কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে পর্ব -১৭

কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৬.
নৈঋতা আর নসিবকে নিয়ে রৌদ্রুপ যখন বাড়ি ফিরল, তখন সকাল সাড়ে ছয়টা। লা’শের খাটিয়ার পাশেই শাহানা খানম অশ্রুসিক্ত চোখে পাথুরে মূর্তির ন্যায় ঠাঁয় বসে আছেন, যেন আশপাশের কোনো খেয়াল তার নেই। শশী বিলাপ করছে। সরফরাজ চৌধুরীর লা’শের ওপর আছড়ে পড়ে গুনগুনিয়ে কেঁদে চলেছে একটি অপরিচিতা মেয়ে। মেয়েটির মুখ দেখা যাচ্ছে না। চারপাশে ‘রৌদ্র এসেছে’ গুঞ্জন কানে আসতেই মেয়েটি মুখ তুলল। ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে ঘুরে দাঁড়াল। সরাসরি তাকাল রৌদ্রুপের দিকে। চোখাচোখি হতেই রৌদ্রুপ এক মুহুর্ত দেরি না করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। কিন্তু মেয়েটি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল। পুরো ব্যাপারটা নৈঋতার দৃষ্টিগোচর হলো। সাদা থ্রি-পিস পরিহিতা মেয়েটি নিঃসন্দেহে একটু বেশিই সুন্দরী। কান্নার কারণে তার ফরসা মুখটা গোলাপী বর্ণ ধারণ করেছে। রৌদ্রুপ নৈঋতাকে নিয়ে এগিয়ে গেল সরফরাজ চৌধুরীর লা’শের খাটিয়ার কাছে। এতক্ষণে অপরিচিতা মেয়েটি নৈঋতাকে খেয়াল করল। ঝাপসা চোখে দেখল নৈঋতা কাঁদছে, আর রৌদ্রুপ তাকে একহাতে আগলে রেখেছে। তারপর আর কিছু মনে নেই মেয়েটার। ওখানেই মূর্ছা গেছে সে। জ্ঞান ফিরলে সে নিজেকে সেই অতি পরিচিত ঘরটায় দেখতে পেল। সেই ঘর, সেই বিছানা, সেই বালিশ। মেয়েকে চোখ খুলতে দেখে শিয়রের পাশে বসে থাকা শাড়ি পরিহিতা অর্ধ বয়স্ক মহিলা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ঝুঁকে পড়ে ডাকলেন,
“শ্রাবণী? এখন কেমন লাগছে, মা? শরীর খারাপ লাগছে?”
শ্রাবণী মাথা দুলিয়ে ‘না’ জানাল। মায়ের সাহায্যে উঠে বসে সারা ঘরে আরও একবার চোখ বুলাল। ভাঙা গলায় শুধাল,
“কয়টা বাজে, আম্মু?”
“সাড়ে সাতটা। তুই বোস, আমি একটু খাবার নিয়ে আসি। কাল থেকে না খেয়ে আছিস।”
“তুমিও তো খাওনি। তোমার ভাইয়ের জন্য তোমার দুঃখ লাগে, আমার মামার জন্য কি আমার দুঃখ লাগে না? সে আমার দ্বিতীয় বাবা ছিল। আমি তার মেয়ের থেকে কম ছিলাম না, মা। আমি তাকে শেষ একবার ডাকতেও পারলাম না।”
বলতে-বলতেই শ্রাবণী আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আলেয়া বেগমও চোখের পানি ফেললেন। বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়িয়ে বললেন,
“এখন আর বাইরে যাস না। এক্ষুনি আসছি আমি।”
শ্রাবণী কান্নার মাঝপথেই তাচ্ছিল্য হাসল। বলল,
“চিন্তা কোরো না, আম্মু। যে মায়া ত্যাগ করে আজও বেঁচে আছি, তা আর ফিরে পাওয়ার বিন্দুমাত্র আশা আমার নেই। দেখলে তো সে কতটা ভালো আছে। সে পারলে আমি কেন পারব না?”
আলেয়া বেগম মাথা নিচু করে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে-মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মায়ের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে শ্রাবণী পুনর্বার হাসল। সে জানে, তার কথা শুনতে চায়নি বলেই পালিয়ে গেছে মা। সকাল দশটায় সরফরাজ চৌধুরীর জা’নাজা অনুষ্ঠিত হলো। লা’শের খাটিয়া কাঁধে তোলার সময় আর বাবাকে ক’বরে শোয়ানোর সময় রৌদ্রুপ খুব করে এক শূন্যতা অনুভব করল। বাবার সাথে-সাথে বড়ো ভাইটার শূন্যতা। বাবার বড়ো ছেলেটা জানলও না সে পিতৃহীন হয়ে গেছে। তার বাবা তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ এই একই সময়ে সে হাসপাতালের বেডে শুয়ে ছটফট করছে। মনটা ভীষণ আঁকুপাঁকু করছে তার। কোনোভাবেই শান্ত হচ্ছে না। বারবার নিদ্রাকে প্রশ্ন করে চলেছে, বাকিরা তার কাছে আসছে না কেন। স্বামীর অবস্থা দেখে নিদ্রার কাছে চোখের পানি আড়াল করাও কষ্টকর হয়ে পড়েছে। শ্বশুরের শেষ মুহূর্তেও সে বাড়ি ফিরতে পারেনি। তবু সে তিহানকে মিথ্যে বুঝাচ্ছে, “বাকিরা বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। বাবা
অল্পতেই বেঁচে গেছেন। রৌদ্রুপ আবার আসবে।”
এই খাপছাড়া উত্তর কেন জানি তিহানের বিশ্বাস হচ্ছে না। তার মন বলছে, কিছু একটা খারাপ হয়েছে, যা তার কাছে লুকানো হচ্ছে। নিদ্রার কাছে সন্তোষজনক জবাব না পেয়ে তিহান রৌদ্রুপের আসার অপেক্ষায় আছে। রৌদ্র নিশ্চয়ই তাকে মিথ্যে বলবে না। রৌদ্রুপ এল সন্ধ্যায়। কিন্তু সে এসেই ডাক্তারের সাথে কথা বলতে চলে গেল। তিহান তখন ঘুমে। নিদ্রার কাছে ভাইয়ের অস্থিরতার কথা শুনে রৌদ্রুপের বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে গেল। ভাই তার অপেক্ষায় আছে জেনেও সে ভাইকে জাগিয়ে তুলল না। ওই কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারবে না সে। তাইতো দরজার কাছ থেকেই ভাইয়ের ঘুমন্ত মুখটা দেখে দ্রুত সরে পড়েছে। তিহানের পায়ের অবস্থা খুব বেশি ভালো না। তাকে আরও কদিন হসপিটালে থাকতে হবে। রৌদ্রুপ নিদ্রাকে বলে দিলো সে যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ তিহানকে না জাগাতে।

রৌদ্রুপ বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় নৈঋতাকে ঘরে বসিয়ে রেখে বলে গেছে, সে যেন বাইরে বেশি ঘুরঘুর না করে। আত্মীয়-স্বজন সবার কৌতূহল তার দিকে। তাদের আদরের রৌদ্র একা বিয়ে করেছে বলে কেউই তেমন সন্তুষ্ট ছিল না। নৈঋতাকে দেখে কেউ রূপের প্রশংসা করেছে। আবার কেউবা মুখের ওপর বলে দিয়েছে, ‘রৌদ্র খাঁটি সোনা চিনল না। শেষে কি না তামা কুড়িয়ে আনল!’ নৈঋতা অবশ্য চুপ থেকে সবার কথা শুনেছে। এসে হতে শশী বা শাহানা খানম তার সাথে একটা কথাও বলেননি। সে যেচে পড়ে কাছে গিয়ে বসেছিল বেশ কয়েকবার। দূরেও ঠেলে দেয়নি কেউ। ইতোমধ্যে নিজের পরিবার নিয়ে হাজারটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে নৈঋতাকে। এ কারণেই রৌদ্রুপ তাকে বাইরে বেরোতে বারণ করে গেছে। একা-একা নৈঋতা খুব বিরক্ত হচ্ছে। নসিবটাও আশেপাশে নেই। বিরক্তিগুলো বিস্ময়ে রূপান্তর করে হুট করেই আগমন ঘটল সকালের সেই অপরিচিতা মেয়েটির। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই সে বলে উঠল,
“কিছু মনে কোরো না। তোমার বর বাইরে গেছে বলে নক না করেই চলে এলাম। ফ্রি আছো? গল্প করতাম আরকি। একা-একা বোর হচ্ছিলাম।”
নিসঙ্কোচ স্বীকারোক্তি। নৈঋতা বিস্ময় চেপে রেখে বলল,
“জি, আসুন না। বসুন।”
মেয়েটা নৈঋতার মুখোমুখি বসে পড়ল। কেমন করে যেন তাকিয়ে রইল নৈঋতার দিকে। নৈঋতা খানিক ইতস্তত বোধ করল। প্রশ্ন করল,
“আপনাকে তো এর আগে কখনও দেখলাম না এ বাড়িতে।”
মেয়েটা উত্তর দিলো,
“দুবছর ধরে আসি না যে। দেখবে কীভাবে?”
“কেন?”
“সেসব তোমার না জানলেও চলবে। যাইহোক, আমি শ্রাবণী। সরফরাজ চৌধুরী আমার মামা।”
নৈঋতা একটু বেশিই অবাক হলো। রৌদ্রুপের কোনো ফুপু আছে বলে তার জানা ছিল না। এতদিন সে জানত রৌদ্রুপের বাবার শুধু ছোটো আরেক ভাই আছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য নৈঋতা প্রশ্ন করল,
“আপন মামা?”
“হ্যাঁ।”
নৈঋতা বিস্ময় চেপে রাখতে পারল না। বলল,
“আমি জানতাম না ওনার কোনো ফুপু আছে।”
শ্রাবণী বোধ হয় প্রসঙ্গ পালটানোর চেষ্টা করল। নৈঋতার মুখটা আলতো ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। রৌদ্র ভাই জিতেছে বলতে হবে।”
নৈঋতা লজ্জায় পড়ে গেল। শ্রাবণী শুধাল,
“তুমি কেমন আছো, নৈঋতা?”
কেমন যেন শোনাল এই প্রশ্নটা। এতক্ষণ বাদে হঠাৎ এমন প্রশ্নে নৈঋতা আরেক দফা অবাক হলো। উত্তর দিলো,
“আলহামদুলিল্লাহ্, ভালো আছি।”
“সবসময় খুব ভালো থেকো, ভালো রেখো। আজকাল সত্যিকারের ভালবাসা দুর্লভ হয়ে গেছে। তুমি সেই দুর্লভ জিনিসটা নিজের করে পেয়েছ। শেষ পর্যন্ত ধরে রেখো। তুমি খুব ভাগ্যবতী। তাইতো রৌদ্র ভাইকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছ। যাকে চেয়েছি, তাকেই পেয়েছি, এমন ভাগ্য সবার হয় না। আমিও চেয়েছিলাম কাউকে, কিন্তু সবার ভাগ্যে তো আর পাওয়া হয়ে ওঠে না।”
শ্রাবণীর এই কয়েক লাইন বাক্য ব্যয়ের মধ্যে নৈঋতা কয়েক হাজার ডেল ব্যথা আঁচ পেল। সরল মনেই জানতে চাইল,
“কেন পাননি?”
“সে চায়নি তাই।”
“আটকে রাখতে চাননি?”
“চেয়েছিলাম, কিন্তু সে আমার ভালোবাসায় আ’ঘা’ত করেছিল।”
“কীভাবে সহ্য করেছিলেন?”
“কাছের মানুষদের আ’ঘা’তগুলো সবসময় অন্তর্ভেদী হয়। তারটাও সেরকমই ছিল। বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আমাকে সহ্য করতে হয়েছিল। প্রথম দিকে ভেঙে পড়েছিলাম, খুব পা’গলামি করেছিলাম। কিন্তু তা কা’টিয়ে উঠতে খুব বেশি সময় লাগেনি।”
“তাকে মনে পড়ে না এখন আর?”
“পড়ে তো, খুব মনে পড়ে। একটা সময় আমি ভাবতাম, প্রেম হচ্ছে ‘আমার তোমাকে চাই’ টাইপ। আর ভালোবাসা হচ্ছে ‘তোমাকে ছাড়া আমার চলবেই না’ টাইপ। আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু এখন তাকে ছাড়াই আমার দিব্যি চলে যাচ্ছে।”
“জীবনটা কি একটা সুযোগ পাওয়ার অধিকার রাখে না? নতুন করে শুরু করতে পারতেন।”
এ পর্যায়ে এসে শ্রাবণী হাসল। কতশত চাপা আর্তনাদ সেই মনকাড়া মুচকি হাসির রেখাটিতে। মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সে বলল,
“জানো তো? ভালোবাসার শুরু থেকেই আমি এক মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলাম। ‘আমি যাকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে ভালোবাসব, কেবল তাতেই আসক্ত থাকব।’ আজও আমি সেই আসক্তি থেকে বেরোতে পারিনি। তবে খুব শীঘ্রই বেরুব। নিজের জন্য নয়, পরিবারের জন্য। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে আমি। আমাকে নিয়ে তাদের হাজারটা স্বপ্ন আছে। একমাত্র মেয়ে হয়ে তাদের স্বপ্ন আমি কীভাবে ভাঙি? আমি জানি তারা কখনও কোনো সিদ্ধান্ত আমার ওপর চাপিয়ে দিবে না। অপেক্ষায় আছে কবে আমি স্বেচ্ছায় সিদ্ধান্ত জানাব। আমি নিজেকে প্রস্তুত করছি। অতীতটাকে হয়তো মুছে ফেলতে পারব না, কিন্তু বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে তো পারব। কোন বাবা-মা চায় তাদের সন্তান খারাপ থাকুক? দেখো, আমিও ভালো থাকব, খুব ভালো থাকব। তাকে ছাড়াই ভালো থাকব।”
নৈঋতা মুগ্ধ হয়ে শ্রাবণীর কথা শুনল। কী সুন্দর করে কথা বলে মেয়েটা! কী মনোরম তার হাসি! বাইরে থেকে দেখলে কে বলবে এই মেয়ের ভেতরটা ভেঙেচুরে একাকার হয়ে আছে? নৈঋতা নিজের মনের কথাটা প্রকাশ করে ফেলল,
“আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন, আপু। ওনার মতো।”
শ্রাবণী ঠোঁট এলিয়ে হাসল। বলল,
“তোমার উনি আমার চেয়েও সুন্দর করে কথা বলেন। তুমিও তার মতো মিষ্টভাষী। যাইহোক, তুমি আমার কথায় কিছু মনে করছ না তো?”
“না।”
“মিষ্টি মেয়ে। তুমি কিছু খেয়েছ?”
নৈঋতা মাথা ঝাঁকাল। উত্তর দিলো,
“উনি বেরোনোর আগে খেয়েছি।”
“উনি দেখছি তোমাকে খুব আগলে রাখে। গুড, এভাবেই ভালোবাসায় থাকো সবসময়।”
নৈঋতার খুব জানতে ইচ্ছে করল, শ্রাবণীর অতীতের সেই মানুষটা কে, যাকে সে আজও এতটা ভালোবাসে? কিন্তু কোনো এক জড়তার কারণে জানা হলো না। মুখ ফসকে বেরিয়ে এল অন্য প্রশ্ন,
“আপনি কেমন আছেন, আপু?”
শ্রাবণী তখন চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে। নৈঋতার প্রশ্ন শুনে কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হেসে বলল,
“আমার তো মনে হয় এই ‘ভালো নেই’ এর পৃথিবীতে আমি একাই বুঝি ভালো আছি। আমাকে রোজ ভালো থাকতে হয়। নিজের জন্য, পরিবারের জন্য। তোমার সংসার জীবনের জন্য শুভ কামনা রইল। পরে আবার কথা হবে। আসছি।”
নৈঋতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই শ্রাবণী দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নৈঋতার কেন জানি মনে হলো শ্রাবণী নিজের চোখের পানি আড়াল করতে একপ্রকার পালিয়ে গেল। চোখের কোণের পানি মুছতে-মুছতে কয়েক পা যেতেই শ্রাবণী থমকে দাঁড়াল। অতি পরিচিত সেই মুখটাও কিছু সময়ের জন্য থমকাল। শ্রাবণীর চোখ দুটো পুনরায় হঠাৎ জ্ব’লে উঠল। কিন্তু সে খুব দ্রুতই নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করল। হাসার চেষ্টা করে বলল,
“পৃথিবীতে কিসের সংখ্যা বেশি, রৌদ্র ভাই? রাগ, অভিমান, হাসি, কান্না, না কি দীর্ঘশ্বাস?”
রৌদ্রুপের স্থির দৃষ্টি তখন তার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির ওপর নিবদ্ধ। শ্রাবণী পরপর দ্বিতীয় তি’রটিও ছুঁ’ড়ে মা’রল,
“কথা বলবে না? ঠিক আছে, বোলো না। বিশ্বাস করো, আগের মতো আজ আর ভালোবাসার দাবি নিয়ে আসিনি আমি। আমি জানি সেই অধিকার আর আমার নেই। তবে আমি আজও বেহায়াই রয়ে গেছি, সেজন্যই মুখ ফিরিয়ে নিতে পারিনি। তোমার বউটা খুব মিষ্টি দেখতে। বুঝলাম, খুব ভালোবাসো বউকে। সবার কপাল তো আর আমার মতো না। তোমার জন্য একটা খুশির খবর আছে। আমি খুব শীঘ্রই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চলেছি। বউকে নিয়ে অবশ্যই আমার বিয়েতে অ্যাটেন্ড করবে। কত এক্সপেক্টেশন তো ধুলায় গড়াল। তোমার থেকে শেষ এটুকুই এক্সপেক্টেশন আমার। রাখা, না রাখা তোমার মর্জি। জোর করার সাধ্য তো আমার কোনোকালেই ছিল না।”
রৌদ্রুপ না চোখ ফিরিয়ে তাকাল, না প্রত্যুত্তর করল। উস-খুস মন নিয়ে সে দ্রুত শ্রাবণীকে পাশ কা’টিয়ে রুমের দিকে এগিয়ে গেল। দরজায় দাঁড়ানো নৈঋতাকেও পাশ কা’টিয়ে সোজা ভেতরে ঢুকে পড়ল। নৈঋতা অবাক চোখে দেখল এতক্ষণ ধরে নিজেকে সামলে রাখা মেয়েটা টলমলে পায়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। তবে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামা আর হলো না। ধপ করে সেখানেই বসে পড়ল। মাথা নিচু করে দুহাতে চুল টেনে ধরে চাপা সুরে হুঁ-হুঁ করে কেঁদে উঠল। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই কোত্থেকে শশী ছুটে এল। শ্রাবণীর কান্না থামানোর চেষ্টায় ব্যস্ত সে। চেঁচিয়ে ফুপুকেও ডাকল। শ্রাবণীর পিঠে অনবরত হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করল,
“কাঁদছ কেন, আপু? রৌদ্র ভাইয়া কিছু বলেছে তোমায়?”
নৈঋতা আলগোছে দরজার কাছ থেকে সরে গেল। দরজা আটকে চুপটি মে’রে বসে রইল খাটের কোণে। রৌদ্রুপ বাথরুম থেকে বেরিয়ে নৈঋতাকে এভাবে বসে থাকতে দেখেও কোনো প্রশ্ন করল না। তোয়ালেতে মুখ মুছতে-মুছতে তিহানের অবস্থার কথা বলতে লাগল। নৈঋতা চুপচাপ সবটা শুনল। গায়ে টি-শার্ট চাপিয়ে রৌদ্রুপ নৈঋতাকে বলল,
“খালামনি নিচে গিয়ে ডিনার করতে বলেছে। চলো।”
নৈঋতা বিনা বাক্যে রৌদ্রুপের সাথে নিচে গেল। শাহানা খানমকে তার বোন একটু খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। তিনি কিছুই মুখে তুলছেন না, একটু পরপরই কাঁদছেন। রৌদ্রুপ আর নৈঋতাকে খাবার দেওয়া হলেও, রৌদ্রুপ নিজের খাবার রেখে মায়ের কাছে গেল। শাহানা খানম ছেলেকে কাছে পেয়েই জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। রৌদ্রুপ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নানান কথা বলে বুঝানোর চেষ্টা করল। নৈঋতা নিজেও কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। রৌদ্রুপ শাহানা খানমের চোখের পানি মুছে দিয়ে খাবার মুখে তোলার জন্য অনুরোধ করল। নৈঋতা রৌদ্রুপের খালামনির থেকে প্লেট চেয়ে এনে ভয়ে-ভয়ে নিচু স্বরে অনুরোধ করল,
“মা, আমি খাইয়ে দিই?”
শাহানা খানম মুখ তুলে তাকিয়ে যেন কিছুটা থমকালেন। তবে কোনো প্রতিক্রিয়া না করে চোখ নামিয়ে নিলেন। নৈঋতা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে পুনরায় বলল,
“এভাবে না খেয়ে থাকলে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। বড়ো ভাইয়া ফিরে এসে বাবাকে পাবে না, তার ওপর আবার আপনাকেও অসুস্থ দেখলে উনি খুব কষ্ট পাবেন। একটু খান না, মা।”
রৌদ্রুপের আত্মীয়-স্বজন কয়েকজন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। নৈঋতার মিষ্টি কথায় কেউ-কেউ সন্তুষ্ট হলেন। শাহানা খানমকে বললেন নৈঋতার অনুরোধ রাখতে। শাহানা খানমকে চুপ মে’রে বসে থাকতে দেখে নৈঋতার মন খারাপ হলো। সে ভাবল শাহানা খানম তাকে পুত্রবধূ মানতে নারাজ বলেই তার হাতে খেতে চাইছেন না। কিন্তু রৌদ্রুপ হঠাৎ তাকে বলল,
“খাইয়ে দাও।”
তার কথায় নৈঋতা সাহস জুগিয়ে এক লোকমা ভাত তুলে শাহানা খানমের মুখের কাছে ধরল। মৃদু স্বরে খেতে অনুরোধ করল। অবচেতন মন জানান দিলো শাহানা খানম কিছুতেই তার হাতে খাবার খাবেন না। কিন্তু তাকেসহ উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে শাহানা খানম নৈঋতার হাতের খাবার মুখে তুললেন। খুশিতে নৈঋতার কান্না পেল। রৌদ্রুপের ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিত হাসি ফুটল। নৈঋতা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে শাহানা খানমকে খাওয়াচ্ছে। শশী এসে এ দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে হা হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সে একবার মায়ের দিকে, আরেকবার নৈঋতার দিকে তাকাচ্ছে। রৌদ্রুপ তাকে কাছে ডেকে খেতে বসতে বলল। শশী যেন মনে-মনে খুব খুশি হলো। কতদিন পর রৌদ্র ভাইয়া তার সাথে আদুরে গলায় কথা বলেছে! শাহানা খানম পুরোটা খাবার খেলেন না। কিছুটা খেয়েই পানি খেয়ে চুপচাপ উঠে চলে গেলেন। রৌদ্রুপ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বড়োরা সামনে থাকায় আজ আর রৌদ্রুপের খাবারের শেষাংশ ভাগ্যে জোটেনি নৈঋতার। কোনোমতে আগেভাগেই খাওয়া সমাপ্ত করে সে ওপরে চলে এসেছে। রৌদ্রুপ এল অনেকটা সময় পর। এসে দেখল নৈঋতা বিপরীত দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। ঘুমায়নি যে তা তার নড়চড়ই বলে দিচ্ছে। অথচ সে এসেছে টের পেয়েও ফিরেও তাকাচ্ছে না।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here