#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – ২০
উচ্ছ্বাস হেসে বলল, ‘ আমরা কিছু করিনি এটা আমরা জানি। কিন্তু ফুলি ভেবেছে,আমরা শুধু কিছু নয়, অনেক কিছু করেছি। আহারে! কই লুকাবে তুমি আজকে? ‘
কুসুম বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, ‘ অনেক কিছু বলতে? ‘
উচ্ছ্বাস কিছুটা ঝুঁকে এলো কুসুমের দিকে। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘ লাইক লিপ-কিস! ‘
কুসুম এক মুহূর্তের জন্যে বোকা বনে গেল। চোখ পিটপিট করে চেয়ে হঠাৎ করে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ কিহ! ‘
উচ্ছ্বাস এখনো হাসছে। কুসুম মুখটা ছোট করে বলল,
‘ ফুলি যদি এখন এসব সবাইকে বলে বাসার সবাই কি মনে করবে? উফ! আপনি এখনো হাসছেন? খারাপ লোক। এমন পরিস্থিতিতে আপনার হাসি আসছে কিভাবে? ‘
উচ্ছ্বাস হাসি থামালো। মুখখানা গুরুগম্ভীর করার চেষ্টা করে বুক উচু করে বলল,
‘ হাসি থামালাম। এখন কি বসে কাদব? স্বামী স্ত্রী আমরা। নিজেদের বেডরুমে কি করছিলাম সেটা নিয়ে বাড়ির লোকেদের মাথা ব্যথা কেন থাকবে? শান্ত থাকো। ওকে? ‘
কুসুম মাথা দোলালো। উচ্ছ্বাস বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। বিছানার উপর থেকে সাদা ফাইল হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাবার জন্যে উদ্যত হল। কুসুম এগিয়ে এল। হাতে উচ্ছ্বাদের সেলফোন। সেলফোন উচ্ছ্বাসের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ এটা কে নিবে? ‘
উচ্ছ্বাস মৃদু হেসে সেলফোন নিয়ে পকেটে রেখে দিল। আসছি বলে বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে। পেছনে পেছনে কুসুমও এলো। নিচে নামতেই ফুলির ভাবির সঙ্গে খুসুরফুসুর কানে এলো। কিছু কথা কুসুমের কানেও এলো। তাতেই লজ্জায় কেমন গুটিয়ে গেল কুসুম। ভাবি কুসুম এবং উচ্ছ্বাসকে আসতে দেখে চোখ রাঙালেন ফুলিকে। ফুলি বড় ভাবির গরম চোখ দেখে মিনমিন করে সেখান থেকে সরে গেল। যাবার আগে কুসুমের কানের কাছে অপরাধবোধ নিয়ে আবার বলে গেল, ‘ আমি সত্যি কিছু দেহি নাই তো ভাবি আফা। মাফ কইরেন আমারে। ‘
কুসুম এবার হেসে ফেলল। কিছু দেখি নি, দেখি নি বলে বলে সবাইকেই কি দেখেছে বলে বেড়াচ্ছে। বোকা মানুষ। ভাবি উচ্ছ্বাসকে ব্যাগ পত্র নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে এগিয়ে এলেন। বললেন,
‘ কোথায় যাচ্ছ? ‘
উচ্ছ্বাস উত্তর দিল, ‘ হসপিটাল। জরুরী প্যাশেন্ট আছে। মাকে বলে রেখো। দুপুরে আসব। ‘
তারপর কুসুমের দিকে চেয়ে ভাবিকে বলল, ‘ ওকে দেখে রেখো একটু। আমি চলে যাচ্ছি। ওর একা একা লাগতে পারে। ‘
উচ্ছ্বাসের কুসুমকে নিয়ে চিন্তা হয় দেখে ভাবি মৃদু হাসলেন। কুসুমের পাশে দাড়িয়ে বললেন, ‘ আমি দেখে রাখব ওকে। তুমি যাও। কাজ শেষ করে আসো। ‘
উচ্ছ্বাস চলে গেল। ভাবি কুসুমকে নিয়ে একটা ফাঁকা রুমে এসে বসলেন। ফ্যান ছেড়ে কুসুমকে বললেন, ‘ চুলটা শুকিয়ে নাও। নাহলে মাথা ব্যথা করবে। ‘
কুসুম যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। শাড়ির আঁচল মাথা থেকে সরিয়ে চুল মেলে দিল। ভাবি কুসুমের পাশে এসে বসলেন। দুজন মিলে গল্প করলেন জমিয়ে। এতেই কুসুমের মন খারাপ হু হু করে পালিয়ে গেল এক ফাঁকে।
দুপুরে খাবারের সময়ও উচ্ছ্বাস এলো না। কুসুম উচ্ছ্বাস আসবে বলে না খেয়ে ছিল। সবাই খেয়ে নিতে বললেও খেলো না সে। বিকেল ৪ টায় উচ্ছ্বাস কল করল তার মাকে। সন্ধ্যায় আসবে এবং সে খেয়ে নিয়েছে জানিয়ে ফোন রেখে দিল। তার খানিক পরই কুসুমকে কল করল। কুসুম তখন অভিমানে, অভিযোগে গরম হয়ে আছে। উচ্ছ্বাসের কল রিসিভ করে কুসুম চুপ করে বসে রইল। কেন আসছে না, ক্খন আসবে কিছুই জিজ্ঞেস করল না। কুসুমকে চুপ থাকতে দেখে উচ্ছ্বাস নিজেই খানিক ঘাবড়ে যাওয়া কণ্ঠ নিয়ে বলল,
‘ দে-দেরি হবে আসতে। খেয়ে নাও প্লিজ। ‘
কুসুম উত্তর দিল না। শুধু জিজ্ঞেস করল, ‘ খেয়েছেন? ‘
উচ্ছ্বাস মৃদু স্বরে বলল, ‘ হু। ‘
কুসুমের আর কিছুই জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনবোধ হল না। চট করে ফোন কেটে দিয়ে খেতে বসল। রাগ, অভিমান এবং অভিযোগে খাবার গলা দিয়ে নামল না। বিয়ের পরের দিন স্বামী কাজের বাহানায় বাইরে বাইরে ঘুরে বেরালে কার মন মেজাজ ঠিক থাকবে। বিয়ের জন্যে ছুটি নিয়েছে। অথচ ঠিকই হাসপাতাল যাচ্ছে। একে ছুটি নেওয়া বলে? যাচ্ছে যাক। তাই বলে সারাদিন সেখানে থাকবে? খাবার সময়েও বাসায় আসবে না? এ কেমন কাজ? কুসুম সবাই খারাপ মনে করবে দেখে চেষ্টা করল অনেকটা খাবার। খাওয়া শেষ হলে বাড়ির কাজের লোকেরা, ভাবি আর উচ্ছ্বাসের মা মিলে সব গোছগাছ করছিলেন। কুসুম নিজেও কিছুটা সাহায্য করল। রান্নাঘরে ভাবি আছেন শুধু। কুসুম ভাবির পাশে দাড়িয়ে উচ্ছ্বা সের বাবার জন্যে চা বানাচ্ছে। ভাবি কাজ করার ফাঁকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ মন খারাপ নাকি? ‘
কুসুম মৃদু স্বরে বলল, ‘ না। ‘
ভাবি বললেন, ‘ উচ্ছ্বাস ডাক্তার মানুষ। ডাক্তারদের সঙ্গে থাকলে এসব অভ্যাস করে নিতে হবে। ঠিকমত বাসায় না আসা, মধ্যরাতে হুট করে বিছানা ছেড়ে হসপিটাল যাওয়া, মাঝেমধ্যে নাইট আউট, ডিনার ক্যান্সেল করতে হবে। রোগী এলে পরিবার ছেড়ে রোগীর কাছে যেতে হবে। এটাই ডাক্তারদের জীবনে স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। মানিয়ে নাও। যত দ্রুত মানিয়ে নিতে পারবে তত ভালো থাকবে, সুখী থাকবে। নাহলে অযথা সংসারে ঝামেলা বাড়বে। ‘
কুসুম শুনল। কিন্তু কিছুই বললো না। চা বানিয়ে বেরিয়ে গেল রান্নাঘর থেকে।
যখন উচ্ছ্বাস এলো তখন রাত প্রায় ১ টা। কুসুম অপেক্ষা করতে করতে সবেই ঘুমিয়েছে। ঘুমন্ত কুসুমের হাতে মোবাইল। মোবাইলে ডায়াল করা উচ্ছ্বাসের নাম্বার। রাতে প্রায় কয়েকবার কুসুম কল করেছিল উচ্ছ্বাসকে। উচ্ছ্বাস কয়েকবার রিসিভ করলেও শেষবার ব্যস্ততার কারণে রিসিভ করতে পারেনি। উচ্ছ্বাস ঘরে এসে বুঝতে পারলো ঘরে এই মুহূর্তে বোম রাখা। কুসুম জেগে গেলেই বিপদ। বোম ফাটতে দু মিনিট সময় নেবে না। উচ্ছ্বাস শব্দ না করে ঘড়ি খুলে টেবিলে রাখল। শার্ট প্যান্ট পাল্টে হাফ ট্রাউজার আর টিশার্ট পরল। কুসুমের গায়ে কাথা টেনে নিজেও কুসুমের পাশে শুয়ে পরল। কুসুমের হাত থেকে ফোন নিয়ে বন্ধ করল। কুসুম প্রায় ঘেমে গেছে। তাই এসি চালিয়ে দিল। ঘুমানোর চেষ্টা করলে কুসুম ঘুমের ঘোরে এসে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে ঘন হয়ে শুয়ে পরল। উচ্ছ্বাস কিছুটা ভরকাল। কুসুম যেন উচ্ছ্বাসের বুকের মধ্যে ঢুকে পরতে চায়। উম নিতে চায় উচ্ছ্বাস গায়ের। উচ্ছ্বাস মৃদু হাসল। হাত বাড়িয়ে কুসুমকে টেনে নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিল। কুসুমের মেয়েলি পিঠে হাত গলিয়ে জড়িয়ে নিল স্ত্রীকে নিজের সঙ্গে। কুসুম আরামে কয়েকবার গুঙিয়ে উঠল। উচ্ছ্বাস হেসে উঠল। বাচ্চাদের মত ঘুমায় কুসুম। শুরু থেকে বাচ্চা মেয়ে বলতে বলতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলা উচ্ছ্বাস আজ বুঝতে পারল কুসুম মোটেও বাচ্চা না। বরং বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বশীল, বুঝদার একজন মেয়ে। কাল সকালে কি হবে ভাবতেই উচ্ছ্বাস কিছুটা শঙ্কিত। নিশ্চয়ই কালকে নিজেদের বেডরুমে কুসুম বোমা ফাটাবে। এবং সেই বোমাটা পরবে সোজা উচ্ছ্বাসের বুকে। ম্যাডাম রেগেমেগে আগুন হয়ে আছেন। আগুন থামাতে উচ্ছ্বাসকে কাল পানি হয়ে যেতে হবে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা পানি।
_____________________________
সকালে কুসুম আগেই উঠেছে। উচ্ছ্বাস তখনও ঘুমে কাহিল। উচ্ছ্বাসের বুকে নিজেকে দেখে কুসুম অবাক হল। পরপরই পুরোনো রাগ মাথাচাড়া দিতেই চট করে সরে এল উচ্ছ্বাসের থেকে। কুসুম আচমকা বাহুবন্ধন থেকে সরে যাওয়ায় ঘুম ছুটে গেল উচ্ছ্বাসের। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাল সে। কুসুম উঠে বসেছে ততক্ষণে। এলোমেলো চুল হাতখোপা করল। পেছনে শুয়ে থাকা উচ্ছ্বাসও উঠে বসেছে। খ্যাঁক-খ্যাঁক করে গলা কেশে কুসুমের মনোযোগ পাবার চেষ্টা করল। তাতে বিশেষ লাভ হল না। কুসুম একবারও তাকালও না উচ্ছ্বাসের দিকে। বিছানা থেকে নেমে শাড়ি নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। উচ্ছ্বাস দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মেয়েটা ভারী ক্ষেপেছে। যতটা ভেবেছিল তার থেকেও বেশি। কুসুম বাথরুম থেকে বের হয়েছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল ঝাড়ছে। হঠাৎ পেছন থেকে উচ্ছ্বাস কুসুমকে জড়িয়ে ধরতেই ভরকে গেল কুসুম। থরথর করে কেঁপে উঠল সর্বাঙ্গ তার। হাত থেকে টাওয়াল খসে পরে গেল। ঘাড়ে উচ্ছ্বাসের গরম নিঃশ্বাস অনুভব করল। সঙ্গে অনুভব করলে মৃদু নেশালো এক কন্ঠ,
‘ স-সরি কুসুম। ‘
#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – ২১
হঠাৎ পেছন থেকে উচ্ছ্বাস কুসুমকে জড়িয়ে ধরতেই ভরকে গেল কুসুম। থরথর করে কেঁপে উঠল সর্বাঙ্গ তার। হাত থেকে টাওয়াল খসে পরে গেল। ঘাড়ে উচ্ছ্বাসের গরম নিঃশ্বাস অনুভব করল। সঙ্গে অনুভব করলে মৃদু নেশালো এক কন্ঠ,
‘ স-সরি কুসুম। ‘
কুসুমের বুকটা যেন ভেসে গেল। ভালো লাগায় প্রজাপতির ন্যায় উড়ে যেতে চাইল কিশোরী মন। কুসুম তবুও নিজেকে কঠিন রাখার চেষ্টা করে বলল,
‘ আ-আদিক্ষেতা দ-দেখাবেন না। ছ-ছাড়ুন। ‘
উচ্ছ্বাস ছাড়ল না। বরং হাতের বাঁধন আরো একটু শক্ত করল। কুসুমের পেটের উপর রাখা হাত আরো একটু চেপে ধরে ঘাড়ে মুখ গুজে বলল,
‘ বিশ্বাস করো, অনেক ব্যস্ত ছিলাম। আমি কিন্তু ইচ্ছে করে দেরি করিনি। ট্রাস্ট মি কুসুম। ‘
কুসুমের বুকের ধড়ফড়ানি যেন বেড়েই চললো ক্রমাগত। হৃদপিণ্ডের তালও খুব একটা ভালো নয়। উচ্ছ্বাসের প্রথম এতটা গভীর স্পর্শ কুসুমের সহ্য হচ্ছে না। কুসুম মৃদু স্বরে বলল,
‘ ট্রাস্ট করেছি। ছাড়ুন এবার। ‘
উচ্ছ্বাস কুসুমের ঘাড়ে থুতনি রেখে আয়নায় কুসুমের দিকে তাকাল। চোখের পলক ফেলে জিজ্ঞেস করল,
‘ রাগ ভেঙেছে? নাকি আরো এক্সপ্লেইন করব? ‘
কুসুম উত্তর দিল না। বরং একটু জোড় খাটিয়েই উচ্ছ্বাসের হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে সরে দাঁড়ালো। উচ্ছ্বাস খানিক দূরে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে কুসুমের দিকে চেয়ে আছে। কুসুম মেঝে থেকে টাওয়াল তুলে চুলে বাঁধতে লাগল। বলল,
‘ আমি বোধহয় কারো কাছে টেকেন ফর গ্র্যান্টেড হয়ে গেছিলাম। সমস্যা নেই। প্রথম তো। ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে। যান, শাওয়ার নিয়ে আসুন। হসপিটাল যাবেন না আজ? ‘
উচ্ছ্বাস দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। আজকে থেকে ছুটি শেষ। আজকে যেকোনো মূল্যে হসপিটাল যেতে হবে। সবে তিনদিনের ছুটি পেয়েছিল। আরো কটাদিন ছুটি পেত। কিন্তু হানিমুনে যাবে বলে সেসব ছুটি আপাতত উহ্য রাখা। বিয়েতে তাই বেশি ছুটি গ্রহন করে নি। উচ্ছ্বাস মাথা চুলকে কুসুমের দিকে তাকাল। এক ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
‘ তোমার রাগ ভাঙলে তারপর শাওয়ারে যাব। রাগ ভেঙেছে? ‘
‘ হু। ‘
উচ্ছ্বাসের বুঝতে বাকি নেই, এই রাগের বহর কটাদিন অব্দি চলবে। গরম আগ্নেয়গিরি শান্ত হতে সময় তো লাগবেই। লাভা হুট করে গলে যায় না। সময় দিতে হয় তাকে। উচ্ছ্বাস আর ঘাটাল না কুসুমকে। কুসুমের চুল থেকে এক টানে টাওয়াল খুলে শীষ বাজিয়ে বাথরুমে চলে গেল। কুসুম হতভম্ব হয়ে গেল। তার টাওয়াল তারই চুল থেকে খুলে নিয়ে গেল? খারাপ লোক।
কুসুম বিছানা গোছালো। উচ্ছ্বাসের শার্ট প্যান্ট সহ যাবতীয় জরুরী জিনিস বিছানার উপর রেখে নিচে এলো। খালামনি কুসুমকে দেখে এগিয়ে এসে বলেন,
‘ কুসুম পায়েস খাবি? বানিয়েছি আজকে। ‘
কুসুম মৃদু হেসে বলল, ‘ তুমি বানালে অবশ্যই খাব। ‘
খালামনি পায়েস প্লেটে নিয়ে কুসুমকে দিলেন। কুসুম নিজে খেল, খাওয়ার ফাঁকে ক’চামচ তুলে খালামণিকেও খাইয়ে দিল। দুজন মিলে বড্ড হাসাহাসি করছে। যা সিড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় উচ্ছ্বাসের কানে এলো। উচ্ছ্বাস মনেমনে কিছুটা তৃপ্তি পেল। কুসুমকে এই বাড়ির বৌ করে আনার সবচেয়ে বেশি ইচ্ছে এবং আগ্রহ ছিল উচ্ছ্বাসের মায়ের। তিনি যেন ছোট থেকেই কুসুমকে একটু বেশিই পছন্দ করতেন। কুসুমের সঙ্গে উচ্ছ্বাসের কখনো ঝগড়া হলে বকার ভাগীদার কুসুম নয় বরং উচ্ছ্বাস নিজে হত। ছোটবেলায় এসব খারাপ লাগলেও, এখন মনে হচ্ছে কুসুম এবং তার মায়ের সম্পর্ক সারাজীবন যেন এমনই থাকে।
খাবার টেবিলে উচ্ছ্বাস কুসুমের পাশে এসে বসল। কুসুম ডান হাত উচু করে রুটিতে হাত দিবে, তার আগেই তার হাত বাঁধা পরল উচ্ছ্বাসের হাতে। কুসুম থমকে গেল। উচ্ছ্বাস নিজের বা হতে কুসুমের হাত দুমড়ে মুচড়ে নিচ্ছে। কুসুমের বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে। টেবিল ভর্তি বড়রা! অথচ এই কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষের কাজ দেখে হতবাক হয়ে যাচ্ছে কুসুম। কুসুম চোখ রাঙিয়ে তাকাল উচ্ছ্বাসের দিকে। উচ্ছ্বাস খেতে খেতে কুসুমের দিকে চেয়ে সবার অগোচরে ডান কানে হালকা ছুঁয়ে মিটমিট চোখে সরি বলল। উচ্ছ্বাসের এমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে সরি বলা দেখে কুসুম না চাইতেও ফিক করে হেসে ফেললো। সঙ্গেসঙ্গে বাকি সবাই কুসুমের দিকে তাকাল। কুসুম সবার এমন জহুরী চাওনি দেখে থতমত খেয়ে গেল। উচ্ছ্বাসও ততক্ষণে কুসুমের ডান হাত ছেড়ে দিয়েছে। এমন ভাব করে খাচ্ছে, যেন তার মত লক্ষ্মী ছেলে আর একটিও নেই। কুসুম সবার এমন চাওনি দেখে একটু কেশে খেতে মন দিল। সবাই ব্যাপারটা উড়িয়ে দিলেও কুসুম মনেমনে আরো একটুখানি প্রেমে পরল উচ্ছ্বাসের। ধীরে ধীরে এই ছেলেটা কুসুমের পুরো পৃথিবীকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিচ্ছে। কুসুম কেমন যেন জালের ন্যায় আষ্টেপৃষ্ঠে ছেলেটার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। চাইলেও সেই সুতো কেটে বের হতে পারছে না। কিন্তু কুসুম কি আদৌ তা চাইছে? উহু! মোটেও না।
___________________________________
গতকাল উচ্ছ্বাস সারাদিন বাসায় আসেনি দেখে ফেরা যাত্রা করা হয়নি। তাই বড়রা মিলে ঠিক করলেন, আজকে কুসুম নিয়মমাফিক নিজের বাপের বাড়ি যাবে। সঙ্গে উচ্ছ্বাসও যাবে। আগামীকাল শুক্রবার। উচ্ছ্বাসের হসপিটাল বন্ধ। তাই নিয়ম যথাযথভাবে পালন করা যাবে। উচ্ছ্বাস হসপিটাল থেকে ফিরতেই তোড়জোড় লেগে গেল সবার মধ্যে। শিউলি এবং উচ্ছ্বাসের বাকি কাজিনরা মিলে একদম সাদামাটাভাবে সাজিয়ে দিল কুসুমকে। হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি পরিয়ে তৈরি করা হল কুসুমকে। সন্ধ্যার চা পর্ব শেষ হতেই উচ্ছ্বাস, কুসুম, শিউলি আর উচ্ছ্বাসের ফুপাত ভাই সঙ্গে গেল কুসুমের বাড়ি। তারা যেতেই কুসুমদের বাড়িতে বিশাল হুলুস্থুল ব্যাপার ঘটে গেল। সাহেদা অর্থাৎ কুসুমের মা মেয়ের জামাই আর নিজের বোনের ছেলের জন্যে বেশ ঘটা করেই আয়োজন করলেন। ও বাড়ি প্রবেশ করতেই খাবারের বহর লেগে গেল। উচ্ছ্বাসকে ঘিরে ধরল কুসুমের অন্যান্য ভাই-বোনেরা। কুসুম এক ফাঁকে রান্নাঘরে মায়ের কাছে চলে এল।
সাহেদা রান্নার দিকটা দেখছেন। কুসুম গিয়ে মা’কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। মেয়ের স্পর্শ পেতেই চোখ ছলছল করে উঠল সাহেদার। পেছনে ফিরে মেয়েকে মন ভরে দেখে নিয়ে ভেজা কণ্ঠে বলেন, ‘ ভালো আছিস? ‘
কুসুম বুঝতে পারল মায়ের ভালো আছিস বলার অর্থ কি? কুসুম মৃদু হেসে বলল, ‘ ঐ বাড়ির সবাই আমাকে খুব ভালো রেখেছে। চিন্তা করো না। ‘
সাহেদা আশ্বস্ত হলেন। কিছুক্ষন কথাবার্তার পর সাহেদা জিজ্ঞেস করলেন,
‘ তোর অনার্স ভর্তি তো কিছুদিনের মধ্যেই। কী করবি ভেবেছিস? পড়াশোনার ব্যাপারে উচ্ছ্বাস কি বলল? ‘
কুসুম ফলের ঝুড়ি থেকে একটা আপেল তুলে সেটায় কামড় বসাল। রয়েসয়ে উত্তর দিল,
‘ খালামনি সেদিন বললেন নর্থ সাউথে পড়ার জন্যে। তারও তাই মত। বাসার পাশে আছে। তার অনেক চেনাজানা মানুষ আছে। সমস্যা হবে না বললেন। তবে এখন ভর্তি হব না। সেখান থেকে ফেরার পর হব। সে কথা বলে রাখবে বলেছে। ‘
সাহেদা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ এখন আবার কোথায় যাবি?’
দেখা গেল কুসুম লজ্জা পেল। মিনমিন করে বলল,
‘ এই মাসের শেষের দিকে কক্সবাজার যাব। সেখান থেকে ফিরে এলে। ‘
সাহেদার আর বুঝতে বাকি নেই, মেয়ে কিসের কথা বলছে। তাই তিনিও আর ঘাটালেন না মেয়েকে। উচ্ছ্বাসের কাছে যাবার জন্যে বলে কাজে লেগে গেলেন।
#চলবে