শেষ বিকেলে তুমি আমি-২৬

#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#আলিশা
#পর্ব_২৬

আমার অভিযোগ শুনে স্মরণ মুচকি হাসলো। আচমকা আলতো করে আমার এক হাত তার হাতের মুঠোয় বন্দী করে নিয়ে ধীর কন্ঠে বলল

— চলে গেলে ভালো হতো না? তোমার আর কারো প্রয়োজন হতে হতো না।

এমন কথা শুনে অনেক বেশি রাগ হলো আমার। সে এখনো আগের প্রয়োজন আর প্রিয়োজন নিয়েই যেন পরে আছে। উপচে পরা রাগ, অভিমান নিয়ে বললাম

— ভালো না বাসলে আমি যাবো কেন আপনার সাথে? আমি এখনও বলবো আমি শুধু প্রয়োজন হতে রাজি নই। আমি প্রয়োজন, প্রিয়োজন দু’টো একসাথে হতে চাই। আর এরজন্য আপনার চলে যেতে হবে কেন?

— হুশ! ঘুমাবো। চুপ। আমার চলে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে কোনো আফসোস নেই। এপারেও একটা বউ আছে ওপারেও একটা বউ আছে। কোনো পারেই একা নই আমি।

কতবড় অসভ্য কথা তার! আমার ভীষণ তর্ক করার ইচ্ছে হলো। কিন্তু দমিয়ে রাখালম। সে অবলীলায় সত্যিই নিশ্চিন্তে আঁখি জোড়া বন্ধ করলো।

.
এই রাতে সেহেরি খাওয়া হলো আজানের দশ মিনিট পূর্বে। স্মরণ ঘুমিয়ে গেলে অঙ্কন প্রথমে খাওয়া শেষ করে এসে স্মরণের পাশে বসলো। তারপর আমি গেলাম। প্রিয়ার সাথে নিচে গিয়ে দ্রুত খেতে হলো। দশ মিনিটে ভাত খাওয়া আমার জন্য ভীষণ কঠিন ছিলো। কয়েক লোকমা মুখে দিতেই আজানের সুর ভেসে আসে। উঠে পরতে হয়। সময়ের সাথে আঁধার কেটে গেলো। দিবা এলো। অঙ্কনও যেন ব্যাস্ত হয়ে পরলো চট্টগ্রাম যাওয়ার জন্য। স্মরণের সকল রিপোর্ট গুছিয়ে নিচ্ছে সে একা। এখানে এতো গরম, সকলের থাকা, খাওয়ার অসুবিধা মানা যাচ্ছে না। দু’জন ডাক্তার মিলে স্মরণের ট্রিটমেন্ট করেছে। তাদের একজন অঙ্কন নিজেই। বিধায় সে সমস্ত ভার নিজের কাঁধে নিয়ে স্মরণকে রিলিজ দিতে চাইছে। চট্টগ্রাম গিয়ে ওখানকার মেডিকেলে রাখা হবে স্মরণকে। কেউ অঙ্কনের সিদ্ধান্ত ফেলে দিতে পারলো না। বড়সড় এক ডাক্তার যদি নিজেই পেশেন্টের দায়িত্ব নেয় তো কে আর কি বলবে?

.
আছরের ওয়াক্তের পর সব গুছিয়ে নিয়ে অঙ্কন ” আল্লাহ ভরসা ” বলে স্মরণকে এম্বুল্যান্সে উঠিয়ে নেয়। সামনের দিকে ড্রাইভারের কাছে নিজে বসে আর আমাকে বসিয়ে দেয় স্মরণের কাছে। প্রিয়া এবার আগে থেকেই অঙ্কনকে মানা করে দিলো সে বাবার সাথে গাড়িতে করে চলে যাবে। অঙ্কন সায় জানায়। জাহিন এসে অঙ্কনের গাড়ি ড্রাইভ করে প্রিয়া সহ বাবাকে নিয়ে রওনা হয় চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে।

গাড়ি ছুটছিলো বেশ রয়ে সয়ে। সারাটা পথ স্মরণের হাত শক্ত করে ধরে বসে রইলাম। অঙ্কন মাঝে মাঝেই পেছনে ফিরে তাকায়। আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা জানতে চায়। এভাবেই পথ সংকীর্ণ হয়ে এলো। তবে ইফতার করা হলো আমাদের গাড়িতেই। শুধু এক বোতল পানি দিয়ে। যেটা গাড়িতে ছিলো। ড্রাইভারের। পরবর্তীতে দোকান দেখে গাড়ি থামিয়ে অঙ্কন কিছু খাবার এনে আমার হাতে দেয়। সারাদিন রোজা রাখার পর অল্প একটু হলেও আমার খাবার খেতে হলো।

.
চট্টগ্রামে পৌছালাম রাত আটটার নাগাদ। সোজা মেডিকেলে। প্রায় অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম আমি নিজেই। স্মরণকে এডমিট করানো হলো। স্পেশাল বেড দিলো অঙ্কন। তারপর না আমার অস্থিরতা কমলো। নিভে গেলো চিন্তার প্রদীপ। সব কিছু ভুলে ধপ করে স্মরণের বেডের পাশে চেয়ারে বসে পরি। মাথা হেলিয়ে দেই বেডে। উপর হয়ে বন্ধ করে নেই ক্লান্ত চোখ জোরা।

.
ভাড়া নেওয়া বাসাতে চলে আসি আমি রাত দু’টোর দিকে। জাহিন পৌছে দিয়ে যায়। হসপিটাল থেকে আমার বাসার দূরত্ব খুব হলে দশ মিনিটের হবে। বাবা হসপিটালে স্মরণের কাছে থেকে যেতে চাইলে অঙ্কন আমার সাথে পাঠিয়ে দেয় জোর করে। আমি আর বাবা বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে সেহেরি করে নেই। ফজরের নামাজ পড়ে নেই। তারপর বাবা চলে যান নিজের বাসায়। স্মরণের জন্য কাপড় আর প্রয়োজনীয় কিছু আনতে।

.

— এই ওষুধ গুলো সকালে, এই দুইটা দুপুরে দিতে হবে। আর তরল কিছু খাওয়াবেন। মাথা একেবারেই নড়চড় না করলে ভালো হয়।

অঙ্কন প্রেসক্রিপশন বুঝিয়ে দিচ্ছিলো আমাকে। আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম। আজ মনটা বেশ হালকা। বাসা থেকে এসে স্মরণকে পূর্ণ জ্ঞানে দেখেছি। অঙ্কন বলেছে মাথার ইনজুরি নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। সব ঠিকঠাক। এখন শুধু একটু পর পায়ের এক্সরে করা হবে। এটা ভালো হলেই সব ভালো। ছোঁয়া জেনে গেছে তার বাবা অসুস্থ। সে এখন উন্মাদ হয়ে আছে বাবাকে দেখার জন্য। জাহিন গেছে তাকে আনতে। বেলা দশটা বাজতে চলল। অঙ্কন বলে গেলো এগারোটায় এক্সরে করা হবে। তার একটু ডিউটি আছে। একবার রাউন্ড দিয়ে আসতে হবে সব বেডে। আমি অপেক্ষায় রইলাম। স্মরণের রুমের দরজায় দাড়িয়ে রইলাম বাবার সাথে।

অপেক্ষার অবসান হলো। স্মরণের এক্সরে করা হলো। রিপোর্ট পাওয়া যাবে ঘন্টাখানেক পর। দেখতে দেখতে এই ঘন্টাটাও কেটে গেলো। রিপোর্ট হাতে এলো। পেশ করলো অঙ্কন স্মরণের সম্মুখেই। একটু চিন্তার বিষয়। পায়ের হাড় ভেঙে গেছে ভালো ভাবেই। জোরা লাগতে বেশ সময় লাগবে। বেড রেস্ট টানা একমাস। তারপর আবারও হয়তোবা অপারেশন করার প্রয়োজন হতে পারে। নিশ্চিত নয়। যদি পুরোপুরি ঠিক না হয় তবে। এমন কথা শুনে আমার আর বাবার মনটা অল্প সল্প খারাপ হলো। কিন্তু স্মরণ যেন ভেঙে পরলো ভেতর থেকে। মুখে জমলো তার আধার। সকলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলে সে হঠাৎ আমাকে কাছে ডাকলো। আচমকাই বলে দিলো

— খেয়া, তুমি চলে যাও। শুধু শুধু একটা অসুস্থ মানুষের কাছে পরে থেকো না। আমার গিলটি ফিল হবে। নিজেকে সেলফিশ মনে হবে। আই থিঙ্ক, ইউ সুড গো। তোমার সুন্দর জীবন দরকার। পুরো জীবনটাই তোমার পরে আছে। আমার জন্য নষ্ট কোরো না। আমি কখনো হাঁটতে পারবো কিনা কে জানে? পুরোপুরি সুস্থ হবো……

মাথাটাই বিগড়ে গেলো আমার। হঠাৎ তার এমন কথা আমাকে অবাক করে দিলো। সেই সাথে ক্ষুব্ধ করলো সেকেন্ডের মাঝে। কখন তাকে কে বলল, সে হাঁটাচলা করতে পারবে না?

— চলে যাবো? সত্যি?

খুবই শান্ত কন্ঠে শুধালাম। স্মরণ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল

— হ্যা, যদিও আমি ভালোবাসি কিন্তু আমার ভালোবাসার জিনিসগুলো কেন যেন চিরস্থায়ী হয় না।

বুকের মাঝে আজ অনাকাঙ্ক্ষিত সুর বেজে উঠলো। সেকেন্ড কয়েকের জন্য থমকে গেলাম আমি। সে আমাকে বলল, সে ভালোবাসে আমাকে!

— এটা চেনেন?

আমার হাতে একটা লাঠি ছিলো। এই রুমের কোণায় পেয়েছি। হাতে রেখেছিলাম বাইরে রেখে আসার জন্য। হঠাৎ বেশ কাজে লেগে যাচ্ছে।

— একটা হকিস্টিকের মতো কিছু মনে হচ্ছে।

আমার প্রশ্নের জবাব। আমি মাথা দুলিয়ে নিলাম। অল্পে অল্পে এগিয়ে গেলাম স্মরণের নিকট। মুখটা তার দিকে ঝুকে নিয়ে বললাম

— আমাকে কি আপনার ফেলনা কিছু মনে হয়? যখন যা ইচ্ছে বলে যান। যা ইচ্ছে করে যান। শুনুন, বউ হলো ভয়ঙ্কর জিনিস। এমনিতেই একটা বউ হারিয়েছেন। দুই নাম্বার বউ দেখে আপনার ভয়ে তটস্থ থাকা একপ্রকার আবশ্যক। এই যে লাঠিটা, বেশ শক্তপোক্ত। রুমের দরজাটা লাগিয়ে আপনার ঐ ব্যান্ডেজ করা পায়ে দুটো লাগিয়ে দিতে আমার দুবার ভাবতে হবে না। আরো বেশি করে অসুস্থ করে দেবো যদি ফলাতুকথা বলেন।

শেষোক্ত কথাটা বেশ চড়া গলায় বলে ফেললাম। স্মরণ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে দেখে গেলো আমাকে। মুখে বলে উঠলো

— হোয়াটটট?

আমি এক হাতে হকিস্টিক ধরে অন্য হাতে শাড়ির আচল দিয়ে বাতাস করার ভঙ্গি করে বললাম

— আসলেই খুব গরম। উফ! পরিবেশটা রিয়েলি হটটটট! আচ্ছা পরিবেশ হট বললেন নাকি আমাকে বললেন। রোজার দিন স্যার…

স্মরণ বেজার ক্ষেপে যাওয়া তো দূর সে মুখের হা ভাবটা এখনও দূর করতে পারেনি। আমার আচরণ যেন তার কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here