কল্পকুঞ্জে কঙ্কাবতী পর্ব -২৮+২৯

#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২৮|

একের পর এক লাগাতার কল এসেই যাচ্ছে। বুঝে উঠতে পারছি না, কল রিসিভ করব না কি করব না। কুঞ্জ ভাই এমন অসময়ে কল কেন দিচ্ছেন? দিচ্ছেন তো দিচ্ছেন, দেখছেন– কল রিসিভ করছি না; তবুও কেন বারবার দিয়েই যাচ্ছেন? হুট করেই আমার মস্তিষ্ক সচেতন হলো।
চতুর্থ বার কল আসতেই আমি রিসিভ করে বসলাম। কিছু বলতে যাব, তার আগেই ওপাশ থেকে কুঞ্জ ভাই বলে উঠলেন, “জেগে আছিস?”

আজিব! জেগে থাকি বা না থাকি– সেটা পরের বিষয়। রাতের ২টায়, টানা চারবার কল দিয়ে একটা লোক কী করে বলতে পারে, ‘জেগে আছিস?’
বলি– মাথায় ঘিলু আছে? সারাদিনের ধকল শেষে এতক্ষণ সেই ডায়েরিটা পড়ে কী সুন্দর মনটা নিয়ে আকাশে উড়িয়ে বেড়াচ্ছিলাম! নাহ! লোকটার তা সহ্য হলো না। চলে এলো শান্তি হারাম করতে।

আমি তাঁর ‘জেগে আছিস’-এর মতো অহেতুক প্রশ্নের উত্তর দিলাম না। উনি অপেক্ষাও করলেন না। আবারও বললেন, “নিচে আয়।”

আশ্চর্য! রাত-বিরেতে ‘নিচে আয়’ বললেই হবে! উনি কি জানেন– আমি ওঁর বাসায়, ওঁরই রুমে আছি না কি আমার বাসার নিচেই দাঁড়িয়ে থেকে বলছেন, ‘নিচে আয়’!

এবার প্রত্যুত্তর করলাম। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললাম, “আমি আপনার বাসায়।”

“জানি। তবে ওটা আমার না, তোর মামার বাসা।”

“ওই একই হলো।”

“একই না।”

“উফ!”

“নিচে আয়।”

আমি এতক্ষণে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি। কুঞ্জ ভাই নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোয় অফ হোয়াইট কালারের হুডি পরিহিত কুঞ্জ ভাইকে দেখে এই তীব্র শীতেও আমার শরীরের রক্ত গরম হতে লাগল। মন মহাশয় ছলাৎ করে লাফিয়ে উঠল। এই মরার ঢং দেখেই মরব আমি। মুহূর্তেই সকালের বিষয় মনে এলো। নাহ! এত সবের পরেও এরকম ছ্যাঁচড়ামি আমাকে সাজে না। নিজেকে সামলে নিলাম। ততক্ষণে কুঞ্জ ভাই ঘুরে দাঁড়ালেন। আমাকে দেখে হাত নাড়িয়ে ইশারা করলেন– নিচে যেতে। উফফ! আবারও! আমার যেন কী হলো, আমি দৌড়ে সদর দরজার কাছে চলে গেলাম। বড্ড সাবধানে দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত গতিতে নিচে নেমে এলাম।

কুঞ্জ ভাই বাইকে হেলান দিয়ে মনোযোগী দৃষ্টিতে ফোন দেখে যাচ্ছেন। এক হাত পকেটে পুরে রাখা। উপরের পাটির দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে রেখেছেন। আশ্চর্য! আমাকে এখানে আসতে বলে এখন ভাব ধরা হচ্ছে! মেজাজ সপ্তম আকাশে উঠল। ওঁকে পাত্তা দিচ্ছি কেন– মস্তিষ্কের এই প্রশ্নে আমার রাগ আরও বেড়ে গেল। এক পা পিছিয়ে চলে যেতে নিয়েও গেলাম না। বরং তীব্র বেগে ঝাঁপিয়ে পড়লাম কুঞ্জ ভাইয়ের উপর। দু’হাতে শক্ত করে কর্লার চেপে ধরলাম। অসাবধানতার বদৌলতে উনি খানিকটা পিছিয়ে গেলেন। পরপরই পুরুষালি শক্তপোক্ত রোমশ হাতটি আলগোছে আমার কোমর জড়িয়ে ধরল। আগলে রাখার চিন্তা কি? হু নৌ’জ!

কাল-বেলা অতিক্রম না করে অসহনীয় রাগটা ঝাড়তেই উঁচু গলায় বলে উঠলাম, “চুপ! কোনো ঢং না। একদম আজাইরা ঢং করবি তো একেবারে জানে মেরে দেব। খুব মজা লাগে– আমাকে টেনশনে ফেলতে পারলে, হ্যাঁ? খুব মজা লাগে? আজ তোর মজা আমি বের করছি। আমার কৈফিয়ত চাই। নতুবা মুখ ফিরিয়ে নিতে দ্বিধা করব না আর..”

তাই কি? কথাগুলো যেন নিজেরই কানে বিঁধল! যার সাথে অভিমান তো হয় কিন্তু দূরত্বটা মন ঠিক মানতে চায় না, তার থেকে মুখ ফেরানো যায় কি? এই যে, সারাদিনের তীব্র অভিমানটা, যা প্রিয়তমের সামান্য এক ডাকে মূর্ছা গেল, তা কি এমনি এমনি? মুখ কি আদতে ফেরানো সম্ভব? তবুও লাগামহীন মুখটা কী কী যে বলে ফেলল! নিজের চেয়ে বছর ছয়েকের বড়ো একটা পুরুষ মানুষকে কী করে এক পলকেই ‘তুই’ সম্বোধন করে ফেললাম? বিষয়টা মাথায় খেলল না।

অগ্নি ঝলসানো চোখ তুলে আরও একবার কুঞ্জ ভাইকে দেখে নিলাম। দু’চোখ ভর্তি বিস্ময়ভাবটা যেন জলের মতো টইটম্বুর করছে! আমি কর্লারটা আরও শক্ত করে চেপে ধরে বাক্য সম্পূর্ণ করতে যাব, তখনই কুঞ্জ ভাই ওঁর হাতের জোর বাড়িয়ে দিয়েছেন। ঘাবড়ে গেলাম আমি। এদিক-ওদিক ব্যস্ত ভঙ্গিতে চোখ বুলালাম। সঙ্গে সঙ্গে টের পেলাম– কোমরের বলিষ্ঠ হাতের প্রয়োগে আগের চেয়ে বেশি মাত্রার চাপটি। নিজের দিকে টানলেন বোধহয়!

কর্লার চেপে রাখা হাতদুটো ঢিলা হয়ে গেল। আপাতত হাতজোড়া তাঁর বুকে অবস্থান করছে। আমার চোখে এখন রাগ নেই, আছে ওঁর পরবর্তী পদক্ষেপটা জানার আকাঙ্ক্ষা আর কারো চোখে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা।

কুঞ্জ ভাই আরও কিছুটা ঝুঁকলেন। আমি ওঁর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি, যা আমার ভেতরটায় তোলপাড় চালিয়ে দিল। চোখ দুটো বন্ধ করে এই প্রহরটা অনুভবের চেষ্টা করছি, যদিও মনোযোগ তো কেবলই মহাশয়ের চালচলন লক্ষ করতেই ব্যস্ত। আপাতত মধ্যবর্তী দূরত্ব ইঞ্চিখানেক! চোখ তুললাম আবার। চোখে চোখ মিলল। মিলল অন্তরের গভীরতম অনুভূতিদের সাক্ষাৎ! তারা ভারি খুশি! আরও এগিয়ে ঠোঁট ছুঁইছুঁই হবার আগেই আমি মুখ ঘুরিয়ে ফেললাম। ওঁর ঠোঁট গিয়ে ঠেকল আমার গালের শেষাংশে। সামান্য হাসলেন কি? নতুবা গালে ছোঁয়ানো ঠোঁটের এই নড়চড়ে ভাবটা কেন?

“মুখ ফিরিয়ে নিতে চাও? এই কি তবে ট্রেইলার? লাভ নেই, প্রাণ। লাভ নেই। আমি ছাড়া তোমার আর গতি নেই। তোমার জন্য তো বাবার বাধ্য ছেলে আমিটা, তাঁর বিরুদ্ধেও গিয়েছি। সেখানে তুমি কী!”

কুঞ্জ ভাইয়ের ফিসসিয়ে বলা কথাগুলো আমার মনে এলোমেলো ভাবে আঘাত করলেও, শেষোক্ত কথাটি.. ‘বাবার বিরুদ্ধে গিয়েছি’–কথাটিতে মস্তিষ্কে টনক নড়ল। এতক্ষণের আকর্ষণ, কামনা সব কৌতুহলে রূপ নিল।

কুঞ্জ ভাই আমাকে ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন। দু’হাত পকেটে গোঁজা। আমাকে দেখে হাসছেন। আশ্চর্য লোক!

আমি ভারি কণ্ঠে শুধালাম, “মামার সাথে কী হয়েছিল?”

কুঞ্জ ভাই মিটমিটিয়ে হাসছেন। আমার রাগ লাগছে আবার। চোখমুখ শক্ত করে বললাম, “আমাকে রাগাবেন না। যা জিজ্ঞেস করছি– বলুন।”

উনি ডান হাতের তর্জনী দিয়ে ঠোঁট চেপে হাসতে হাসতে বললেন, “যথা আজ্ঞা, মহারানি। প্রশ্ন পেশ করুন।”

“আমার চেহারায় কি লেখা আছে– আমি জোকার?”

“কই দেখি! না তো। লেখা নেই তো।”

“তবে হাসছেন কেন? এত বেয়াদব হয়েছেন কেন?”

“স্যরি, আপু। উক্ত প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নাই। কৃপা করিয়া কি আপনি পরবর্তী প্রশ্ন করিবেন?”

“চুপ চুপ চুপ! আমি আপনার কোন জন্মের আপু লাগি?”

“এই যে সারাক্ষণ ভাই ডাকতে ডাকতে আমার সেদ্ধ করা জীবনটা ভেজে খাচ্ছেন, কিছু কি বলেছি? তাহলে আপনি কেন বকছেন? আপনারও উচিত আমার মতো উদার মনের হওয়া। আর আপু তো সম্মানের ডাক। আমি আপনাকে সম্মান দিচ্ছি। আমি আপনাকে উঠতে বসতে এমন সম্মান দিতে চাই।”

“ওমা.. তাই?”

“জি, আপু।”

“চুপ, বেয়াদব লোক! আমি তোর কোন জন্মের আপু লাগি রে? বউ ডাক, বউ। বউকে আপু ডাকলে পাপ লাগে।”

আমার রণচণ্ডী রূপ দেখে মাঝ রাতের ফাঁকা রাস্তায় কুঞ্জ ভাই হো হো করে হেসে উঠলেন। কী মোহাচ্ছন্ন সেই হাসির স্নিগ্ধতা। হঠাৎ আমি এই হাসিতে ডুবে যেতে গিয়েও গেলাম না, নিজেকে সামলে নিলাম। দু-কদম এগিয়ে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালাম।

সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, “কথা ঘোরানো হচ্ছে?”

উনি হাসি থামালেন। গম্ভীর মুখে বললেন, “কী খাচ্ছিস দিন দিন?”

আমি আবারও অবাক হয়ে মুখ হা করে ফেললাম। আবার কী? জিজ্ঞেস করার অবসরও পেলাম না। উনি সেই ফাঁকে পুনরায় বললেন, “তুই একটা উন্নত মানের গাঁধি ছিলিস, এখন গোরু হচ্ছিস। তোর ইম্প্রুভমেন্ট হচ্ছে, নবু। এভাবেই এগিয়ে যা। একদিন মানুষ হয়ে পুরো বিশ্বকে চমকে দিবি। আমরা খুব আশাবাদী।”

“আপনি ভারি অসভ্য লোক তো! কথা ঘোরাবেন না, বলছি। সত্যি বলুন। কি? বলবেন না?”

কুঞ্জ ভাই কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। এরপর বাইকে উঠে বললেন, “বলব। ওঠ।”

আমি উঠলাম না। মাটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি তাগিদ দিয়ে বললেন, “দেরি হচ্ছে। সকালে একটা মিটিং আছে। আয়।”

মুখ খুললাম আমি, “কই যাব?”

“গন্তব্য না থাকলে কি রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়? চলা যায় না?”

“যায়। তবে স্বার্থপর মনুষ্যজাতি গন্তব্য ছাড়া এমনি এমনি চলে না।”

“যেখানে স্বয়ং গন্তব্য নিজেই আমার পাশে। সেখানে কার পিছে ছুটব? চল, আমরা বরং উদ্দেশ্যহীন পথ পাড়ি দিই।”

আমি বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম ওঁর দিকে। তারপর বিনা শব্দে পিছে উঠে বসলাম। কুঞ্জ ভাই মুচকি হেসে বাইক স্টার্ট দিলেন।

__________
“কুঞ্জ, ভাই! ধীরে চালান না! ভয় হচ্ছে।”

“কীসের ভয়? জাস্ট ইনজয় ইট, নবু। চোখ বন্ধ কর আর আমাকে আরেকটু শক্ত করে ধর।”

আমি ওঁকে শক্ত করে ধরলাম। চোখও বন্ধ করলাম। তবে ভয় দমল না। আবারও চিৎকার করে উঠলাম, “দোহায় লাগে, কুঞ্জ ভাই। থামান আপনি। আমার খুব ভয় করছে।”

কুঞ্জ ভাই বাইক থামালেন না। শুধু বললেন, “আমি আছি না?”

হ্যাঁ, উনি আছেন। মনের ভেতর কেমন করে ভালো লাগারা নাচতে লাগল! ঠোঁটে হানা দিলো হাসির ঝলক। তখনই তীব্র আলোকরশ্মি চোখে বিঁধল। সামনে ট্রাক! সজোরে প্রিয় পুরুষটির নাম নিয়ে চিৎকার করে উঠলাম…

চলবে..#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২৯|

“কী সমস্যা আপনার? কী করতে যাচ্ছিলেন, কী? চাচ্ছিলেন কী? মরে যাই? আরে! আমি তো মানসিকভাবে প্রতিদিনই মরছি। আনুষ্ঠানিকভাবে মারার দরকার কী?”

হাঁপাতে হাঁপাতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে তেজী কণ্ঠে কথাগুলো বলছি। কুঞ্জ ভাই অনিমেষনেত্রে তাকিয়ে আছেন। আমার কথা শেষ হতেই বললেন, “ডোন্ট ইউ ট্রাস্ট মি?”

আমি হতাশ হয়ে বললাম, “আই ট্রাস্ট ইউ বাট… এভাবে কেউ বাইকিং করে?”

কুঞ্জ ভাই হাসলেন। বললেন, “তোমার বিশ্বাসের নমুনা দেখলাম। কখনও এমন কোনো সিচুয়েশন এলে, আমায় বিশ্বাস করবে কি না– তা দেখলাম। আচ্ছা, আমাকে এখনও এটুকু চিনতে পারোনি? আমি নিজে মরলেও তোমার ক্ষতি চাইব না, হতে দেবও না।”

“যদি কিছু হয়ে যেত? কী প্রুভ করতে চাইছিলেন?”

ভ্রু-কুঞ্চিত করে কথাটুকু বললাম। বাঁকা হেসে বললেন, “না, কিছু না।”

কথাটি সম্পূর্ণ করেই ধীর পায়ে মেইনরোডের বাঁয়ে থাকা ঝোপের দিকে পা বাড়ালেন। বড্ড অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ। বাজে ক’টা? উম.. তিনটে? কুঞ্জ ভাই ধীরে ধীরে ভেতরের দিকে বিলীন হতে লাগলেন। আমি হাত উঁচিয়ে ডাকলাম, “আরে! আরে! করছেনটা কী? যাচ্ছেন কই?”

কুঞ্জ ভাই ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে তাকালেন আমার দিকে। সরু রাস্তাটি বরাবর চাইলে, ছোটো খাটো একটা জঙ্গল বলে দিতে দ্বিধা করবে না কেউ। চারোপাশে ঝোপঝাড়, লতাগুল্মে সাজানো বিশালাকৃতির গাছপালা, ভেতরে হয়তোবা অজানা-অচেনা-অদেখা আরও অনেক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ আছে। গাছগাছালির ফাঁকফোকর দিয়ে মোহময়ী চাঁদের অতিরঞ্জিত আলোতে কুঞ্জ ভাইকে অন্য রকম লাগছে। বে-শ অন্যরকম। আমি যতদূর জানি, লোকালয়ে এমন জায়গা পাওয়া দুষ্কর। তবে এটা কী?

কুঞ্জ ভাই আমার থেকে অনেকটা দূরে। আমি রোডে দাঁড়িয়ে আর উনি ভেতরের দিকে। না হলেও ৬০-৭০ মিটার দূরে আছেন! উনি ডাকলেন আমায়, “নবনী!”

নিস্তব্ধ রাতে ওঁর আওয়াজটা বাতাসে বাড়ি খেল, এভারেজ শব্দটা জোরেশোরেই শোনা গেল। পরপর আবার বললেন, “এসো।”

আমি পিছু পিছু গেলাম। উনি দাঁড়িয়ে আছেন। আমি যেতেই উনি আমার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় পুড়ে নিলেন। হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে ভাঁজে নিজের আঙ্গুল রাখলেন, বেশ শক্ত করে আটকে নিয়ে পা বাড়ালেন সামনের দিকে।

জ্যোৎস্না রাত, সরু রাস্তার দুপাশ দিয়ে গাছপালা, উপরের দিকটা সামান্য খোলা, আকাশের ঠিক উপরে এক ফালি চাঁদ, তারা-নক্ষত্রের মেলা, বাতাসের রোমাঞ্চিত শব্দগুচ্ছ আর পাশে প্রিয় পুরুষটি! সবে মিলে মনটা এলোমেলো করে দিচ্ছে। যেতে যেতে কুঞ্জ ভাইকে শুধালাম, “কই যাচ্ছি?”

“শান্তির নীড়ে।”

আমি তো ঠিক এই হাতের মুঠোতেই শান্তি খুঁজে পাচ্ছি। আর কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই আমার। এখানেই বেশ আছি। পথ ফুরোলেই যদি হাত ছেড়ে দেন? থাক, যাওয়ার প্রয়োজন নেই! মনে মনে কথাগুলো আওড়ালেও মুখে আনতে পারলাম না। কেমন যেন ঘোরে আচ্ছন্ন আমি। যা দেখছি, তাই ভালো লাগছে। মন ভালো থাকলে বুঝি দূরপাল্লার বাসের হর্নের শব্দও সুরেলা গানের ধ্বনি লাগে?

বেশ এগোতে এগোতে একটা ঝিলের কাছে গেলাম। ছোট্টো গোলাকার একটা ঝিল। ঝিলের সম্পূর্ণ পাড় ৮-১০ হাত জায়গা নিয়ে করা। ফাঁকা জায়গাটুকুতে ছোটো-ছোটো মসৃণ ঘাস জন্মেছে। এছাড়া ঝিলটিকে সম্পূর্ণ ঘিরে রেখেছে পেরিয়ে আসা গাছের দলেরা। দেখে মনে হচ্ছে– কেউ খুব যত্নে এই জায়গাটি বানিয়েছে। কুঞ্জ ভাই হাত ছেড়েছেন কখন– জানা নেই। আমি ঘুরে-ফিরে পুরোটা দেখলাম। কী স্নিগ্ধ লাগছে!

জুতো খুলে এগিয়ে গিয়ে ঝিলের টলটলে জলে পা ভিজিয়ে বসে পড়লাম। পরনে একটা হালকা রঙের স্কার্ট আর সাদা ক্রপটপ ছিল, এর উপরে মোটা শাল জড়ানো। ঝিলের হিমশীতল জলে পুরো শরীর কেঁপে উঠল। সেই সাথে ভালো লাগার আবেশে মন জুড়িয়ে গেল। এতক্ষণে কুঞ্জ ভাইও জুতো খুলে, জিন্স গুটিয়ে এগিয়ে এসে আমার পাশে বসলেন।

আমি ওঁর দিকে আবেগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। উনি তা দেখে বললেন, “শীত করছে?”

মিথ্যে বললাম না, “একটু করছে।”

উনি ব্যস্ত হয়ে হুডিটা খুলতে লাগলেন। বললেন, “এটা নাও, শীত কম করবে। বাইকেও অনেক শীত করেছিল, না?”

“হুম.. কিন্তু লাগবে না।”

“কেন?”

“বেশি শীত করছে না। একটু করছে.. সামান্য।”

“তো, নাও।”

“আপনার শরীর খারাপ করবে। তাপমাত্রা ১২° সেলসিয়াসের কম এখানে।”

উনি আরও কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, তার আগেই আমি বলে উঠলাম, “প্লিজ, অযথা জেদ করবেন না। ভালো লাগছে এভাবেই। রাগ করতে চাচ্ছি না।”

অগত্যা উনি আর কথা এগোলেন না। চুপ করে আকাশের দিকে তাকালেন। আমি ওঁর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে একবার আমার নজরে যতটুকু আঁটে, দেখে নিলাম। ডান পাশটা, বাঁ পাশটা, সামনেটা, ঝিলের পানির মাঝে খোলা আকাশের উপরের ওই চাঁদটা… সবটা দেখে নিলাম। আবার কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে তাকাতেই উনি সাঁই বেগে ঘাসে পিঠ ঠেকিয়ে শুয়ে পড়লেন। চোখ বুঁজেই বললেন, “জানো– আমি এখানে প্রায়ই আসি?”

অবাক হলাম। সেই সাথে ওঁর এই জায়গাটা খুঁজে পাবার রহস্যও ভেদ করলাম। মস্তিষ্কে বিচলিত হলো একটা কথাই, ‘দুনিয়াতে রহস্য বলে কিছু নেই। যা আমরা জানি না– তাই আমরা রহস্য নামে আখ্যায়িত করি। নতুবা সবেরই এক ব্যাখ্যা আছে।’

আমি মিহি কণ্ঠে বললাম, “জানতাম না।”

উনি বলা শুরু করলেন, “৬-৭ বছর আগে এসেছিলাম।”

“আপনার কলেজ লাইফে? তখন তো বেশ ভদ্র-সদ্র পড়াকু ছেলে ছিলেন। কোথাও তেমন যাওয়া-আসা ছিল না। কীভাবে কী? সাথে কে এসেছিল?”

“একাই এসেছিলাম।”

“মানে? কীভাবে?”

“কলেজ বাঙ্ক দিয়ে।”
আমার চোখ কোটর থেকে বের হওয়ার উপক্রম। শেষমেশ উনি কলেজ বাঙ্ক দিতেন– এটা জানা হলো আমার? উনি আমাকে চমকে যেতে দেখে হাসলেন। বললেন, “বাইক নিয়ে মানিকগঞ্জ যাচ্ছিলাম, একটা স্কুল ফ্রেন্ডকে পিক করতে। মাঝপথে বাইক থেমে যায়, আর স্টার্ট নিচ্ছিল না। আশেপাশে কোনো গ্যারেজও ছিল না। তাই সেই ফ্রেন্ডকে কল দিয়ে প্রবলেমটা শেয়ার করলাম। ও এখান থেকে কিছুটা দূরেই থাকে। মেকানিক নিয়ে ঘন্টা খানেকের মাঝেই আসবে, ওয়েট করতে বলল। আমি ওয়েট করতে করতে হাঁটতে লাগলাম। তখনই এই ঝিলটা দেখেছি। প্রচুর ভালো লেগে যায়। এরপর মাঝেসাঝেই আসা হয়। তখন অবশ্য এত গোছালো ছিল না। এটা এরকমই সতেজ ও সুন্দর যাতে থাকে– সেজন্য পরিচর্যার লোকও রেখেছি। এখানে শরৎকালে এলে বেশি শান্তি লাগে। কাশফুল ফোঁটে ওদিকটায়।”

হাত দিয়ে দেখালেন উনি। তারপর আমার দিকে চাইলেন। আমি ওঁর দিকেই তাকিয়ে আছি। মুচকি হেসে বললেন, “আচ্ছা, তোমার কাছে জীবন মানে কী?”

“বেঁচে থাকার ইচ্ছে।”

“ইচ্ছে ফুরিয়ে গেলেই কি মানুষ মারা যায়?”

“আত্মার মরণ তো তখনই হয়।”

“তবে শারীরিক ভাবে বেঁচে থাকে কেন? পুরোপুরি বিলীন হলেই তো পারে!”

“জানেন? প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার একটা উদ্দেশ্য থাকে। আপনি হয়তো কোনো একসময় ভাববেন– এই জীবনে আর পাবার কিছুই নেই, সব শেষ। কিন্তু না। সব শেষ হলে, কখনই আপনি বেঁচে থাকতেন না। আপনি জানবেনও না– জীবনের শেষ মুহূর্তে এসেও কীভাবে, কার উপকারে আসছেন। এমনকি মৃত্যুর পরও আপনার দেহটা অন্যের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হবে। উম.. পোকামাকড়ের খাদ্যরূপে, মাটির উর্বতার জন্য সার রূপে!”

“ভালোই কথা শেখা হয়েছে– দেখছি!”

“ও একটু-আধটু আগে থেকেই জানি। কেবল কারও কাছে বলার ইচ্ছেটা ঠিক হয়ে ওঠে না– বলেই কেউ জানে না।”

“তা আজ আমার কাছে কেন হলো?”

“হবে না? আপনার কাছে তো গোটা আমিটাকেই ভেঙেচূরে উপস্থাপন করেছি!”

কুঞ্জ ভাই স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। কিছুটা থমকে থাকা সময় যেতেই বললেন, “ভালোবাসা মানে কী বোঝো?”

আমার অকম্পিত জবাব, “আপনাকে বুঝি।”

উনি চুপ মেরে গেলেন। আমি সামান্য হেসে বললাম, “বলবেন কি?”

লম্বা একটা শ্বাস টেনে বললেন, “আমার চোখের ভাষা কী তোমার জানা নয়? সেই ছোট্টোটি থাকতেই তো শিখে নিয়েছিলে। তবে এখন কেন মুখ ফুটে সব বলতে হবে?”

“যাতে ভবিষ্যতে কোনোদিন অস্বীকার করতে না পারেন আমায়। কোনোদিন বলতে না পারেন– আমার আপনার উপর অধিকার নেই। অব্যক্ত কথার খেলাপ করার জন্য বাহানা না দিতে পারেন যে, আপনি কোনো অঙ্গিকার করেননি।”

“আমাকে বিশ্বাস করো না?”

“করি। সময়কে করি না, সিচুয়েশনকে করি না। একটা কথা জানেন কি? সময় আর পরিস্থিতি যে কোনো মানুষকে বদলে দিতে পারে।”

“অভিজ্ঞতা এত?”

“তা নয়তো কী? এই-যে, যেখানে আপনি আমার সাথে কথা না বলে থাকতেই পারতেন না, আমাকে না জ্বালালে যেন আপনার ঘুমই হতো না; সেখানে সেই আপনিই মাসের পর মাস যোগাযোগ রাখেননি।”

“ব্যস্ত ছিলাম।”

“সে-বাহানা আমায় দেওয়া লাগবে না। আপনি কতটুকু ব্যস্ত হলে কতটুকু সময় আমাকে দেন, তা আমার মুখস্ত।”

“ভুল বুঝছ তুমি।”

“না। তবে এক্সপ্লেনেশন চাচ্ছি। নয়তো আপনার কল আসতেই আপনার কাছে চলে আসতাম না। আপনার সাথে এই মাঝ রাতে এখানে আসতাম না। আমার রাগ সামলাতে পারবেন। কিন্তু অভিমান! সেটা এতটাও ঠুনকো নয়।”

“শুনেই ছাড়বে?”

“বলতে চাইলে, বলুন। নতুবা জোর করার অভ্যেস আমার নেই।”

“আমার উপর কার জোর খাটে– তাও কি বলা লাগবে?”

আমি চুপ রইলাম এবার। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মানসপটে ভেসে উঠছে পুরোনো সব কান্ডগুলো। এই অসভ্য পাষাণটার প্রেমে কী করে পড়লাম, ভেবে পাচ্ছি না। তাকিয়ে দেখলাম, ওঁর চোখ আমার মাঝেই নিবদ্ধ। আমাকে তাকাতে দেখেই বললেন, “আরে! বলছি তো! মন খারাপ করো কেন? তোমায় বলব না তো কাকে বলব? তুমি হচ্ছ কী এ আমার, কী যেন! উফ! মনে পড়ছে না।”

“তা মনে পড়বে কেন?”

“আসলে বয়স হচ্ছে তো, মনভুলো হয়ে যাচ্ছি।”

এই মুহূর্তে আমার খুব হাসি পেল এবং আমি হেসেও দিলাম। আমার হাসির শব্দ বাতাসে বেজে আমারই কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। হাসি চাপিয়ে রাখার মতো ভয়ঙ্কর কষ্টসাধ্য কাজ দ্বিতীয়টি নেই। লোকটা নেহাতই পাগল!

“মে-বি হুমায়ূন আহমেদ স্যার ঠিকই বলেছেন। বেশিরভাগ রূপবতী মেয়ে নকল হাসি হাসে। হাসার সময় ঢং করার চেষ্টা করে। তখন, তাদের হাসি হায়েনার হাসির মতো হয়ে যায়।”

কথাটা কানে যেতেই আমার হাসি তৎক্ষনাৎ থেমে গেল। ডানে তাকিয়ে দেখলাম– উনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। আচ্ছা, উনি কী বললেন এটা?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here