‘ কথা দিলাম ‘ 🌸❤️
||পর্ব ~ ৫৪||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
দেবাংশু উঠে চলে গেলে দিয়ারা বসে থাকে ওখানে ঠায়। ধীরে ধীরে নিজের মুখ ঢেকে ফেলে দু হাত দিয়ে।
দিয়ারা: (মনে মনে — এইজন্যেই দি বলেছিলো যে, সবটা জানার পর ও দেবদাকে দোষ দিতে পারে না। কাওর অতীত এতটা ভয়ংকর বিষহ হতে পারে আমি ভাবতেই পারিনি। হয়তো এতটা ভয়ংকর বিষহ বলেই দেবদার বর্তমানকে প্রভাবিত করছে। এরকম চলতে থাকলে হয়তো ভবিষ্যতটাও প্রভাবিত হবে। আমি ভালো ভেবেই বুঝতে পারছি দেবদা এখনও নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি কিন্তু আমায় ও’কে বোঝাতে হবে যে, যেটা হওয়ার সেটা হয়ে গেছে। অতীতকে শুধরানো আমাদের হাতে নেই, যেটা হাতে আছে সেটা হচ্ছে অতীতকে ভুলে, অতীতের থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতকে ঠিক করা। বোঝাতেই হবে আমায়! আমি পারবো না ও’কে এভাবে কষ্টের মধ্যে দেখতে।)
দিয়ারার চোখের সামনে এক একটা ঘটনা ভেসে উঠলো যেগুলোর সাথে দেবাংশু বর্তমান আর অতীতের মিল পেয়েছে। নিজের দিদির বলা কথাগুলো এখন জানো অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে। সত্যি সে নিজেই বুঝতে পেরেছে দেবাংশুর এতটা রিয়্যাক্ট করার কারণ। অর্জুনকে খামোখা রাগ, ইনসিকিউর ফীল করতো না সে। যথেষ্ট কারণ ছিলো দেবাংশুর প্রত্যেকটা পদক্ষেপ, কথা বলার পিছনে। “কিন্তু”.. শব্দটা মাথায় আসতেই দিয়ারা উঠে দাঁড়ালো আর দেখলো দেবাংশু ওর দিকে একভাবে তাকিয়ে ছিলো। দিয়ারা তাকাতেই চোখ নীচে নামিয়ে নিলো আর ইতস্তত বোধ করতে লাগলো। দিয়ারা কোনো কিছু না ভেবে এগিয়ে গিয়ে দেবাংশুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
দিয়ারা: আমি জানি তুমি এখনও নিজেকে ক্ষমা করতে পারছো না।
দেবাংশু: ক্ষমা করার মতো কোনো কাজ করিনি আমি।
দিয়ারা: সব ভুলের ক্ষমা হয় দেবদা।
দেবাংশু: একটা পবিত্র মেয়ের চরিত্রর উপর প্রশ্ন তোলাটাও?
দিয়ারা সোজা হয়ে দাঁড়ায়, এতক্ষণ দিয়ারা জড়িয়ে ধরলেও দেবাংশু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। দিয়ারা কিছু বলতে যাবে তার আগেই দেবাংশু বলে,
দেবাংশু: একটা ভুল মানুষের অপরাধের সাথে একটা ঠিক মানুষের তুলনা করেছি আমি। নিজের অতীতের জন্য একটা মেয়েকে তাঁর পেশা আর কিছু ঘটনা নিয়ে, তাঁর চরিত্রের উপর জাজ করেছি, কথা বলেছি। একজনের উপর জমে থাকা রাগ, অন্য একজনের উপর ঝারাটা কি ঠিক? তাও আবার সেন্সিটিভ একটা বিষয় নিয়ে। আমি পারবো না দিয়া, আমি পারবো না নিজেকে ক্ষমা করতে। এইসব কিছুর দায় একমাত্র আমার, আমার উচিৎ ছিলো নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা। একবার ভাবা যে আমি একটা মেয়ের সন্মান নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু আমি ভাবিনি, নিজের অতীতকে নিজের মাথার উপর, শাসন করতে দিয়ে নিজের মনের কথা শুনিনি। তুই চলে যা দিয়া, আমার সাথে থাকলে ভবিষ্যতে হয়তো আরো হার্ট হবি। আমি যতদিন না নিজের অতীতের উপর নিয়ন্ত্রণ করা শিখবো ততদিন কাওর সামনে আসবো না। একা ছেড়ে দে আমায়।
[কোনো পেশাকে বা কোনো মেয়েকে ছোটো করা আমার উদ্দেশ্য নয়। গল্পের প্লটের সুবিধার্থে এইগুলো ব্যবহার করা হয়েছে।]
দেবাংশু কথাগুলো বলে পিছিয়ে যায়। সে এতক্ষণ নীচের দিকে তাকিয়ে একনাগাড়ে কথাগুলো বলে গেলেও আড় চোখে লক্ষ্য করেছে দিয়ারার চোখের জল। এই মুখটার দিকে তাকালে হয়তো আবারও সে টলে যাবে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে তাই দিয়ারার দিকে না তাকিয়ে, নীচের দিকে তাকিয়েই পিছিয়ে যায় এবং সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে যায়।
দিয়ারা: এতদিন তো একাই ছিলে তুমি। পেরেছো নিজের উপর, নিজের অতীতের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে? নাকি শুধু আমি কষ্ট পেয়েছি সেটা নিয়েই ভেবে গেছো কোনটা?
দিয়ারার কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে এমন একটা প্রশ্ন শুনে দেবাংশু হাত মুঠো করে নেয় কারণ এই প্রশ্নের উত্তর নেই তাঁর কাছে।
দিয়ারা: একা থাকলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না দেবদা। একটু ভালো করে ভেবে দেখলে দেখা যাবে এতো দিন তুমি একাই ছিলে। একাই লড়ছিলে নিজের অতীতের সাথে, কতটুকু সার্ভাইভ করতে পেরেছো? সার্ভাইভ করতে পারলে এইদিনটা আজ আসতো না। সেইসময় তোমার অনুভূতি বলে কিছু ছিলোই না কারণ সেইসময় তোমার উপর শুধু তোমার মস্তিষ্ক শাসন করতো। কিন্তু যখন তুমি আমাকে দেখেছিলে তখন প্রথম তোমার মন কিছু বলেছিলো তোমাকে। এইসব রাগ, হিংসে, অভিমান সবকিছু মন নিয়ন্ত্রণ করে। সর্বোপরি ভালোবাসা মন দিয়ে হয়, মস্তিষ্ক দিয়ে নয়। তুমি আমাকে ভালোবাসো দেখেই তোমার রাগ হয়েছে আমার উপর অধিকার নেই বলায়, হিংসে হয়েছে অর্জুন আমার কাছে আসায়, অভিমান হয়েছে তোমাকে অবহেলা করায়। এইসবের জন্যই তুমি সেদিন আমাকে ওই কথাগুলো বলেছিলে কারণ তুমি একজন ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েছো আরেকজনকে হারাতে চাওনি সেই একই মানুষের কাছে। কীভাবে এটা মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ হয়?
দেবাংশু কিছু না বলে হুরমুর করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে নিজের ঘরে চলে গেলো। দিয়ারা যেই জিনিসটা দেবাংশুকে বোঝাবে বলে ঠিক করছে, সেই জিনিসটা যে ও’কেও গ্রাস করছে সেটা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে দিয়ারা।
দিয়ারা: (মনে মনে — কেন এমন করছো তুমি? কেন আমার কথাগুলো, আমাকে বোঝার চেষ্টা করছো না? আমি তোমাকে হারাতে পারবো না কিছুতেই। কীভাবে বোঝাবো তোমায় তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি। কীভাবে?)
দিয়ারা মুখে হাত চেপে কান্না করতে লাগে। বেশ কিছুক্ষণ কান্না করে নিয়ে কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে দেবাংশুর ঘরে চলে যায় ও। ঘরের সামনে গিয়ে দেখে দরজা খোলা, দিয়ারা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পরে। দেবাংশু হাঁটুর উপর দুই হাতের কুনই ভর করে বসে আছে নীচের দিকে তাকিয়ে। দিয়ারা ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসে, বাহু জড়িয়ে ধরলেও দেবাংশু কোনো প্রতিক্রিয়া জানায় না। দিয়ারার চোখ দিয়ে অবিরাম জল গড়িয়ে পরছে। একটাসময় সে নাক তাঁকে দেবাংশু বলে ওঠে,
দেবাংশু: তোকে চলে যেতে বললাম না আমি? (রাগী সুরে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দিয়ারার দিকে তাকিয়ে)
দিয়ারা: যাবো না। (নাক টেনে)
দেবাংশু: (একটা হতাশার শ্বাস ফেলে আবারও নীচের দিকে তাকিয়ে) কেন যাবি না? তোকে এতো কিছু…
দিয়ারা: যখন যাচ্ছিলাম তখন কেন আটকালে আমাকে? কেন বললে ছেড়ে যেতে না?
দেবাংশু: (নিশ্চুপ)
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর দিয়ারা নিজের হাত সরিয়ে নিলো দেবাংশুর বাহু থেকে। যায় কারণে দেবাংশু সেদিকে তাকিয়ে দিয়ারার দিকে তাকাতেই ওর বুকের ভিতরটা আবারও মোচড় দিয়ে উঠলো। দিয়ারার চোখ মুখ লাল হয়ে রয়েছে অতিরিক্ত কান্নার ফলে এবং সে এখন সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে যেই দিয়ারাকে দেখে মনে হচ্ছিলো সে মত বদল করবে না কিছুতেই এখন মনে হচ্ছে, তাঁর মত বদল হয়েছে। দিয়ারার চোখ মুখ শক্ত হয়ে যাওয়া দেখে দেবাংশুর মনের ভয়টা আবারও তীব্র হতে শুরু করলো। দিয়ারা এবার বলে উঠলো,
দিয়ারা: আমার মনে হয় সত্যি এবার আমার চলে যাওয়া উচিত। তুমি যখন আমাকে চাও’ইনা তখন আমার এভাবে তোমাকে জোর করাটা ঠিক নয়। সত্যিই তো, তুমি এটাই ভাবছো যে ভবিষ্যতে আমিও তোমার মায়ের মত তোমাকে ঠকাবো। অন্য ছেলের সাথে…
দেবাংশু: শাট আপ!! (জোরে ধমক দিয়ে)
দেবাংশু দিয়ারার দুই বাহু শক্ত করে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে ও’কে ঝাঁকিয়ে বললো,
দেবাংশু: আমি এইসব কিচ্ছু ভাবছি না ড্যাম ইট!
দিয়ারা: কেন ভাবছো না?
দেবাংশু: (অবাক হয়ে) হোয়াট? কেন ভাববো এটা আমি? তুই আর আমার মা একটা আলাদা মানুষ। আমি কখনও আমার মায়ের জায়গায় তোকে বসাইনি ইচ্ছা করে, ওই ঘটনাগুলো আমাকে বাধ্য করেছে। সব ক্লিয়ার হওয়ার পর আমি কেন ভাববো অমন?
দিয়ারা: কিন্তু তোমার কথা অনুযায়ী তোমার অতীত তোমাকে এখনও নিয়ন্ত্রণ করছে তাই তোমার এটাই ভাবা উচিৎ আমিও তোমার মায়ের মত তোমাকে ঠকাবো।
দেবাংশুর হাতটা আলগা হয়ে গেলো দিয়ারার কথা শুনে। সামনের দিকে তাকিয়ে কথাটা ভাবতে শুরু করলেই দিয়ারা পাশ দিয়ে বলে উঠলো,
দিয়ারা: যেদিন থেকে তোমার মনে আমার জন্য অনুভূতি এসেছে সেদিন থেকেই তোমার মন তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তোমার অতীতের ঘটনা তোমার মনকে প্রভাবিত করেছে দেখেই তোমার মনে হয়েছে তুমি আমাকে হারাতে পারবে না। যদি তাই না হতো, তোমার মস্তিষ্ক যদি তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করতো তাহলে কিছুক্ষণ আগে তুমি আমাকে আটকাতে না। এই যে তুমি এত কিছু ভাবছো আমাকে নিয়ে, কষ্ট পাচ্ছো আমাকে নিয়ে সেটা তুমি ভাবতে না, কষ্ট পেতে না। কারণ তোমার মস্তিষ্ক তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করতো আর তুমি ভাবতে যে আমিও তোমার মায়ের মত যেমনটা এতদিন অন্য মেয়েদের ভেবে এসেছো।
দেবাংশু: এইভাবে সব মেয়েদের সাথে একজনকে গুলিয়ে ফেলা, এক ভাবা তো ঠিক না তাই না?
দিয়ারা: একদমই ঠিক না। এইটা তুমি আগে ভাবনি কারণ তোমার মধ্যে ফিলিংস কাজ করতো না। আমরা মুখে যতই বলি আমরা নিজেদের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করবো, নিজের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করবো, আমরা সেটা করতে কখনওই সফল হয়ে উঠি না। দুটো বিষয়েই আমরা নিজেরা সব থেকে বেশি কষ্ট পাই। তুমি যেটা করেছো তার পিছনে কারণ ছিল, কথাগুলো বলে তুমি ঠিক করনি এটা সত্যি। কিন্তু তুমি তো সেটা নিজের সজ্ঞানে বলনি, ভেবে বলনি। ভাবার সময় পেলে তো ভাববে। ঠিক ভাবে ভাবল তুমি কখনওই এমন কিছু বলতে না যেমনটা আগে কখনও আমাকে বলনি। অন্য মেয়েদের বলবে কি? তুমি তো তাঁদের নিয়ে ভাবতেই না। এইবার নিজেকে দোষ দেওয়া বন্ধ করো প্লিজ!
দেবাংশু: আমি পারবো আমার অতীতের কষ্টটা ভুলে এগোতে? আবার তোকে কষ্ট দিয়ে ফেলবো না তো?
দিয়ারা: এর উত্তর তো তোমার কাছেই আছে।
দেবাংশু: আমার কাছে?
দিয়ারা: হ্যাঁ। তুমিই ভেবে দেখো এর আগে যখন তুমি আমার সাথে ছিলে তখন তোমার অতীতের কথা মনে পরেছে কি না। অন্য মেয়েদের ক্ষেত্রে তুমি প্রথম থেকেই ভেবেছো যে তাঁরা তোমাকে ঠকাতেই পারে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে কি প্রথম থেকে ভেবেছো নাকি ঘটনা গুলো ঘটার পর ভেবেছো?
দেবাংশু: এতগুলো বছরে শুধুমাত্র সেই সময়টুকুই আমি অতীতের কথা ভাবতাম না, বলা যেতে পারে আমার মনে আসতো না যখন আমি তোর সাথে থাকতাম। এইজন্যইআমি চাইতাম তোর সাথে সময় কাটাতে।
দিয়ারার একটু খারাপ লাগলো কথাটা শুনে। সত্যি তো, নানান বাহানা দিয়ে সে এড়িয়ে যেতো দেবাংশুকে। তবে সেও তো ইচ্ছা করে কিছু করেনি।
দিয়ারা: যখন আমাদের মন আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে তখন আর আমাদের কিছু করার থাকে না। কোনো ঘটনার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, ভালোবাসার মানুষকে হারানোর ভয়ে আমরা অনেক সময় অনেক কিছু বলি। পরে কষ্টটাও আমরা সমান ভাবে পাই কিন্তু তখন তো কিছু করার নেই তাই না? সেটা একটা ভুল কিন্তু সেটাকে ধরে রেখে যদি আমরা দিনের পর দিন আরও কষ্ট দিয়ে নিজেদের বর্তমান আর ভবিষ্যতটাকে নষ্ট করি তাহলে সেটা অন্যায়। অতীতের ভুল শুধরানো আমাদের আয়ত্তে নেই কিন্তু সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে, অতীতকে স্মৃতির পাতায় রেখে বর্তমান আর ভবিষ্যতকে সুন্দর করা আমাদের আয়ত্তে আছে। এতটাই সুন্দর আমরা করতে পারি যে সেই অতীতটা স্মৃতি হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে হাস্যকর হয়ে উঠবে, হাসবো আমরা সেই অতীতেই উপর।
দিয়ারা চুপ করে যায়। দেবাংশু একভাবে বসে আছে। অনেকটা সময় চলে গেলে দিয়ারা মনে একটু সাহস নিয়ে বলে ওঠে,
দিয়ারা: ভালোবাসার মানুষকে হারানোর ভয়কে কাটিয়ে ওঠা যায় না কখনও। ওটা আজীবন থেকে যায় কোথাও না কোথাও। বরং যখন থাকে না তখনই অবহেলার সৃষ্টি হয় আর যখন তীব্র হয়ে যায় তখন অবিশ্বাসের। সব ঘটনা ঘটার পিছনে কারণ থাকে, আজ তোমার সাথে এই ঘটনাটা না ঘটলে হয়তো তুমি কখনও নিজের অতীতকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেতে না। এইবার তোমার সিদ্ধান্ত তুমি সেই সুযোগ গ্রহণ করবে নাকি ফিরিয়ে দেবে?
দেবাংশু দিয়ারার কথা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পর দিয়ারার বিপরীত দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। যার ফলে দিয়ারার চোখে আবারও জল ভরে ওঠে। কিছুক্ষণের মধ্যে সেটা গাল গড়িয়ে বেয়েও পরতে থাকে। দিয়ারা নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। ভাবছে এতক্ষণ এতো চেষ্টা যখন সফল হলো না তাহলে এটা কি আর সফল হবে? যদিও সে চায় চিৎকার করে কাঁদতে কিন্তু সেটা দেবাংশুর সামনে নয়। দিয়ারা নিজের কান্নাটা কোনো মতে গিলে জড়ানো কণ্ঠে কাঁপা কাঁপতে থাকার ঠোঁটের দ্বারা বলে,
দিয়ারা: আ..আসছি দেবদা…
দেবাংশু: গো টু হেল উইথ ইউর দা! অর্জুনকে গিয়ে বলবি দা আমাকে নয়। (দিয়ারার দিকে ফিরে ধমক দিয়ে)
দিয়ারা কেঁপে ওঠে দেবাংশুর ধমকে। দেবাংশু দিয়ারাr কাঁপতে থাকা ঠোঁট দেখে বলে,
দেবাংশু: সেদিনকে সজ্ঞানে কাছে যাইনি বলে আজকে সজ্ঞানে কাছে যেতে বাধ্য করছিস এভাবে? (ভ্রু উঁচিয়ে, ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি রেখে)
দিয়ারা: তুমি..তুমি…
দিয়ারাকে নিজের বুকের মাঝে টেনে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দেবাংশু। যার ফলে দিয়ারা অঝোরে কান্না শুরু করে। দেবাংশু দিয়ারার মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ে ওর কানের কাছে বলে,
দেবাংশু: অনেক কাঁদিয়েছি তোকে আর না। এইবার নিজের সবটা দিয়ে চেষ্টা করবো তোকে ভালো রাখার। এতটা ভালোবাসবো যে তুই ভাববি এরকম ভালোবাসা পাওয়ার জন্য বারবার কাঁদতে পারলে ভালো হয়।
দিয়ারা দেবাংশুর কথায় কান্নার মাঝেই হেসে ফেললো আর বুকে একটা ঘুষি মারলো যার ফলে দেবাংশুও হেসে ফেললো। তারপর একটু নাক টেনে নিয়ে বললো,
দেবাংশু: আমি কখনও তোর কষ্টের কারণ হতে চাই না। তবে যদি কষ্টই না থাকে তাহলে পরবর্তী সুখটাও উপভোগ করা যায় না। তাই আমি প্রমিজ করছি যে, ইচ্ছা করে কোনদিনও তোকে কষ্ট দেবো না। তোকে বোঝার চেষ্টা করবো, আর আমার দিকটাও বোঝানোর চেষ্টা করবো। আই লাভ ইউ দিয়ু! প্লিজ আর না, তোর চোখের জলগুলো আমার বুকে তীরের মতো বিঁধছে।
দেবাংশুর মুখে “দিয়ু” ডাকটা শুনে ধীরে ধীরে শান্ত হতে লাগলো দিয়ারা। শান্ত হওয়ার পর আস্তে করে বললো,
দিয়ারা: যে আমাকে ভালোবাসবে আমার হাসির কারণ হবে, সেই আমাকে কষ্ট দেবে, আমার কান্নার কারণ হবে এটাই স্বাভাবিক। তোমার সবটা জানার আগে যেমন তোমাকে ভালোবাসতাম সবটা জানার পরেও তেমনই তোমাকে ভালোবাসি আর ভবিষ্যতেও একইভাবে ভালোবাসবো। আই লাভ ইউ মোর দেব..আচ্ছা অংশু!
দেবাংশু: (সোজা করে) আরেকবার বল?
দিয়ারা: (লাজুক হেসে) অংশু!
দেবাংশু: (একটু রেগে) পুরোটা বলতে বলেছি!
দিয়ারা: আই..
দেবাংশু: চোখে চোখ রেখে শেষ করবি। (একটু বিরক্ত হয়ে গিয়ে, ভ্রূ কুঁচকে) আই লাভ ইউ মোর (চোখের দিকে তাকিয়ে) অংশু..উম!!
কথাটা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই দেবাংশু দিয়ারার ঘাড়ে এক হাত রেখে, ও’কে নিজের দিকে টেনে ওর ঠোঁটজোড়ায় নিজের ঠোঁটজোড়া চেপে ধরে। বিস্ময় কাটিয়ে দিয়ারার ঠোঁটজোড়ার মাঝে ব্যবধান সৃষ্টি হলেই দেবাংশু নিজের মতো করে আধিপত্য ফলানো শুরু করে। কারণ দেবাংশু জানে, এই মানুষটা শুধু ওর নিজের। ওর নিজের সম্পদ! যার উপর শুধু ওর অধিকার। অন্যদিকে ঠিক তেমন ভাবেই দিয়ারা এই আধিপত্য ফলানো উপভোগ করতে থাকে আবেশে, সে চায় না কোনো বাঁধা দিতে। এই একটা মানুষকেই সে সারাজীবন উপভোগ করতে চায়, তাঁর ভালোবাসা উপলব্ধি করতে চায় নিজের শরীরে। কিছু সময় কেটে গেলে দিয়ারা নিজেও সাড়া দেওয়া শুরু করে।
পরেরদিন সকালে,
সিয়ারা দুরুদুরু বুকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে আধভিকের কেবিনের দিকে। এই কয়েকদিন কাজের চাপে, দিয়ারা আর দেবাংশুর বিষয়টা ভাবতে গিয়ে, ওদের সময় দিতে গিয়ে আধভিককে একদমই সময় দেওয়া হয়নি। আর অবাক বিষয় সেই প্রথমদিনের পর আধভিকও আর কোনো অভিযোগ করেনি সিয়ারার কাছে। তবে নিজের দিক থেকে কোনো খামতিও রাখেনি। রোজকর মতো সময় অনুযায়ী ফোন করে খোঁজ নিয়েছে। সিয়ারার নিজেরই খারাপ লাগছে এইসব কথা ভেবে। ছেলেটা কখনও নিজের দিক থেকে কোনো ত্রুটি রাখে না, নিজের সর্বস্ব দিয়ে দেয় আর ও? শুধু কষ্ট দেয় আধভিককে। এই কথাটা ভেবে ভেবেই সারারাত ঠিকভাবে ঘুমাতে পারেনি সিয়ারা। বারবার আধভিকের কথা মনে পরছিলো, ওর কাছে আসতে মন চাইছিলো। তাই তো সকাল হতে না হতেই ছুটে চলে এসেছে তবে এখন ভাবছে কোন মুখে সামনে যাবে?
বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে আধভিকের কেবিনে ঢুকে পরলো সিয়ারা। ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে সামনে ফিরতে দেখলো আধভিক মন দিয়ে নিজের ডেস্কে হেলান দিয়ে, এক হাত পকেটে গুঁজে আরেক হাতে ফাইল দেখছে।
সিয়ারা: (মনে মনে — ডাকবো? হয়তো কাজে ব্যস্ত আছে। একবার তাকালো পর্যন্ত না আমার দিকে। চলে যাবো? তাই যাই বরং, এখন আর ডিস্টার্ব করবো না।)
সিয়ারা যেতে গিয়েও যেতে পারলো না। ওর মন মানছে না কিছুতেই। ও আধভিকের কাছে যেতে চায়, ওর অভিমান ভাঙাতে চায়। তাই আর না ভেবে ধীর পায় এগিয়ে যায় আধভিকের দিকে। আধভিকের সামনে গিয়ে কিছু বলার আগেই সিয়ারাকে অবাক করে দিয়ে আধভিক ফাইলে চোখ রেখেই ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় যা দেখে সিয়ারার চোখ ছলছল করে ওঠে। সিয়ারা আধভিকের হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে ছলছল চোখে মুখে হাসি নিয়ে আর দেরী না করে আধভিকের বুকের মাঝে চলে যায়। আধভিক এক হাতে সিয়ারাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে যখন টের পায় সিয়ারা দুহাত দিয়ে শক্ত করে ও’কে জড়িয়ে ধরেছে। সিয়ারার মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ে আবারও ফাইলে মন দেয় আধভিক।
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে🥀]
সব কিছু স্বচ্ছ করার জন্যেই আজকের এই পর্ব, এতটা বিশ্লেষন। আশা করছি আর কোনো প্রশ্ন বা দ্বন্দ্ব নেই আপনাদের। থাকলে জানাবেন, আমি নিশ্চয়ই ক্লিয়ার করার চেষ্টা করবো। ধন্যবাদ।❤️’ কথা দিলাম ‘ 🌸❤️
||পর্ব ~ ৫৫||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
আধভিক: তারপর? বোনের কথা ভাবা শেষ করে, আমার কথা ভাবার সময় হলো ম্যাডামের? অবশ্য শুধু বোন তো না, বন্ধু, নতুন বন্ধু, কাজ সব কিছু ভাবার পর আর কি! (টিজ করে)
সিয়ারা: আভি প্লিজ, এভাবে বলো না। আমি সত্যি কনট্যাক্ট করতে চেয়েছিলাম তোমার সাথে কিন্তু কাজের চাপে আর হয়ে ওঠেনি। (আধভিকের দিকে তাকিয়ে অসহায় মুখ করে)
আধভিক: (ফাইলের দিকে তাকিয়ে) হম, বুঝতে পেরেছি। তাহলে? এখন বলো আমাকে কি প্রয়োজন? কোন কাজে আসতে পারি আমি তোমার?
সিয়ারা: তোমার মনে হয় আমি প্রয়োজনে এসেছি তোমার কাছে? (ছলছল চোখে, কাঁপা গলায়)
আধভিক এতক্ষণ ফাইলের দিকে তাকিয়েই কথা বলছিলো স্বাভাবিক ভাবে। সিয়ারার প্রশ্ন শুনে আধভিক সিয়ারার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
আধভিক: ওহ মাই ব্যাড! তোমার তো আমাকে প্রয়োজন নেই কোনো কিছুতেই। আমার সাহায্য ছাড়াই তুমি সব কিছু করতে পারো। আমাকে জানানোর কি বা দরকার যখন নিজেই সব পারো। আই গট ইট! (আবারও ফাইলের দিকে তাকালো)
সিয়ারা বেচারি ভাবছে বলবে তো কি বলবে। সত্যিই তাঁর ভুল, সে একবারও আধভিককে কল ব্যাক করেনি এই কয়েকদিনে। কাজের প্রেসার ছিলো ঠিক কিন্তু একটা মেসেজ বা কল তো করাই যেতো। আধভিক যতটুকু করতো ততটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিলো ওদের কথা বলাটা তাও কিছুক্ষণের জন্য। আধভিকের অভিমান হওয়াটা স্বাভাবিক। নিজের শত কাজের মাঝেও আধভিক ঠিক সিয়ারার খোঁজ নিয়েছে। যখন সিয়ারা ফোন ধরেছে কোনো অভিযোগ রকম অভিযোগ করেনি। হয়তো চাইনি ওইটুকু কথা বলাটাও নষ্ট হোক, কারণ সিয়ারা তো আর কল ব্যাকও করতো না। এটা ভেবেই সিয়ারার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো।
আধভিক একটু অবাক হয়ে গেলো সিয়ারাকে কাঁদতে দেখে। নিজের ফাইলটা এইবার রেখে সিয়ারাকে দু হাত দিয়ে কোমর জড়িয়ে নিজের কাছে টেনে জিজ্ঞেস করলো,
আধভিক: সিয়ু কাঁদছো কেন? ইটস ওকে। আমি জাস্ট টিজ করছিলাম তোমাকে। জ্বালাতন করার চেষ্টা করছিলাম কথার দ্বারা।
সিয়ারা: আ’ম স্যরি! আমার উচিত ছিল তোমাকে এটলিস্ট মেসেজ করা।
সিয়ারা এটুকু বলেই ফুঁপিয়ে উঠলো আর আধভিক সিয়ারার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরলো। তারপর ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
আধভিক: ইটস ওকে মাই লাভ। তুমি ফার্স্ট টাইম কাজে প্রেসার ফেস করছো তাই হয়েছে। আমিও যখন ফার্স্ট টাইম প্রেসারে পরে ছিলাম খাওয়া দাওয়া ভুলে গেছিলাম। প্রথম বার এরকম হয় জান। আমি কিচ্ছু মনে করিনি।
সিয়ারা: সত্যি? (আধভিকের দিকে তাকিয়ে)
আধভিক: (নাক টেনে) সত্যি। এই যে তুমি নিজে আমার কাছে এসেছো এতেই আমি খুশি। যাই হোক, আমাকে পুরোপুরি ভুলে তো আর যাওনি..(আবারও টিজ করে)
সিয়ারা: তোমাকে তো আমি..(আধভিকের বাহুতে মেরে)..তুমি খুব খুব খুব বাজে।
আধভিক: আরে লাগছে তো! কি করলাম আমি?
সিয়ারা: (আধভিকের কলার ধরে) তুমি জানো না তুমি আমার কাছে কতোটা ইম্পর্ট্যান্ট? মানছি একটা ভুল হয়ে গেছে তার মানে এই না যে আমি তোমাকে ভুলে যাবো। ভুলে যাওয়ার হলে আগেই ভুলে যেতে…
আধভিক: (ঠোঁটে আঙুল রেখে) শশশ! আগের কোনো কথা শুনতে চাই না আমি এখন। কোনো সময় নষ্ট না করে এখন আমার ক্ষতিপূরণ চাই।
সিয়ারা: ক্ষতিপূরণ? কিসের ক্ষতিপূরণ? (অবাক হয়ে)
আধভিক: এই যে, এই কয়েকদিন আমার সাথে কথা না বলা, দেখা না করা, আমার কাছে না এসে আমাকে অপেক্ষা করানোর ক্ষতিপূরণ। সাথে শাস্তিও পাবে এর জন্য, কারণ তোমার আইডিয়া নেই আমার কতটা একা লাগছিলো এই কয়েকদিন। এইটার জন্য আমাকে কত কষ্ট পেতে হয়েছে জানো? এইটার শাস্তি তো পেতেই হবে তোমায়।
সিয়ারা মুখটা কাচুমাচু করে ফেলে। তারপর একটা ঢোঁক গিলে বলে,
সিয়ারা: কি, কি শাস্তি?
আধভিক কোনো কথা না বলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সিয়ারার দিকে। ওর চোখের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ঠোঁটের দিকে দৃষ্টি যেতেই সিয়ারা বুঝে যায় আধভিক কি বলতে চায়। সিয়ারা দৃষ্টি সরে যেতে চাইলেও আধভিক যেতে দেয় না। সিয়ারা বাধ্য হয়ে আধভিকের দিকে আবার তাকালে আধভিক সিয়ারার চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিলো।
আধভিক: তোমার অনিচ্ছায় আমি কিছুই করবো না লাভ। তোমাকে আমি শাস্তি দেবো ভাবলে কীভাবে?
কথাটুকু বলে আধভিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সিয়ারার দিকে তারপর সরে যেতে নেয় কিন্তু সেই মুহুর্তে ওর শার্টে সিয়ারার শক্ত করে ধরে রাখা হাত ওকে বাঁধা দেয়। আধভিক সিয়ারার চিবুকে হাত দিয়ে মুখটা উঁচু করে সিয়ারার মুখটা ভালোভাবে দেখে নেয়। সিয়ারার বন্ধ থাকা চোখের কাঁপুনি, তিরতির করে কাঁপা ঠোঁট এবং কয়েকদিনের অভাব! আধভিককে নিয়ন্ত্রণ ছাড়া করে দিচ্ছে। গভীর ভাবে ঠোঁট ছোঁয়ায় সিয়ারার ঠোঁটে। কিছুক্ষণ স্থিরভাবে থাকার পর সিয়ারার ঠোঁটের মাঝে ব্যবধান সৃষ্টি হলেই আধভিক ধীরে ধীরে সিয়ারার ঠোঁট আকড়ে ধরে। সিয়ারাও জানো এটার অপেক্ষাতেই ছিলো। কাজের চাপে আধভিকের সাথে কথা না বলে থাকলেও ও’কে মিস করেনি তা নয়। আধভিকের ভালোবাসার অভাব সিয়ারা প্রত্যেকটা মুহুর্তে মনে করেছে। তাই বাঁধা দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।
অন্যদিকে,
দিয়ারার ঘুমটা হঠাৎ করে ভেঙে গেলে সে চোখ খুলে, চোখটা আশে পাশে বুলিয়ে নিয়ে আবার চোখটা বন্ধ করে ফেলে। একটু ধাতস্থ হয়েই তড়াক করে উঠে বসে।
দিয়ারা: আমি এখানে কি করছি?
__দিদি, কালকে রাতে দেবাংশু দাদাবাবু তোমাকে দিয়ে গেছে। তুমি ঘুমিয়ে ছিলে তাই উনি তোমাকে কোলে করে নিয়ে এসেছিলেন আর আমাকেও ডাকতে না করেছিলেন। অনেকক্ষণ ছিলেন বেশ আপনার সাথে, তারপর চলে গেছেন।
দিয়ারা গতরাতের কথা ভেবে লাজুক হাসলো কিন্তু সামনে ওর পি.এ. আছে বলে ও সাথে সাথে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলে,
দিয়ারা: ঠিক আছে তুই এখন যা।
মেয়েটি হাল্কা হেসে চলে গেলে দিয়ারা পাশ থেকে নিজের টেডি বিয়ার জরিয়ে ধরে টেডি বিয়ারে মুখ গুঁজে হাসতে লাগলো।
ফ্ল্যাশব্যাক……………………………………
দিয়ারার ঘুমটা ভাঙতেই ও নিজের কোলে ভার অনুভব করলো। সোজা হয়ে উঠে বসে দেখলো দেবাংশু নিশ্চিন্তে ওর কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। দিয়ারা হাসে দেবাংশুকে দেখে।
দিয়ারা: থাক ডাকবো না, এই কদিন যে ঠিকভাবে ঘুমাতে পারেনি সেটা তো মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। আব…রাত হয়ে এসেছে, খায়ও তো নি কিছু। এই কয়েকদিন ওইসব ছাড়া আর কিছু পেটে ঠিকভাবে পরেছে কি না কে জানে।
দিয়ারা সাবধানে দেবাংশুর মাথাটা তুলে একটা বালিশে রাখলো আর ওর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। রান্নাঘরে আসতেই একটা মেয়ে বললো,
__ম্যাম আমি রান্না করে দিয়েছি স্যারের জন্য। স্যারের কেয়ারটেকার আমাকে বলে গেছেন স্যারের খাবার করে দেওয়ার জন্য।
দিয়ারা: আচ্ছা, তুমি কি সুপ করেছো?
__না। করে দেবো?
দিয়ারা: না না ঠিক আছে। তুমি যাও গিয়ে শুয়ে পরো অনেক রাত হয়েছে।
__ম্যাম আমি এখানে থাকবো না, সামনেই বাড়ি আমার।
দিয়ারা: তাহলে তো এক্ষুনি বেরিয়ে পরো। আমি কি এগিয়ে দিয়ে আসবো?
__না না তার দরকার নেই।
দিয়ারা: আলবাত দরকার আছে। তুমি আমাদের জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলে নিশ্চয়? চলো আমি এগিয়ে দিচ্ছি।
দিয়ারা মেয়েটাকে নিয়ে এগোতে শুরু করলো আর ও’কে বুঝিয়ে দিলো কখন কখন এসে রান্না করে দিয়ে যেতে হবে। রান্নাটা করে দিয়েই জানো চলে যায় রাতে, এতক্ষণ থাকার প্রয়োজন নেই। গেটে পৌঁছাতেই মেয়েটি দেখলো তাঁর দাদা দাঁড়িয়ে আছে।
__ম্যাম আমার দাদা এসেছেন আমাকে নিতে। আর যাওয়ার দরকার নেই।
দিয়ারা: আচ্ছা। (হেসে)
মেয়েটি চলে গেলে সিকিউরিটি গার্ড দিয়ারার দিকে এগিয়ে আসলে দিয়ারা একটু নার্ভাস ফীল করতে লাগে। কিন্তু সিকিউরিটি গার্ডকেই ইতস্তত বোধ করতে দেখে দিয়ারা নিজেই জিজ্ঞেস করে,
দিয়ারা: কিছু বলবেন?
__না মানে, আপনি কি সিয়ামার বোন?
দিয়ারা: হ্যাঁ। তাই আপনি আমাকে তুমি বলতে পারেন। আপনি বলার প্রয়োজন নেই। (হেসে)
__(হেসে) দেব বাবা ঠিক আছে এখন? এই কয়েকদিন ধরে ওকে এমন দেখছি যাতে আমরা অভ্যস্ত নই তো তাই আর কি!
দিয়ারা: ঠিক আছে আপনাদের দেব বাবা। ঘুমাচ্ছে এখন। আর চিন্তা করতে হবে, আপনারা যেই দেব বাবাকে দেখে অভ্যস্ত এইবার থেকে আবার তেমনই দেখতে পাবেন। আমি আসি?
__হ্যাঁ মা, তবে তুমি বাড়ি যাবে না? রাত হলো তো?
দিয়ারা: হ্যাঁ যাবো তো। আগে ও’কে একটু কিছু খাইয়ে দি, তারপর চলে যাবো। আমি গাড়ি এনেছি অসুবিধা হবে না।
__আচ্ছা। দেখে ভালো লাগছে যে কেউ একজন তো এলো যে আমাদের দেব বাবাকে সামলাতে পারে। জানো? দেব বাবা এই বাড়িতে তখনই আসে যখন ওর মন খারাপ থাকে বা রেগে থাকে। অনেকদিন পর এসেছে এই বাড়িতে আর যেভাবে এসেছিলো তাতে সেদিন সত্যি আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। কিন্তু তুমি যাওয়ার পর পরিবেশ শান্ত দেখে একটু স্বস্তি পেয়েছিলাম। নাহলে তো ঘরের জিনিস পত্র আবার কিনে আনতে হতো।
দিয়ারা হেসে উঠলো ওনার কথা শুনে। তারপর ওনাকে জানিয়ে ভিতরে চলে গেলো আর রান্নাঘরে গিয়ে একটু সুপ বানাতে শুরু করলো।
অন্যদিকে,
দেবাংশুর ঘুমটা ভাঙতেই দেবাংশু আশে পাশে তাকিয়ে দিয়ারাকে খুঁজতে লাগলো। চোখটা ঘড়ির দিকে যেতেই দেবাংশু ভাবলো,
দেবাংশু: ওহ শিট! দশটা বেজে গেছে? দিয়ু মনে হয় বাড়ি চলে গেছে। একা একা চলে গেলো? শিট! আমার উঠে যাওয়া উচিত ছিলো। আমার ফোনটা..??
দেবাংশু নিজের ফোনটা খুঁজতে গিয়ে মনে পরলো ফোনটা ড্রয়িং রুমে আছে। দেবাংশু উঠে নীচে চলে গেলো আর ড্রয়িং রুমে ফোনটা টেবিল থেকে নিতে গিয়েই রান্নাঘর থেকে আওয়াজ শুনতে পেলো।
দেবাংশু: কাকা যাঁকে রান্নার জন্য রাখবে বলেছিলো সে এখন রান্না করছে? যায়নি এখনও?
দেবাংশু রান্নাঘরের সামনে যেতেই দেখলো দিয়ারা মন দিয়ে রান্না করছে। প্রথমে হাসি ফুটে উঠলেও পরে কিছু একটা মনে পরতেই ওর হাসিটা মলিন হয়ে গেলো। তৎক্ষণাৎ নিজের মাথা থেকে চিন্তা গুলো ঝেড়ে ফেলে বললো,
দেবাংশু: হঠাৎ আমার রান্নাঘর নষ্ট করার মানেটা বুঝলাম না তো?
দিয়ারা: একদম আজে বাজে কথা বলবে না বলে দিলাম। আমি মোটেও রান্নাঘর নষ্ট করছি না। হুহ! (তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে)
দেবাংশু: (দু হাত ভাঁজ করে) সে কি? ছোটোবেলায় তো দেখেছি রান্নাঘরে ঢুকে ময়দা মেখে ভুত হতিস। এখন অবশ্য কেনা ময়দা মাখিস। যাক গে, একবার তো তোর পিছু পিছু ঢুকায় ছুরি নিয়ে আমার গলা…এই এই কি করছিস! (ভয় পেয়ে মাথা পিছনে সরিয়ে নিয়ে)
দিয়ারা: ছোটোবেলায় গলাটা কাটিনি ভয় দেখিয়েছি, এখন আমি তোমার গলা কেটে দিতে পারি। একটা আজে বাজে কথা বলেছো তো দেখবে নাক, কান, গলা সব কেটে দেবো।
দেবাংশু: আমি কি কোনো বাজে কথা বলতে পারি তোকে? আমি ম..মজা করছিলাম।
দিয়ারা: ম..মজা এমন করা উচিত যাতে সাজা না পেতে হয়। হুহ! (দিয়ারা আবার রান্নায় মন দিলো)
দিয়ারা ঘুরে যেতে দেবাংশু বুকে হাত দিয়ে এমন একটা ভাব করলো জানো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সেটা আড় চোখে দেখে হাসলো দিয়ারা। দেবাংশুর মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি এলো। ও দিয়ারার পিছনে গিয়ে, পিছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বললো,
দেবাংশু: আমার নাক, কান, গলা কেটে দিবি মানলাম, বাট তারপর “সব” বলার মানে টা কি? হোয়াট ডু ইউ মিন বাই সব? হম? (বাঁকা হেসে)
দিয়ারা কথাটা একটু ভালো ভাবে ভাবতেই চোখ বড়ো বড়ো করে ফেললো। রেগে দেবাংশুর দিকে তাকাতেই দেখলো দেবাংশু ঠোঁট চেপে হাসছে।
দিয়ারা: তুমি কি সত্যিই চাইছো আমি তোমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ভাসিয়ে দি? তখন তোমার ইচ্ছা মত পিস করবো তোমার। ছাড়ো আমায়! লজ্জা বলে কিছুই নেই। (বিড়বিড় করে)
দেবাংশু: মডেলদের আবার লজ্জাও থাকে? উপস! স্যরি! হবে না আর।
দিয়ারা: এই তুমি যাবে? আমি কিন্তু..
দেবাংশু: সাবধানে! (দিয়ারার হাতটা ধরে)
দিয়ারা দেবাংশুর সাথে কথা বলতে বলতে ছুরি দিয়ে চিকেন পিস করছিলো। আরেকটু হলেই হাতটা কেটে যেতো যা দেবাংশু দেখে আটকে দেয়। এই ঘটনার পর দেবাংশু চুপ করে দিয়ারাকে শুধু পিছন থেকে হালকা করে জড়িয়ে ধরে থাকে। দিয়ারার সুপ তৈরির জন্য চিকেনটা দিয়ে দিতেই দেবাংশু শান্ত স্বরে আবার বলে উঠলো,
দেবাংশু: ইউ নো? আমি ছোটোবেলায় একবার মা কে রান্না করতে দেখেছি। একদিন মায়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, “আমার জন্য রান্না করেছো?” মা উত্তরে বলেছিলো…
দিয়ারা: কি বলেছিলো?
দেবাংশু: “কে তুই যে তোর জন্য আমি রান্না করবো? সরে যা এখান থেকে একদম।” তারপর থেকে ভুলেও কখনও রান্নাঘরে আসতাম না মা রান্নাঘরে থাকলে। না কখনও কাওকে বলতাম যে আমার জন্য রান্না করে দিতে।
দিয়ারা: (দেবাংশুর গালে ঠোঁট ছুঁয়ে) তুমি চাইলে আমি তোমার জন্য রোজ রান্না করতে পারি।
দেবাংশু এক গালে হেসে দিয়ারার কপালে কপাল ঠেকিয়ে রাখে। কিছুক্ষণ পর বলে,
দেবাংশু: সে ঠিক আছে, কিন্তু সেটা খাওয়া যাবে তো?
দিয়ারা: হও, তোমাকে তো আমি..!!
দেবাংশু বেরিয়ে এসে ড্রয়িং রুমে চলে আসে হাসতে হাসতে। দিয়ারা একটা নিশ্বাস ফেলে, হেসে ফেলে। তারপর মনে মনে ভাবে, কি করে নিজের মা এমন ব্যবহার করতে পারে নিজের ছেলের সাথে? এমন ব্যবহার হয়তো সৎ মায়ের থেকে প্রাপ্য কিন্তু নিজের ছেলের সাথে?
দিয়ারা আর না ভেবে সুপটা নামিয়ে ফেলে। তারপর ওর মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। ও একটা চামচে করে সুপ নিয়ে দেবাংশুর দিকে এগিয়ে যায় আর গিয়ে বলে,
দিয়ারা: এই, দেখো তো টেস্ট করে কিছু লাগবে নাকি আর?
দেবাংশু সম্মতি দিলে দিয়ারা সুপটা খাইয়ে দেয় দেবাংশুকে। দেবাংশু সুপটা মুখে নিতেই ওর মুখভঙ্গি পাল্টে যায়। কোনো মতে সুপটা গিলে নিয়ে দিয়ারার দিকে তাকালে ও দেবাংশুকে জিজ্ঞেস করে,
দিয়ারা: সব ঠিক আছে? নাকি কিছু লাগবে?
দেবাংশু: (গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে? না, সব ঠিক আছে। কিছু লাগবে না। খুব ভালো হয়েছে।
দিয়ারা: (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) ঠিক আছে তাহলে আমি নিয়ে আসছি।
দিয়ারা সুপ আনতে চলে গেলে দেবাংশু মুখ বেজার করে বসে থাকে কিছু বলে না। একটা ঢোঁক গেলে এটা ভেবে যে এখন পুরো এক বাটি সুপ ও’কে শেষ করতে হবে।
দিয়ারা: এই নাও। তাড়াতাড়ি শুরু করো, এই কয়দিন ঠিকভাবে কিছুই খাওয়া হয়নি ওইসব ছাড়া।
দেবাংশু: হ্যাঁ? হ্যাঁ হ্যাঁ। খাচ্ছি। (একটা ঢোঁক গিলে)
দেবাংশু আর কথা না বাড়িয়ে সুপের বাটিটা হাতে নিয়ে, বুক ভরা নিশ্বাস নেয়। তারপর সুপটা এক চামচ খায়। হঠাৎ ওর টেস্টটা চেঞ্জ লাগে। তাই আরেকবার সুপটা খায় কিন্তু এইবার আর চোখ বন্ধ করে না। দেবাংশু আবারও সুপটা খেয়ে দিয়ারার দিকে তাকাতেই হো হো করে হেসে ফেলে দিয়ারা।
দেবাংশু: তুই ইচ্ছা করে টেস্ট করাতে যখন এনেছিলি তখন লবণ মিশিয়ে এনেছিলি তাই না? (চোখ সরু করে)
দিয়ারা প্রতি উত্তরে হাসতে থাকে। দিয়ারার হাসি দেখে দেবাংশুও হালকা হেসে ফেলে। দিয়ারার চোখ যায় টেবিলের উপর। টেবিলের উপর কিছু ছবি পরে আছে, যেগুলো ওর।
দিয়ারা নিজের সুপের বাটিটা রেখে ওই ছবিগুলো হাত তুলে নিলো। দেবাংশু তা দেখে নিজের হাতের বাটিটা রেখে পাশ থেকেই দু হাত দিয়ে দিয়ারাকে জড়িয়ে ধরে দিয়ারার ঘাড়ে মুখ গুঁজে দেয়।
দিয়ারা: তুমি দার্জিলিংয়ে গিয়ে এই ছবিগুলো তুলেছিলে? কখন? আমি তো টের পাইনি।
দেবাংশু: যখন তুমি পাহাড় দেখতে ব্যস্ত ছিলে, আমি তখন তোমাকে দেখতে ব্যস্ত ছিলাম। (স্লো ভয়েসে)
দিয়ারার শরীর শক্ত হয়ে যায় দেবাংশুর কথা শুনে। প্রতি উত্তরে দিয়ারা শুধু লাজুক হাসে আর ছবিগুলো দেখতে থাকে। খাওয়া হয়ে গেলে দিয়ারা দেবাংশুকে বলে টেবিলে রাতের খাবার দেওয়া আছে জানো খেয়ে নেয়। তারপর দিয়ারা বেরিয়ে যেতে নিলেই দেবাংশু বলে সে যাবে তাঁকে পৌঁছে দিতে। দিয়ারা আর কথা না বাড়ালে ওরা দুজন বেরিয়ে পরে। রাস্তায়, গাড়িতেই দিয়ারা ঘুমিয়ে পড়ে। তাই দেবাংশু দিয়ারাকে না ডেকে কোলে তুলে নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে যায়। ঘরে নিয়ে শুয়ে দেওয়ার পর দিয়ারার কাছে থেকে সরে আসতে চাইলে দিয়ারা দেবাংশহর কলার শক্ত করে ধরে থাকে। যার কারণে দেবাংশু পিএ-র দিকে তাকালে পি এ সরে যায় ওখান থেকে। দেবাংশু হেসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর আস্তে আস্তে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যায় ওখান থেকে।
ফ্ল্যাশব্যাক এন্ড………………………………..
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে🥀]
আমার পরীক্ষা চলছে তাই জন্যেই দেরী হচ্ছে। বুধবারের পর থেকে আবার যেমন একদিন পর পর দিচ্ছিলাম তেমনই দেবো।