#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার
৩৪.
এক জোড়া চোখ অস্থির।কপালের ঘাম চোখের পশ্চাৎ বেঁয়ে গড়িয়ে পরছে।দুরুদুরু বুকে শ্বাস ফেলছে খুব সতর্ক ভাবে।কিঞ্চিৎ শব্দ হলেই হয়তো ধরা পরে যাবে,এই ভয়ে।আলমারির খুব কাছে কারোর অস্তিত্ব টের পেয়ে আরেকটি অস্তিত্ব সাবধানে সটানভাবে দাঁড়ায়।দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছে ফাঁসির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে।গলায় দঁড়িটা এমন ভাবে বেঁধে দিয়েছে যে, একটু নড়লেই দঁড়ি আটকে দম বেড়িয়ে যাবে!
কড়া পারফিউমের ঘ্রাণ নাকে লাগতেই ডগিরা ঘেউঘেউ করে উঠলো।আলমারির কাছে পরিচিত পারফিউমের গন্ধ পেতেই ডগিরার এইরূপ প্রতিক্রিয়া।ডগিরার কন্ঠ শুনে বুকে হাত দিয়ে ফোঁস করে দম ছাড়ে অর্ক।বলতে গেলে এতক্ষণ রুদ্ধশ্বাসেই দাঁড়িয়ে ছিল ও।তখন দরজার বাহিরে পায়ের আওয়াজ শুনতে পেয়ে ভেবেছিল হয়তো মেহেনূর বা অন্যকেউ আসছে।এইমুহূর্তে সবাই যখন নিচে তখন ও একা উপরে চুপিচুপি মেহেনূরের ঘরে ঢুকেছে,একে তো বিনা অনুমতিতে ওমন চুপিসাড়ে এসেছে তারউপর যদি ধরাও পরতো তাহলে ব্যাপারটা খুব বিশ্রী পর্যায়ে চলে যাবে।তাই নিজেকে আড়াল করার জন্য তড়িঘড়ি করে কোথায় গা ঢাকা দিবে বুঝতে পারছিল না।তখন সামনে এই আলমারিটা ছাড়া আর কিছু চোখে পরে নি।সাতপাঁচ না ভেবে হুট করে এই আলমারিতেই ঢুকে পরলো।
অর্ক ঘনঘন শ্বাস টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করছে।আর কিছুক্ষণ এই আলমারির ভেতরে থাকলে দম আটকে এমনিতেই মারা যাবে ও।এইদিকে ডগিরার চিৎকার ক্রমশ বেড়েই চলেছে।ডগিরা যদি এইভাবে চিৎকার করতে থাকে তবে অচিরেই ওর ধরার পরার সম্ভাবনা আছে।অর্ক রাগে চোয়াল শক্ত করে আলমারি থেকে বেরিয়ে আসে।অর্ককে দেখা মাত্রই ডগিরা দ্বিগুণ জোরে ঘেউঘেউ শুরু করে দেয়।এতক্ষণ অবধি ঠিকঠাক থাকলেও এখন ওর চিৎকারে নির্ঘাত সারা বাড়ির মানুষ এখানে এসে উপস্থিত হবে।অর্ক কোনো কিছু চিন্তা না করে ডগিরাকে কোলে নিয়ে ওর মুখ চেপে ধরলো।ডগিরা তাও চুপ হয় না।চিৎকার করেই যাচ্ছে।অর্ক আরো শক্ত করে ওর মুখ চেপে ধরে রেখেছে।দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে ডগিরা ওর নখ দিয়ে অর্কের হাতে আঁচড় কাটে। অর্ক রাগে আর বিরক্তিতে ডগিরাকে আলমারির ভেতর রেখে দরজা বন্ধ করে দেয়।যাতে ওর চিৎকার নিচ অবধি আর শোনা না যায়। ডগিরাকে বন্দী করে বিশ্বজয়ের হাসি টেনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়াতেই আলমারির ভেতরে কেমন একটা শব্দ হতেই থমকে দাঁড়ায় অর্ক।শব্দ হওয়ার সাথে সাথে ডগিরার চিৎকারও বন্ধ হয়ে যায়।ক্লান্ত হয়ে চুপ করে গেছে ভেবে অর্ক ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।পরমুহূর্তেই অর্কের মনে কয়েকটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে বার বার।আলমারির ভেতর হওয়া শব্দটা কিসের শব্দ ছিল?ডগিরা কোনো আওয়াজ করছে না কেন?ও কি একবার চেক করে দেখবে?
নিজের মনকে সায় দিয়ে অর্ক ফের ঘরের ভেতরে এসে আলমারিটা খুলতেই আঁতকে উঠলো।আলমারির ভেতর ডগিরা নেই!বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে অর্ক।এটা কিভাবে সম্ভব?অর্ক দ্রুত আলমারির ভেতর ঢুকে চারদিকে হাতড়াতে থাকে।কিন্তু না এখানে কোনো ভাঙাচুরাও নেই যেটার মাধ্যমে ডগিরা এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারে।তাহলে ডগিরা গেল কোথায়?অর্ক আলমারির ভেতর থেকে বের হয়ে আলমারির চারপাশে, ঘরের প্রত্যেকটা কোণায় কোণায় খুঁজতে থাকে।কিন্তু ডগিরাকে আর পায় না।মাথার চুল উল্টে ধরে পাইচারি করছে অর্ক।নিজের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে ওর। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।
পরমুহূর্তেই মেহেনূরের গলার স্বর শুনতে পেয়ে হকচকিয়ে যায় অর্ক।মেহেনূর ডগিরাকে ডাকতে ডাকতে এদিকেই আসছে।এখন মেহেনূরকে কি জবাব দিবে ও?কি বলবে ওকে? ও ডগিরাকে গায়েব করে দিয়েছে!জিভ দিয়ে শুকনো ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে নিয়ে একটা ঢোক গিলে অর্ক।মাথার নিউরনগুলো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে,মস্তিষ্ক এক্কেবারে ফাঁকা।এইদিকে মেহেনূর প্রায় চলেই এসেছে।এই বুঝি ধরা পরে গেল!এখন ও কোনদিকে যাবে?হায় আল্লাহ তুমি রহম করো।মাটি দুভাগ করে দাও নয়তো উপর থেকে দঁড়ি ফেলো!এই মেয়ে যে ধুরন্ধর!ঠিক বুঝতে পেরে যাবে ডগিরার নাই হওয়ার পিছনে ওর হাত আছে!
– মেহেনূর!
কলির ডাকে দাঁড়িয়ে যায় মেহেনূর।এই সুযোগে অর্ক আবার আলমারির ভেতর ঢুকে পরলো।কলি এগিয়ে এসে ফের বললো,
– কোথায় যাচ্ছো?নিচে সবাই তোমাকে খুঁজছে।
– না মানে কলি আপু,আসলে অনেকক্ষণ ধরে ডগিরাকে দেখছি না তাই এইদিকে খুঁজতে এসেছিলাম।ভেবেছিলাম ও হয়তো আমার রুমে এসেছে।
– ও রুমে থাকলে তোমার ডাকে সাড়া দিতো না?নিচে কোথাও আছে হয়তো।তাই তো কোনো রেসপন্স করছে না।
– তাই হবে হয়তো!আচ্ছা চলো।
মেহেনূররা চলে যেতেই অর্ক রাগে ক্ষোভে আলমারির ভেতরে এলোপাতাড়ি ঘুষি মারতে থাকে।নিজের কাজে লজ্জিত ও।ডগিরা মেহেনূরের কাছে ঠিক কতটা প্রিয় ও সেটা জানে।এখন যদি ডগিরাকে না পাওয়া যায় তাহলে ও কি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে?নিজের চোখেই ছোট হয়ে যাবে ও।আলমারির ভেতর থেকে বেরুনোর জন্য পা বাড়াতেই আচমকায় আলমারিটা নড়ে উঠতেই চমকে উঠলো অর্ক।হঠাৎ ওর চারদিক থেকে চারটা কাঁচ নিচ থেকে উপরে উঠে আসলো।ও কিছু বুঝে উঠার আগেই আলমারিটা নিচের দিকে খসে পরে যেতে লাগলো।অর্ক ভয় পেয়ে দুই হাত আলমারির দেয়ালে ঠেকিয়ে একটু ঘেষে দাঁড়ায়।সেকেন্ড তিনেক পরেই সশব্দে আলমারিটা থেমে যায়।নিজ থেকে আলমারির একটা দরজা খুলে যায়।পরমুহূর্তেই কোথা থেকে একটা সিঁড়ি এসে ভিড়ে দরজার সামনে।অর্ক শুধু হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।এতক্ষণ কি ঘটলো বা এখনই এসব কি ঘটছে কিছুই ওর বোধগম্য হচ্ছে না।পিয়ানোর শব্দ কানে আসতেই চকিত দৃষ্টিতে তাকায় সামনের দিকে।সাথে সাথে অর্কের চক্ষু চড়াকগাছ।
চারদিকে নিকষকালো অন্ধকার।দক্ষিণ কোণা থেকে এক চিলতে রশ্মি এসে পড়েছে ওই পিয়ানোর উপর।সেই আলোর পথ ধরে ধোঁয়া বেরুচ্ছে খুব গাঢ়তর ভাবে।সাদা রঙের পিয়ানোর উপর ধবধবে সাদা ডগিরা দৌড়াচ্ছে।ওর পায়ের চাপেই পিয়ানোতে তরঙ্গ তুলছে।এইমুহূর্তের অর্কের মনে হচ্ছে, ডগিরা মারা যাওয়ার পর বেহেশতে গিয়ে দিব্যি সুখে আছে,নিস্পাপ প্রানের অকাল মৃত্যুতে বেহেশতে মালিক সান্ত্বনা স্বরূপ এই পিয়ানো ডগিরাকে গিফট করেছে!যেটার সাথে এখন ও খেলা করছে।কিন্তু বেঁচে থাকা অবস্থায় তো আর বেহেশত দেখা সম্ভব না।ও হয়তো ভুল দেখেছে।দেখার ভুল ভেবে চোখ ঘষে নিয়ে ফের সামনে তাকালো অর্ক।না এটা ডগিরাই!ওর মনের ভুল নয়।
এই সব কি ঘটছে?এইসব অর্কের কাছেওর মতিভ্রম বলে মনে হচ্ছে।ডগিরার চিন্তায় ওর মাথাটা হয়তো এবার গেছে!নয়তো এইসব কি হাবিজাবি দেখতে ও!ওর মনে হচ্ছে এইগুলো কিছুই ঘটে নি বা ঘটছে না।দীর্ঘ একটা শ্বাস টেনে অর্ক ক্ষণকালের জন্য চোখ বন্ধ করে নিলো।চোখ খোলার পর সব আগের মতোই হয়ে যাবে এই আশায়।কিছুক্ষণ পর যখন চোখ খুললো তখন সবকিছুই একটু আগের মতোই অস্বাভাবিক লাগছে অর্কের কাছে।নিজেকে বিশ্বাস করানোর জন্য নিজের হাতে চিমটি কাটে অর্ক।বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে অর্ক।এখানে যা ঘটছে সবটাই বাস্তব!অর্ক অনেক চিন্তা ভাবনা করে সিঁড়িতে পা রাখলো।সিঁড়িতে পা রাখতেই সিঁড়িটা নিজ থেকেই চলতে শুরু করে,এক্সেলেটরের মতো।সিঁড়িটা থেমে যেতেই সিঁড়ি থেকে নিচে মেঝেতে পা রাখতেই “Welcome to Kiran’s world ” বাক্যের সাথে সাথে নিকষকালো অন্ধকারের অবসান ঘটিয়ে হঠাৎ ছাদের মাঝখান থেকে বড়সড় একটা লাইটের আলো এসে নিচের থাকা পিয়ানোটা সম্পূর্ণ আলোকিত করে তুললো।আলো জ্বলে উঠতেই অর্ক চমকে উঠলো সেইসাথে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।ক্ষণকাল আগে কি শুনেছে ও?কিরণের কণ্ঠস্বরের সাথে ও কি কিরণের নামও শুনেছে?আদৌ কি এটা কিরণই নাম ছিল?নাকি ও ভুল শুনেছে?
অর্ক তড়িৎ বেগে ফের সিঁড়িতে উঠে পরলো।একটু আগে স্পষ্ট কিরণের নামটাই শুনেছিল ও।তাও কেন জানি বিশ্বাস করতে পারছে না।বার বার মনে এটা হতে পারে না।এটা হওয়ার নয়!ও ভুল শুনেছে।তবে এবার ভালো করে পরখ করে নিয়ে নিজের কানকে বিশ্বাস করবে।তাই ও আবার সিঁড়িতে উঠে দাঁড়ায়। অর্ক সিঁড়িতে উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথে লাইটগুলোও নিভে যায়।আরেক দফায় আঁতকে উঠলো অর্ক।পরমুহূর্তেই এটা ভেবে নিজেকে সামলে নিলো যে,এই ওয়েলকামিং এর সাথে লাইটের বিষটিও চমৎকার ভাবে সেট করা,অন্যরকম স্পেশাল টেকনিক।এই ব্যাপারটা কিন্তু চমৎকার।এটার মধ্যে যে কাউকে স্পেশাল ফিল করানোর মতো শক্তি আছে।যাইহোক অর্ক আর ওইসব না ভেবে নিজের মনের ধারণাকে সত্যি প্রমাণ করার জন্য সিঁড়ি থেকে নিচে নামতেই আবার একই বাক্যের ধ্বনি উচ্চারিত হতে লাগলো।শূন্যে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থির রেখে সেই প্রতিধ্বনিত বাক্য শুনলো বারকয়েক।
ভুল!অর্কের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে!ও যেটা তখন শুনেছিল এখনো ঠিক সেই একই কথা শুনেছে।বার বার রিপিট করে শুনেছে অর্ক। ও ওর কিরণের নামই শুনতে পেয়েছে প্রতিবার।সেই সাথে কিরণের মাদকতা ছড়ানো সেই কন্ঠস্বর।পদে পদে বিস্মিত হচ্ছে অর্ক।তবে ওর এখনো মনে হচ্ছে ও কোনো ঘোরের মধ্যে আছে।এটা আদৌ কোনো বাস্তবতা নয়!অর্ক রুদ্ধশ্বাসে ঝিম ধরে দাঁড়িয়ে আছে।চোখ বন্ধ করে ফিরে যায় মিনিট বিশেক আগের মুহূর্তে।যখন ও আলমারির বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিল আর মেহেনূর দরজার বাহিরে।পুরো ঘটনাটি রিমাইন্ড করছে অর্ক।অর্কের ভাবনার সুতো ছিঁড়ে ডগিরার চিৎকারে।চটজলদি চোখ খুলে তাকায় ডগিরার দিকে।অর্ক ডগিরার দিকে এগোতে নিলেই ডগিরা দৌঁড়ে চলে যায় অন্যদিকে।
ডগিরার পিছু নেওয়ার জন্য পা বাড়াতেই অর্কের দৃষ্টি পরলো দক্ষিণ পাশের দেয়ালটার উপর।ওইদিকের আবছা আলোয় তরুণীর ছবিটা অস্পষ্ট দেখালেও ডগিরাকে চিনতে এক বিন্দুও ভুল করে নি অর্ক।এতক্ষণে অর্কের স্মরণে এলো ও একটা বড়সড় রুমের ভেতরে আছে।ওর হাঁটার শব্দে সারা ঘর জোরেই মৃদঙ্গ তুলছে।শুনে বোঝা মুসকিল এই শব্দের উৎপত্তিস্থল কোথায়!অর্ক দ্রুত এগিয়ে যায় দেয়ালে টাঙানো ওই ছবিটির দিকে।পাঁচ ফুট সাইজের ছবিটায় ডগিরাকে দেখা যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু তরুণীর মুখটা সুস্পষ্ট নয়।বিশাল সাইজের এই ছবির দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো অর্ক।তাও ঠাহর করতে পারলো না।আরো দুই কদম এগিয়ে একদম ছবিটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।আনমনেই ছবিটির দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় অর্ক।ছবির কাঁচ স্পর্শ করতেই ছবিটি অদৃশ্য হয় যায়।শিউরে উঠলো অর্ক।ঘটনাটি এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিল যে ও ভয় পেয়ে ছিটকে দূরে সরে যায়।কিছুক্ষণ সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কাঁচটায় ফের স্পর্শ করলো।সাথে সাথে দৃশ্যমান হয় অন্য একটি ছবি।কিন্তু এটা দেখার জন্য অর্ক মোটেও প্রস্তুত ছিল না।অর্কের সামনে দৃশ্যায়িত ছবিটি স্বয়ং কিরণের।অর্ক না পারছে নিজের চোখকে অবিশ্বাস করতে আর না পারছে বিশ্বাস করতে।হঠাৎ করেই ওর হাত-পা কেমন যেন কাঁপতে লাগলো!কাপা কাপা হাতটা আরো একবার স্পর্শ করলো ওই ছবিটা।সাথে সাথে ওই ছবিটাও অদৃশ্য হয়ে যায়।পরিবর্তে আসলো অন্য একটি ছবি।একই ঘটনা রিপিট করতে করতে আটটা ছবি পর পর দেখলো অর্ক।সবগুলোই কিরণের ছবি।
হাটু গেড়ে ধপ করে নিচে বসে পরলো অর্ক।কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছে না।মেহেনূরের আলমারিতে সিক্রেট লিফট,তারপর এই সিক্রেট রুম।কিরণের কন্ঠস্বর,কিরণের সাথে ডগিরার ছবি।এটা কিরণের দুনিয়া!কিরণের দুনিয়া?মেহেনূরের সিক্রেট রুমে কিরণের দুনিয়া?স্বাগতম বার্তার কথা মনে হতেই মাথা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায় অর্ক।হিসাবে একটু গড়মিল হচ্ছে।তবে অর্ক হিসাবটা আপাত মস্তক মেলাতে না পারলেও এটা ঠিক বুঝতে পারছে উত্তরটা হয়তো ওর হাতের খুব কাছেই আছে!শুধু একটু ইনভেস্টিগেশন করতে হবে।অর্ক পাগলের মতো সারাঘর জুড়ে কিছু খুঁজতে লাগলো।ঘরের মধ্যভাগ ছাড়া সবটাই অন্ধকারে ছেঁয়ে আছে।অনেক খুঁজাখুঁজির পর কাঙ্খিত জিনিসটি পেয়ে সুইচ টিপতেই পুরো ঘর আলোয় ঝলমল করে উঠলো।অর্ক নির্বাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলো পুরো ঘরটা।এটা যে-সে ঘর নয়।কোনো সাধারণ ঘর তো নয়-ই।বরং এটা বিশাল বড় একটি মিউজিয়াম!এমন কোনো বাদ্যযন্ত্র নেই যে এখানে পাওয়া যাবে না।বিশাল এই ঘরের ঠিক মাঝখানেই পিয়ানোটা রাখা।ঘরের দেয়ালগুলোতে এক ইঞ্চি জায়গায়ও অবশিষ্ট নেই।সবখানে কিরণের ছবি,অর্ক যেদিকে তাকাচ্ছে সেইদিকেই কিরণ।একপর্যায়ে একটা ছবিতে অর্কের চোখ আটকে যায়।মেহরাব সাহেব আর রেনুফা বেগমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে রাওনাফ আর কিরণ।আর কিরণের কোলে ডগিরা।ছবিটির নিচে ঠিক ডানপাশে ছোট্ট করে ইংরেজিতে লেখা “Kiran’s World “।অর্ক বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো কয়েক মুহুর্ত।হুট করেই অর্ক ওর বুকের মধ্যে তীব্র ব্যাথা অনুভব করতে লাগলো।কিছু বোঝে উঠার আগেই জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পরলো।
চলবে……
[বি.দ্র. রিচেক হয় নি তাই বানান ভুল থাকতে পারে]#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার
৩৫.
একটা স্টেজ শো তে কিরণকে বলতে শুনেছিলাম,“মানুষ আবহাওয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত!মানুষ তার চরিত্রের সাথে মুড অনুযায়ী পাল্টায়!” কিরণের বলা সেই কথাটার মানে আমি কখনই বুঝতে পারতাম না।আমরা জানি সময়ের সাথে সাথে প্রতিটা মানুষই পরিবর্তনশীল।কেউ কখনো ঠকে পরিবর্তিত হয়।আবার কেউ কাউকে ঠকিয়ে তাঁর পথ পরিবর্তন করে।তবে আজ কিরণের বলা সেই কথাটার মানে বুঝতে পারলাম।
অয়নের কথা শুনে হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকা অর্ক সহ কেবিনে উপস্থিত থাকা প্রত্যেকে বিস্মিত হয়ে অয়নের দিকে তাকায়।অর্কের মলিন মুখে শীতল চাহনি দেখে অয়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
– এখন পাগলামি করলে কি হবে?নিজেকে কষ্ট দিলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে?ওইদিন মেহেনূরকে প্রত্যাখ্যান করে তুই নিজেই ঠকে গিয়েছিলি।খাঁটি হিরাকে হাতের কাছে পেয়েও চিনতে পারিস নি।তুই ওর এতো কাছে থেকেও ওকে চিনতে পারলি না।সবাই বার বার করে বলেছিলাম,এমন করিস না মেহেনূর খুব ভালো মেয়ে।কিন্তু তুই কারোর কথাই শুনিস নি।যাকে বিবিজান বিবিজান বলে ডেকে সারাবাড়ি মাথায় তুলতিস,সেই বিবিজানকেই কষ্ট দিয়েছিস।তাঁর মুখের কথার কোনো দামই রাখলি না।নিজের বাবা মায়ের মুখ ছোট করেছিস।আর তোর মামা?লোকটাকে সেই ছোট্ট বেলা থেকে দেখে এসেছি।কত ভালোবাসতেন তোকে।তুই তাকেও বাদ রাখলি না!এখন তুই কোন মুখে তাঁদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবি?তাঁদের সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল,তাদের পছন্দ সঠিক ছিল না!সেটার প্রমাণ কি আদৌও আছে তোর কাছে?
অর্ক মাথা নিচু করে বসে আছে।ও যা করেছে তার জন্য বন্ধুদের কাছ থেকে একটু আধটু কটুবাক্য ওর শোনাই উচিৎ।পরমুহূর্তেই কি মনে করে যেন হুট করে মাথা তোলে তাকালো অর্ক।পুরোরুমে চোখ বুলিয়ে নিলো একবার।কলি,দিহাদ আর অয়ন ছাড়া অন্য কেউই নেই এখানে।অর্ক অয়নের এতোগুলো প্রশ্নের একটারো জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করে উৎকন্ঠিত স্বরে বললো,
– আমাকে হসপিটালে কে নিয়ে এসেছে?
– এম্বুল্যান্স এর ড্রাইভার!
অয়নের উত্তর শুনে ফিক করে হেসে দেয় দিহাদ আর কলি।অর্ক ওদের দিকে এক পলক তাকিয়ে অয়নের দিকে চোখ রাঙিয়ে ফের বললো,
– অয়ন একদম ফাজলামি করবি না।যা জিজ্ঞাস করেছি সেটা বল।আরে….
অয়নের কেন যেন বিরক্ত লাগছে,আবার খুব রাগও হচ্ছে।অর্কের পুরো কথা না শুনেই অয়ন রুম থেকে বেড়িয়ে যায়।অর্ক ক্ষণকাল আশ্চর্য হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো।কলি আর দিহাদ একটু দূরে পেতে রাখা সোফাটায় বসে আছে।অর্ক জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকালে দিহাদ বললো,
– মেহেনূর কাল রাতে ওর ব্যাপারে সবকিছু আমাদের বলেছে।অবশ্য মেহেনূর নিজের ব্যাপারে কখনোই কাউকে কিছু বলতে চায় না।কিন্তু ও মিথ্যা কথাও বলে না।কালকে জাস্টিন ট্রুডোকে দেখে আমাদের একটু না অনেকটাই কৌতুহল জাগে যে,সাধারণ একটা মেয়ের জন্মদিন পালন করতে একটি দেশের প্রেসিডেন্ট চলে আসলো?অবশ্য জাস্টিন ট্রুডোর অমায়িক আচার আচরণের কথা সবাই জানে।যাইহোক, যখন এই প্রশ্নের উত্তর মেহেনূরের কাছে জানতে চাইলাম তখন মেহেনূর সবটা বললো।মেহেনূর যে অন্যদের থেকে আলাদা সেটা আমরা জানতাম।কিন্তু ওই যে কিরণ চৌধুরী সেটা আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পাই নি,এই যা।কিন্তু বিশ্বাস কর ভাই,আমরা সত্যিটা জানার পর এতোটাও রিয়েক্ট করি নি যতটা রিয়েক্ট করলে হসপিটালে ভর্তি হতে হয়!
– তুই কি আমাকে খুঁচা দিয়ে কথাটা বললি?
– তোকে খোঁচা দিতে আমার বয়েই গেছে।
কথাটা শেষ করেই দিহাদ ঠোঁট বাঁকিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়।অর্ক অবাক না হয়ে পারছে না।ও যেটা জিজ্ঞাস করছে সেটার উত্তর তো দিচ্ছেই না উল্টো সবাই মুখ ভেংচি দিয়ে চলে যাচ্ছে।অর্ক কলির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখ করে বললো,
– কলি,আমার উত্তরটা কিন্তু পেলাম না।
অর্কের কথায় স্মিত হাসলো কলি।কলি বরাবরই ঠান্ডা মেজাজের আর চুপচাপ।হুটহাট রাগ দেখানো ওর স্বভাবে নেই।তবে অর্কের উপর ওর যে রাগ নেই তেমনটা কিন্তু নয়।ওরো রাগ আছে তবে ও এতো সহজে সবার মতো রাগ দেখাতে পারে না।কলি ক্ষুদ্র একটা শ্বাস টেনে ধীর কন্ঠে বললো,
– কাল মেহেনূরই তোকে হসপিটালে নিয়ে এসেছে।সারারাত তোর পাশে মেহেনূরই ছিল।তোর ঘুম ভাঙার একটু আগেই বাসায় গিয়েছে।
অর্ক কলির কথা শুনে শুধু মৃদু হাসলো।কলি যে ঘুরে ফিরে মেহেনূরের কথা বলবে সেটা যেন ও আগে থেকেই জানতো।পরমুহূর্তেই কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
– তোরা বাসায় যাস কেন?তোরাও তো সারারাত এখানে ছিলি।
– তোকে কে বলেছে আমরা সারারাত এখানে ছিলাম?
কলির কথা শুনে অর্ক কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাস করলো,
– মানে?
– আমরা তো জানতামই না তুই হসপিটালে ভর্তি!সকালে রোশনির কাছে সবটা শুনে আমরা কিছুক্ষণ আগে এসেছি।আমরা আসার পরেই মেহেনূর এখান থেকে বাসায় গিয়েছে।
কলির কথা শুনে অর্ক আশ্চর্য হয়ে গলায় স্বর উঁচু করে বললো,
– কি!
অর্ককে বিস্মিত হতে দেখে কলি শীতল কণ্ঠে বললো,
– আমি সবটা বলছি তো,তুই চুপ করে শোন।
– বল শুনি তোদের কি এমন কাজ ছিল যার জন্য তোরা আমার খবরটুকুও নিতে পারিস নি।আমি যদি মরেও যেতাম তাহলেও তো তোরা দেখতে আসতি না!
– অর্ক!
কলি চোখ পাকিয়ে অর্কের দিকে তাকায়।কলির ধমকে অর্ক থতমত খেয়ে যায়।মুখ ভার করে বললো,
– সরি,মুখ ফসকে বলে ফেলেছি।বল কি বলবি।
– তুই তো জানিসই শান্ত আর তনিমার বিয়ের প্রায় এক মাস হতে চলল অথচ এখনো ওদের মধ্যে তেমন কোনো ঘনিষ্ঠতা হয় নি।শান্ত বেচারাকে এখনো আলাদা ঘরে ঘুমাতে হয়।বউয়ের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য বাসর নামক শব্দটি ওর ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারি নি।তনিমা শান্তর উপর রাগ করে শান্তকে ওর ঘরে অবধি ঢুকতে দেয় না।কাল রাতে ওদের বাসর ছিল।মেহেনূরই সবটার আয়োজন করেছে।আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলে মেহেনূর আমাদেরকে রাতে বলে নি যে তুই হসপিটালে আছিস।তনিমাদের স্পেশাল রাতটা স্পয়লার হয়ে যাবে বলে রাতে ওদেরকে কিছু জানানো হয় নি।
– ও আচ্ছা এই ব্যাপার!
– হ্যাঁ।আচ্ছা একটা কথা বল তো।
– কি কথা?
– মেহেনূরের ঘরে থাকা ওই সিক্রেট লিফটের কথা তুই কিভাবে জানলি?
কলি প্রশ্নটা করে অর্কের দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আছে।অর্ক ফিক করে হেসে দিয়ে বললো,
– সে এক লম্বা কাহিনী।পরে একসময় বলবো।এখন বাসায় চল।
অর্ক পরমুহূর্তেই হাসি থামিয়ে অসহায় মুখ করে ফের বললো,
– সবকিছু এলোমেলো হয়ে আছে।কিভাবে সবটা সামলাবো বুঝতে পারছি না।আমাকে একটু সাহায্য কর প্লীজ।
– কি করতে হবে?
…………..
_____________________________
শান্ত আর তনিমা গিয়েছে সুইজারল্যান্ড,হানিমুনে।সুইজারল্যান্ড এ চলে যাওয়ার আগে তনিমা ওহিকে ওর ফোনটা দিয়ে গিয়েছে।ওহি সিঁড়িতে বসে ডগিরাকে কোলে নিয়ে একের পর এক ছবি তুলছে।ছবি তোলার এক পর্যায়ে ওর ফোনটা হাত থেকে পড়ে যায়।ফোনটা পড়ার সাথে সাথে ডগিরাও ঘেউঘেউ করে উঠলো।
রোশনি দুপুরের রান্না করছে।রান্নাঘরে এতক্ষণ মেহেনূরই ছিল।অর্ধেক রান্না মেহেনূর করেছে আর বাকিটা রোশনি করছে।তিন্নিও ছিল মেহেনূরের সাথে।মেহেনূর শাওয়ার নিতে গিয়েছে।বাড়িতে ওহি ছাড়া আর কেউ নেই বলে তিন্নি রোশনির সাথে রান্নাঘরেই আছে।কারণ ও ওহির মুখোমুখি হতে চায় না।ওহিকে ওর একদম সহ্য হয় না।কিন্তু আচমকায় ডগিরার চিৎকার শুনে তিন্নি রান্নাঘর থেকে তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে আসে।তিন্নিকে দেখা মাত্রই ডগিরা দৌঁড়ে গিয়ে ওর কোলে উঠে পড়ে।ঘটনা কি ঘটলো বুঝতে না পেরে তিন্নি ডগিরার মাথা আর শরীরে হাত বুলাতে বুলাতে উৎকন্ঠিত স্বরে বললো,
– কি হয়েছে ডগিরা?তুমি…….
তিন্নি ওর কথা শেষ করার আগেই ওহিকে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে কপাল সংকুচিত করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।ওহি সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।তিন্নি ওহির দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখে ওর কাছ থেকে তিন চার ফুট দূরত্বে ওহির ফোনটা পড়ে আছে।তিন্নির আর বুঝতে বাকি রইলো না এখানে কি ঘটেছে।ফিক করে হেসে উঠলো তিন্নি।তিন্নির হাসির শব্দ শুনে মৌনতা ভেঙে মুখ তুলে তাকালো ওহি।প্রথমে তিন্নির দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালেও রাগটা বেশিক্ষণ স্থায়ী ছিল না।তিন্নির হাসি মাখা মুখটা দেখতেই ওহির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।নিজের অজান্তেই ডান হাতটা গালে দিয়ে এক ধ্যানে অতিবাহিত করলো কয়েক মুহূর্ত।একপর্যায়ে ওহির দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠলো তিন্নি।ওহিকে ওইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসি থামিয়ে দেয়।ওহির ওইরূপ চাহনিতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছে ওর।ভ্রুকুটি করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ ভেংচি দিয়ে তিন্নি ওখান থেকে চলে যায়।
– ওহি?
মেহেনূরের ডাকে ওহির ভাবনায় সুতো ছিড়ে।তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি থেকে উঠে দাঁড়ালো ওহি।চারপাশে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলো তিন্নি অনেকক্ষণ আগেই চলে গেছে।মেহেনূরের দিকে ঘুরে মৃদুস্বরে বললো,
– জ্বি আপু,কিছু বলবেন?
– এখানে ওইভাবে বসে আছো কেন?
– না আসলে ডগিরাকে নিয়ে ছবি তুলছিলাম……..
ছবির কথা বলতেই ফোনের কথা মনে পড়ে ওহির।হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি থেকে নেমে এসে ভাঙা ফোনটা হাতে নিয়ে ঠোঁট উল্টে বললো,
– ডগিরাকে নিয়ে ছবি তুলছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে ফোনটা হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে গেছে।
মেহেনূর উপর থেকে নেমে এসে ওহির হাত থেকে ফোনটা নিয়ে এপিঠ-ওপিঠ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে স্মিত হেসে বললো,
– কোনো ব্যাপার না!যাও গিয়ে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসো।দুপুরের খাবার খেতে হবে না?
ওহির মন খারাপ দেখে মেহেনূর গলা খাঁকারি দিয়ে চাপা স্বরে বললো,
– কনসার্ট দেখবে?
ওহির চোখ চকচক করে উঠলো।মেহেনূরের কথার প্রত্যুত্তরে শুধু উৎকন্ঠিত স্বরে বললো,
– লাইভ কনসার্ট?
– সারপ্রাইজ!
মেহেনূর ফিসফিস করে বললো।মেহেনূরের কথা শুনে ওহি মুখ ছোট করে কিছু একটা ভাবতে লাগলো।ওহি এই কদিনে এটা ঠিকই বুঝতে পেরেছে যে,মেহেনূরের সারপ্রাইজ মানেই বেশ বড়সড় কোনো ধামাকা।তাই ও মেহেনূরকে ফিরতি কোনো প্রশ্ন না করে নির্বিকার ভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো।মেহেনূর ওহির মুখের অবস্থা দেখে ঠোঁট টিপে হেসে চলে আসার জন্য উদ্যত হতেই ওহি অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
– আপু ফোনটা দিয়ে……
– এটা দিয়ে তোমার কোনো কাজ নেই।সব সময় এত ফোন ফোন করো কেন হুম?যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো।
মেহেনূরকে কড়াগলায় কথা বলতে শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় ওহি।মেহেনূর ওহির অগোচরে মুখ টিপে হাসছে।মেহেনূরের এমন হুট করে রেগে যাওয়ার উৎস সন্ধানে বিভোর হয়ে আছে ওহি।মেহেনূর ওহিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ পাকিয়ে ফের বললো,
– কি হলো এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন?যাও।
ওহি আর কিছু বলতে পারলো না।চুপচাপ সিঁড়ি বেঁয়ে উপরে চলে যায়।মেহেনূর ওর হাতে থাকা ফোনটার দিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে ক্ষুদ্র একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে।ফোনটা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে।মেরামত করালেও পুরোপুরি ঠিক হবে না।পরমুহূর্তেই আরেক দফায় দীর্ঘ শ্বাস টেনে গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– ভাবী লাঞ্চের জন্য রোশানকেও ডেকে নিও।আমার ফোনটা খুঁজে পাচ্ছি না তাই ওকে কল দিতে পারি নি।আর শোনো আমি একটু বাইরে যাচ্ছি ফিরতে দেরি হতে পারে।
_____________________________
সময় দুপুর আড়াই’টা।মেহেনূর সবে বাসায় ফিরেছে।ডাইনিং টেবিলের দিকে নজর পড়তেই ভ্রু কুঁচকে আসে মেহেনূরের।অর্ক ছাড়া সবাই নিজের মতো করে খাচ্ছে।সবার খাওয়া কতদূর দেখার জন্য টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো মেহেনূর।সবার খাওয়া মাত্র অর্ধেক হয়েছে।টেবিলে খালি থালাটা উপুড় করে রাখা মেহেনূরের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে অর্ক খেতেই আসে নি?সবাইকে খেতে বলে মেহেনূর ওর ঘরে চলে যায়।
ওহি সবার আগে খাওয়া শেষ করে উঠে যায়।এতে ভীষণ অবাক হয় তিন্নি।যদিও মুখে কিছু বলে নি তবে মনে মনে ঠিকই ভাবছে,ওহি আজ এতো চুপচাপ কেন?ফোনটা ভেঙে গিয়েছে বলে?হবে হয়তো!তিন্নি এতকিছু না ভেবে নিজের পাতের অবশিষ্ট খাবারটুকু শেষ করে টেবিল ছেড়ে উঠে যায়।এক এক করে সবাই খাওয়া শেষ করে উঠে যায়।
আজকে মেহেনূরের একটা কনসার্ট আছে।কনসার্টটা টরেন্টো শহর থেকে একটু দূরে।বাসা থেকে একটু তাড়াতাড়িই বের হবে যাতে পরে ওইখানে পৌঁছাতে দেরি না হয়।ঘরে এসে মেহেনূর নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়েছে।তারপর টেবিলের উপর রাখা একটা কালো রঙের প্যাকেট নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে।
ওহি আবার ডগিরার সাথে দুষ্টুমিতে মেতে উঠেছে।দরজার আড়াল থেকে ডগিরা আর ওহির কান্ড দেখে মেহেনূর মিটিমিটি হাসছে।এই ডগিরার সঙ্গ নিতে গিয়েই ফোনটা ভেঙেছে এখন ফের সেই ডগিরার সঙ্গই নিচ্ছে।মেহেনূর বেশ বুঝতে পারছে এখন ওহি কারো কাছেই যেতে পারবে না।দিহাদ বউ নিয়ে ব্যস্ত,অয়ন রোশানকে নিয়ে একটু বেরিয়েছে।রোশনি বাবার বাসায় গেছে।তিন্নির সাথে আড্ডা দেওয়ার তো প্রশ্ন আসে না।বাকি রইলো মেহেনূর।ঘন্টা দুয়েক আগে মেহেনূরের কাছে যে ঝাড়ি খেয়েছে তাতে বেচারা বেশ লজ্জা পেয়েছে।তার ক্ষানিকটা নমুনা ডাইনিং টেবিলেই দেখেছে মেহেনূর।খাওয়ার সময় চুপচাপ ছিল।
মেহেনূর গলা খাঁকারি দিয়ে ওহির ঘরে ঢুকলো।মেহেনূরকে দেখতে পেয়েই ডগিরা দৌঁড়ে গিয়ে মেহেনূরের কোলে উঠে পড়লো।ওহি ঠিকঠাক হয়ে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ স্বরে বললো,
– আপু,ডগিরাকে একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার।ওর শরীরটা খুব গরম,জ্বর এসেছে।গলাটাও কেমন শব্দ করছে,মনে হয় ঠান্ডা লেগেছে।
– আমি ওকে ঔষধ খাইয়ে দিয়েছি,ঠিক হয়ে যাবে।ডগিরার সাথে তো তোমার বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে দেখছি।
ওহি মেহেনূরের কোল থেকে ডগিরাকে নিজের কোলে নিয়ে স্মিত হেসে বললো,
– ডগিরা দেখতে এতোটাই কিউট যে,যেকেউ ওর সাথে সখ্যতা করতে চাইবে।
ওহির কথার প্রত্যুত্তরে হাসলো মেহেনূর।হাতে থাকা প্যাকেটটা ওহির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
– এটা ধরো।তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিচে চলে আসো।আমরা একটু পরেই বের হবো।আর শোনো,
তখন যে আমি তোমাকে বকা দিয়েছিলাম তার জন্য কি তুমি আমার উপর রাগ করেছো?
– আরে না,কি বলেন আপু।রাগ?তাও আবার আপনার উপর?আপনার উপর কেউ রাগ করতে পারবে?আপনি তো আপনার উপর রাগ করার মতো কারণ বা সুযোগ কোনোটাই আপনি রাখেন না,তাহলে কিভাবে রাগ করবো বলুন তো।
– তাহলে নিশ্চয়ই লজ্জা পেয়েছো?
– হ্যাঁ,একটু!
ওহির অপকটে সত্যি কথা শুনে হেসে দেয় মেহেনূর।পরমুহূর্তেই মেহেনূর কোমল স্বরে বললো,
– এতো লজ্জা পেতে হবে না।ভাই বোনদের সম্পর্ক গুলো এমনই হয়।টক,মিষ্টি,ঝাল মিলিয়ে দুষ্টু মিষ্টি একটা সম্পর্ক।আমিও তো তোমার বোনই হই।তখন তোমার সাথে একটু দুষ্টুমি করেছিলাম।আচ্ছা আসছি আমি,তুমি জলদি রেডি হয়ে চলে আসো।
– প্যাকেটে কি আছে আপু?
– আমার ভাইয়ের মুখের এক টুকরো হাসি!
মেহেনূর চলে গেছে।দরজার দিকে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে ওহি।এই মেয়েটা কিভাবে যেকোনো বিষয় খুব সহজেই সামলে নেয়?ছোট থেকে বড়,সবার দিকে তার নজর।কি সুন্দর করে আমার ভাই বললো।যদি কেউ ওদের দেখতো তাহলে অবলীলায় বলে দিতো,তারা হয়তো সত্যিই আপন ভাই বোন।ওহি হাতের প্যাকেটটা দেখে ফিচেল হাসলো।মেহেনূর তাহলে ওর ফোনটা মেরামত করে ফেরত দিয়েছে!ফোনটা তো সরাসরি ওর হাতে দিলেই হতো।বক্সের ভেতরে করে দেওয়ার কি দরকার ছিল!প্যাকেটের ভেতর থেকে বক্সটা বের করতেই ওহির চক্ষু চড়াকগাছ।মেহেনূর ওকে নতুন একটা ফোন দিয়েছে।বক্সের উপরে ছোট একটা নীল রঙের চিরকুট লাগানো।ওহির চিরকুটটা হাতে নিয়ে থম মেরে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো।“কেউ ভালোবেসে কিছু দিলে সেটা নিতে হয়,আপত্তি করতে নেই”লেখাটা চোখে পড়তেই ওহি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় বসে পড়লো।এই কথার প্রত্যুত্তরে আর কোনো কথাই থাকে না।ওহি আজ জীবনের প্রথম একটা বোনের অভাব ফিল করছে।ওরো যদি মেহেনূরের মতো একটা বোন থাকতো তাহলে কতো ভালো হতো!ওকে কত আদর করতো,ভালোবাসতো।
চলবে…….