেয় ওরা মজা করছে।

‘কিরে তুই পাত্র পছন্দ করেছিস আর আমরা জানি না?’,রুহি মন খারাপ করে বলে।

‘আমি নিজেই মাত্র জানলাম আমার যে পছন্দের পাত্র আছে।পায়েল তুই বল পাত্রটা কে?’,রাইদা পায়েলকে জিজ্ঞেস করে।

‘কে আবার আমাদের আরাফ ভাই যাকে তুই পছন্দ করিস।’,পায়েল জবাব দেয়।

‘আসলেই রাই ফেরার পরে একবারো আরাফ ভাইয়ের বিষয়ে কিছু বললি না কিছু হয়েছে?’,রুহি জিজ্ঞেস করে।

রাইদা চুপ হয়ে যায় কি জবাব দেয় ভেবে পায় না। অর্ক রাইদাকে পর্যবেক্ষণ করে বুঝে পারে রাইদা বড় কোনো ঘটনা লুকানোর চেষ্টা করছে।

‘তোকে এতো গোলাপ কে দিলো তাও রঙ বেরঙের? আমার জানা মতে তুই গোলাপ অপছন্দ করিস।’,হুট করে রাইদাকে প্রশ্ন করে অর্ক।

‘এগুলো তো যামিনী আপু দিয়েছে।পায়েল তুই রাই গোলাপগুলো।’,রাইদা ভেবে বলে।

পায়েল আর রুহি গোলাপ গুলো ভাগ করে নেয়। অর্কের মনে এরপরেও খচখচ করতে থাকে। যেই রাইকে সে চিনে সেই রাইকে সে দেখতে পাচ্ছে না।

মিসেস ফিরোজা আজকে রাইদার পছন্দের সকল রান্না করেছে।রুহি আর বাপ্পি মিসেস ফিরোজাকে রান্নায় সাহায্য করে। বাকিরা রুমে আড্ডায় ব্যস্ত থাকে।
রাত নয়টা বাজলে সবাই একত্রে খেতে বসে।মিসেস ফিরোজা একে একে সকলকে খাবার বেড়ে দেয়।

‘বাসায় ফিরবি সেটা কি আন্টি জানে?’,খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে অর্ক।

‘না জানাইনি একেবারে গিয়ে সারপ্রাইজ দিবো।’,রাইদা জবাব দেয়।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাইদা মিসেস ফিরোজার সাথে বসে কিছুক্ষণ গল্প করে।উবার ডেকে অর্ক রাইদার লাগেজ নামিয়ে দেয়। সকলের থেকে বিদায় নিয়ে রাইদা নিজের বাসায় রওনা দেয় যদিও অর্ক সাথে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু রাইদা না করে দেয়। বাকিরাও নিজেদের নীড়ে ফিরে যায়।

ফ্ল্যাটের কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে দেয় রাইদার মা রওশন আরা।মেয়েকে দেখে তিনি৷ হাসিমুখে জড়িয়ে ধরতে নিলে রাইদা তাকে পাশ কাটিয়ে লাগেজ টেনে নিজের রুমের দিকে যায়। দরজা লাগিয়ে রওশন আরা রান্নাঘরে গিয়ে লেবুর সরবত বানিয়ে মেয়ের রুমে যায়। রাইদা রুমে ঢুকে লাগেজটা ধপ করে বিছানায় ফেলে হাত পা ছড়িয়ে নিজেও শুয়ে পরে।

‘তোর জন্য লেবুর সরবত এনেছি নে খা আর রাতের কী খাবি বল রান্না করে দিচ্ছি।’,রাইদার সামনে সরবতের গ্লাসটা ধরে বলে রওশন আরা।

‘আমি খেয়ে এসেছি রাতে কিছু খাবো না।’,ফোনের দিকে তাকিয়ে রাইদা জবাব দেয়।

‘কতদিন পর বাসায় ফিরলি প্রায় মাস খানেক হয়ে গেলো।কি কপাল আমার মেয়ে জন্ম দিয়েও সেই মেয়েকে ঘরে পাই না আর মানুষের ছেলেরাও আজকাল ঘরে মায়ের পাশে থাকে।পাশের ফ্ল্যাটের ছেলেটা ওর মায়ের কথা ছাড়া এক পা ও নড়ে না।’,সরবতের গ্লাসটা রাইদার পড়ার টেবিলে রেখে বিলাপ করতে থাকে রওশন আরা।

‘পাশের ফ্ল্যাটের আন্টিও ছোট বেলা থেকে তার ছেলেকে যথেষ্ট সময় দিচ্ছে এবং মানসিক অত্যাচার করেনি।এবার তো এক মাস পর ফিরেছি কিন্তু ভাবছি এখন যদি বের হই এক বছরের আগে নিজের মুখ এ বাসার লোকদের দেখাবো না।’,হাই তুলে রাইদা জবাব দেয়।

রাইদার কথা শুনে রওশন আরা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে।

‘তুই কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস? মনে হচ্ছে তুই বাসায় না থাকলে আমার চলবে না? বহুত পা লম্বা হইছে তোর দাঁড়া তোর পা ভাঙার ব্যবস্থা করতেছি।’,রাইদার সামনে গিয়ে আঙুল নাড়িয়ে বলে রওশন আরা।

‘এই তো পেয়াঁজের মতো খোলস ছেড়ে এখন নিজের আসল রুপে এসেছেন এতেই তো আপনাকে মানায় মিসেস রওশন। রুম থেকে বের হন আমি ঘুমাবো এখন।’,কথাগুলো বলে ঘুমের ভান ধরে শুয়ে থাকে রাইদা।

রওশন আরা কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করে নিজের রুমে চলে যায়। রাইদা উঠে রুমের দরজা লাগায় সে জানে এখন তার বাবাকে কল দিয়ে দুনিয়ার বিচার দিবে তারপর তার বাবা এসে এক বস্তা জ্ঞান ঝেরে যাবে।

ফোন হাতে নিয়ে রাইদা অর্ককে কল দেয়। অর্ক বাইক চালাচ্ছিলো তাই কল রিসিভ করে না। অর্ক কল রিসিভ না করায় রাইদা আবারো কল দিতে নেয় অর্ককে তখনি সায়নের কল আসে।
কল রিসিভ করে রাইদা ফোন কানে দিয়ে চুপ করে থাকে। রাইদার সাড়াশব্দ না পেয়ে সায়নও চুপ করে থাকে।

মিনিট দুয়েক পর বিরক্ত হয়ে রাইদা বলে,’কি সমস্যা কল দিয়ে কথা না বললে কল দিয়েছেন কেনো?’

‘মনে হচ্ছে আমার বউয়ের মন মেজাজ খারাপ অনেক।আমি ভাবতাম আমি রাগ করবো আর বউ রাগ ভাঙাবে এখন তো দেখছি উল্টা।সারাক্ষণ আমার বউ রেগে গাল ফুলিয়ে রাখে।’,হাসতে হাসতে সায়ন বলে।

‘একদম ফালতু কথা বলবেন না তাহলে এক্ষুনি এসে আপনাকে মেরে হাত পা ভেঙে হাসপাতালে পাঠাবো।’,সায়নকে শাসিয়ে বলে রাইদা।

‘আমি ঠিকানা মেসেজে লিখে দিচ্ছি তুমি জলদি আসো।’

‘ফালতু লোক।’

‘একটা জিনিস খেয়াল করছো রি? তোমার ছোট বেলার চঞ্চলতা আমার মধ্যে ভর করছে আস্তে আস্তে আর আমার গম্ভীর ভাব তোমার মধ্যে ভর করছে।’

‘মোটেও না।আমি আপনার মতো অতো পাষাণ মানুষ না।’

‘আমি পাষাণ দেখেই তোমার পিছনে ঘুরঘুর করি আর তুমি পাষাণ নও তাই আমাকে বিয়ের পরও পাত্তা দাও না।’

রাইদা সায়নের কথার পিঠে কি জবাব দেবে খুঁজে পায় না। সায়ন একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে যেটা ফোনের অপর পাশ থেকে রাইদা স্পষ্ট শুনতে পায়।

‘রি আমি জানি তুমি আমায় মানার চেষ্টা ও করছো না শুধু অভিনয় করছো যাতে আমি বুঝি তুমি চেষ্টা করছো। আমি কিন্তু জোর করে অধিকার আদায় করতে চাই না শুধু চাই তুমি একটু পাশে থাকো।এত বছরে এটা বুঝেছি জোর করে কখনো কারো থেকে ভালোবাসা আদায় সম্ভব না, জোর করলে শুধু ঘৃণাই আসবে।আমি নিজের সব ইগো ঠেলে তোমার জন্য নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করছি,তোমার থেকে আমি আশা করছি এমন কোনো ব্যবহার পাবো না যা আমায় কঠিন হতে বাধ্য করবে। ‘,ঠান্ডা স্বরে সায়ন বলে।

রাইদা ঠিক সায়নের এই ঠান্ডা স্বরে বলা কথা গুলোই ভয় পায়।

‘আপনি আমায় ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে হু*ম*কি দিলেন?’

‘বউকে হু*ম*কি দিতে হয় না রি এগুলো সব অধিকার থেকেই বললাম।তুমি তো আমাকে চেনোই নতুন করে বলার কিছু নেই।’

‘আপনাকেও আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে এসেছি।আপনি যদি মনে করেন আপনি ত্যা*ড়া তাহলে আমি মহা ত্যা*ড়া।’

রাইদার কথা শুনে শব্দ করে সায়ন হেঁসে দেয়।

‘আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি কেমন আছে? মা তো অলরেডি তার বিয়াইনের সাথে কথা বলার জন্য নাম্বার চাচ্ছে।’

‘ফোন রাখছি ঘুমাবো এখন আমি।’,রাইদা বিরক্ত হয়ে বলে।

‘খবরদার ফোন বন্ধ করবা না আমি ফ্রেশ হয়ে আবার কল দিবো আর শ্বাশুড়ির নাম্বারটা আমাকে দিও।’

‘শ্বাশুড়ি আপনার নাম্বারও আপনি চেয়ে নেন, কল রাখলাম।’,কথাটা বলে কল কেটে দেয় রাইদা।

কল কাটার পর সায়নের নাম্বার থেকে মেসেজ আসে।

‘তার মানে বলছো শ্বাশুড়িটা আমার আর তুমিও বিয়ে মেনে নিয়েছো?’

মেসেজ পড়ে রাইদা চরম বিরক্ত হয়।রাইদাকে রাগিয়ে সায়ন হাসতে থাকে।

ফোন বিছানার উপর ফেলে রাইদা চলে যায় চেঞ্জ করতে। জামা পাল্টে বিছানায় এসে ফোন হাতে সায়নের পাঠানো মেসেজ পড়ছিলো রাইদা তখন দরজায় নক করার শব্দ হলে উঠে গিয়ে দরজা খুলে। দরজা খুলেই দেখে তার বাবা মান্নান রাফায়েদ দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। রুমে ঢুকেই মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন মান্নান রাফায়েদ।

‘কি রে মা কেমন আছো?’,মান্নান রাফায়েদ জিজ্ঞেস করেন।

‘দেখতেই পাচ্ছো বেঁচে আছি।’,মান্নান রাফায়েদের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বলে রাইদা।

‘ছোট মেয়েটা এতো বড় হয়ে গেছে এখন বাবাকে কলও দেয় না।’

‘আর সেই মেয়েটা যখন ছোট ছিলো তার বাবা তাকে সময় দেয়নি। তাদের নিজেদের করা ভুলের মাশুল গুনতে হয়েছে সেই ছোট মেয়েকে।’

রাইদার মুখে এমন কথা শুনে মান্নান রাফায়েদের হাসিমুখ মিলিয়ে যায়।

‘তুমি দেখছি এখন মুখে মুখে তর্ক করো শুনলাম তোমার মা কে উল্টা পাল্টা বলেছো।তোমার মা রুমে কাঁদছে আর তুমি একবারো গিয়ে মাফ চাইলে না।’,গম্ভীর মুখে কথাগুলো বলে মান্নান রাফায়েদ।

‘আপনারা কি চাইছেন সেটা বলেন স্পষ্ট করে।এভাবে আমাকে মানসিক যন্ত্রণা দিবেন না।’

‘আমরা এতো বছর যা করেছি তোমার ভালোর জন্যই করেছি।’

‘হ্যা সেই ভালোর ফলই এখন পাচ্ছেন।আপনারা নাকি আমার জন্য পাত্র দেখছেন?’

‘তোমাকে এই খবর কে বললো?’,চমকে জিজ্ঞেস করে মান্নান রাফায়েদ।

পাশের রুম থেকে রওশন আরা মান্নান রাফায়েদকে ডাক দেয়।

‘তার মানে খবরটা সত্যি।আপনাকে ডাকছে গিয়ে শুনেন কি বলে,আমরা না হয় এ বিষয়ে পরে আলোচনা করবো।’

‘রাইদা জেদ ছাড়ো যা হয়েছিলো ভুলে যাও।তোমার মা এবং আমি ভুল বুঝতে পেরেছি আমাদের এভাবে এড়িয়ে যেও না।’,রাইদার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে মান্নান রাফায়েদ।

রাইদা কোনো জবাব না দিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরে।মান্নান রাফায়েল নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুখ ভাড় করে রুম থেকে চলে যায়। রাইদা শুয়ে চিন্তা করতে থাকে এভাবে আর কতদিন চলবে?


(চলবে..)

(জ্বর সহ প্রচন্ড চোখ ব্যথা তারপরও আজকে গল্প লিখে দিলাম হয়তো আগামীকালকে দিতে পারবো না।আস্তে আস্তে অসুস্থতা বাড়ছে সবাই দোয়া করবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here